Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
সিঁদুরের মূল্য            কবিতা চক্রবর্ত্তী
ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করছে। গাদা পেটি মিলিয়ে অনেকগুলো মাছ। মাছটা তো পারুল নিজের হাতেই কেটেছে। অনেক বড়ো মাছটা। দেখেই কেমন লোভ লাগছে। গিন্নিমা বলেছেন অর…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন


সিঁদুরের মূল্য

         

            কবিতা চক্রবর্ত্তী


ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করছে। গাদা পেটি মিলিয়ে অনেকগুলো মাছ। মাছটা তো পারুল নিজের হাতেই কেটেছে। অনেক বড়ো মাছটা। দেখেই কেমন লোভ লাগছে। গিন্নিমা বলেছেন অর্ধেক ভাজা রাখতে আর অর্ধেক ভাপা করতে।


    ভাপা আগে করা হয়েগেছে । এবার বাকি মাছ গুলো ভাজা হবে। মাছ ভাজতে ভাজতে ছেলে মেয়ের মুখদুটো মনে পড়লো পারুলের । ওরা তো ইলিশ মাছের স্বাদ কেমন সেটাই বোধহয় ভুলে গেছে।তিন বাড়ি রান্না করে যা পায়,তাতে তো কোনরকমে নুন ভাতের জোগাড় হয়। তাও রেশন দোকানে বিনা পয়সায় চালটা  পেয়ে যায়,তাই রক্ষা।।আর কোনোদিন  শেষবেলায় বাজারে যদি  নরম হয়ে যাওয়া মাছ আল্পদামে পায়,কিনে নিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়ে দুটো কে ভেজে দেয়।


     দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাদের বেশ সুখের সংসার ছিল। ওদের বাবা রাজমিস্ত্রি ছিল। দুজনে যা রোজগার করতো বেশ ভালোভাবেই দিন চলে যেত। তারপর কি যে হলো। মানুষটা কেমন যেনো পাল্টে গেলো।সংসারে মন নেই। একটা পয়সা দিতনা।মাঝে মাঝে তো বাড়িতেও আসতো না। তারপর একদিনতো বেরিয়ে আর ফিরে এলো না।অনেক খুঁজেছিল পারুল। তারপর শুনলো সে নাকি আর একটা সংসার পেতেছে। আর খোঁজ করেনি।এই ভাবেই কষ্ট করে ছেলে মেয়ে দুটো কে বড়ো করছে। অনেকেই অনেক প্রস্তাব দিয়েছে,কিন্তু সে সেইদিকে তাকায়নি।শুধুমাত্র ছেলে মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে। ওদের সে মানুষ করবে যে ভাবেই হোক।


এই বাড়ির গিন্নিমাকে পারুল একদম পছন্দ করেনা।সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকে।কিছুই পছন্দ হয়না তার। কিন্তু এই বাড়ির নতুন বউ অহনা কে তার খুব ভালো লাগে। কয়েক মাস বিয়ে হয়েছে। কি সুন্দর করে কথা বলে।কিন্তু বউটার ও অনেক কথা শুনতে হয় শাশুড়ির কাছে সারাক্ষণ। খুব গরীবের মেয়ে তো। উঠতে বসতে খোঁটা। সংসারে সেও কাজের লোকের মতোই থাকে। খাওয়া পরা সব কিছুতেই শাশুড়ির খোঁটা। শুধু শ্বশুর মশাই তাকে একদম নিজের মেয়ের মতো ভালবাসেন। ওর বর টাও কিছু বলেনা মাকে।  মা যা বলে তাই করে।মায়ের বাধ্য ছেলে।


অনেকগুলো মাছ ভাজা হলো।  কিন্তু কোনোদিন যা করেনা পারুল, আজ তাই করলো। লোভ সামলাতে পারলনা। না না ,নিজের জন্য না।ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য।একটা ভাজা মাছ কাগজের মধ্যে করে ব্লাউসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো। বাড়ি গিয়ে দুজনকে অর্ধেক অর্ধেক করে দেবে। কি যে খুশি হবে ওরা। ভেবেই মনটা খুশিতে ভরে উঠলো পারুলের। 


