Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গল্প#এক_বৃষ্টির_রাতে#অমিতাভ_রায়
                                   -
     সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। জোলো হাওয়া বইছে। বৃষ্টি অনিবার্য। বেশ জমিয়ে খিচুড়ি খেয়ে দিবানিদ্রা দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু, না বেরিয়ে উপায় নেই। আজ ওকে মগরায় যেত…

 


#গল্প

#এক_বৃষ্টির_রাতে

#অমিতাভ_রায়


                                   -


     সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। জোলো হাওয়া বইছে। বৃষ্টি অনিবার্য। বেশ জমিয়ে খিচুড়ি খেয়ে দিবানিদ্রা দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু, না বেরিয়ে উপায় নেই। আজ ওকে মগরায় যেতে হবে অফিসের কাজের জন্য। আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। উপায় নেই। চিরঞ্জীব হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরে। খুব একটা ভীড় নেই। মগরায় এগারোটার দিকে পৌঁছলো। ভেবেছিল দুপুর দুপুর বেরিয়ে যাবে কাজ সেরে। কিন্তু, কাজ শেষ হল ঠিক সন্ধের দিকে। এখানেই লাঞ্চ করে নিয়েছিল চিরঞ্জীব। স্টেশনে যখন এলো, তখন প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। স্টেশন প্রায় ফাঁকা। আজ নিতান্ত প্রয়োজন না থাকলে কারোর বেরোবার কথা নয়। যারা বেরিয়েছে, তারাও দেরি করে ফেরার ঝুঁকি নেয় নি। কিন্তু, ট্রেন আর আসে না। স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে কারণ জানতে গিয়ে মাথায় হাত চিরঞ্জীবের। এই দুর্যোগে ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একটু আগেই স্টেশন মাস্টার খবর পেয়েছেন। এবার ঘোষণা করবেন। বাইরে বেরিয়ে এল চিরঞ্জীব। মোবাইল ফোন কাজ করছে না। বাড়িতে খবর দেওয়া যাবে না। সামনে একটা চায়ের দোকানই শুধু খোলা রয়েছে। আর সব দোকান বন্ধ। সেখানে গিয়ে চিনি ছাড়া চা দিতে বলে বসে চিরঞ্জীব। বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আজ আর ঘরে ফিরতে পারবে না। বুড়ো চা-ওয়ালা চা দিয়ে বলে,"কলকাতায় যাবেন বুঝি?" চিরঞ্জীব মাথা নেড়ে অসহায়ের মতো বলে,"ট্রেন তো বন্ধ!" বুড়ো বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,"বন্ধ তো হবেই। সারাদিন ধরে যা বৃষ্টি হচ্ছে! শুনলাম ওদিকে আরো বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কয়েকজন নাকি বাজ পড়ে মারাও গিয়েছে।" চারদিকে অন্ধকার। আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। ভয় লাগে চিরঞ্জীবের। যদি বাজ পড়ে। দূর থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়। বুড়ো বলে,"আপনার কপাল মনে হয় ভালো।" গাড়িটা এসে চা দোকানের সামনেই থামলো। জানলা দিয়ে চালকের মুখ বেরিয়ে এলো। "চাচা, সিগারেট দাও।" বুড়ো একটা কমদামী সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে দেয়। বলে,"কোথায় যাচ্ছো গো ভাইপো?" "আর বোলো না চাচা। বলাগড়ে একজন মারা গিয়েছে। তার ডেডবডি নিয়ে এই ওয়েদারে যেতে হবে কলকাতায়! সেখানেই বাড়ি। এখানে আত্মীয়র বাড়িতে ঘুরতে এসেছিল।" "এই বাবুটাকেও নিয়ে যাও। কলকাতায় যাবে।" চালক চিরঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে বলে,"চলে আসুন। ভালোই হলো। রাতের বেলায় শুধু একটা মরা নিয়ে যাওয়া ভালো লাগে না। একটা জ্যাঁতা লোকও থাকুক।" বুড়ো আর চালক দুজনেই হেসে উঠলো। চিরঞ্জীব অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়িতে উঠে বসতে বাধ্য হয়। ড্রাইভারের পাশে বসে। পিছনে তো মরাটা থাকবে! ওখানে বসবে না চিরঞ্জীব। 


