Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

প্রথম-খেয়া-সেরা-সাহিত্য-সম্মাননা

একটি গল্পশিরোনামঃ- গন্তব্যের সন্ধানকলমেঃ- রজত সরকারতারিখ--১০/১১/২০২২
সৌরিশ এক বহুজাতিক সংস্থার লালবাজার স্ট্রীটের অফিসে জয়েন করেছে বছর খানেক হল। এর আগে আই আই এম করে পুনের এক সংস্থায় কাজ করেছিল তিন বছর, তারপর কলকাতায়, আর মাস ছয়েক …

 


একটি গল্প

শিরোনামঃ- গন্তব্যের সন্ধান

কলমেঃ- রজত সরকার

তারিখ--১০/১১/২০২২


সৌরিশ এক বহুজাতিক সংস্থার লালবাজার স্ট্রীটের অফিসে জয়েন করেছে বছর খানেক হল। এর আগে আই আই এম করে পুনের এক সংস্থায় কাজ করেছিল তিন বছর, তারপর কলকাতায়, আর মাস ছয়েক পরই আয়ারল্যান্ডে চলে যাবে পাঁচ বছরের কন্টাক্ট আপাতত, পরে ইচ্ছে হলে কন্টাক্ট বাড়াবে। অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সৌরিশ এখানে কাজ করে চলেছে তার নিজের জায়গায়। এই এক বছরের কর্ম জীবনে নিলাদ্রীর সঙ্গে সৌরিশের বন্ধুত্ব খুব জমে উঠেছে। নিলাদ্রীর এখানে প্রায় চার বছর কাজ করছে, ওর বাড়ি পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার কাছে ত্রিলোকচন্দ্রপুর গ্রামে, এখানে বৌবাজারের মেসে থাকে। সৌরিশের বাড়ি বালিগঞ্জে, ওর বাবা হাইকোর্টের দশ জন নাম করা উকিলের এক জন, দাদুও বড়ো ব্যারিস্টার ছিলেন, ওর দাদাও ভালো পসার জমিয়েছে ওকালতিতে, একমাত্র ওই পরিবারের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে অন্য কাজ করছে।

এই ডিসেম্বরেই নিলাদ্রীর বিয়ে, বৌভাতে প্রায় পুরো অফিসই যাচ্ছে বাস রিজার্ভ করে, শুধু সৌরিশ আর অর্ক বিয়ের একদিন আগে থেকে উপস্থিত থাকছে নিলাদ্রীর গ্রামের বাড়িতে, বৌভাতের পরের দিন ফিরবে। নিলাদ্রীর বিয়ে হচ্ছে দুর্গাপুরের কাছে ইছাপুর বলে একটা গ্রামে, মেয়েটির নাম পৃথা। প্রায় চার বছরের প্রেম ওদের, ট্রেনে আলাপ যাতায়াতের পথে। প্রতি সোমবার নিলাদ্রী অফিস আসার জন্য পানাগড় থেকে ট্রেনে উঠত আর পৃথা এম. এ. পড়ার সময় দুর্গাপুর থেকে বর্ধমানে ইংরেজী পড়তে আসত ঐ দিন, বর্ধমানেরই এক সর্বজন বিদিত স্যারের কাছে। পানাগড় থেকে বর্ধমান প্রায় এক ঘন্টার পথ, তাও আবার সপ্তাহে একদিন! সেই এক ঘন্টার সফরে পৃথা বান্ধবীদের সাথে যেখানে বসত, প্রথম প্রথম নিলাদ্রী ওখানেই দাঁড়াত, বর্ধমানে ওরা উঠে গেলে সিটটা পাওয়ার লোভে। পৃথা একটু বিরক্ত হত স্বাভাবিক ভাবেই, ঠিক আন্দাজ করতে পারতনা নিলাদ্রীকে, পরে অবশ্য সে বুঝতে পারে সিটের জন্যই নিলাদ্রীর এখানে দাঁড়ানো, আর কিছু না। এক সময় নিলাদ্রীর প্রতি বিশ্বাস এল পৃথার মনে, ওরা চার পাঁচ জন মেয়ে মিলে নিলাদ্রীর জন্য একটা সিটও রাখতে লাগল। এখন নিলাদ্রীকে আর এক ঘন্টা দাঁড়াতেও হয়না পানাগড় থেকেই সিট পেয়ে যায়, তবে মহিলা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে একটু অস্বস্তিও হয়, কারো সাথে তেমন কথাও বলতে পারে না, কি কথাই বা বলবে! কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। এরকমই এক দিন যেতে যেতে হঠাৎ গান বন্ধ হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলেই দেখতে পায় একটি মেয়ের হাত তার কানের পাশ থেকে সরে যায়। সেদিকে তাকাতেই মেয়েটি খুব সাবলীল ভাবে বলে ওঠে,

- কেমন ছেলে তুমি, এতো দিন যারদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, তার পাশে বসার জায়গা করে দিলাম আমরা আর তারপর তার সাথে কথা না বলে চোখ বন্ধ করে গান শোনো!

- না, মানে আপনি...

