দেবাঞ্জন দাস, ৩১ জানুয়ারি: বেসরকারি সংগঠন হেল্পএজ ইন্ডিয়া, যারা বয়স্কদের প্রয়োজন ও অসুবিধাগুলো নিয়ে কাজ করে, তারা বাজেট সম্পর্কে তাদের সুপারিশ মাননীয় অর্থমন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারমনের কাছে পেশ করেছে যেখানে বয়স্কদের জন্য এ…
দেবাঞ্জন দাস, ৩১ জানুয়ারি: বেসরকারি সংগঠন হেল্পএজ ইন্ডিয়া, যারা বয়স্কদের প্রয়োজন ও অসুবিধাগুলো নিয়ে কাজ করে, তারা বাজেট সম্পর্কে তাদের সুপারিশ মাননীয় অর্থমন্ত্রী শ্রীমতি নির্মলা সীতারমনের কাছে পেশ করেছে যেখানে বয়স্কদের জন্য একটি বিশেষ মন্ত্রক তৈরি করা; তাঁদের রোজগার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিচর্যার ক্ষেত্রে এখুনি কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং চলতি সরকারি প্রকল্পগুলোতে বয়স্ক মানুষদের, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা এবং অতিবৃদ্ধদের যুক্ত করার আবেদন জানানো হয়েছে।
রোহিত প্রসাদ, সিইও, হেল্পএজ ইন্ডিয়া, জানালেন “বয়স্কদের পরিচর্যায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া, অন্তর্ভুক্তি এবং নীতির রূপায়ণ অতিমারির পরে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন বয়স্কদের বিপন্নতা একেবারে অতি প্রকট, এই মুহূর্তের হিসাব অনুযায়ী ভারতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ১৪০ মিলিয়ন। এই বয়স্ক জনসংখ্যা আগামী তিন দশকে দ্রুত আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। ২০৪৭ সালের মধ্যে বয়স্ক জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বৃদ্ধির এক বিস্ফোরণ হবে। তাঁদের আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজন মেটাতে এখুনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তার জন্যে বেশ ভাল পরিমাণ অর্থের সংস্থান এখুনি বরাদ্দ করা দরকার। আমরা অনুরোধ করছি বয়স্কদের পেনশন বাড়িয়ে মাসে অন্তত ৩০০০ টাকা করা হোক, বয়স্ক মহিলা ও অতিবৃদ্ধদের সমস্ত সরকারি প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক, পারিবারিক সদস্য যিনি বাড়ির বয়স্কদের পরিচর্যা করেন তার কর ছাড় দিয়ে পরিচর্যায় উৎসাহ দেওয়া হোক। চলতি আর্থিক, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সামাজিক পরিচর্যা ব্যবস্থাগুলোকে জোরদার করা হোক যথেষ্ট পরিমাণ তহবিল বরাদ্দ করে। আমরা সরকারকে বয়স্কদের জন্য আয়ুষ্মান (দীর্ঘায়ু) মন্ত্রক তৈরি করতেও অনুরোধ করছি, যা বয়স্কদের নানারকমের সমস্যা সামলাবে এবং বয়স্কদের জন্য প্রকল্পগুলো চালাবে।”
বয়স্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বৃদ্ধি করতে হেল্পএজ যেসব সুপারিশ করেছে তার মধ্যে আছে:-
বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা, অতিবৃদ্ধ এবং বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা (PMJAY)-য় নথিভুক্তকরণ অভিযান। এমনিতে PMJAY এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হেলথ অ্যাশিওরেন্স প্রকল্প এবং বয়স্কদের বিমা দেয়। এই প্রকল্পের আওতায় পড়েন এমন বয়স্কদের উপর বিশেষ জোর দেওয়া/অভিযান চালানো যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কারণ তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি, যা PMJAY-র কাজের মূল জায়গা। আয়করদাতা ছাড়া সারা দেশের ৮০+ বয়সের মানুষকে PMJAY-র আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বয়স্কদের পরিচর্যার জন্য একমাত্র প্রকল্প ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর হেলথ কেয়ার অফ দি এলডারলি (NPHCE)-র (২০১০ সালে চালু করা হয়েছিল) দিকে এখুনি নজর দেওয়া দরকার। সমস্ত জেলায় এই প্রকল্পের দ্রুততর এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রূপায়ণ দরকার। যদি বাজেটে “ফ্লেক্সি-পুল”-এর মধ্যে টাকা না রেখে এই অনন্য উদ্যোগের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ করা হয় তাহলে বেশি ভাল ফল পাওয়া যাবে।
