বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতির পর তা পঠনপাঠনের বিষয় হিসাবে চালু হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই জনজাতিটি রয়ে গ্যাছে যে তিমিরের সেই তিমিরেই। এদের রহন-সহন, খাদ্যাভ্যাস, আদব কায়দা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে বয়ে গ্যাছে প্…
বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতির পর তা পঠনপাঠনের বিষয় হিসাবে চালু হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই জনজাতিটি রয়ে গ্যাছে যে তিমিরের সেই তিমিরেই। এদের রহন-সহন, খাদ্যাভ্যাস, আদব কায়দা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে বয়ে গ্যাছে প্রকৃতি প্রেম। এরা হিন্দু/আর্য নয়। অনেক গবেষকের মতে এই জনজাতিটিও অন্যান্য আদিম জনজাতির মতোই টোটেমিক। অর্থাৎ এরা গোত্রে বিবেচিত নন, এরা গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী। তাই এদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতেও স্পষ্টভাবে ছাপ ফেলে প্রকৃতি। নানান ট্যাবু ও টোটেমদের মধ্যে প্রকৃতি তার গভীর প্রভাব আচ্ছাদিত করে রাখে। হাবার্ট একেই ‘প্রেতবাদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এই কুড়মি জনজাতির ভাষা ও জীবনের মতোই এদের পার্বণগুলিও ভিন্নতর স্বাদের এবং অদ্ভুত সুন্দরও।যেমন এইটুসু পরব পালিত হয় পৌষ সংক্রান্তির দিন। এই উৎসব এখন আর শুধুমাত্র কুড়মিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই উৎসব এখন সারা বাংলার উৎসব। কুড়মি লোকজীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনী সবথেকে বেশী ধরা পড়ে যে গানে তা হল টুসু গান।
অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লেপে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।
টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়।
পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে মেয়েরা গোবর দিয়ে পৌষ বুড়ি তৈরী করে সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে গান করতে করতে সারা রাত পৌষ আগলায়। এই পৌষ আগলানো মানে ফসল আগলানো। খেতে পাকা ফসল, পুরুষেরা রাতে সেখানে পাহারায় ফসল আগলানোতে ব্যস্ত। মেয়েরা তাই গৃহের রক্ষক, একা রাত জাগা যায় না। তাই দলবেঁধে উৎসব।
টুসু ঘরের মেয়ে, ফসল রূপী অাবাদের দেবী।এই আরাধনা কবে থেকে চলে আসছে তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও সম্রাট অশোকের আমলে এই একই ধরনের সমান্তরাল উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায় ধৌলি ও জৌগাডা শিলালিপিতে পাওয়া যায়।
সমগ্র ধলভূম,বরাভূম ও মানভূমগড় জুড়ে একটা প্রচলিত কাহিনী শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলেই।কাশীরাজের কন্যা টুসু ও ভাদু ইত্যাদি ইত্যাদি.. কান্তু গবেষনায় স্পষ্ট হওয়া গ্যাছে যে এই গল্প গল্পই।তার কোন সারবত্তা নেই কুড়মি সংস্কৃতি বা রুচির সাথে।
তাই এই ঘরের শস্যরূপী দেবীর কাছেই যত আবদার, অভিযোগ এবং তার কাছেই আনন্দের প্রকাশ। গানগুলিতে তারই প্রকাশ ঘটে।
#চাল উলহাব রসে রসে
মুঢ়ি ভাজব রগড়ে
সতীন মাগি মইরয়েঁ গেলে
কাঠ চালাব সগড়ে
সতীন মইরল্য ভাল হল্য
ছাতির ভাত মর হেঁট হল্য
সতীন ছিল চৈখের বালি
তাই আগে অকে লিল
#
"টুসুর মাচায় লাউ ধরেছ্যে
ধরেছ্যে জড়া জড়া
হাত বাড়াঞে ধইরতে গেলে
পায় জড়া পানের খিলি
জড়া জড়া পানের খিলি
যাঁতি কাটা সুফারি...
#১)টুসুর চালে লাউ ধইরেছে
লাউ তুল্যেছে বাগালে
যবে বাগাল ধরা যাবি
বড়বাবুর হুজুরে
যখন বাগাল ধরা যায় মা
তখন হামরা বাঁধঘাটে
ঘাটের হল্যৈদ ঘাটে দিঞে
হামরা যাই মা দরবারে
দরবারে যে গেছলে টুসু
মকদ্দমায়ঁ কি হল্য
মকদ্দমায় ডিগরি হল্য
নীলমনি চালান গেল
বা
#২)"উপরে পাটা তলে পাটা
তার উপরে দারোগা
ও দারোগা সইরাঞ বস গ
টুসু যাবেক পুরুল্যা
পুরুল্যা যে গেছলে টুসু মকদ্দমায় কি হল্য
মকদ্দমায় ডিগরি হল্য
নীলমনি চালান গেল"(এই দু ভাবেই গাওয়া প্রচলিত)
রাত পোহালে আসে মকর।
"তদের ঘরে টুসু ছিল
দিন করি আনাগনা
কাইল ত টুসু চল্যে যাবে
হবে গ দুয়ার মানা"
গানে গানে টুসু নিরঞ্জন। রঙীন সুদৃশ্য চৌড়লে চাপিয়ে টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বড়ো জলাশয় বা নদীতে। সবেধন নীলমণি কন্যারত্নটিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়ার সময়, গ্রাম্য রমণীদের সে কি শোকবিহ্বল চেহারা! অশ্রুসিক্ত বদনে তখন সেই মন খারাপের গান-
"আমার বড়ো মনের বাসনা,
টুসুধনকে জলে দিবো না।"
মকর পরবের অপরিহার্য অঙ্গ টুসু গান। মানুষের চিরন্তন আশা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এইসব টুসু গানে। মানভূমের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের দিনে মানুষকে সচেতন করার কাজে টুসু গানের এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।প্রকৃত অর্থেই টুসু কুড়মিদের মহামিলনের পরব।
মোট কথা জঙ্গলমহল জুড়ে চলে সারা বছরের উৎসব বাতাবরণ। এই আনন্দ এই নেগাচার কুড়মিদের রন্ধ্রে রক্তে মজ্জায়। এর কোনও লিপিবদ্ধ নিয়মাবলীও নেই। নেই বাধ্যবাধকতাও। তবুও তারা হৃদয়ের টানে মেতে ওঠে উতসবগুলিতে। এই উৎসব চলে আসছে পুরুষানুক্রমিক।