- হ্যাঁ, আমি মানে দোয়েল, আমি অন্ডাল থেকে আসি, আর ও হল পৃথা দুর্গাপুর থেকে ওঠে।

- আচ্ছা আচ্ছা, আমি নিলাদ্রী।

- বেশ, ওদিকে সুপর্ণা, গার্গী আর মিঠু। তুমি কি পড়াশোনা করো?

- পড়াশোনা! না না!

- সে কি! লেখাপড়া করো না! তাহলে রোজ কোথায় যাও?

- আমি অফিস যাই, চাকরী করি।

- সেকি! এই টুকু ছেলে, পড়াশোনা না করে চাকরী কর কেন!

- না মানে পড়াশোনা বলতে আমি তো সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, এম. টেক. অবধি পড়ে এখন চাকরী করছি কলকাতায়।

- ও বাবা! এতো সফ্টস্পোকেন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার! আমরা তো ভেবেছিলাম ক্লাস টুয়্যাল্ভ বোধয়।

নিলাদ্রীর ওপাশে জানলার ধার থেকে পৃথা এবার দোয়েলকে থামাতে উদ্যোগ নিয়ে বলল,

- কি যাতা বলছিসরে তোরা চুপ কর না!

দোয়েল নিলাদ্রীর বুকের সামনে ঝুঁকে পৃথাকে বলল, - উহ্ খুব গায়ে লাগছে বল! বড্ড কষ্ট হচ্ছে!

পৃথা বড়ো বড়ো চোখে ওকে থামতে বললে দোয়েল নিলাদ্রীকে বলল, দেখো তুমি যখন বলে ফেলেছি আর আপনি বলতে পারবনা, প্রথমে তোমাকে অনেকটা জুমিয়ার ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তুমি অনেকটাই সিনিয়ার তাই তোমাকে আমরা দাদা বলব, অবশ্য পৃথা কি বলবে সেটা ওর থেকে জেনে নিও, তোমার প্রতি ওর ফিলিংসটা কি সেটা সম্পর্কে আমরা সিওর নই।

এই সব কথা বার্তার মধ্যে বর্ধমান এসে গেছে, মেয়েরা সব সিট ছেড়ে উঠে পড়ল নামার সময় দোয়েল নিলাদ্রীকে বলে গেল, আজকের মতো আমরা আসি, সামনের সপ্তাহের মধ্যে তোমরা একে অপরের প্রতি ফিলিংসটা ঠিক করে ফেলো কিন্তু, আর তোমার নাম্বারটা আমাকে দাও, কোন ট্রেনে কোথায় আছি জানিয়ে দিতে কাজে লাগতে পারে। নাম্বারটা নিয়ে দোয়েলরা সবাই হাসতে হাসতে নেমে গেল, পৃথার ফর্সা মুখটা শুধু লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। এরপর অফিস নিয়ে নিলাদ্রী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, কাজের চাপে এসব আর মাথায় নেই, শুধু সোমবার এলেই পৃথার পাশের জায়গাটা ওর জন্য পাকা হয়ে গেছে, গল্প করতে করতে বর্ধমান পর্যন্ত ভালোই কাটছে, তবে পৃথার সাথে নিলাদ্রী সেদিনের পর থেকে ঠিক সাবলীল হতে পারছে না। মনের কোনে কেমন একটা ভাব যেন উঁকি দিচ্ছে, তবে সেটা যে কেমন তা বুঝে উঠতে পারছেনা নিলাদ্রী।

সেদিন সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যা বেলা, অফিস থেকে ফিরে মেসে শুয়ে শুয়ে হঠাৎ ওর মনে হল পৃথা মেয়েটা খারাপ না, খুব সুন্দরী না হলেও একটা মিষ্টতা আছে। কথা কম বলে, দোয়েলদের মতো হৈ হুল্লোড় খুব একটা করে না বলেই মনে হয়, খুব করুন ওর চোখের চাউনি, বেশ মায়াবী মুখটা। তবে কি নিলাদ্রী ঐ মায়াবী মুখের মায়ায় পড়ে যাচ্ছে! নিজের মনেই হেসে উঠল, কি সব ভাবছে শুয়ে শুয়ে! কাল শুক্রবার, অফিসের এক গাদা কাজ সেরে চারটের মধ্যে বের হতে হবে বাড়ি ফেরার জন্য। বিছানার পাশে রাখা ফোনটা তুলে নিয়ে দেখল হোয়াটসঅ্যাপে অনেক গুলো নোটিফিকেশন জমে আছে, স্ক্রল করতে করতে দেখল একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ, খুলে দেখল, - কি গো! এদিকের ফিলিংস তো ভালোই, তোমার কোনো ফিলিংস কি হচ্ছে! দেখেই একটা রিপ্লাই লিখল, কোন ফিলিংস এর কথা বলছেন, আপনি কে বলছেন যদি একটু বলেন, মানে আমার কাছে এই নাম্বারটা সেভ নেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা বেজে উঠল, রিসিভ করতেই একটি মিষ্টি নারী কন্ঠ,

- প্লীজ কিছু মনে করবেন না, ঐ মেসেজটা আমি করিনি, আমার ফোন থেকে দোয়েল আমাকে না জানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, আমি জানতামই না, এই মাত্র দেখলাম।

- না না ঠিক আছে, পাঠিয়ে ভালোই করেছে, অন্তত আপনার ফিলিংসটা তো জানতে পারলাম। এতক্ষণ আপনার কথাই ভাবছিলাম, আসলে আমারও কেমন যেন একটা ফিলিংস হচ্ছে, আপনার তরফ থেকে যদি সবুজ সংকেত পাই তাহলে আমার ফিলিংসের পালে একটু বাতাস লাগে।

ওপাশ থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে আবার বলল, - কি হল! চুপ কেন? কিছুতো বলুন!

