Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

লেখক অমিতাভ রায়ের গল্পগুচ্ছ

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন #গল্প    #মেঘ    #অমিতাভ_রায়                     -
     "মেঘের দেশে এক রাজকন্যা আছে। সে হাসলে আকাশ সোনা রোদ্দুরে ভরে যায়। তার মন খারাপ হলে আকাশ অন্ধকার- গুমোট হয়ে যায়, সে রেগে গেলে ঝড় হয়। আর, সে যখন কাঁদে…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

#গল্প

    #মেঘ

    #অমিতাভ_রায়

                     -


     "মেঘের দেশে এক রাজকন্যা আছে। সে হাসলে আকাশ সোনা রোদ্দুরে ভরে যায়। তার মন খারাপ হলে আকাশ অন্ধকার- গুমোট হয়ে যায়, সে রেগে গেলে ঝড় হয়। আর, সে যখন কাঁদে, তখন বৃষ্টি ঝরে পড়ে আকাশ থেকে।" ঠাম্মার মুখে এই গল্প শুনে মনসিজ জিজ্ঞেস করতো, "ঠাম্মা, ঐ রাজকন্যার নাম কী?" ঠাম্মা  বলতো,"সে কী রে, নামই জানিস না? তার নাম যে মেঘমালা।" মনসিজ জানলা দিয়ে আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতো। তারপর বলতো,"ঠাম্মা, আমি মেঘের দেশে যাবো।" ঠাম্মা হাসতে হাসতে ওকে কোলে জড়িয়ে ধরতো। বলতো, "মন, সেখানে গিয়ে তুই মেঘের দেশের রাজকন্যাকে বিয়ে করবি?"  খুব লজ্জা পেতো মনসিজ। সেসব দিনের কথা এখনও পরিষ্কার মনে আছে মনসিজর। ঠাম্মা ওকে খুব ভালবাসতো। আজ ঠাম্মাই কোথায়? হয়তো মেঘের দেশেই। একটু বিষণ্ণ হয়ে যায় মনসিজ। আকাশটাও মেঘে ভরে গেছে৷ জোলো হাওয়া গায়ে লাগছে বৃষ্টি হবে বোধহয়। 


     তিতির বাড়ি ফিরে আসতেই নিশার মা বললো, কেউ একজন অপেক্ষা করছিল। সে একটু বাইরে গিয়েছে। আবার আসবে। বেশ বিরক্ত হল তিতির। আজ কলেজের পরীক্ষা সামলাতে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। এর পরে আবার এতো খাতা দেখতে হবে। এতো ছাত্র-ছাত্রীকে নেওয়ার পরিকাঠামো কলেজের নেই। প্রিন্সিপালকে বলে কোনো লাভ নেই। অনেক কিছু নাকি এই ছাত্র- ছাত্রীর সংখ্যার উপরে নির্ভর করে। এইসব ভাবতে ভাবতে মুখ-হাত ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরোতেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায় তিতির। নিশার মা দরজা খুলে দেয়। বসার ঘরে গিয়ে চমকে যায় ও। বহুদিন বাদে মনসিজকে দেখল তিতির। আগের মতোই আছে। "কীরে, খবর কী? কেমন আছিস?" তিতির মৃদু হেসে বলে, "ভালোই আছি। তুই?" "আমি ঠিক নেই। ভেবেছিলাম একাই কাটিয়ে দেব। পারলাম না।তোর কথা মনে হয় খুব। ব্যাস, চলে এলাম।" লজ্জায় লাল হয়ে গেল তিতিরের মুখ। তবে, ও জানে- এটাই মনসিজর বলার ভঙ্গি। মনসিজ যে দেশে ফিরেছে সেটাই ওর জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করল," তা, মেঘের দেশের মানুষের পরের অভিযান কী?" মনসিজ বলে, "আবার মহাকাশে যাব। তার আগে তোর সঙ্গে দেখা করতে এলাম। এক কাপ গরম কফি খাওয়া দেখি।"