কিন্তু সেটা অহনা দেখে ফেললো। অপ্রস্তুত পারুল বুঝে  পেলনা কি বলবে।মাছটা বের করতে গেলো,কিন্তু আহনাই তাকে বারন করলো। বললো , রেখে দাও। আমি বুঝি গো তোমার কষ্ট। ছেলে মেয়ের জন্য  নিলে তো। আমারও তো  খুব কষ্ট হয়,আমার ভাইটার জন্য।কতদিন হয়তো মাছ ই খেতে পায়না। আর আমি এখানে কত কিছু খাই। তুমি নিয়ে যাও। আমি কাউকে কিছু বলবো না।


দুপুরে সবাইকে খেতে দিয়ে তারপর অহনা খায়।এটাই শাশুড়ি ঠিক করে দিয়েছেন।মাছ মাংস সবাইকে দিয়ে,যা বেচেঁ যায় তাই খায় অহনা।তার স্বামীরও তাতে কোনো হেলদোল নেই। কোনোদিন বলেও না একসাথে খাওয়ার জন্য। যদিও শাশুড়ি মার ওপর কথা বলার সাহস কারুর নেই। শ্বশুর মশাই মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেন,তোমার রেখেছো তো।নিজের বাটির থেকে কিছুটা তুলে দেন,এতটা খেতে পারবেন না বলে ।যদিও এটা কার জন্য সেটা অহনা বোঝে।মানুষটা যে ঠিক নিজের বাবার মতোই ভালবাসেন তাকে।লুকিয়ে চানাচুর বাদাম ভাজা, চপ কিনে দেন তাকে।


এরকম চলতে থাকে কিছুদিন। রান্নাঘরে গিয়ে শাশুড়ির চোখের আড়ালে মাছ মিষ্টি সব দিতে থাকে পারুলকে অহনা। তাতে তার নিজের কষ্টটা হয়তো একটু লাঘব হয় । কিন্তু বেশিদিন এটা চলে না। একদিন শাশুড়ি এটা দেখে ফেলে। ভীষণ অশান্তি হয়। পারুলকে তো কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয় ।আর আহনাকেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। সাথে উপরি পাওনা স্বামী শাশুড়ির বাপের বাড়ি তুলে কথা বলা।এই ভাবেই দিন চলে অহনার। 


     কেটে গেছে চার বছর। অহনার পরিস্থিতি একই আছে। শুধু বদলের মধ্যে তার জীবনে একটা ছোট্ট ফুটফুটে ছেলে এসেছে।দু বছর বয়স। তাকে নিয়েই দিন কেটে যায়। বাপের বাড়ি খুব একটা দূর না। বাসে আধ ঘণ্টা মতো। কিন্তু তাও কতদিন যাওয়া হয়না। আজ শাশুড়িকে অনেক বলে অনুমতি পেয়েছে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য  বাপের বাড়ি যাওয়ার । একটা কারণও আছে অবশ্য। সামনেই ভাইটার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। সারাদিন পড়াশুনা করে। বাবার তো ক্ষমতা নেই সেরকম ভালো মন্দ খাওয়ানোর। তাই লুকিয়ে কিছু টাকা ভাইকে দিতে যাচ্ছে। একটু ঘি দুধ ডিম খাওয়ার জন্য। না,এটা তার স্বামীর টাকা না। সেতো মনেই করেনা বউদেরও কিছু হাত খরচের প্রয়োজন। তার মতে খাওয়া  পড়া সবই তো দিচ্ছি।আলাদা হাত খরচের কি দরকার।  যদিও এতে তার মার পূর্ণ সমর্থন আছে।  কিন্তু  শ্বশুর মশাই প্রত্যেক মাসে তার পেনশন নিয়ে এসে সবার অলক্ষে অহনার হাতে কিছু করে টাকা দেন। সেই টাকাই অহনা জমিয়ে রেখেছিল। সেটাই আজ ভাইকে দিতে যাচ্ছে।


বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অহনা। হটাৎ পিছন থেকে কে যেন,নতুন বৌদিমনি বলে ডাক দিল। পিছনে তাকিয়ে দেখলো পারুল।মুখে একগাল হাসি। কত বদল হয়েছে পারুলের। সেই পারুলের সাথে এই পারুলের কোনো মিল নেই। দামী শাড়ি পড়া। সাজ পোশাক সব মিলিয়ে কে বলবে ও রান্নার কাজ করে!!!