- জানিনা।

- কি জানেন না? আমি কি আমার স্বপ্নটা দেখে যেতে পারি?

- সেটা আপনার স্বপ্নকেই জিজ্ঞাসা করুন।

- তাই তো করছি, এখন আমার স্বপ্ন যদি বলে জানিনা, তাহলে আমার কি হবে?

- আমি আপনার স্বপ্ন বুঝি?

- কোনো সন্দেহ আছে?

- কি জানি!

- আচ্ছা, আমিই জেনে নেবো, একদিন দেখা করা যাবে?

- দেখা তো সোমবার হবেই!

- ও রকম না, শুধু আমরা দুজন থাকব, আর কেউ না।

- কিন্তু কিভাবে! কবে, কোথায়?

- আপনি দিন আর জায়গা ঠিক করুন, আমি পৌঁছে যাবো।

একটু ভেবে পৃথা বলল, - কাল তিনটের সময় দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে আসতে পারবেন? আমার কম্প্যুটার ক্লাস আছে, তারপর দেখা করব।

- আমি আসছি।

সেই রাতটা নিলাদ্রীর যে কি ভাবে কাটল তা নিলাদ্রীও ভাবতে পারেনি, একদিকে আনন্দ, এক দিকে উৎকন্ঠা, মনে মনে ঠিক করে নিল কাল অফিসে শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে এগারোটার মধ্যে কেটে পড়বে। সময় যেন আর কাটেনা, ঘুমও আসতে চায়না, ল্যাপটপে কালকের অফিসের কাজগুলো এগিয়ে রাখল, ভাবল আরেক বার পৃথাকে ফোন করবে, কিন্তু সেটা ঠিক হবে না ভেবে কোনো রকমে রাতটা কাটাল। সকাল বেলা সেভিং করে সুন্দর দেখে একটা জামা প্যান্ট পড়েই অফিস, কাজ টাজ বুঝিয়ে পৌনে এগারোটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ধর্মতলা। এগারোটা পঁয়তাল্লিশের ভলভো বাসে উঠে পড়ল। একটা পঞ্চাশ নাগাদ শক্তিগড়ে চা খেতে খেতে খেতে হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশনের শব্দ শুনে নিলাদ্রী দেখল, পৃথার মেসেজ, - আমি তিনটের সময় 89 মলের সামনে থাকব। উত্তরে নিলাদ্রী লিখল, পৌঁছে যাব।

সবুজ ধানখেত আর কাশ বনের মাঝে বিশাল জাতীয় সড়ক দিয়ে বাসটা ওকে নিয়ে ছুটে চলল, যাতে দেরি না হয়ে যায় পৃথার সাথে নিলাদ্রীর প্রথম ডেটিং এর, যেন সেই কথা ভেবে। তিনটের আগেই বাস সিটি সেন্টারে পৌঁছাল, সেখান থেকে অটোয় পাঁচ মিনিটে 89 মল। বন্ধ হয়ে যাওয়া বিগ বাজারের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগল আশে পাশে পৃথা আছে কিনা, দেখতে না পেয়ে বুঝল এখনো আসেনি, আসবেই বা কি করে! তিনটে এখনো বাজেনি, ঘরির কাঁটাও যেন এক সেকেন্ড এগোতে পাঁচ মিনিট সময় নিচ্ছে, নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে, উত্তেজনার পারদ ক্রমশ উর্দ্ধমুখী, কখন পৃথা আসবে! কি হবে আজ তাদের প্রথম কথা! কে আগে কথা বলবে! আরো কতো চিন্তা ভাবনা যে নিলাদ্রীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এসব ভাবতে ভাবতে কখন তিনটে দশ বেজে গেছে, এবার টেনশন শুরু, তবে কি.... এমন সময় সামনের রাস্তায় একটু দূরে দেখতে পেল একটি মেয়ে বেশ হন্তদন্ত হয়ে আসছে, একটু সামনে আসতেই বুঝল ঐ পৃথা আসছে, কি সুন্দর লাগছে ওকে! হলদে রঙের একটা কুর্তি পরেছে, সাথে রাণী কালারের লেগিংস আর ওড়না, চুলটা বেশ অন্যরকম ভাবে বাঁধা! এই পৃথাকে আগে কখনো দেখেনি নিলাদ্রী, পৃথা কে এতোটা সুন্দরী কখনো লাগেনি ওর, সামনের সিঁড়ি গুলো দিয়ে নেমে পৃথার দিকে এগিয়ে গেল একটু জের কদমে। একটু এগিয়ে HDFC ব্যাঙ্কের সামনে যখন দুজন দুজনের মুখোমুখি হল, কারো মুখেই কোনো কথা নেই, যেন হাজার বছরের পথ চলার ক্লান্তির এখানেই পরিসমাপ্তি হল, এমনই তৃপ্তি দুজনের চোখে মুখে। পৃথা অবনমিত নেত্রে নিলাদ্রীকে বলল,

- অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন না? আসলে আমি অনেকটা দেরি করে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না প্লীজ।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল, গল্প করতে করতে সোজা চলে এল জংশন মলে।

এভাবেই শুরু হল দুজনের প্রেম, চলল প্রায় এক বছর, তত দিনে পৃথারাও এম এ পাশ করে গেছে, দুই বাড়ির সম্মতিতে আগামী ১৬ই ডিসেম্বর নিলাদ্রী আর পৃথার বিয়ে আর সেই উপলক্ষে আজ ১৪ই ডিসেম্বর সৌরিশ আর অর্ক বিকেল বেলা পৌঁছে গেল ত্রিলোকচন্দ্রপুর হাইস্কুলের মাঠের কাছে। সৌরিশ নিজে ড্রাইভ করে এসেছে নিজের নতুন KIA Seltos গাড়িতে। এখানেই অপেক্ষা করছিল নিলাদ্রী, সঙ্গে আরো দুজন, সম্ভবত নিলাদ্রীরই বন্ধু আর একটি ছোটো ছেলে। আরো তিন চারটে গাড়ি রাখা আছে। পেস্তা সবুজ স্যুট আর ভেতর গাঢ় নীল রঙের শার্টিনের শার্ট পড়ে সৌরিশ গাড়ি থেকে নামল, সঙ্গে অর্কও। নিলাদ্রী সৌরিশ আর অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলল, তোরা এসে গেছিস ভাই, অনেকটা সাহস পেলাম, বেশ নার্ভাস লাগছিল। যাই হোক, গাড়ি তোদের এখানেই রাখতে হবে, বাকি পথটা বাইকে চল, গাড়ি বাড়ি অবধি যাবেনা, যে রাস্তায় গাড়ি যায় ওখানে একটা কালভার্ট তৈরি হচ্ছে। শর্ট কার্টে যাবো, বেশি রাস্তা নয় খুব জোর ৫০০ মিটার। নিলাদ্রী বলল, বাইক নয় হেঁটেই যাব আমরা চল, বলেই পেছনের সিট থেকে নিজেদের ছোট ট্রলি লাগেজ দুটো বের করে নিল। নিলাদ্রী লাগেজ দুটো বাইকে করে পাঠিয়ে দিয়ে একটা বড়ো দিঘীর পাশ দিয়ে মেঠো পথে দুজনকে নিয়ে ছোট ছেলেটির হাত ধরে এগোতে লাগল। ছোট ছেলেটি নিলাদ্রীর ভাইপো, নাম অর্পন, ক্লাস এইটে পড়ে। বিশাল দিঘীর কালো জল টলটল করছে সাথে তীব্র শীতের উত্তরের বাতাস। অর্ক জ্যাকেটের হুডটা মাথায় চাপিয়ে নিল। বাঁদিকে দিঘী আর জানদিকে দিগন্ত বিস্তৃত পাকা ধানের খেত হাওয়ায় ঢেউ খেলে নাচছে মনের আনন্দে, দূরের দীগন্ত ঘন কুয়াশায় ঢাকা, এই সাড়ে তিনটেয় এতো কুয়াশা, তাহলে সন্ধ্যার সময় কি হবে ভেবে সৌরিশ বেশ শিহরিত হয়ে উঠল, মনে মনে ভাবল এই চারটে দিন বেশ ভালোই যাবে। কিছুটা হাঁটার পর সারি দিয়ে খেজুরের গাছ যার মাথেয় মাটির কলসী টাঙানো। নিলাদ্রী বলল, এসব ওদেরই, সকালে টাটকা রস খাওয়া হবে। দূরে প্যান্ডেল আর গেট দেখে সৌরিশরা বুঝল এটাই নিলাদ্রীদের বাড়ি। গেটের মধ্যে ঢুকে দেখল তখনও প্যান্ডেলের কাজ চলছে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ভুটভুট আওয়াজ, কোথাও সাব মার্সিবল পাম্প চলছে। বাড়ির সদর দরজার কাছে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিলাদ্রী সৌরিশদের সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি হলেন আমার বাবা আর ইনি বড় কাকু, শান্তিনিকেতনে থাকেন, ওখানেই অধ্যাপনা করেন। সদর দরজা পার হতেই বিয়ে বাড়ির হৈচৈ ঠাওর করা গেল, ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা দাপাদাপি করছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে বেশ বড়ো তিন তলা বাড়ি, মঝখানে কংক্রীটের উঠোন, তুলসী মন্দির আর সামনে একটা দোতলা বড়ো বাড়ি, বাঁদিকটায় বড়ো প্যান্ডেল করা হয়েছে যার এক দিকে রান্নার ব্যবস্থা আর এপাশটায় বাড়ির লোকেদের খাওয়া দাওয়ার জন্য টেবিল চেয়ার পাতা। দুটো বড়ো বাড়ির মাঝখানে ডান দিকের কোনাটায় বড়ো বড়ো দুটো ধানের মড়া। বেশ সম্পন্ন বাড়ির ছেলে নিলাদ্রী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তবে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই নিলাদ্রীর মতোই হাসি খুশী। সৌরিশরা ভেতরে আসতেই নিলাদ্রীর মা বললেন,

- এসো বাবা এসো, দীপু সকাল থেকেই তোমাদের জন্য ছটফট করছে, ও সব সময় তোমাদের কথা বলে। আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো বাবা? সৌরিশ বলল,

- না কাকীমা, কোন অসুবিধা হয়নি।

- বেশ বেশ, আগে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খাও, সেই কখন বেরিয়েছো!

