Emerald dove
রাকেশ সিংহদেব
..........................
*গ্রাম বাংলার ঘুঘুরা*
এ পাখির ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শৈশব কৈশরের সেই ফেলে আসা গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের …
Emerald dove
রাকেশ সিংহদেব
..........................
*গ্রাম বাংলার ঘুঘুরা*
এ পাখির ‘ঘুঘু-ঘুঘু বা ক্রুরর-ক্রুরর-ক্রুরর’ আওয়াজ যখন কানে ভেসে আসে তখন শৈশব কৈশরের সেই ফেলে আসা গ্রামের বাঁশঝাড় অথবা ঠা-ঠা রৌদ্দুরের অলস দুপুরগুলির কথা মনে পড়ে যায়।যেখানে কোনো জনমানুষের সাড়া নেই সেই নিঝুমের মাঝে বাজছে ‘ঘুঘু-ঘুঘু’ সুরের মূর্ছনা। এই পাখি আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। বাংলা সাহিত্য কিংবা গানে এরা আজও সমান দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে যুগ যুগ ধরে। বাংলা গদ্য ও কবিতায় ঘুঘু এসেছে বিভিন্ন রূপে।
*পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;*
*পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু;জনার মনে;*
*আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।*
* - জীবনানন্দ দাশ (পশ্চিমবঙ্গ)*
কিংবা
*থাকুক তোমার একটু স্মৃতি থাকুক*
*একলা থাকার খুব দুপুরে*
*একটি ঘুঘু ডাকুক*
*- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (বাংলাদেশ)*
এরমধ্যে রামঘুঘু (Oriental Turtle Dove) পরিযায়ী পাখি এবং শীতকালে জেলার বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে। ঘুঘু পাখিদের প্রিয় খাবার বিভিন্ন শস্যদানা এরমধ্যে ধান, গম, সরিষার প্রতি আসক্তি বেশি। আবার এদের খুটে খুটে মাটিও খেতে দেখা যায়। বিশেষ করে ঘাসে ভরা জমিতে এটা-সেটা কুড়িয়ে খায়। মাদকতা রয়েছে এদের মধুর কন্ঠস্বরে। নিজ প্রজাতির বাইরেও অন্য প্রজাতির ঘুঘুদের সঙ্গেও এরা একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়।
*তিলা ঘুঘু Spotted Dove*
তিলা ঘুঘুর দেখা মেলে যত্রতত্র। অনেকটাই মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। পাখিটার ইংরেজি নাম: Spotted dove, বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia chinensis । লম্বায় এরা ২৮-৩০ সেন্টিমিটার। কপাল, মাথা, মুখ, গলা, বুক বেগুনি-গোলাপি। ডানার ওপর সাদা ছিট ছিট। ঘাড়ের দু’পাশে কালোর ওপর সাদা ছোপ। লেজ কালচে-বাদামি। লেজের তলা সাদা। ঠোঁট কালচে। চোখের চারপাশের বলয় লালচে। পা-পায়ের পাতা সিঁদুরে লাল। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। তবে আকারে স্ত্রী পাখি সামান্য ছোট। প্রজনন সময় সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত। এ ছাড়াও গ্রীষ্মেও ডিম পাড়তে দেখা যায়। বাড়ীর কার্নিশে বা নির্জন কোনে, যেকোনো গাছেই এরা বাসা বাঁধে। বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চিকন লতা বা শুকনো দূর্বাঘাস। ডিম পাড়ে ১-২টি। বেশিরভাগ সময় ২টি ডিম পাড়ে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়ে মিলেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন।
*রাজ ঘুঘু Eurasian Collared Dove*