   কলেজে দুজনের খুবই বন্ধুত্ব ছিল। তখন থেকেই তিতির জানে মনসিজর মহাকাশে যাওয়ার জন্য কী আগ্রহ! ও মহাকাশবিজ্ঞানী হবে ভেবেছিল। ঠাম্মার গল্প প্রায়ই করতো। বলতো, মেঘের দেশের রাজকন্যার কথা। সবাই ওকে সে নিয়ে ক্ষ্যাপাতো। কফি আর ডালমুটের প্লেট টেবিলে রেখে বসে তিতির। "কতদিন পরে ডালমুট খাচ্ছি রে।" একমুঠো ডালমুট তুলে নিয়ে বলে মনসিজ। "মেঘের দেশের রাজকন্যার সঙ্গে দেখা হল? আমি তো ভাবলাম কোনো মেঘবালিকাকেই বিয়ে করে ফেলেছিস।" তিতির বলে ওঠে। কফির কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিল মনসিজ। কাপ নামিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিতিরের দিকে। অস্বস্তি হচ্ছে তিতিরের। মৃদু হেসে মনসিজ বলে, "একটা সত্যি কথা বলি তোকে। বেশ কিছুদিন তো কেটে গেল- একাই দিব্যি জীবন কাটাচ্ছিলাম। কাউকেই সেই অর্থে কাছে পাই নি বা চাই নি। কিছুদিন থেকে তোর কথা খুব মনে হচ্ছে। এমনকি তোকে স্বপ্নেও দেখলাম। কী দেখলাম জানিস?" তিতির নীরবে তাকিয়ে থাকে মনসিজর দিকে। "দেখলাম, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। আশেপাশে ভাসছে মেঘ। একটা মেঘ দেখতে ঠিক তোর মতো। আমার খুব ইচ্ছা হল তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য। তার মধ্যেই মেঘটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেল। খুব কষ্ট হচ্ছিল জানিস। তাই, এবারে দেশে ফিরেই তোর সঙ্গে দেখা করলাম। তিতির কী বলবে বুঝে পায় না। মনসিজকে ওর খুব ভালো লাগে। মনসিজও ওকে পছন্দ করে। কিন্তু, দুজনেই বিয়ে করার কথা কখনও ভাবে নি।  শহর ছেড়ে চলে গেল মনসিজ। এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল তিতির। বাবা চলে গেছে। মা প্রায়ই বিয়ের কথা বলে। সে ইচ্ছেই নেই তিতিরের। মার ঘরে  যায় মনসিজ। কিছুক্ষণ বকবক করে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে," এবারে মহাকাশ থেকে ফিরে একসঙ্গে থাকবো বুঝলি।" তিতিরের বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে। ওর হাতটা চেপে ধরে মুখের সামনে এনে ঠোঁট দিয়ে একবার স্পর্শ করেই দরজা খুলে জনারণ্যে হারিয়ে যায় মনসিজ। 


     মনসিজ মহাকাশযাত্রার আগে আরেকবার কথা বলেছিল তিতিরের সঙ্গে। খুব কম সময়ের জন্য কথা। কীরকম যেন বিষণ্ণ লাগছিল ওকে। "আজকাল ভাবি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। তোকে কাছ থেকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। অনেকদিন সময় নষ্ট হল আমার মনের কথা তোকে বলতে।" তিতিরের মনে হল মনসিজর গলা ধরে আসছে। মা আজকাল প্রায়ই মনসিজর কথা জিজ্ঞেস করে। কিছুটা আন্দাজ করেছে বোধহয়। টিভিতে দেখা গেল মনসিজর মহাকাশযাত্রার লাইভ টেলিকাস্ট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী - সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছে। ও যে মনসিজর কলেজের বন্ধু- সেটা অনেকেই জেনে গিয়েছে। প্রিন্সিপাল পর্যন্ত মনসিজর খবর জানতে চাইছিল। দুদিন পরে কলেজ থেকে ফিরে তিতির দেখে মা টিভির সামনে বসে খবর দেখছে। মা কোনদিন খবর দেখে না। সিরিয়ালের চ্যানেলে দেওয়ার আগে বোধহয় কিছু একটা চোখে পড়েছে মার। ও মার দু কাঁধ ধরে টিভির দিকে তাকায়। কিন্তু, এ কী দেখাচ্ছে! মনসিজর সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন আর ওর মহাকাশযানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মার কাঁধ থেকে ওর দুটো হাত শিথিল হয়ে সরে গেল। মা উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,"নিশ্চয়ই খোঁজ পাওয়া যাবে রে। চিন্তা করিস না।" তিতির বুঝতে পারে মার কাপড় ভিজে যাচ্ছে ওর চোখের জলে।


  চারদিকে হইচই পড়ে গেছে। সারাক্ষণ টিভিতে একই আলোচনা। তিতিরেরও ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিল। ও রাজি হয় নি। কলেজেও সবাই সহানুভূতির চোখে ওর দিকে তাকায়। সেদিন আমাজন থেকে একটা বই ডেলিভারি দিতে আসে। বিস্মিত তিতির ভাবে, ও তো কিছু অর্ডার দেয় নি। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল, শেষ যেদিন মনসিজর সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল সেদিন মনসিজ বলেছিল, ওর একটা প্রিয় বই তিতিরকে পাঠাবে। প্যাকেট খুলে তিতির দেখে মনসিজর প্রিয় কবি  ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার বই। বইটা খুলে অন্যমনস্ক হয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা কবিতার দিকে চোখ পড়তে থমকে যায় তিতির। "I wandered lonely as a cloud"। চুপ করে বইটা হাতে নিয়ে বসে থাকে তিতির। সেরাতে ও স্বপ্ন দেখে, মেঘের উপরে বসে হাত বাড়াচ্ছে মনসিজ। সেই হাত ছুঁতে চাইছে তিতির। কিন্তু, কিছুতেই পারছে না। ঘুম ভেঙে গেল তিতিরের। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি ঝরছে। মনে মনে তিতির বলে, " ফিরে এসো মন- ফিরে এসো।"

 🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️🏵️

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

#গল্প

       #স্মৃতির_সরণি।

       #অমিতাভ_রায়


                        -


     কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কাজ ছিল। মিটিয়ে বেরোতে দুপুর হয়ে গেল। গোলদীঘির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো দিনের কথাগুলো ভাবছিল সায়ন। শীতকালের মিঠে রোদ গায়ে লাগিয়ে হাঁটতে বেশ ভাল লাগছিল। কতদিন পরে এল ও। ছাত্রজীবনের কথা ভাবতে বেশ ভাল লাগছিল। দরিদ্রঘরের এক তরুণ অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে এসে পা রেখেছিল। মনে অনেক দ্বিধা- দ্বন্দ্বও ছিল। বংশের কেউ কোনদিন উচ্চশিক্ষা পায় নি। ও কি ওর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে? কোন সকালে বেরোতে হতো বাড়ি থেকে! ট্রেনের মান্থলি টিকিট কেটে রাখতো। দরিদ্র দিনমজুর বাবার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য হাতখরচ আর টিউশনি করিয়ে সামান্য যে টাকা পেতো তা দিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হতো। তার ওপর বই বা খাতা কেনার জন্যও কিছু টাকা বাঁচাতে হতো। শিয়ালদহের পাইস হোটেলের খবর দিয়েছিল ওরই এক সহপাঠী। সেখানেই ক্লাসের ফাঁকে খেয়ে নিতো সায়ন। সেই পাইস হোটেলের মালিক নিরঞ্জনদার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল ওর। হাতে টাকাপয়সা না থাকলেও খেতে অসুবিধে হতো না। পরে শোধ করে দিলেও চলতো। একবার রাজনৈতিক গন্ডগোলের পরে বাস,ট্রাম, ট্রেন অবরোধ হয়েছিল। তখন ঐ হোটেলেই ওকে রেখে দিয়েছিল নিরঞ্জনদা। সায়ন হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল পরের দিন। সায়নকে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করিয়ে তুলেছিল। তারপর থেকে নিরঞ্জনদার ঘরে ওর অবাধ যাতায়াত। বৌদি ওকে খুব ভালবাসতো। কোনদিনই ও নিরঞ্জনদা আর বৌদিকে ভুলতে পারবে না। বিদেশে চাকরি পেয়ে চলে যাওয়ার পরে ওর মা হঠাৎই চলে যায় দুদিনের অসুখে ভুগে। বাবাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সায়ন। বাবা কিছুতেই রাজি হলনা। তারপর বাবাও চলে গেল। সে কারণেই ওর এখানে আসা। ভাবতে ভাবতে নিরঞ্জনদার পাইস হোটেলের কাছে চলে এদেছে সায়ন। এখানে ও খাবে সেটা ঠিক করেই রেখেছিল। ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। 


  হোটেলে ঢুকে সায়ন দেখে নিরঞ্জনদা বসে বসে ঢুলছে। টেবিলে বসে খাবারের অর্ডার দিল সায়ন। লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে দেখছে। এরকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাহেবি পোশাক পরা লোক সচরাচর এখানে আসে না। খেতে খেতে সায়ন দেখে নিরঞ্জনদা হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ন উঠে এগিয়ে যায় নিরঞ্জনদার দিকে। নিরঞ্জনদা বলে,"বাবু সত্যি তুই? না কি ভুল দেখছি?" নিরঞ্জনদা ওকে বাবু বলে ডাকতো। "হ্যাঁ নিরঞ্জনদা, আমি।" নিরঞ্জনদার চোখ ঝাপসা। বলে,"আয়, খেয়ে আয়। তোকে কতদিন দেখিনি।" সায়ন খেয়ে হাত ধুয়ে আসে। ওর বাবা- মার কথা শোনে নিরঞ্জনদা। তারপর বলে,"তোর বৌদি চলে যাওয়ার আগে তোর কথা খুব বলতো?" চমকে সায়ন বলে,"বৌদির কি হয়েছে?" অন্যদিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় নিরঞ্জনদা বলে,"হঠাৎই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।" সায়ন কিছু বলতে পারে না। নিরঞ্জনদা বলে,"আমাদের তো ছেলেপুলে নেই। তোকেই ও খুব ভালবাসতো" কথায় কথায় বেলা গড়ায়। সন্ধ্যা নামে। সায়ন উঠে পড়ে। কাল ভোরেই তো ফেরা। নিরঞ্জনদা বলে,"এখানে এলে আবার আসিস।" নিরঞ্জনদার চোখ ছলছল করে। বাইরে বেরিয়ে স্টেশনের দিকে এগোয় নিরঞ্জন। ও ভেবেছিল, আর কার জন্য ও দেশে ফিরবে। এখন মনে হচ্ছে, এই মানুষটা ওর কেউ নয়, তবু ওর জন্যই এদেশে আসতে হবে। একটা অদ্ভুত মায়া অনুভব করে সায়ন। হয়তো এই মায়ার আয়ু বেশীদিন নয়। ট্রেনে ওঠার পরে জানলার ধারে বসে একবার স্টেশনের ভীড়ের দিকে তাকায় সায়ন। মনে হয় ঝাপসা দুটো চোখ যেন ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻🌻

 #সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

#গল্প

     #ভাঙনের_পরে

     #অমিতাভ_রায়

                      -


     ভয়ংকর একটা ঝড় আসছে। খবর পেয়েই মনসিজ মিটিং ডাকলো। দফতরের সবাইকেই এই দুটো দিন ছুটি না নিতে বলল। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের সতর্ক করার কাজ শুরু হয়ে গেল। কেউ যেন এই কয়েকদিন মাছ ধরতে না যায় এটা দেখতে হবে। এর আগের ঝড়ের সময় কয়েকজন জেলে নিষেধ না মেনে মাছ ধরতে গিয়েছিল। ওদের মাছধরার নৌকা হারিয়ে গিয়েছিল। পরে নৌকা আর জেলেদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। এবারে তাই অনেক সতর্ক থাকতে হবে। প্রচার বাড়াতে হবে। এইসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল মনসিজ। গ্রামগুলোর যেসব স্কুল নিরাপদ, সেখানে নদীর ধারে যে সমস্ত মানুষ থাকে তাদের থাকার ঠিকঠাক একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আগেরবারে এ নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। সে ঝড়ের পরে এই দু বছরে মনসিজ অনেকটা পরিণত হয়ে গিয়েছে। মনে হয় না খুব একটা অসুবিধা হবে। তবে, যথেষ্ট খাটনি হচ্ছে সন্দেহ নেই।


     কাজ সেরে রাতে মাকে ফোন করলো। মা, ওকে সাবধানে থাকতে বলল। এই ঝড়ের খবর পেয়ে মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তার উপর এখনও বৌমা বাড়ি ফেরে নি। সাথীকে এখনও বুঝে উঠতে পারে নি মনসিজ। ওর পক্ষে চাকরি ছেড়ে এখানে আসা সম্ভব নয়। সাথী চাকরি ছাড়ুক, এটা চায়ও না মনসিজ। কিন্তু, সাথী এই কয়েক বছরে একবার মাত্র এখানে এসেছিল। মনসিজ বাড়ি গেলেও কিরকম একটা নির্লিপ্ত থাকে। যেন, খুব একটা খুশী হয় না। মা বলে,"একটা নাতি- নাতনি না হলে ভালো লাগছে না।" মনসিজ মার কথার মধ্যে লুকোনো ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেও নীরব থাকে। ওদের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র সোমেন অবিবাহিত। ও বলে,"তোদের যে হাল দেখছি, বিয়ে করার আর সাহস নেই।" সত্যিই তাই! সুহাসের বিয়েটা ভেঙেই গিয়েছে। রাকা আর একটা বিয়ে করেছে। কাকে দোষ দেবে বন্ধুরা ভেবে পায় না! আকাশ আর নীলার মধ্যেও সম্পর্ক মোটেই ভালো নেই। দিনরাত ঝগড়া লেগেই আছে। সাথীর সঙ্গে মনসিজর অবশ্য কথা কাটাকাটি হয় না। হবেই বা কী করে! সাথী ওর সঙ্গে কথাও বলে না খুব একটা। ওর সমস্যাটা যে কী তা বুঝে উঠতে পারে না মনসিজ। কিন্তু, এখনও বাড়ি ফেরে নি সাথী! কেন? চিন্তায় পড়ে যায় ও। চেনাজানা অনেকেরই দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। কিন্তু, কেন? এ সময়ের এ এক অদ্ভুত রোগ! মনসিজর বাবা সংসারের কোনো ব্যাপারেই থাকতোনা। অন্যদিকে জেঠু খুঁটিনাটি সব ব্যাপারেই মাথা গলাতো। দুজনের দাম্পত্য সম্পর্কে কোনো সমস্যাই ছিল না। পাড়ার কালিপদকাকু আর তার বৌয়ের ঝগড়ায় ওদের বাড়িতে কাকচিল বসতো না। অথচ, বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে ওদের। ভেবেই হাসি পেয়ে যায় মনসিজর। ফোন বাজছে। ধরতেই উদ্বিগ্ন আব্দুলের কণ্ঠস্বর, "স্যার, নদীর বাঁধে এক জায়গায় ফাটল ধরেছে। এখনই মেরামত না করলে, ঝড়ের সময় মুশকিল হবে।" আব্দুল খুবই সিরিয়াস ছেলে। এরকম ছেলেকেই দরকার। আপাতত, সাথীর কথা ভাবার আর সময় নেই। কোনরকমে পোশাক বদলেই ছোটে মনসিজ।


   বাঁধটা বাঁচানো গেছে। কিন্তু, প্রবল ঝড়ে অনেক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। এই কদিন দুচোখে ঘুম নেই মনসিজর। এদিকে সাথী এখনও ঘরে ফেরেনি। মাকে বলে দিয়েছে চিন্তা না করতে। ও ঠিকই আছে। অবশ্য সে নিয়ে ভাবারও সময় নেই মনসিজর। স্কুলগুলোয় ছুটছে- ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। নদীর ধারের সমস্ত গ্রামবাসীই চলে এসেছে স্কুলে। তাও টহল দিতে গিয়ে একটা কুঁড়েঘরের ভিতরে আর্তনাদ শুনে ছুটে যায় মনসিজ। একটি বউ পড়ে আছে মেঝেতে। তার গায়ের উপরে চালের একাংশ পড়েছে। বাকি চালের তলায় চাপা পড়ে আছে এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুজনেই শেষ। বউটাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। জানা গেল, বউটি মা হতে চলেছে৷ গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ওদের সদ্ভাব ছিল না। বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। ওর বর ওকে গর্ভবতী অবস্থাতেই পরিত্যাগ করে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেই থেকে বউটি এখানে থাকে। হাসপাতালে বউটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছিল মনসিজ। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। সাথীর ফোন। গম্ভীর গলায় সাথী ঘোষণা করল, "আমি আর তোমার বাড়িতে ফিরছি না। ডিভোর্সের পেপারে সই করে দিও।" নির্বাক হয়ে বসে থাকে মনসিজ। কেন? কেন? উত্তর খুঁজে পায় না। হয়তো সাথী অন্য কারোর প্রেমে পড়েছে। ভাবতে পারে না ও। 