  বলাগড় থেকে শুধু মরাটাকেই তুলে দিল। আর কেউ উঠলো না। এরকম আত্মীয় কোনদিন দেখেনি চিরঞ্জীব! ওখানে বাড়ির লোকজন মরা নামিয়ে নেবে। গাড়ি এবার আসাম রোড দিয়ে চলল কলকাতার দিকে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে। খুব একটা জোরে চালানো যাচ্ছে না। চারদিকে জমাট অন্ধকার। বেশ কিছু জায়গায় জল জমে গিয়েছে। দিল্লিরোডে এসে অবস্থাটা ভালো বোঝা গেল। চালকের নাম সুবীর। ও বলে,"কী ভয়ংকর অবস্থা দেখুন! শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো কিনা কে জানে?" সুবীর যে বোতল থেকে মাঝেমাঝেই জল খাচ্ছে- সেটা দেখছিল চিরঞ্জীব। কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই ও বুঝতে পারলো এটা জল নয়। গন্ধই সব পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে। সুবীর ওর চিন্তিত দৃষ্টি দেখে দেখে মুচকি বলল,"চিন্তা নেই স্যার। আমাদের অভ্যাস আছে। আপনিও একটু লালজল খাবেন নাকি?" চিরঞ্জীব মাথা নাড়ে৷ আর ঠিক সে সময় গাড়িটা কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সুবীর নীচে নামে। তারপর একটা গালাগাল দিয়ে বলে, "মালিক শুধু লাভের টাকা খাবে। গাড়ি সারাবে না।" ভয় পেয়ে যায় চিরঞ্জীব। গাড়ি কী এখানেই রাতে আটকে থাকবে! এই মরা আর এই মাতাল ড্রাইভারের সঙ্গে সারারাত কাটাতে হবে! তা অবশ্য হল না। একটু পরেই গাড়িতে উঠে বসল সুবীর। দিব্যি গাড়ি চলতে লাগল। কিন্তু, অনেকক্ষণ যাওয়ার পরে ডানকুনির ঠিক আগে গাড়ি আবার বিগড়ালো। এবার সুবীর গাড়ির অবস্থা দেখে গম্ভীর মুখে বলল,"উপায় নেই। কাছেই আমার চেনা এক মেকানিকের বাড়ি। ওকে একবার আনতেই হবে। সামান্য সময় লাগবে। আপনি শুধু মরাটা পাহারা দিন।" এখন অবশ্য ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সুবীর অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে টলতে টলতে এগিয়ে গেল।


  বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। সুবীর আর ফেরে না। চারদিকে জমাট অন্ধকার। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে রাখছিল চিরঞ্জীব। কিন্তু, চার্জ ফুরিয়ে আসছে। আর টর্চ জ্বালিয়ে রাখা ঠিক হবে না। মরা পাহারা দেবে কী, গাড়ির পিছনের সীটের দিকে তাকাবার সাহস ওর নেই! চোখ চলে গেলে মরার সাদা কাপড়টা অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে। ভয়ে শিউরে উঠছে চিরঞ্জীব। কখনও ভাবছে গাড়ি থেকে নেবে যাবে। কিন্তু, সে সাহসও পাচ্ছে না। অগত্যা চোখ বুজে বসে থাকে চিরঞ্জীব। মনে মনে রামনাম জপ করে। কখন দুচোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল ও খেয়াল করে নি। খেয়াল এলো গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজে। খুব লজ্জা পেল চিরঞ্জীব। গাড়ি যে সারানো হয়ে গিয়েছে সেটা ও খেয়ালই করে নি! "সালা, ড্রাইভারটা গাড়ির কিছুই বোঝে না। আমি দিব্যি চালাতে পারছি। ও মাল গিলে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে কে জানে?" হিমশীতল কণ্ঠে কে যেন বলে ওঠে। এ তো সুবীরের গলা নয়। চোখ খুলে পাশে চালকের দিকে তাকায় চিরঞ্জীব। আর, সঙ্গে সঙ্গেই একটা বরফের ডেলা যেন ওর মেরুদন্ড বেয়ে নেমে যায়। সাদা কাপড়টা গায়ে কোনরকমে জড়ানো। যে লোকটা গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে তার অবয়বটা চিনতে দেরী হয় না। পিছনে তাকিয়ে দেখে সীটে মৃতদেহটা নেই! থাকার কথাও নয়। ওর ঠিক পাশেই বসে আছে মরা লোকটা। থরথর করে কাঁপে চিরঞ্জীব। দরজা খোলার জন্য হাত বাড়াবার জোরও যেন ওর আর নেই। গাড়ি চলতে শুরু করে। চিরঞ্জীব আর সহ্য করতে পারছে না। ওর চারদিকটা যেন দুলছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। 


  চোখ খুলে চিরঞ্জীব দেখে ওর মুখে ছিটোচ্ছে সুবীর। সঙ্গে আরেকজন লোক। ও রাস্তায় শুয়ে আছে। গাড়িটা রাস্তার পাশে একটা তালগাছে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে চোখ খুলতে দেখে সুবীর বলে,"আপনি গাড়ি চালাতে গেলেন কেন? ভাগ্যিস বেঁচে গিয়েছেন। আর মরাটা কী করে ড্রাইভারের সীটে চলে এল কে জানে? বোধহয় ধাক্কা মেরে আপনি পাশের সীটে জ্ঞান হারিয়ে উলটে গিয়েছিলেন, আর মরাটা পিছনের সীট থেকে....তাই বা কী করে হবে?" সুবীর ভেবেই যায়। ভোরের আলো ফুটছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।