রাজ ঘুঘু বিচরণ করে ঝোপ-জঙ্গল, খোলা মাঠ প্রান্তর কিংবা কৃষিজমিতে। জোড়ায় জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে এটা-সেটা কুড়িয়ে খায়। ভোর ও গোধূলিতে খাদ্য সংগ্রহে তৎপর থাকে। এদের ইংরেজি নাম: Indian Ring Dove বা Eurasian Collared Dove, বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia decaocto | রাজ ঘুঘু লম্বায় ৩০ সেন্টিমিটার। ঘাড়ে অর্ধচন্দ্র কালো রেখার জন্য এরা কণ্ঠী ঘুঘু নামে পরিচিত। দেহের উপরি ভাগ ধূসর বর্ণের। ডানার পালক কালচে। বুক ফিকে নীলচে পাটকিলে। তলপেট ছাই ধূসর। লেজের তলার পালক গাঢ় ধূসর। লেজের বাইরের পালকের ডগা সাদা। চোখের তারা লাল। চোখের বলয় পালকহীন ধূসরাভ-গোলাপি চামড়ায় আবৃত। পা ও পায়ের পাতা উজ্জ্বল লাল। ঠোঁট কালো। স্ত্রী-পরুষ পাখি দেখতে প্রায় একই রকম। প্রজনন সময় মার্চ থেকে জুন। পুরুষ পাখি প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করে, ‘ক্রুরু- ক্রুরু-ক্রুরু’ সুরে ডেকে। ঝোপ জঙ্গল ঘেরা গাছের নিচের দিকে শুকনো ঘাস লতা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। স্ত্রী-পুরুষ পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৬-১৮ দিন। এরা নিরীহ এবং শান্ত প্রকৃতির পাখি।
*লাল ঘুঘু Red Turtle Dove*
ইংরেজি নাম: Red Turtle Dove বা Red collared Dove, বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia tranquebarica| এরা ‘লাল রাজঘুঘু’ এবং ‘জঙ্গলা ঘুঘু’ নামেও পরিচিত। প্রজাতিটি লম্বায় ২৩ সেন্টিমিটার। মাথা নীলাভ-ধূসর। ঘাড়ে মোটা কালো বন্ধনী। বন্ধনীর উপরে-নিচে থাকে সরু সাদা বন্ধনী। পিঠ ও ডানার পালক ইট রঙের লালচে। ডানার প্রান্ত পালক কালচে। নিতম্ব নীলাভ-ধূসর। বুক ও পেট হালকা গোলাপী। লেজ ধূসর। লেজের নিচের দিকটা সাদা। স্ত্রী পাখির রঙ ভিন্ন। দেহের উপরের দিকে গাঢ় হলদে-বাদামি। নিচের দিকে হলদে-ধূসর। উভয়ের ঠোঁট কালো, পা বেগুনি-কালো। ওড়ার পালক কালো। প্রজনন সময় নির্দিষ্ট নয়। বছরের যে কোনো সময়ে এরা প্রজননে সক্ষম। বাসা বাঁধে গাছের ডালে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে লতা ও সরু কাঠি। ডিম পাড়ে দুটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১২-১৫ দিন।
*ক্ষুদে ঘুঘু Laughing Dove*
আমাদের জেলায় অন্যান্য ঘুঘুদের তুলনায় কিছুটা বিরল দর্শন ‘ক্ষুদে ঘুঘু’। দৈর্ঘ্য কমবেশি ২৬-২৭ সেন্টিমিটার। মাথা ও ঘাড় গোলাপি-বাদামি। পিঠ বালু মিশ্রিত বাদামি বর্ণ। লেজের বাইরের পালক সাদা। লেজের গোড়া ও কাঁধের পালক ধূসর। ডানার প্রান্ত পালক কালো। ওড়ার পালক কালো। বুক গোলাপি-বাদামি। পেট বালু মিশ্রিত বাদামি। চোখ বাদামি কালো। ঠোঁট শিং কালো। পা গোলাপি লাল। নখর কালো। দেখতে অনেকটাই তিলা ঘুঘুর মতো। কণ্ঠস্বরও সেরকম। বিচরণ করে মাঠে-ঘাটে। তবে সেটি অবশ্য শুষ্ক শস্যভূমি হতে হবে। ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে এলাকা এদের একদম অপছন্দ। ইংরেজি নাম: Little brown Dove বা Laughing Dove, বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia senegalensis | প্রধান খাবার শস্যবীজ, ঘাসের কচি ডগা ও মাটি। মাঝেমধ্যে উইপোকা খেতে যায়। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। অঞ্চলভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের রয়েছে। গাছের তেডালে অথবা দালানের ফাঁকে খড়কুটা দিয়ে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ১-২টি। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৩-১৫ দিন। শাবক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে উড়তে শেখে।
*রাম ঘুঘু Oriental Turtle Dove*