   বউটা সুস্থ আছে। ওর বাচ্চা হয়েছে। খবরটা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরোতে যাচ্ছিল ও। পিছন থেকে নার্স ডাকছে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। "স্যার, ডক্টর সিনহা আপনাকে ডাকছেন। একটু দেখা করে যান প্লিজ।" ডাক্তারের আবার কী হল! এই লোকটাকে চেনেও না মনসিজ। নতুন এসেছে নিশ্চয়ই।" নার্সের পিছন পিছন ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকে মনসিজ। "কী রে, ভালো আছিস?" চমকে যায় মনসিজ। "শ্রাবণী তুই! আমি তো ভেবেছিলাম কোনো একটা লোক!" শ্রাবণী হাসে। এই শ্রাবণীর প্রতি এক সময়ে একটা টান ছিল মনসিজর। এখনও ওকে দেখে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। তাহলে সাথীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এখনও শ্রাবণীর ওপর সেই টান ওর হারায় নি। শ্রাবণী জয়েন্টে চান্স পেয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আর দেখা হয় নি। "তুই এই অঞ্চলের মানুষের অনেক উপকার করেছিস শুনলাম। খুব ভালো লাগলো। বাচ্চাটাকে দেখেছিস?" মাথা নাড়ে মনসিজ। "চল, দেখবি চল " মনসিজকে দেখে বউটার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মনসিজ ভাবে, মা আর বাচ্চাকে একসঙ্গে দেখার মতো সুন্দর দৃশ্য আর কিছু নেই। "বউটার একটা ব্যবস্থা করে দিস। ওর তো কেউ নেই শুনলাম।" মনসিজ বলে,"ব্যবস্থা হয়ে যাবে।" একসঙ্গেই বাইরে বেরোয় ওরা। আজও আকাশে মেঘ জমে। যে কোনো মুহূর্তেই বৃষ্টি নামবে। "তোর খবর কী বল? বিয়ে করেছিস তা জানি।" "একটু আগে সে বিয়ে ভাঙার ঘোষণাও হয়ে গিয়েছে।" "সে কী? কেন?" "জানি না" দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয় মনসিজ। তারপর বলে,"তোর কী খবর?" "জানিস না?" "না তো- কী ব্যাপার?" "আমার বরও ছিল ডাক্তার। নার্সিংহোমে লোকটা কিডনিপাচারের ব্যবসা খুলে বসেছিল! ঘেন্নায় পালিয়ে এসেছি।" খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল শ্রাবণীকে। তারপর মৃদু হেসে বলে,"তোর সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল। কেউ ভালো কিছু করলে মন ভালো হয়ে যায়।" শ্রাবণী ওর হাত চেপে ধরে। "চালিয়ে যা মনসিজ।" ধীরে ধীরে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যায় ও। মনসিজ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। তারপর হাতের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণীর ছোঁয়া অনুভবের চেষ্টা করে। ভাবে, সময়টাকে যদি পিছিয়ে নেওয়া যেতো। আর তখনই প্রবল বৃষ্টি নামে। মায়ের ফোন এসেছে। গাড়িতে উঠে ফোন ধরতেই মার গলা ভেসে আসে," জানিস খোকা, বৌমা নাকি....।" মাকে থামিয়ে দিয়ে মনসিজ বউটাকে কীভাবে বাঁচানো গেছে, বাচ্চাটাকে কীরকম দেখতে - এইসব গল্প বলে। চারদিক বৃষ্টিতে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। শ্রাবণীর মুখটা ভাসছে যেন মেঘলা আকাশে। মার গলা ভেসে আসে,"খোকা তুই পাগল হয়ে যাস না রে! কীসব আজেবাজে বকছিস? জানি, বউ চলে গেলে মানুষ এরকম হয়ে যায়। চিন্তা করিস না। সম্পর্ক ভাঙে- আবার নতুন সম্পর্কও তৈরী হয়। আমি তোর কাছে যাবো। ভেঙে পড়িস না খোকা।" বৃষ্টির শব্দে মার শেষদিকের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে আসে।

🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺

 #সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন


#গল্প

                 #অসমাপ্ত_পান্ডুলিপি 

                       #অমিতাভ রায় 

                                      -


   উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হয়নি শেখরের। বিলুদার ফোনটা এসেছিল সন্ধেবেলায়। "টিকিটটা তুই পাবিই শেখর। সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। কাল যে কোনো সময়ে ডিক্লেয়ার করবে।" আর ঘুম হয়! সকাল থেকে টিভি চালিয়ে টিভির সামনে বসে আছে শেখর। সুস্মিতাও রীতিমতো টেনশনে রয়েছে। সুস্মিতা মেয়েকে নিয়ে কয়েকদিন বাপের বাড়িতে রয়েছে। সেখান থেকেই ফোনে বারবার খবর নিচ্ছে। লালুর মা সকালের চা আর ব্রেকফাস্ট দিয়ে রান্না করে চলে গিয়েছে। এখনও কোনো খবর দিচ্ছে না। জানলার বাইরে রাস্তায় একটা কমবয়সী ছেলে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোন করেই যাচ্ছে। কাকে কে জানে? একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে শেখর৷ টিভির দিকে চোখ। খেয়াল ছিলনা শেষ সিগারেটও ধরিয়ে ফেলেছে। সিগারেট নিতে গিয়ে দেখে প্যাকেট শেষ। পাজামা আর গেঞ্জি পরেছিল শেখর। ফতুয়াটা গায়ে গলিয়ে মোবাইল পকেটে পুরে ও বাইরে বেরোয়। ছেলেটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন। আজকালকার ছেলেগুলো যা হয়েছে না! সারাক্ষণই ফোন আর ফোন। জীবনে যেন আর কিছুই নেই! ফতুয়ার পকেট কাঁপছে। কেউ ফোন করেছে। ফোন বের করে দেখে নরেশের ফোন। দেখেই মুখ কঠিন হয়ে ওঠে ওর। বিলুদাকে সহ্য করতে পারেনা নরেশ। সেকারণে শেখরকেও। এবারে টিকিট পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল নরেশেরও। নিশ্চয়ই হতাশ হয়ে ফোন করেছে। ফোনে নরেশের গলা শুনতে পায় শেখর। "তুই টিকিট পেয়েছিস। কিন্তু, এবারে বিলুদা নিজেই টিকিট চেয়েছিল। ক্ষেপে গেছে। তোকে মারবে বলে সুপারিকিলার লাগিয়েছে। তোকে খুন করতে পারলে ও টিকিট পেয়ে যাবে।" শেখর ফোন কেটে দেয়। যা তা বকছে! টিকিট না পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে নরেশের। হাসি পেয়ে যায় শেখরের। পরক্ষণেই অদ্ভুত একটা ভয় হয়। সত্যিই যদি বিলুদা সুপারিকিলার লাগায়! মেরুদন্ড বেয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে যায় ওর। তেমন একটা গরম নেই। তবু ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায় শেখর। হঠাৎ একটা সন্দেহ হয় শেখরের। এই ছেলেটা সেই সুপারিকিলার নয় তো? ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকায় শেখর। ছেলেটা ফোন ছেড়ে পকেটে হাত দিয়েছে। একটা রিভলভার পকেট থেকে বেরিয়ে আসছে না? সত্যিই তো! ছেলেটা ওর দিকে তাক করেছে। ভয়ে শরীরটাকে নড়াতেই পারছেনা শেখর। পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গিয়েছে! প্রাণপণ চেষ্টায় পিছনে ফিরে দৌড়াতে যায় শেখর। একটা কানফাটা আওয়াজ। পিঠে কিছু একটা বিঁধেছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। রাস্তায় পড়ে যায় শেখর। মোবাইল ফোন পকেট থেকে রাস্তায় পড়ে গেছে। কেউ একটা ফোন করেছে। অসহ্য যন্ত্রণা! চোখ বুজে আসতে চাইছে। তবু কোনরকমে ফোনের দিকে তাকায় শেখর। সুস্মিতা ফোন করেছে। তাহলে কি ওর নাম ঘোষণা করেছে? সেটাই জানাতে ফোন করছে সুস্মিতা? কিন্তু, চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শেখরের। আর চোখ খুলতে পারছে না শেখর। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।


    একটা খুন হয়েছে। একটা লোক রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ভীড় জমে গিয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সুহাসের মনে হল, একটা অসমাপ্ত পান্ডুলিপি যেন পড়ে রয়েছে! কিন্তু, এখন আবেগের সময় নয়। লোকটা ভোটে দাঁড়ানোর টিকিট পেয়েছে। অথচ তার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। না! এখন এসব ভাবার সময় নেই। চ্যানেলের দর্শকদের সব জানাতে হবে। মাউথপিস তুলে নিয়ে ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকায় সবথেকে জনপ্রিয় চ্যানেলের সাংবাদিক সুহাস। রাতে হুইস্কির বোতল থেকে সোনালি তরল ঢালতে ঢালতে লিপিকার দিকে তাকিয়ে সুহাস ভাবে, সবার মনই এক একটা পান্ডুলিপি। ও এখন স্বপ্ন দেখছে। অথচ, বিলুবাবু টিকিট পেয়েই জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছে। শেখরের হত্যাকারীদের বিলুবাবু দেখে নেবে! আসল খবর যদিও সুহাস জানে। সব পান্ডুলিপিই কি আর প্রকাশিত হয়! লিপিকার ঠোঁট এগিয়ে আসছে ওর ঠোঁটের দিকে। সুহাসের মনে হয়, সত্যি কথা বোধহয় ভুলে যেতে হয়। ভুলতে পারবে কি ও? সুস্মিতা সুহাসের ছোটবেলার বন্ধু। সদ্য স্বামীহারা হয়ে ও বিচার চাইছে। বিলুবাবুর ফাঁসি হোক চাইছে। ফোন করেছিল সুহাসকে। এদিকে চ্যানেলে প্রচুর বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেয় বিলুবাবু। মালিকের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সারা দেশের রাজনৈতিক জগতে বিশাল প্রভাব। তাহলে? উত্তর জানেনা সুহাস। জানতেও চায়না। সোনালি তরলে চুমুক দিয়ে লিপিকাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয় ও।

🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷 

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন

#গল্প

        #পিকনিক

        #অমিতাভ_রায়

                         -


      "হ্যাঁগো, মনে আছে এখানে একবার আমাদের পিকনিক হয়েছিল?" সুরমার কথা শুনে সেকথা মনে পড়ে গেল প্রগতির। "সে কি আজকের কথা!" পুরনো দিনের কথা ভেবে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রগতি। "দাদু, তুমি আর ঠাম্মা পিকনিক করেছিলে? বিয়ের আগে?" রিয়া কিছুটা বিস্মিতই। "না- দিদিভাই, পিকনিক কি দুজনে হয়? আরো অনেকে ছিল।" "তখনই তোমাদের প্রেম হয়ে গেল! ঠাম্মাকে যা দেখতে ছিল না! ছবিতে দেখেছি।" "এখন খারাপ দেখতে হয়ে গেছি নাকিরে?" সুরমা হাসতে হাসতে বলে। "না, ঠাম্মা- তুমি এখনও সুন্দর।" ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। নদীটা হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। প্রগতি ভাবে, ঠিক এভাবেই ওদের জীবন থেকে পুরনো সময় হারিয়ে গিয়েছে। "ঠাম্মা, আজ সন্ধেবেলায় তোমাদের সেই পিকনিকের গল্প শুনবো।" দাদুকে নিয়ে এসেছিল বাবা কলকাতার ডাক্তারকে দেখাবার জন্য। দাদুদের ফিরে যাওয়ার সময় রিয়া বায়না ধরেছিল দাদুদের সঙ্গে যাবে বলে। ওর কলেজে এখন ছুটি। দাদু-ঠাম্মা খুব খুশী। বাবা- মা আপত্তি করেনি। বাবা ওদের ট্রেনে তুলে দিয়েছে। বাবা মাঝেমাঝেই দাদুকে বলে কলকাতায় এসে থাকতে। দাদু গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এখানে কিছুতেই আসতে চাইছে না। শেষ বিকেলে স্টেশনে নামল ওরা। হারাদাদা এসেছে ওদের নিয়ে যেতে। এখন এখানে খুব টোটো চলে। আগে ভ্যানরিক্সাই ছিল একমাত্র সম্বল। তারও আগে নাকি গরুর গাড়িতে যেতে হতো- আর উৎসব-অনুষ্ঠানে ছিল পালকি। দাদুর কাছে এসব শুনেছে রিয়া। অনেকদিন পরে দেশের বাড়িতে যাচ্ছে ও। স্টেশন ছাড়িয়ে কিছুটা এগোতেই মাঠঘাট, গাছপালা, চাষের ক্ষেত, পুকুর- চারদিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছে ও। সূর্যটা বিশাল মাঠের ওপারে অস্ত যাচ্ছে। মাঠটা অদ্ভুত একটা লাল রঙের আভায় ভরে গিয়েছে। বাড়িতে ঢোকার আগেই অন্ধকার নেমে এল। টর্চের আলোয় ওরা ঘরে ঢুকলো। 


   হারাদাদা আর লক্ষ্মীদিদি আছে বলেই দাদু-ঠাম্মা এখানে এখনও থাকতে পারছে। দাদু তো প্রায় অথর্ব হয়েই পড়েছে। ঠাম্মারও তো অনেক বয়স হয়েছে! তবু রিয়া আসতে ঠাম্মা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দাদু তো ওকে চোখে হারাচ্ছে যেন। কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইছে না। পরেরদিন সন্ধেবেলায় মুড়ি তেলেভাজা খেয়ে বারান্দায় ওরা আড্ডা দিচ্ছিল। কলকাতায় এখন পচা গরম। অথচ সন্ধেবেলা থেকে কি সুন্দর হাওয়া দেয় এখানে। মনে হয় পাখাই লাগবে না। অপার্থিব চাঁদের আলোয় ভরে গিয়েছে চারদিক। দুটো নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। আমগাছের ডালগুলো দুলে উঠছে হাওয়ায়। মাঝেমাঝে প্যাঁচার ডাকে চারদিক আরো রহস্যময় হয়ে উঠছিল। রিয়া বলে, "দাদু, পিকনিকের ব্যাপারটা বলো?" দাদু হেসে ফেলল। "সে ছিল একদিন, বুঝলি?" রিয়া মাথা নাড়ে-ও বুঝেছে। ওর শঙ্খ ঘোষের কবিতাটার কথা মনে পড়ে যায়। সেদিনই স্যার পড়াচ্ছিলেন। "সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনের কলকাতা।" দাদু প্রায় সেই ভঙ্গিতেই বলল বলে ওর হাসি পেয়ে গেল। দাদু বলতে শুরু করলো।


