*নামটি তাহার খঞ্জন*
রাকেশ সিংহদেব
--------
খঞ্জন পাখিদের দেখতে ভীষণ সুন্দর। ছিপছিপে গড়ন। চেহারাটা বেশ মায়াবী। শীতের পরিযায়ী হয়ে আসে। বিশেষ করে ওরা শীত শুরু হওয়ার প্রাক মুহূর্তেই এসে হাজির হয় , একেবারে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত থাকে।…
*নামটি তাহার খঞ্জন*
রাকেশ সিংহদেব
--------
খঞ্জন পাখিদের দেখতে ভীষণ সুন্দর। ছিপছিপে গড়ন। চেহারাটা বেশ মায়াবী। শীতের পরিযায়ী হয়ে আসে। বিশেষ করে ওরা শীত শুরু হওয়ার প্রাক মুহূর্তেই এসে হাজির হয় , একেবারে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত থাকে।প্রাকৃতিক আবাসস্থল জলাশয়ের কাছাকাছি স্যাঁতসেঁতে জমি। কীটপতঙ্গ শিকারের উপযুক্ত স্থান জলাভূমি হলেও জলে নেমে শিকার ধরে না। তবে কখনো কখনো পায়ের পাতা ভিজিয়ে কীটপতঙ্গ খেতে দেখা যায়। স্বভাবে চঞ্চল এই পাখি সব সময় লেজ দুলিয়ে হাঁটে। মিষ্টি সুরে গান গায়। প্রজনন মরসুমে নিজের বাসভূমে ফিরে যায়। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত। জোড়ায় জোড়ায় কিংবা একাকী বিচরণ করে। অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতির পাখি এরা। স্থিরতা এদের খুবই কম। মাঠে বিচরণকালে সারাক্ষণ লেজ নাড়তে দেখা যায়। আসলে ওদের কোমরের গড়ন একটু ভিন্ন ধাঁচের এবং শরীর অপেক্ষা লেজের দৈর্ঘ্য বড় হওয়ায় সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে এই কারণে লেজটাও দুলতে থাকে। আর তা দেখে মনে হয় বুঝি ওরা নেচে বেড়ায় সারাদিন। আমাদের রাজ্যে সাধারণত যেসব খঞ্জন পাখিদের নিয়মিত দেখা যায় তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
*বাংলা নাম: সাদা খঞ্জন*
ইংরেজি নাম: white wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla alba
সাদা খঞ্জন লম্বায় ৮ ইঞ্চি। চিকন শরীর। শরীরের তুলনায় লেজটা লম্বা। এদের কপাল, চোখের দু’পাশ, গলা ও গাল সাদা। মাথা, ঘাড়, ডানার কিছু পালক কালো। বুকে কালো ছাপ। পিঠ ছাই-ধূসর। কিছু পালক ধূসর-সাদার মিশ্রণ। লেজ কালো, দু’পাশের পালক সাদা। বুক ও পেটের সব পালক সাদা। ঠোঁট-পা কালো। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে এক রকম মনে হলেও পার্থক্য সামান্য। স্ত্রী পাখি সামান্য দীপ্তিহীন। প্রজনন সময় মে-জুলাই। মাঠ-প্রান্তর অথবা জঙ্গলের নীরব স্থানে পেয়ালা আকৃতির বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৫-১৭ দিন।
*বাংলা নাম: ‘হলদেমাথা খঞ্জন’*
ইংরেজি নাম: Citrine Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla citreola
এদের গড় দৈর্ঘ্য ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮-২৫ গ্রাম। মাথা উজ্জ্বল হলুদ। ঘাড় কালো। পিঠ শ্বেত স্লেট-ধূসর। ডানার পালক জলপাই ধূসর, সঙ্গে সাদা টান। লেজ কালো। গলা ও দেহতল উজ্জ্বল হলুদ হলেও কালো ছোপ লক্ষ্য করা যায়। চোখ গাঢ় বাদামি। ঠোঁট হলদে ধূসর। পা কালো বাদামি। অন্যদিকে স্ত্রী পাখির মাথার মধ্যখানে কালো টান, দুই পাশ হলদে। থুতনি ও গলা হলদেটে। পিঠ ধূসর। ডানায় কালো-সাদা টান। হলদেটে বুকে কালো মালা সাদৃশ্য রেখা। প্রজনন পালক ভিন্ন। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে জুন। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। তবে প্রজনন সময়ে এখানে থাকে না, পাড়ি জমায় নিজ বাসভূমি ইউরোপ, আফ্রিকায়। মাঝে মাঝে এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ডিম-বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ৪-৫টি। ফোটে ১৩-১৫ দিনে।
*বাংলা নাম: ‘হলদে খঞ্জন’*
ইংরেজি নাম: Western Yellow Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla flava