আমাদের জেলায় শীতের সকাল বিকেলে বাঁশের ঝাড়ের উঁচুতে বড় পায়রার মত এদের দেখতে পাওয়া যায় । এরা আসলে আমাদের রাজ্যের উত্তরের পার্বত্য এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ইংরেজি নাম: Oriental Turtle Dove বা Rufous Turtle Dove, বৈজ্ঞানিক নাম: Streptopelia orientalis| প্রজাতিটি লম্বায় ৩০ থেকে ৩২ সেমি। ঠোঁট লম্বা এবং পিঠের পালক লালচে বাদামি আর মিশেল। মাথা নীলাভ-ধূসর। ঘাড়ের দুপাশে কয়েকরটি অর্ধচন্দ্রাকার দাগ থাকে। পিঠ ও ডানার পালকে ইট রঙের লালচে অর্ধগোলাকার দাগযুক্ত পালকের বিন্যাস থাকে। লেজ ধূসর। লেজের নিচের দিকটা সাদা। স্ত্রী পাখির রঙ অভিন্ন। উভয়ের ঠোঁট লালচে, পা বেগুনি-কালো। এরা দলবেঁধে ধানক্ষেতে ভিড় করে। ফুলের মুকুলও এদের খাবারের তালিকাভুক্ত। মার্চ থেকে জুন এদের প্রজননের মরসুম তবে বছরের যে কোনো সময়ে এরা প্রজননে সক্ষম। বাসা বাঁধে গাছের ডালে। উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে লতা ও সরু কাঠি। ডিম পাড়ে দুটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৫-১৭ দিন।
*পান্না ঘুঘু বা সবুজ ঘুঘু Asian Emerald Dove*
আমাদের দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে অপেক্ষাকৃত বিরল দর্শন এই ঘুঘুর ইংরেজি নাম: Asian Emerald Dove। বৈজ্ঞানিক নাম: Chalcophaps indica indica |
এরা লম্বায় ২৫-২৮ সেন্টিমিটার। এদের মাথা ও ঘাড় ধূসর। কাঁধ সাদা। পিঠ সবুজ। ডানার প্রান্ত এবং লেজ কালো। গলা থেকে তলপেট পর্যন্ত উজ্জ্বল গোলাপি। ঠোঁট ও পা লাল। স্ত্রী পাখি আকারে সামান্য ছোট। রঙে সামান্য তারতম্য রয়েছে। স্ত্রী পাখির মাথা ঘাড় বাদামি। কাঁধের সাদা দাগটি অস্পষ্ট। এদের প্রধান খাদ্য ধান ও অন্যান্য শস্যদানা। মাটিতে বিচরণকালে খুঁটে খুঁটে মাটি এবং উইপোকা খায়। প্রজনন সময় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর। মাটি থেকে প্রায় ৫ মিটার উঁচুতে গাছের ডালে বাসা বাঁধে। সরু, নরম ও শুকনো ঘাস-লতা দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ১-২টি। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৭-১৮ দিন।
গ্রামবাংলার অতিচেনা বা স্বল্পচেনা বিভিন্ন প্রজাতির ঘুঘু পাখিদের সংখ্যা বিভিন্ন পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতায় ক্রমশ কমে আসছে। একসময় সর্বত্রই ছিল ঘুঘু পাখির অবাধ বিচরণ। উঠোনের গাছগুলোতে, বাড়ি সংলগ্ন বাঁশ ঝাড়ের ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে এই পাখিরা ঘু-ঘু ডাকে মুখর করে রাখত পরিবেশ। কিন্তু এই লাজুক চঞ্চল পাখিগুলোর মাথাতেও আজ বিপদের কালো ছায়া! সবচেয়ে বেশি শিকার হওয়া পাখিদের মধ্যে বকের পরেই এরা সবচেয়ে বেশি শিকারিদের ফাঁদে পড়ছে। স্বভাবত এরা সুচতুর নয়, অত্যন্ত নীরিহ গোত্রের পাখি ফলে শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা করে সহজেই এদেরকে ফাঁদে ফেলছে। এছাড়াও শখের এয়ারগানের টার্গেটে এ পাখিই বেশি মারা পড়ছে। আবার গ্রামগঞ্জের বিলাসি মানুষের খাঁচায় এ পাখিই বন্দি হচ্ছে বেশি, এর প্রধান কারণ ঘুঘুরা বাসা বাঁধে একেবারেই মানুষের নাগালের ভেতরে। মাঝে মধ্যে এত নিচু স্থানে বাসা বাঁধে যে, শিশু-কিশোরদের ফাঁদে শাবকসহ বড় পাখিও ধরা পড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে শাবক চলে যায় বন্দি জীবনে। আর প্রাপ্তবয়স্ক পাখিরা চলে যায় রান্নার কড়াইতে। আমাদের সৌভাগ্য এতসব অত্যাচারের পরেও এরা এখনও সন্তোষজনক হারে আমাদের জেলায় বিচরণ করছে। এদের রক্ষা করে পরিবেশে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য।