শাল পাতার ডায়েরি ঃ এক
অমিত মাহাত
ছেঁড়া কাঁথা ও ইঁদুর জীবন
১
ঠান্ডাটা বেশ জাঁকাচ্ছে এইবার। সবে পৌষ। কিন্তু শীতের কামড় বেশ কষ্টকর। তার উপর রোজ রোজ স্নানেও কেন অনীহা বাড়ছে তা ওই কামড়ের ভয়ে। গত রাতে জমে যাচ্ছিল পায়ের নীচের দিকটা। সা…
শাল পাতার ডায়েরি ঃ এক
অমিত মাহাত
ছেঁড়া কাঁথা ও ইঁদুর জীবন
১
ঠান্ডাটা বেশ জাঁকাচ্ছে এইবার। সবে পৌষ। কিন্তু শীতের কামড় বেশ কষ্টকর। তার উপর রোজ রোজ স্নানেও কেন অনীহা বাড়ছে তা ওই কামড়ের ভয়ে। গত রাতে জমে যাচ্ছিল পায়ের নীচের দিকটা। সাহস করে পা মেলতেও ভয় করে। পাছে ছেঁড়া কাঁথার 'ভুলুকে' পা না বেরিয়ে যায়। তাই পা গুটিয়ে যাকে বলে গুটিসুটি। কম্বল খানারও এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে গত শীতেই। আর এবারেও তাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া। কাঁহাতক আর চাপ নেবে।
ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে ধনঞ্জয়ের ফোন এল। ও ঝাড়গ্রাম আসবে। পোস্ট অফিসে ট্রেনিং রয়েছে দুদিন ওর। এবং রাতে হল্ট করবে আমার এখানে।
আমি বেশ চাপে তখন। জমিতে পড়ে রয়েছে পাকা ধান। সেইসব খামারে তোলার কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যে খোলা মাঠে শীতের আদর নিচ্ছি। আর নিজেকে ক্ষয় করছি। যেভাবে চটিজোড়া পাতলা হতে হতে পার করে তার আয়ুকাল। যেভাবে প্যান্টের পেছন পাতলা হতে হতে একসময় তাপ্পিমারা হয়। সেভাবেই আমার তাপ্পিমারা জীবন রক্তাক্ত হতে হতে ভার্চুয়াল সুখের মলম লাগায় ক্ষতস্থলে। এর বেশি তো কিছু নয়। যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন।
কষ্টের ভেতরেও সুখ আছে। খুশি আছে। খুঁজে নিতে জানলে তখন অন্যসুখ। বেশ খুশি খুশি লাগে নিজেকে। ধনঞ্জয় বছর পাঁচেক বাদে আসছে তাই একটু বেশিই খুশি। এবং খানিক চিন্তিতও।
চিন্তা এই -কী পাতব বিছানায়? যে কাঁথায় বের করি তা ব্যবহারের অযোগ্য। শীত হয়ত যাবে ঠিকই। ছেঁড়া কাঁথা লুকোব কিসে? মুখ রাখল মায়ের পুরনো কাপড়। কাপড়ের ওয়াড়। কবেকার।
কোন ছোটবেলায় মনটা চলে গেল এক লহমায়। এই কাপড় মা পরত এক সময়। শাল পাতা সেলাইএর শব্দ আর মায়ের মুখ একটা আদল ভেসে আসছে। তখন আমার হাফপ্যান্ট। হয়ত ক্লাস সিক্স। আজ আটাশতম শীতের মাসে জীবনের আঁকিবুঁকি কাটছি ডায়েরির পাতায় পাতায়।
সুতো ছিঁড়ে পড়ছে ছেঁড়া কাঁথার মতোই এই জীবনের। লিখতে বসে রক্তাক্ত হই রোজ।
২
ঘুমোলে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আজকাল। ঘুমের ভেতর পুরনো মৃতজন। কথা বলছে। গল্প জুড়ছে আমার সাথে।
চোখ বুঝলে জ্যাঠামশাই এসে আমার খাটের পাশে এসে বসেন। কথা খুঁজেন জুতসই। যা দিয়ে আমার মন গলানো যাই।
আমার কাঁধে হাত রাখেন। স্পর্শ অনুভব করেন হয় তো। একসময় মৃদু ঝাঁকুনি দেন। এবং সেই চেনা গলা -বুড়ো রে হামার ভাতাটা করি দে বাপ। সত্তর বছর পার করল্যম। আর কদিন বা বাঁচব?