হেল্পএজ ইন্ডিয়া পরিবারের লোকেদের বয়স্কদের পরিচর্যা করার জন্য ইনসেন্টিভ দেওয়া চালু করার পক্ষেও জোরদার সওয়াল করেছে। সংগঠনের সুপারিশ হল মৌলিক কর ছাড়ের উপর আরও কিছুটা ছাড় চালু করা হোক। যেমন যেসব করদাতা ৮০ বছর পর্যন্ত বয়সের বাবা-মা/শ্বশুর-শাশুড়ির দেখাশোনা করেন তাঁদের ৩.৫ লক্ষ টাকা (২.৫ লক্ষ টাকার কর ছাড়ের উপর) এবং তার বেশি বয়সের মানুষের দেখাশোনা করলে ৫.৫ লক্ষ টাকা ছাড় দেওয়া হোক। এই ছাড় দাবি করতে পারবেন বয়স্ক মানুষটির কোনো একজন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান।
যেসব মহিলা বয়স্ক বাবা-মা এবং পরিবারের বয়স্ক মহিলাদের দেখাশোনা করেন তাঁদের জন্য বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য পরিচর্যা ভাতা চালু করার নতুন ব্যবস্থার সুপারিশও করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মহিলাদের এই প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে।
আয় এবং জীবিকার দিক থেকে দেখলে LASI অনুসারে ৩৬% বয়স্ক মানুষ কর্মরত। এই সংখ্যা শহরাঞ্চলের চেয়ে (২৬%) গ্রামাঞ্চলে (৪০%) অনেক বেশি। এঁদের বেশিরভাগই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে বয়স্কদের জন্য পেনশনের সুবিধা পান এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৩০%।
অনুপমা দত্ত, হেড – পলিসি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, হেল্পএজ ইন্ডিয়া, বলেন “যে দুটো বড় জায়গায় এ বছরের বাজেটে নজর দেওয়া দরকার সেগুলো হল বয়স্কদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাওয়া এবং অতিবৃদ্ধদের জন সংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। বিশেষ করে বয়স্ক মহিলাদের দিকে নজর দেওয়া দরকার। তাঁদের PMJAY-র মত কিছু যুগান্তকারী প্রকল্পে নথিভুক্ত করা দরকার এবং ওল্ড এজ পেনশন প্রকল্পে অগ্রাধিকারের আওতায় আনা দরকার। দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা ব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি প্রয়োজন। বিশেষ করে মহিলারা পরিচর্যার কাজে অস্বাভাবিক মাত্রায় যোগদান করেন। তাঁরাই মূল পরিচর্যাকারী অথচ বৃদ্ধ বয়সে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েন। এই ব্যাপারটা স্বীকার করা প্রয়োজন। এবং তাঁদের সফলভাবে সমাজে অবদান রাখার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে বাঁচতে সক্ষম করার জন্যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।”
বয়স্কদের আয়ের নিরাপত্তা বাড়াতে হেল্পএজ যেসব সুপারিশ করেছে তার মধ্যে আছে:-
ওল্ড এজ পেনশন সর্বজনীন করে দিয়ে বয়স্ক মহিলা এবং অতিবৃদ্ধদেরও এর আওতায় নিয়ে আসা। মাসিক ভাতা ৩০০০ টাকা হওয়াই শ্রেয়। কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে একটি ন্যূনতম সামাজিক পেনশন চালু করে পথ দেখাক। ন্যাশনাল সোশাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (NSAP)-এ কেন্দ্রীয় সরকারের অবদানের ন্যূনতম বৃদ্ধি প্রয়োজন। এখন তার পরিমাণ ২০০-৫০০ টাকা, যা গত ১৪ বছরে পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। ওই টাকার পরিমাণ ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের জন্য বাড়িয়ে মাথাপিছু মাসে ১০০০ টাকা এবং ৮০ ও তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের জন্য বাড়িয়ে মাসে মাথাপিছু ১৫০০ টাকা করা দরকার। এই মুহূর্তে বয়স্কদের পেনশন বেশিরভাগ রাজ্যে মাসে মাথাপিছু ৫০০ টাকার কাছাকাছি।
বয়স্ক নাগরিকদের কর ছাড়ের সীমা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হোক। এই মুহূর্তে এই ছাড় ৬০-এর বেশি বয়সীদের জন্য এই ছাড় ৩ লক্ষ টাকা আর ৮০-র বেশি বয়সীদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা। বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা (৬০+) এবং অতিবৃদ্ধদের ক্ষেত্রে সমস্ত ষাটোর্ধ্ব মানুষের জন্যই উচ্চতর সীমা বিবেচনা করা হোক।