ইউরোপ এবং এশিয়ার উষ্ণতা এই পাখির জন্য আদর্শ। এরা আফ্রিকা এবং দক্ষিন এশিয়াতে পরিযায়ী হয়ে আসে। এদের গড় দৈর্ঘ্য ১৫-১৬ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮-২৫ গ্রাম। মাথা উজ্জ্বল হলুদ। পেট হলুদ এবং পিঠ জলপাই রঙের।অন্য অবস্থাতে বা ভিন্ন পালকসজ্জায় পেটের পালক এই হলুদ এর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত ধূসর সাদা হতে পারে। এরা নরম কর্দমাক্ত জলাভূমিতে থাকতে পছন্দ করে। এরা জলজ ঘাসের মধ্যে বাসা বানিয়ে ডোরাকাটা ৪-৮ টি ডিম পাড়ে।
*বাংলা নাম : ‘ধূসর খঞ্জন’*
ইংরেজি নাম : Grey Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla Cinerea|
প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য ১৭-১৮ সেন্টিমিটার। ঠোঁট নীলচে ধূসর। মাথা, পিঠ, লেজের উপরিভাগ ধূসর। ডানা ও লেজ কালোর ওপর সাদা খাড়া ডোরা দাগ। ডানার নিচ থেকে লেজের শেষাংশ পর্যন্ত পরিষ্কার হলুদ। ডানার প্রান্ত কালচে। গলা সাদাটে। পেট ও লেজের নিচ হলদেটে। স্ত্রী পাখির মাথা কালো, নিচের অংশ হলুদ। থুতনি, গলা কালো। প্রজনন সময়ে গলার কালো রঙ থাকে না। প্রজনন মৌসুম এপ্রিল থেকে জুলাই। ওই সময় ইউরোপ ও আফ্রিকার দক্ষিণের দেশগুলোতে অবস্থান করে। মাঝেমধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ডিম-বাচ্চা তোলে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন।
*বাংলা নাম : ‘সাদা ভ্রু খঞ্জন’*
ইংরেজি নাম : White Browed Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Motacilla maderaspatensis
‘সাদা ভ্রু খঞ্জন’ ২১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যে পর্যন্ত হয়। এরা খঞ্জনদের মধ্যে বৃহত্তম প্রজাতি। এদের সাদা সুপারসিলিয়াম বা ভ্রু থাকে এবং বড় সাদা উইন্ডবার সহ কালো ওপরের অংশ, মাথা এবং বুক রয়েছে। আন্ডার পার্টসের বাকি অংশগুলি সাদা হয়। স্ত্রীলোকের চেয়ে পুরুষের চেয়ে কালো কম তীব্র থাকে। অপরিনত পাখিরা স্ত্রীদের মতো বাদামী-ধূসর যেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক পাখিরা উজ্জ্বল কালো হয়ে থাকে। ‘সাদা ভ্রু খঞ্জন’ ভারতের আবাসিক ব্রিডার এবং এটি ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় পাখি।
প্রজনন মরসুম মার্চ থেকে অক্টোবর। দক্ষিণ ভারতে, যখন নদীর স্তর নেমে আসে এবং পুনরায় বর্ষা বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এদের নেস্টিংয়ের মরসুম অব্যাহত থাকে। এরা জলের কাছাকাছি মাটিতে কাপ-আকৃতির বাসা বানায় এবং তাঁর মধ্যে সাধারণত তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে ।
*বাংলা নাম: ‘বনখঞ্জন’*
ইংরেজি নাম: Forest Wagtail
বৈজ্ঞানিক নাম: Dendronanthus indicus |
এরা লম্বায় ১৬-১৮ সেন্টিমিটার। ঘাড়ের দুপাশ জলপাই রঙা। বুক ও পেট সাদা। তার ওপর চওড়া কালো দুটি দাগ। ডানার প্রান্তের পালক ময়লা হলুদ। লেজ পাটকিলে কালো। তবে লেজের দুপাশের পালক সাদা। শরীরের তুলনায় লেজটা বড়। চোখ দুটো বেশ মায়াবী। চোখের ওপরে সাদা বাঁকানো টান। পা হালকা গোলাপি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে প্রায় একই রকম। সব ধরনের খঞ্জনই দেখতে সুন্দর। সে তুলনায় বনখঞ্জন একটু নিষ্প্রভ। তবে চেহারাটা মায়াবী। বনখঞ্জন হিংসুটে কিংবা ঝগড়াটে নয়। বিচরণ করে একাকী। এরা পরিযায়ী পাখি। শীত শুরু হওয়ার আগেই উপমহাদেশে চলে আসে। থেকে যায় গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। অন্যসব খঞ্জন সাধারণত মাঠ-প্রান্তরে বিচরণ করলেও এরা বনে জঙ্গলে বেশি বিচরণ করে। তুলনামূলকভাবে ফাঁকা জঙ্গল এদের পছন্দ। সব ধরনের খঞ্জনের প্রিয় খাবার পোকামাকড়। বনখঞ্জনরাও তদ্রুপ বনপ্রান্তরে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খেয়ে থাকে। প্রজনন সময় মে-জুলাই। বাসা বাঁধে ঘাসবনে অথবা গাছের গোড়ার খাঁজে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে শুকনো ঘাস, নরম লতাপতা। বাসার আকৃতি লম্বাটে। ডিমের সংখ্যা ২-৫টি। ডিম ফুটতে সময় নেয় ১৭-১৯ দিন।
সমস্ত প্রজাতির খঞ্জন পাখিই পতঙ্গভুক প্রকৃতির। এদের প্রধান খাবার ভূমিজ কীট। সারাদিন মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় শিকার করে।