নিজস্ব সংবাদদাতা,দাঁতন,পশ্চিম মেদিনীপুর.....'. পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতনে সাড়ম্বরে প্রকাশিত হল 'বাংলার বৃহত্তম দিঘি শরশঙ্কা' শিরোনামাঙ্কিত একটি গবেষণাগ্রন্থ। প্রায় ৬ বছরের নিরলস সমীক্ষা ও গবেষণার পরে এমন আকর গ…
নিজস্ব সংবাদদাতা,দাঁতন,পশ্চিম মেদিনীপুর.....'. পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতনে সাড়ম্বরে প্রকাশিত হল 'বাংলার বৃহত্তম দিঘি শরশঙ্কা' শিরোনামাঙ্কিত একটি গবেষণাগ্রন্থ। প্রায় ৬ বছরের নিরলস সমীক্ষা ও গবেষণার পরে এমন আকর গ্রন্থ লিখতে পেরেছেন শিক্ষক তথা আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক সন্তু জানা । গ্রন্থ প্রকাশ সমারোহে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন মেদিনীপুর কলেজ ( অটোনোমাস )-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সত্যরঞ্জন ঘোষ ।
দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা বাংলার দাঁতনে অবস্থিত প্রাচীন শরশঙ্কা দিঘি অবিভক্ত বাংলার মধ্যে মনুষ্য-খননে সৃষ্ট বাংলার বৃহত্তম জলাশয়। এই দিঘির সঙ্গে মহাভারতের পঞ্চ পাণ্ডবদের আগমনের লোকশ্রুতি জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে । দিঘির একটি ঘাটের নাম আজও 'পাণ্ডবঘাট' নামে পরিচিত । একদা ওড়িশার গঞ্জাম পর্যন্ত সুবিস্তৃত ছিল প্রাচীন বাংলার প্রথম স্বাধীন সম্রাট শশাঙ্কের রাজত্ব। মনে করা হয় গৌড়েশ্বরের নামানুসারেই দিঘির নাম শরশঙ্কা । তিনিই এর প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা । সুবিশাল দীঘিটির জলভাগ ১৪২ একর। সুউচ্চ পাড় মিলিয়ে ১৫০ একর ছাড়িয়েছে । এমন অবিশ্বাস্য নিদর্শন বাংলায় আর দ্বিতীয়টি নেই। চার দিকে প্রাচীন মন্দির ও মাজারের সমাহার । যুগ-যুগান্তর ধরে পৌষ সংক্রান্তির দিন নিজ নিজ ধর্মীবিশ্বাসে লালিত হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি এই দীঘিতে পবিত্র স্নান করেন। আয়োজিত হয় লোকায়ত মকরমেলা ।
আরো বহু অজানা ইতিহাস, কিংবদন্তী, প্রত্নসমীক্ষা ও পরিবেশ চর্চার নিবিড় অনুসন্ধানে গবেষক সন্তু জানা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার একটি বই। এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান আর্টের অধ্যক্ষ ড. দীপক কুমার বড় পণ্ডার অভিমত, "একটি দিঘিকে ঘিরে যে কত রকম আলোচনা হতে পারে, তা এই গ্রন্থ পাঠে অনুধাবিত হবে । আমার বিশ্বাস, সন্তু জানা লিখিত এই গ্রন্থ বাংলার আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে।" বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে শরশঙ্কায় আগত পরিযায়ী পাখিদের উদ্দেশে । শরশঙ্কার মাটি দিয়ে তৈরি টেরাকোটার ফলক সমৃদ্ধ অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন শিল্পী বরুণ সাহু ।
দণ্ডভুক্তি একাডেমি আয়োজিত গ্রন্থ প্রকাশ সমারোহের দিন দাঁতনের নামকরণ করা হয় রাজা শশাঙ্ক নগর । অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মেদিনীপুর কলেজ ( অটোনোমাস )-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সত্যরঞ্জন ঘোষ, দাঁতন-১ বিডিও চিরঞ্জিত রায়, আই.সি দাঁতন থানা তীর্থসারথি হালদার, ভাস্কর সুধীর মাইতি, আলোচক গোপাল বসু, কবি সিদ্ধার্থ সাঁতরা, সমাজকর্মী সুদীপ খাঁড়া,'শিক্ষারত্ন' সুব্রত মহাপাত্র, দাঁতন-১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কনক পাত্র, গবেষক প্রবাল কান্তি হাজরা, নাসির আলি, পার্থ সারথি দাস সহ মেদিনীপুর জেলার বহু বিশিষ্ট শিক্ষক, অধ্যাপক এবং গবেষক বৃন্দ ।
লেখক সন্তু জানা তাঁর বক্তব্যে বলেন, " বাংলার বিস্ময় এই শরশঙ্কা দিঘিকে নিয়ে প্রথম কোন গ্রন্থ এটি । তবে, ইতিহাস ও কিংবদন্তী ছাড়াও প্রাচীন দাঁতনের জনপদ অবস্থান অনুসন্ধান, বিংশ শতকের প্রথম দশকে পুরীতীর্থ যাত্রীরদের কাছে দাঁতনের দিঘি সরাইখানার গুরুত্ব, দেশভাগের পরে দিঘির পাড়ে শরণার্থী জীবন, ব্রিটিশ জমানায় শরশঙ্কার মালিকানা, বিলুপ্তপ্রায় মাছ ও গাছের বিবরণ প্রভৃতি বিষয়ে উপাদান সংগ্রহ করে তথ্য পরিবেশন করেছি । দাঁতন আক্ষরিক অর্থেই একটি ঐতিহাসিক স্থল । ১৬ শতকের শেষার্ধে এতদঅঞ্চলে মুসলমান আক্রমণের সময় বহু মন্দিরের অবশিষ্টাংশ, বিগ্রহ, প্রত্ন অবশেষ বিভিন্ন জলাশয়ে নিক্ষেপ করেছিলেন শঙ্কিত মানুষ । দাঁতন এলাকার এমন ২২ টি দিঘি, জলাশয়, পুকুর থেকে পঞ্চাশ অধিক প্রত্নবস্তুর বর্তমান হাল-হকিকত, বৈশিষ্ট্য, অবস্থান এবং পরিমাপ সমৃদ্ধ সুদীর্ঘ তালিকা প্রকাশ এই গ্রন্থের বিশেষ আকর্ষণ, যা আগামী গবেষকদের নতুন পথের দিশা দেবে ।" অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সত্যরঞ্জন ঘোষ, ভাস্কর সুধীর মাইতি এবং কবি ও আলোচক গোপাল বসুকে 'দণ্ডভুক্তি স্মারক সম্মান ' প্রদান করা হয়।