- না না কাকীমা, একদম ব্যস্ত হবেননা আমাদের নিয়ে, আমরা যখন যা দরকার ঠিক নিয়ে নেব।

- তা তো নেবেই, নিজের বাড়ি মনে করে থাকবে এখানে। তবু এখন আগে কিছু খাও, এই মনিমা…. এদিকে আয় তো…..

অর্ক নিলাদ্রীকে বলল, হ্যাঁরে তোর ডাকনাম নিলু না হয়ে দীপু হল কি করে?

- আসলে দাদার নাম অপুর্ব, ডাকনাম অপু, আর তার সাথে মিলিয়ে আমারটা দীপু হয়ে গেছে।

এই সব কথার মাঝখানে নিলাদ্রী বলল, চল তোদের ঘরটা দেখিয়ে দি, এই বলে সামনের দোতলার ওপর তলায় নিয়ে গেল। বেশ বড়ো একটা ঘর, লাগোয়া বাথরুম, ঘরের সামনে খেলা বারান্দা। ঘরের মধ্যে একটা বড়ো খাট বোতের সোফা আর একটা টেবিল চেয়ারও রয়েছে বসে লেখালেখির জন্য। নিলাদ্রী বলল, তোদের পাশের ঘরটাই আমার। সৌরিশ বলল,

- ফুলশয্যা কি ওঘরেই হবে?

- না, সেটা ঠিক এখনো জানিনা। আগে বিয়েটাই তো হোক!

- তাঠিক, তোর তো একটা হিল্লে হতেই চলেছে, অনেক দিনের সাধনার সিদ্ধিলাভ কি বল?

- বলিস তো তোরও একটা ব্যবস্থা করি, দেখ কাউকে যদি পছন্দ হয়।

এই সব কথার মাঝে দরজার বাইরে থেকে এক নারী কন্ঠ, - দদা তুই কি এঘরে? নিলাদ্রী বলল,

- হ্যাঁ মনি ভেতরে আয়।

ঢেউ খেলানো বড়ো ঘেরের সাদা গাউন জাতীয় পোশাক পারা একটি মেয়ে ঘরে ঢুকল, সাথে একটি মেয়ে দুজনের হাতেই খাবারের থালা, নানা রকম মিষ্টি আর ফিসফ্রাই দিয়ে ভরা। অপূর্ব সুন্দর দেখতে, গায়ের রং গোলাপী, সুন্দর দুটো টানা চোখ চশমা পরা, তুলি দিয়ে আঁকা ঠোঁট কাশ্মিরী মেয়েদের মতো খাড়া নাক, একেবারে সৌন্দর্যের ফুল প্যাকেজ। এক নজরেই মাথা ঘুরে গেল সৌরিশের। নিলাদ্রী বলল, ও আমার খুড়তুতো বোন, শান্তিনিকেতনে থাকে, ওখানেই ফাইনআর্টসে মাস্টার্স করছে, নাম অদ্বিতা আর এই হল আমার ছোট বোন আরদ্রা, হেসে বলল ও কিন্তু শান্তিনিকেতনেই থাকে, বিশ্বভারতীর স্কুলে টুয়্যাল্ভে পড়ে। অর্ক বলল একজন তো অনন্য এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই অপর জন তো সেই ষষ্ঠ তাকরা! নিলাদ্রী বলল, হ্যাঁ নামের মানে তো তাই বলছে। খাবার গুলো টেবিলে রাখ! হতে করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! আরদ্রা বলল জেম্মা তোমার বন্ধুদের খাইয়ে তারপর আমাদের যেতে বলেছে। ওরা তিন বন্ধুই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে নিলাদ্রী বলল, তাহলে কে কাকে খাওয়াবি তোরা ঠিক করে নে। আরদ্রা খাবারের থালা নিয়ে অর্কর সামনে এসে বলল, নিন, এগুলো খেয়ে নিন, একটাও ফেলবেন না যেন আমরা বেছে বেছে সব থেকে ভালো মিষ্টি গুলো এনেছি। দিদিভাই ঐ দাদার দায়িত্ব তোকেই দিলাম, যত্ন করে খাওয়া, নাহলে জেম্মা বকবে। নিলাদ্রী বলল, বা বা তোরা দুজন যখন আমার দুই বন্ধুর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিস আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই, এখন থেকে তাহলে সৌরিশের দায়িত্ব মনি মানে অদ্বিতার আর অর্কর দায়িত্ব তো আরদ্রা নিয়েই নিয়েছে। এই সব কথা বার্তার মধ্যে অদ্বিতা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল, কাথা গুলোর মানে যে অন্য রকমেরও হয়। তবে বিয়ে বাড়িতে এরকম মজা একটু ভালোই লাগছে ওর। আরদ্রা বলল, আপনারা খেয়ে নিন তারপর আপনাদের গ্রামটা দেখাতে নিয়ে যাবো আমরা। নিলাদ্রী বলল, বেশ তোরা এখন যা, ঠিক আধ ঘন্টা পর এসে ওদের খবর নিবি, ওরা এখন একটু ফ্রেশ হবে। খাবার গুলো টেবিলে রেখে ওরা দুবোন চলে গেল, সৌরিশ স্যুট ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে একটা ট্র্যাক প্যান্ট আর হুডি জ্যাকেট পরল, অর্কও একটা ট্রাউজার আর জ্যাকেট পরে খাওয়ায় মনোনিবেশ করল। নিলাদ্রী বলল আজ রাতে সামনেই আমাদের ক্লাব আছে, তার ওপর তলায় আমাদের বন্ধুদের ব্যাচেলার পার্টি হবে, ততক্ষণ তোরা একটু রেস্ট নে, আমি কয়েকটা কাজ সেরে আসছি। সৌরিশ বলল, তুই আমাদের নিয়ে একদম চাপ নিস না, নিজের কাজ কর, আমরা সব ম্যানেজ করে নেব। ফিশ ফ্রাই শেষ হতে না হতে অদ্বিতা চা নিয়ে হাজির, ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সৌরিশ ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,