        কি দেখছো গো অমন করে তাকিয়ে? হেসে বললো পারুল। তোমাকে দেখছি গো,বললো অহনা। কি সুন্দর লাগছে তোমাকে দেখে। তুমি কেমন আছো গো বৌদিমিনি? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? পারুলের প্রশ্নে একটু হেসে অহনা বললো,সবাই ভালো আছে। আমার একটা ছেলে হয়েছে। যেও একদিন।

পারুল বললো,না গো সেই অপমান আমি আজও ভুলিনি গো।


পারুলকে দেখেই যাচ্ছে অহনা। হটাৎ বললো ,আচ্ছা পারুল তুমি যে আগে কত চওড়া করে সিঁদুর পড়তে।এখন দেখছি আর সিঁদুরের চিন্হ নেই। তবে কি তোমার স্বামী.....

 পারুল হেসে বললো ,না গো।আমার স্বামী মারা যায়নি। নতুন বউ বাচ্চা নিয়ে বহাল তবিয়তে ঘর করছে। আমিই শুধু শুধু সিঁদুর পড়তাম। তুলে দিয়েছি ইচ্ছে করে। কি লাভ বলতো ওরকম সিঁদুর পড়ার?

জানতো তোমাদের বাড়ির কাজ ছাড়ার পর আমি একটা নতুন বাড়িতে কাজ ধরেছি। এখনও সেখানেই কাজ করি। একটাই বাড়িতে কাজ করি। শুধু একজন মানুষের। দাদাবাবু একা থাকেন।বউ মারা গেছে।ছেলে বাইরে বোর্ডিংয়ে থাকে। একা মানুষ।আমি সব কাজ করি। দাদাবাবুর বাড়ির নিচের তলার একটা ঘরে থাকি। জানতো আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে দাদাবাবু খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। আমার কোনো অভাব উনি রাখেননি। আমিও তেমন ওনার কোনো অভাব রাখিনি।

আমার ,আমার ছেলে মেয়েকে যার দেখার কথা ছিল,সে তো দেখলো না। সে শুধু সিঁদুর টুকুই দিয়ে ছিল। কিন্তু আর একজন, সিঁদুর না দিয়েই সব দায়িত্ত্ব পালন করছে। তাই সিঁদুর টা তুলে দিয়েছি গো। আমি খুব সুখী এখন।


পারুল চলে গেলে,ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ অহনা। পারুলের শেষ কথাগুলো কানে বাজছে এখনও। ও খুব সত্যি কথাগুলো আজ বলে গেলো ওর মতো করে ।সত্যিই তো সিঁদুর দান,সাত পাকে ঘোরা,এগুলোর মধ্যে তো অনেক প্রতিজ্ঞা থাকে। অনেক কথা দেওয়া। কতজন পালন করে?? কিছু সংস্কারও আমাদের মনে গেঁথে আছে। হাজার প্রতিকূল অবস্থা থেকে যা কিছুতেই বেরোতে দেয়না আমাদের। কজন পারে পারুলের মতো করতে? সংস্কারমুক্ত হয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করতে? পাপ তো মানুষের মনে। বাস্তব পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। কিন্তু অহনা তো পারেনি,সব কিছুর প্রতিবাদ করতে।এটাই আসলে বেশিরভাগ মেয়েদের সাথে হয়ে থাকে। সংস্কারের বাঁধনে সারাজীবন আটকে থাকে।