-তুই বাঁচবি জ্যেঠা। কেজোকথার মতো শোনালেও এটাই মন থেকে চাওয়া।
-হারু জাল তো তর বন্ধু। তুই বল না যায়ে। তা বাদে প্রধান বটে। তুই বললে না বলবেক নাই।
-আচ্ছা বলব। আর আমি ত্য পাটি করি নাই। উ কি শুনবেক জ্যেঠা?
-কেনে শুনবেক নাই! তাইলে ভোট দিলম ক্যানে!
তারপর ঘুম ভেঙে গেল। জল খেতে হবে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিছানার চারপাশে নজর বোলালাম। জ্যেঠা তো একটু আগেও বসেছিল খাটের পাশে। এখন নেই। চলে গেলেন। কোথায়? খেয়াল হল। তাঁর চিতাতে অগ্নি সংযোগ করে এসেছি গত পরশু দুপুরে। জ্যেঠার শরীর বিভূতিপ্রাপ্তির মুহূর্তে সংসারের ফেলে দেওয়া ভাঙা কুলোয় কলসি কয়েক জল ঢেলেছি মাত্র। চিতা নেভানো হলে হাঁটু মুড়ে বসে খই অর্পন আর শাল পাতার দোনায় জল খেতে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার এ মুখ তিনি আর দেখবেন না। বুনো কুল কাঁটা ডিঙিয়ে জীবনের দিকে পা বাড়ালাম। জ্যেঠা রইলেন কুল কাঁটার ওই পারে।
মানুষটা চলে গেলেন। আমি তাঁর কথা রাখতে পারি নি। পারি নি বুড়ো বয়সের একটা অবলম্বন দিতে। বার্ধক্য ভাতা করে দিতে পারলে মানুষটা বেঁচে যেতেন। বুড়ো বয়সের খালিহাত। মৃত্যুর নামান্তর। জ্যেঠাকে তো দেখলাম। এক বুক অপ্রাপ্তি রেখে চিতায় উঠলেন। আমার ও খালি হাত। এদিক ওদিক করে দু পঞ্চাশ আসে হাতে। দুবেলা ভাত আর তেল নুন আমারও লাগে। তিরিশ টাকায় দিন চালানো কি কষ্টের সেটা জ্যেঠা বুঝতেন। এখন আমি।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। এই জীবন এভাবেই বইতে হবে। কিন্তু কদ্দিন? কে জানে। তেস্টা পেয়েছে। জলের পাত্র আঢাকা। জলে কী যেন ভাসছে। ভাসুক।
আহা এ যে ইঁদুরছানা। জলডুবিতে দেহ রেখেছে বেচারা।
হায়! আমার কি তবে ইঁদুরজন্ম!
অমিত মাহাত
ছেঁড়া কাঁথা ও ইঁদুর জীবন
১
ঠান্ডাটা বেশ জাঁকাচ্ছে এইবার। সবে পৌষ। কিন্তু শীতের কামড় বেশ কষ্টকর। তার উপর রোজ রোজ স্নানেও কেন অনীহা বাড়ছে তা ওই কামড়ের ভয়ে। গত রাতে জমে যাচ্ছিল পায়ের নীচের দিকটা। সাহস করে পা মেলতেও ভয় করে। পাছে ছেঁড়া কাঁথার 'ভুলুকে' পা না বেরিয়ে যায়। তাই পা গুটিয়ে যাকে বলে গুটিসুটি। কম্বল খানারও এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে গত শীতেই। আর এবারেও তাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া। কাঁহাতক আর চাপ নেবে।
ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে ধনঞ্জয়ের ফোন এল। ও ঝাড়গ্রাম আসবে। পোস্ট অফিসে ট্রেনিং রয়েছে দুদিন ওর। এবং রাতে হল্ট করবে আমার এখানে।
আমি বেশ চাপে তখন। জমিতে পড়ে রয়েছে পাকা ধান। সেইসব খামারে তোলার কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যে খোলা মাঠে শীতের আদর নিচ্ছি। আর নিজেকে ক্ষয় করছি। যেভাবে চটিজোড়া পাতলা হতে হতে পার করে তার আয়ুকাল। যেভাবে প্যান্টের পেছন পাতলা হতে হতে একসময় তাপ্পিমারা হয়। সেভাবেই আমার তাপ্পিমারা জীবন রক্তাক্ত হতে হতে ভার্চুয়াল সুখের মলম লাগায় ক্ষতস্থলে। এর বেশি তো কিছু নয়। যাহা বাহান্ন তাহাই তিপান্ন।