- সব সময় আমাদের নিয়ে ব্যস্ত না থাকলেও চলবে, আমরা চা খেয়ে নিচে আসছি।

- ও আচ্ছা, তাহলে আমি এখন যাই?

- না না, আমি চলে যেতে বলিনি, বসলে বসতেই পারো, গল্পও করতে পারো, শুধু আমাদের গেস্ট ভেবে স্পেশাল কেয়ার নিতে বারণ করছি। তবে কাজ থাকলে আটকে রাখব না।

এবার অদ্বিতা পড়ল মুশকিলে বুঝতে পারছেনা কি করবে, থাকবে না চলে যাবে। ব্যাপারটা আন্দাজ করে অর্ক বলল, ওকে এভাবে বিপদে ফেলছিস কেন বলতো, বেচারী যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছে না আবার থাকতেও পারছেনা। শোনো, চা খেয়ে আমরা একটু স্মোক করব যদি কিছু মনে না করো। ধোঁয়ার মধ্যে সৌরিশ তোমাকে রাখতে চাইছে না, আবার লজ্জায় বলতেও পারছেনা। অদ্বিতা বলল, না না মনে করব কেন, আমি যাচ্ছি, তবে আপনারা ছেলেরা এতো স্মোক করেন কেন বলুন তো! সৌরিশ বলল,

- sorry মানতে পারলাম না, এখন ছেলেদের থেকে বেশি মেয়েরা স্মোক করছে।

- মোটেও না! আপনাদের শহরে করতে পারে, আমাদের এখানে না।

- আমাদের শান্তিনিকেতনের কথা বলো না, আমরা সব জানি।

- না, আপনারা কিছুই জানেন না, আর যদি করেও, সেটা কি আপনার ভালো মনে হয়!

- হ্যাঁ, এটা বলতে পারো, ভালো যে নয় এটা স্বীকার করছি, তবে মাঝে মাঝে একটা দুটো খাই, রোজ না। এখন বন্ধুর বিয়েতে এসেছি, একটা ফেসটিভ মুডে আছি তাই...

- ঠিক আছে ঠিক আছে, আমার কাছে জবাবদিহি করার কি আছে! আমার যেটা মনে হল বললাম, কিছু মনে করবেন না প্লীজ। আর হ্যাঁ আজ সন্ধ্যাবেলা বাইরের প্যান্ডেলে গান বাজনা হবে, আপনারা থাকবেন কিন্তু।

- বাহ্ দারুন তো! আমার গান শুনতে খুব ভালো লাগে, অবশ্যই থাকব।

- শুধু শুনলেই হবে না, গাইতেও হবে।

- সর্বনাশ! আমি গান টান গাইতে পারিনা।

- ইশ, আপনার মিথ্যে বলতে লজ্জা করে না! দীপুদা সব বলেছে, আপনি গানও গান, গীটারও বাজান।

- দেখেছিস অর্ক! নিলাদ্রীর মেয়েদের মতো পেটে কোনো কথা থাকে না।

- আপনি কথায় কথায় মেয়েদের টানেন কেন বলুন তো!

- ছি ছি কি কথা বলছ! আমি মেয়েদের ধারে পাশেও থাকিনা। এবার অদ্বিতা লজ্জায় হেসে ফেলে বলল,

- আমি সে টানার কথা বলিনি! যাক আমি এখন আসি, আপনারা দরকার হলেই আমাকে বা বোনকে ডাকবেন কিন্তু।

অদ্বিতা ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে আরদ্রার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল, আরেকটু হলে ধাক্কা লাগত দুজনের। আরদ্রা বলল,

- দিদিভাই তুই এখানে!