বয়স্ক মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটে (FD) সুদের মাত্রা ষাটোর্ধ্বদের জন্য বাড়ানো উচিত এবং তাঁদের আয় করমুক্ত হওয়া উচিত, যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই ওটাই তাঁদের বেঁচে থাকার মূল ভরসা। এই মুহূর্তে সেকশন 80TTB অনুসারে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির আয় হওয়া ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত সুদে ছাড় পাওয়া যেতে পারে। এই সীমা বাড়িয়ে ১,০০,০০০ টাকা করা হোক।
যেহেতু বয়স্কদের মধ্যে অনেককেই এখন ও বাঁচার জন্য কায়িক পরিশ্রম করে , সেহেতু গরীব বয়স্কদের MGNREGA (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, ২০০৫, যা প্রত্যেক আর্থিক বর্ষে একটি গ্রামীণ পরিবারের একজন কর্মসংস্থান প্রার্থী প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য, যিনি দক্ষতাহীন কায়িক পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক, তাঁকে একশো দিনের মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়)-র অন্তর্ভুক্ত করা হোক এবং অন্তত ৫% কাজ তাঁদের জন্য সংরক্ষণ করা হোক। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলাদের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ করা হোক। যেসব নিয়োগকর্তা ৬৫ বছরের পরেও কর্মীদের কাজে রাখেন তাঁদের জন্য ট্যাক্স ইনসেন্টিভের কথা বিবেচনা করা হোক।
সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আর্থসামাজিক এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তার জন্য প্রয়োজন NAPSrC (ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সিনিয়র সিটিজেনস)-এর মত চলতি সরকারি প্রকল্পগুলোতে আরও বেশি বরাদ্দ। সঙ্গে দরকার প্রত্যেক জেলায় মাল্টি-সার্ভিস ডে কেয়ার সেন্টারের জন্য এক বিশেষ প্রকল্প। সেই সেন্টারগুলোতে ডে কেয়ার, চিকিৎসার ব্যবস্থা, শারীরিক সক্ষমতা, বিনোদন এবং নতুন দক্ষতা তৈরির ব্যবস্থা থাকবে।
মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অফ পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেনস অ্যাক্ট-এর মত যুগান্তকারী আইনের রূপায়ণে এবং এই আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হোক, যাতে বয়স্কদের নিরাপত্তা ও সসম্মানে বাঁচা নিশ্চিত করা যায়।
ইতিমধ্যে হেল্পএজ ইন্ডিয়ার দেখানো পথে তৈরি এল্ডার-সেলফ-হেল্প-গ্রুপগুলোকে (ESHG) শক্তিশালী করে তুলে গরীব বয়স্কদের জীবনধারণ এবং আয়ের সুযোগ তৈরি করা হোক। গ্রামাঞ্চলের গরীব বয়স্কদের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হোক।
অতিমারীর পর বয়স্কদের পক্ষে ডিজিটাল বিভাজন আরও বিশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে সমস্ত ব্যবস্থা (ব্যাঙ্কিং, ইউটিলিটি, স্বাস্থ্য, আর্থিক ও অন্যান্য লেনদেন) ডিজিটাল ইন্ডিয়া/ই-গভর্ন্যান্স প্রকল্পের ফলে ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বয়স্করা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। হেল্পএজ জোরালোভাবে সুপারিশ করছে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া/CSC/ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক (MeitY)-এর অধীনে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য একটি ডিজিটাল ক্ষমতায়ন উদ্যোগ চালু করা হোক।
অতিমারীর পরে বয়স্কদের বিপন্নতা আরও বেড়ে গেছে এবং বয়স্কদের বেঁচে থাকার দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা করার জন্য, তাঁরা যাতে সসম্মানে এবং সযত্নে বাঁচতে পারেন তার জন্যে এখুনি ব্যবস্থা নেওয়া আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।