কষ্টের ভেতরেও সুখ আছে। খুশি আছে। খুঁজে নিতে জানলে তখন অন্যসুখ। বেশ খুশি খুশি লাগে নিজেকে। ধনঞ্জয় বছর পাঁচেক বাদে আসছে তাই একটু বেশিই খুশি। এবং খানিক চিন্তিতও।
চিন্তা এই -কী পাতব বিছানায়? যে কাঁথায় বের করি তা ব্যবহারের অযোগ্য। শীত হয়ত যাবে ঠিকই। ছেঁড়া কাঁথা লুকোব কিসে? মুখ রাখল মায়ের পুরনো কাপড়। কাপড়ের ওয়াড়। কবেকার।
কোন ছোটবেলায় মনটা চলে গেল এক লহমায়। এই কাপড় মা পরত এক সময়। শাল পাতা সেলাইএর শব্দ আর মায়ের মুখ একটা আদল ভেসে আসছে। তখন আমার হাফপ্যান্ট। হয়ত ক্লাস সিক্স। আজ আটাশতম শীতের মাসে জীবনের আঁকিবুঁকি কাটছি ডায়েরির পাতায় পাতায়।
সুতো ছিঁড়ে পড়ছে ছেঁড়া কাঁথার মতোই এই জীবনের। লিখতে বসে রক্তাক্ত হই রোজ।
২
ঘুমোলে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আজকাল। ঘুমের ভেতর পুরনো মৃতজন। কথা বলছে। গল্প জুড়ছে আমার সাথে।
চোখ বুঝলে জ্যাঠামশাই এসে আমার খাটের পাশে এসে বসেন। কথা খুঁজেন জুতসই। যা দিয়ে আমার মন গলানো যাই।
আমার কাঁধে হাত রাখেন। স্পর্শ অনুভব করেন হয় তো। একসময় মৃদু ঝাঁকুনি দেন। এবং সেই চেনা গলা -বুড়ো রে হামার ভাতাটা করি দে বাপ। সত্তর বছর পার করল্যম। আর কদিন বা বাঁচব?
-তুই বাঁচবি জ্যেঠা। কেজোকথার মতো শোনালেও এটাই মন থেকে চাওয়া।
-হারু জাল তো তর বন্ধু। তুই বল না যায়ে। তা বাদে প্রধান বটে। তুই বললে না বলবেক নাই।
-আচ্ছা বলব। আর আমি ত্য পাটি করি নাই। উ কি শুনবেক জ্যেঠা?
-কেনে শুনবেক নাই! তাইলে ভোট দিলম ক্যানে!
তারপর ঘুম ভেঙে গেল। জল খেতে হবে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিছানার চারপাশে নজর বোলালাম। জ্যেঠা তো একটু আগেও বসেছিল খাটের পাশে। এখন নেই। চলে গেলেন। কোথায়? খেয়াল হল। তাঁর চিতাতে অগ্নি সংযোগ করে এসেছি গত পরশু দুপুরে। জ্যেঠার শরীর বিভূতিপ্রাপ্তির মুহূর্তে সংসারের ফেলে দেওয়া ভাঙা কুলোয় কলসি কয়েক জল ঢেলেছি মাত্র। চিতা নেভানো হলে হাঁটু মুড়ে বসে খই অর্পন আর শাল পাতার দোনায় জল খেতে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমার এ মুখ তিনি আর দেখবেন না। বুনো কুল কাঁটা ডিঙিয়ে জীবনের দিকে পা বাড়ালাম। জ্যেঠা রইলেন কুল কাঁটার ওই পারে।
মানুষটা চলে গেলেন। আমি তাঁর কথা রাখতে পারি নি। পারি নি বুড়ো বয়সের একটা অবলম্বন দিতে। বার্ধক্য ভাতা করে দিতে পারলে মানুষটা বেঁচে যেতেন। বুড়ো বয়সের খালিহাত। মৃত্যুর নামান্তর। জ্যেঠাকে তো দেখলাম। এক বুক অপ্রাপ্তি রেখে চিতায় উঠলেন। আমার ও খালি হাত। এদিক ওদিক করে দু পঞ্চাশ আসে হাতে। দুবেলা ভাত আর তেল নুন আমারও লাগে। তিরিশ টাকায় দিন চালানো কি কষ্টের সেটা জ্যেঠা বুঝতেন। এখন আমি।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। এই জীবন এভাবেই বইতে হবে। কিন্তু কদ্দিন? কে জানে। তেস্টা পেয়েছে। জলের পাত্র আঢাকা। জলে কী যেন ভাসছে। ভাসুক।
আহা এ যে ইঁদুরছানা। জলডুবিতে দেহ রেখেছে বেচারা।
হায়! আমার কি তবে ইঁদুরজন্ম!