- হ্যাঁ, চা দিতে এসেছিলাম, আমি নিচে চললাম, তুই আয়।

- হ্যাঁ চল, আমি একটা কথা বলেই আসছি। এই বলে সৌরিশের কাছে এসে বলল, আপনি গীটারটা এনেছেন তো!

সৌরিশ অর্কর দিকে অবাক হয়ে তাকাল, দেখে আরদ্রা বলল,

- অবাক হবার কিছু নেই, আপনারা কে কি সঙ্গে আনবেন, রাত্রে আপনাদের ক্লাবের দোতলায় কোন পার্টি হবে সবই আমি জানি। আসলে দীপুদা আমার দাদা হলেও বন্ধুর মতো। পৃথা বৌদির কথা ও আমাকেই প্রথম বলেছিল, দিদিভাইকে না। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, আমি নিচে গিয়ে দেখি আয়োজন কতদূর এগোল।

আরদ্রা নিচে চলেযেতে অর্ক সিগারেটটা ধরাল। এর মধ্যে মাইকের আওয়াজ শোনা গেল, ততক্ষণে অন্ধকার নেমে গেছে। সৌরিশ আর অর্ক নিচে এসে দেখল উঠোন প্রায় ফাঁকা, বাইরের প্যান্ডেলে এসে দেখল সবাই এখানে। মঞ্চ রিতিমতো তৈরি, কিবোর্ড, অক্টোপ্যাড, থুম্বা উত্যাদি সেট করা হচ্ছে, নিলাদ্রী বলল,

- এইতো তোরা এসে গেছিস, সৌরিশ তোর গীটার কোথায়!

- গাড়িতে।

- ও আচ্ছা, এই রতন তুই বাইকে সৌরিশকে নিয়ে স্কুলের মাঠে যা।

সৌরিশ রতনের সাথে গিয়ে গীটার নিয়ে এল, শুরু হল গানের আসর। বাড়ির ছেলে মেয়েরাই গান গাইল, অদ্বিতা পর পর কয়েকটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইল, অসাধারন গলা, গান যে নিয়মিত শেখে এবং রেওয়াজ আছে বোঝাই গেল। নিলাদ্রীর অনুরোধে সৌরিশও গাইল একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত, “এসেছিলে তবু আসোনাই জানায়ে গেলে”। সবাই খুব নাম করল সৌরিশের গানের। এরপর অনুষ্ঠান শেষ হলে খাওয়া দাওয়া হল সাড়ে দশটা নাগাদ, অবশ্য নিলাদ্রী সৌরিশ আর অর্ককে নিয়ে পাড়ার বন্ধুদের সাথে ক্লাবের দোতলায় ব্যাচেলার্স পার্টি করল অর্কর আনা স্কচ সহযোগে। খুব আনন্দ হল সেই রাতে, ঠান্ডাও প্রচন্ড! তিন চার ডিগ্রী তাপমাত্রা হবে। সকলেরই জমিয়ে নেশাটা হয়েছে আজকের মৌতাতে।

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে অর্ক আর সৌরিশ গরম জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামটা ঘুরে দেখতে, সূর্য না উঠলেও ভোরের আলো ফুটে গেছে, ঘন কুয়াশায় দশ হাত দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না, সেই দিঘীর কাছে এসে দেখল লোকেরা খেজুর গাছ থেকে রস নামাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় রতনের সাথে দেখা, সে প্রায় জোর করে টাটকা রস খাওয়াল ওদের দুজনকে। তারপর দিঘীর পাড়ে সিগারেট ধরিয়ে খানিক ক্ষণ গল্প করে বাড়ির দিকে এসে রতন বলল, চলো বন্ধু তোমাদের দীপুদের মন্দির দেখিয়ে আনি। কাল যেখানে গান বাজনা হচ্ছিল সেই প্যান্ডেলের পেছনেই একটা সুন্দর কালী মন্দির। মন্দিরের সামনে আসতেই দেখা হল অদ্বিতা আর আরদ্রার সঙ্গে, ওরা মন্দিরের দাওয়ায় বসে ছিল। হঠাৎ রতনের ফোন বেজে উঠল, রতন বলল, তোমরা এসো আমাকে একটু ভেতরে যেতে হবে কাকা ডাকছে, মাছ ধরার খবরটা দিয়ে আসি। আরদ্রা সৌরিশকে বলল, কি! কালতো রাত বারোটা অবধি ভালোই পার্টি হল! সৌরিশ তাড়াতাড়ি নিজের ঠোটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করাল, অদ্বিতা মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল।