    "বুঝলি দিদিভাই। তখন এখানে কোএড কলেজ ছিল না। এমনিতে তখন মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার তেমন সুযোগও ছিল না। প্রেম তো পরের কথা। তবে, তোর ঠাম্মাকে প্রথমবার দেখেই বোল্ড আউট হয়ে গিয়েছিলাম।" রিয়া দেখে ঠাম্মার মুখে মৃদু লজ্জার হাসি ফুটে উঠেছে। "তা, একটা সুযোগ চলে এল। তোর ঠাম্মার বাবা আর আমার কাকু একই মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল। ওরা- প্রাক্তন ছাত্ররা মিলে একটা পিকনিক করতো। সেই পিকনিকে কাকু আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি কলকাতায় কাকুর বাড়ি একবার কাকুকে না বলেই চলে গিয়েছিলাম। কাকুদের সেদিন পিকনিক ছিল। কাকিমা বলল, "ও এখানে একা কি করবে? ওকেও সঙ্গে নিয়ে নাও।" তা সেটাই হলো। গিয়ে দেখি নদীর পাড়ে একটা বাংলোয় পিকনিক। সব ডাক্তারেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এমন সময় দেখলাম তোর ঠাম্মাকে। ওর বাবার সঙ্গে এসেছে। ওর বাবার শরীর খারাপ। কিন্তু, পিকনিক মিস করতে পারবে না। সবার সঙ্গে দেখা হবে। মেয়ে জোর করে সঙ্গে এসেছে। সবার অনুরোধে তোর ঠাম্মাকে গান গাইতে হল। গঙ্গার ওপর তখন সোনারোদ পড়েছে। সোনালি আভা। হাওয়ায় নদীর পাড়ের গাছগুলো কাঁপছে। আর তোর ঠাম্মার গান। খুব ভালো লেগেছিল।" দাদু থেমে গেল। আকাশে মেঘ করেছে। একটু একটু করে চাঁদটা ঢেকে যাচ্ছে। জোলো হাওয়া। বৃষ্টি হবে বোধহয়। "ব্যাস, তুমি প্রেমে পড়ে গেলে! বললে কিভাবে?" রিয়ার কথা শুনে দাদু হেসে উঠল। "বললাম আর কোথায়?" "মানে?" বিস্মিত রিয়া বলে। "গল্পের এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল, তা হলো না।"


   দাদু আবার বলতে শুরু করে। "সেদিন পিকনিকে খাওয়াদাওয়া দারুণ হয়েছিল। কিন্তু, আমার তখন সেসবে মন নেই। তোর ঠাম্মার কথাই ভাবছিলাম। কেউ আলাপ করিয়ে দেয় নি। তোর ঠাম্মাও পাত্তা দেয়নি।" "সে কি!" রিয়া বলে ওঠে। "তখন ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে লোকে অবাক হতো। তাছাড়া, তোর দাদুর সাহসই হয়নি আমার সঙ্গে কথা বলার।" দাদু বলে ওঠে, "সে যা হোক, এরপর কয়েকবছর কেটে গেল। আমি এই গ্রামেরই স্কুলে চাকরি পেয়ে গেলাম। আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এরকম সময়ে কাকু-কাকিমা একদিন এসেছিল। সে সময়ে শুনলাম, তোর ঠাম্মার বাবা মারা গেছে। ওর মা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছে।" রিয়া দেখে ঠাম্মার চোখে জল। ও ঠাম্মার হাতটা চেপে ধরে। দাদু আবার বলতে শুরু করে, "আমার চোখের সামনে তখন আবার তোর ঠাম্মার মুখ ভাসছে। কাকিমাকে তোতলাতে তোতলাতে বলেই দিলাম।ভেবেছিলাম, বাবা এই অসবর্ণ বিয়েতে রাজি হবে না। কিন্তু, বাবা রাজি হয়ে গেল। পরে শুনলাম, দাদুকে একবার তোর ঠাম্মার বাবা কঠিন অসুখ থেকে সারিয়ে তুলেছিল। বাবা এটা ভোলেনি। ব্যাস, আমায় আর পায় কে? তোর ঠাম্মাকে বিয়ের রাতে বলেছিলাম- "পিকনিকের পরে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে, আর কখনো আমায় ছেড়ে যেওনা।" মেঘে ঢেকে গেছে চাঁদ। আবছা হয়ে গেছে চারদিক। একটা অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। পরে ঠাম্মার মুখে রিয়া শুনেছে এটা একরকম বুনো ফুলের গন্ধ। হঠাৎ ঠাম্মা রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, "তুমিই তো আমায় ছেড়ে যেতে চাইছো। এতো শরীর খারাপ করে ফেললে কেন?" দাদু ম্লান হেসে বলে,"আমি চলে গেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো। তুমি এলে ওখানেই পিকনিক করবো।" ঠাম্মা মুখ নীচু করে ফেলে। রিয়া বুঝতে পারে ঠাম্মা কাঁদছে। এক পশলা বৃষ্টি ঝরে পড়ে ভিজিয়ে দিল সবকিছু।