সারা দিনটা কাটল নানা আনন্দের মধ্যে দিয়ে, কাল বিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আজ সকলের ব্যস্ততা তুঙ্গে, কিভাবে যে সকাল গড়িয়ে রাত্রি হল বোঝাই গেলনা। পরদিন ভোর চারটের সময় সকলে কথাবার্তায় সৌরিশদের ঘুম ভেঙে গেল। দধিমঙ্গলের অনুষ্ঠান হবে। সৌরিশরা নিচে নেমে এল, দেখে মেয়েরা সব নতুন শাড়ী পরে খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। অদ্বিতি আর আরদ্রা এক রকমের জামদানী শাড়ী আর গায়ে পশমিনা শাল জড়িয়ে নানা কাজের ব্যস্ততার মাঝেও অর্ক আর সৌরিশকে সুপ্রভাত জানাতে ভুলল না। দধিমঙ্গলের ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই গায়ে হলুদের তোড়জোর শুরু হয়ে গেল। গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে কনেরবাড়ি যাওয়ার দায়িত্ব পরল অর্ক সৌরিশ আর রতনের ওপর, সঙ্গে অদ্বিতা আর আরদ্রা। সৌরিশের গাড়িতেই তত্ব নিয়ে যাওয়া হল, পথ দেখাতে সৌরিশের পাশে রতন। পৃথার সাথে সৌরিশদের আগে ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার, আজ প্রথম দেখা। খুব আদর যত্ন করা হল ওদের। ইছাপুর খুব পুরনো আর বর্ধিষ্ণু গ্রাম, বেনাচিতির থেকে একটু খানি। বিকেলে নিলাদ্রী যখন বিয়ে করতে এল, তখনও সৌরিশের গাড়িতে অর্কর সাথে অদ্বিতা আর আরদ্রা এল। আজ সৌরিশের পরনে খুব সুন্দর পার্পেল কালারের পার্টি স্যুট আর অর্ক পরেছে একটা রয়্যাল ব্লু স্যুট। দুজনকেই রাজপুত্রের মতো লাগছে, সাথে অদ্বিতি আর আরদ্রার সাজও অসাধারণ। ওদের দুবোনকে তো অপ্সরা মনে হচ্ছে। বিয়ে ছিল গধুলী লগ্নে, বাসর রাত জমে উঠল দারুন ভাবে, একদিকে পৃথার বান্ধবী দোয়েলের নেতৃত্বে সুপর্ণা, গার্গী আর মিঠু আর এদিকে বর পক্ষের অদ্বিতা আর আরদ্রা ছাড়াও বাকি ভাই বোনেরা। অদ্বিতা বাসরে গাইল রিমঝিম গিরে শাওন, সৌরিশ ওর সাথেই একটা অন্তরা গাইল, মহেফিলমে ক্যায়সে কহদে কিসিসে, দিল বন্ধ রহা হ্যায় কিসি অজনবী সে।

পরদিন সকাল বেলা নিলাদ্রী আর পৃথাকে নিয়ে নিলাদ্রীদের বাড়ি ফিরে আসার পর নানা হৈ হুল্লোড় করে কাটল দিনটা, পরের দিন বৌভাত হল খুব ধুমধাম করে, আর তারপরদিন ভোরেই সৌরিশরা কলকাতা ফিরে আসছে, নিলাদ্রীর মা বললেন, বাবা দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে যাও, সৌরিশ বলল কাকীমা পাঁচদিন হল বাইরে আছি, অনেক কাজ জমে গেছে, আজ যাই আবার আসব। নিলাদ্রী ছাড়াও অদ্বিতা আর আরদ্রা স্কুলের মাঠ পর্যন্ত এলো ওদের বিদায় জানাতে। পথে সৌরিশ অদ্বিতাকে বলল, আমাদের ঘরের বালিশের তলায় তোমার জন্য একটা জিনিস রেখে এসেছি, যদি পছন্দ হয়, ব্যবহার করতে পারো।

সৌরিশরা বেরিয়ে যাওয়ার পর বেশ মন খারাপ নিয়ে অদ্বিতা ফিরে আসছে বোনের হাত ধরে, ওর বুকে যেন একটা ভারি পাথর চাপানো রয়েছে, কেন এমন হচ্ছে বুঝতেই পারছে না, এদিকে মনে কৌতূহলও হচ্ছে, কি বলে গেল সৌরিশ! কি রেখে গেছে ওর জন্য! তাড়াতাড়ি ঘরে এসে সোজা চলে গেল দোতলার সেই ঘরটায়, যেখানে সৌরিশরা ছিল। ঘরে ঢুকে বালিশের তলায় দেখল একটা কাগজ, যাতে একটা ফোন নাম্বার লেখা, আর লেখা আছে যদি ভালো লাগে এই নাম্বারটা ডায়াল করতে পারো, আমাকে পাবে। আর যদি অনুমতি দাও, তাহলে বাড়িতে বলব, আমার গন্তব্যের সন্ধান পেয়েছি। আর বাবা মাকে পাঠাবো তোমার বাবা মার সাথে কথা বলতে। তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম, আমার প্রস্তাব অপছন্দ হলে আমার ধৃষ্টতাকে মার্জনা করে দিও, তোমাকে কখনোই বিরক্ত করব না।

চিঠিটা পড়ে অদ্বিতার চোখের কোন দুটো ভিজে গেল, দৃষ্টিটাও ঝাপসা হয়ে এল, তবে বুকের থেকে সেই পাথরটা নেমে গিয়ে অনেকটা হলকা বোধ হতে লাগল নিজেকে। ওর মনের অজান্তে এমনই একটা ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে কখন বুঝতেও পারেনি।