Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

লিটল ম্যাগাজিন : অন্তর বাহির
____________________
---------------------------------

ঋত্বিক ত্রিপাঠী

পর্ব: এক

লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন 

সব পত্রিকাই লিটল ম্যাগাজিন নয়। অবশ্য, সব লিটল ম্যাগাজিনই পত্রিকা। এই হল এককথায় লিটল ম্যাগাজিনে…


লিটল ম্যাগাজিন : অন্তর বাহির
____________________
---------------------------------

ঋত্বিক ত্রিপাঠী

পর্ব: এক

লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন 

সব পত্রিকাই লিটল ম্যাগাজিন নয়। অবশ্য, সব লিটল ম্যাগাজিনই পত্রিকা। এই হল এককথায় লিটল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞান ও দর্শন।
#
আমি তো অংশ। সমগ্রের সঙ্গে মিশতে চাইছি। এটা বিজ্ঞান। অন্যদিকে, সমগ্রের মধ্যেই আমার অস্তিত্ব। এটাই দর্শন। বিজ্ঞান ও দর্শনকে সমান্তরাল ভাবতে পারলেও ক্ষতি নেই। কারণ, দর্শন তার নিজের গুণেই বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে যাবে। এই যাওয়া বিরোধিতার মধ্য দিয়ে নয়। কিছু বিরোধ যদি থেকে থাকে তবে তা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে।
#
অর্থাৎ, লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই তার নিজের সঙ্গে। আমি কেমন করে বাঁচব-- এই আত্মজিজ্ঞাসা নিয়েই তার পথচলা। অন্যকে অস্বীকার করব না, অন্যের অন্ধ অনুকরণও করব না। আমি আমার মতো বাঁচব। অর্থাৎ নিরপেক্ষতা।
#
নিরপেক্ষতা জন্ম নেয় না। অর্জন করতে হয়। এই অর্জন, সহজ পথে আসে না। রোদ বৃষ্টি বজ্রপাতের মধ্য দিয়েই আসে, যদি চরিত্রটি হাঁটতে থাকে। শুধু পাঠ নয়, শুধু ভ্রমণ নয়, কর্মাত্মক জীবন ও যন্ত্রণা, অক্ষরের সঙ্গে সহবাস--তাকে নিরপেক্ষতার পথ দেখায়। আর চাই, মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তা। এই স্বভাবগুণেই তার মধ্যে জন্ম নেবে অভিমান, অনুরাগ। জীবনকে আরও পাওয়া, প্রাণকে অর্জন। অর্থাৎ জীবনানন্দ।
#
বহু মানুষই তো অনেকরকম বাঁচে, সব মানুষ কি আর তার জীবনকে পায়! নিজেই কি নিজেকে চিনতে পারে! চেনে না, তার কারণ, তার জীবনানন্দ নেই। সে পৃথিবীতে জন্মেও পৃথিবীকে পুরো পায় না। জীবনও তার কাছে অংশ। তবুও সে বেঁচে থাকে! হয়তোবা তার নিজের মতো কোনও ব্যাখ্যা থাকে। আবার সেই কথা : কেমন করে বাঁচব!  আমি আমার জীবনকে কতখানি পেতে চাইব!  কতখানি উদ্যোগী হব আত্ম-আবিষ্কারে!
 #
এই যে আমি,আমার আমার--এ সব আসলে অস্তিত্বের অংশ। কে আমি, কেন আমি! জন্মের আগে কী, পরে কী--এ সব প্রশ্নের স্থির সংজ্ঞা নেই, অথচ সংজ্ঞা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তৈরী হয় আত্মজিজ্ঞাসা। এই আত্মজিজ্ঞাসাই আমাকে আমিত্ব থেকে সরিয়ে রাস্তায় দাঁড় করায়। আমি ফের হাঁটতে থাকি। খুঁজি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ শব্দ অক্ষরের ঘরবাড়ি। দাওয়ায় বসি। ছায়ায় জিরিয়ে নিই। পথে নামি। সঙ্গে ছায়া। বুঝতে পারি ছায়া ও আমি। বিজ্ঞান ও দর্শন। যুক্তি ও তর্ক। ক্রমশ দিগন্ত বেড়ে যায়। জীবনকে পাই আরও বেশি করে।
#
দর্শন সময়কে পুনর্নির্মাণ করে। ঠিক কিংবা ভুল--এমন সরল সমীকরণে সে আটকে নেই। লিটল ম্যাগাজিনের গতিপ্রকৃতিও তাই জটিল নয় অথচ সরল সমীকরণের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়।
#
সূচনাপর্বে সাময়িক পত্রপত্রিকা। পরবর্তী সময়ে নানা উপধারা। বিবর্তনের নিয়মে। তার একটি শাখা এই লিটল ম্যাগাজিন। বিশেষ দর্শনের কারণে সে স্বতন্ত্র।
#
সূচনাপর্বকে বলা যেতেই পারে সাহিত্যের আঁতুড়ঘর। তবে লিটল ম্যাগাজিন প্রমাণ করেছে সে সাহিত্যের আঁতুড়ঘর নয়-- একমাত্র ঘর। যদি শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই ধরি, তাহলে বাণিজ্যিক দশ- বারোটি পত্রিকা, যেখানে সাহিত্য কিছু স্থান পায়, সেখানে বিনোদন মুখ্য। বিনোদনের লক্ষ : জনরুচি। অধিকাংশ পাঠকেরই জন্মগত এক অস্থিরতা ও অবদমিত  কামনাবাসনা থাকে। সেই কামনা-বাসনাকে ধরতেই বাণিজ্যিক পত্রিকা তার মতো পরিকল্পনা করে। হয়তোবা সেও এক দর্শন। তবে সে ক্ষেত্রে দর্শনের চেয়ে বিজ্ঞান গুরুত্ব পায়। তাই সাহিত্যের--শৈশব থেকে যৌবন, যৌবন থেকে আমৃত্যু--সমগ্র জীবনের একমাত্র আশ্রয়স্থল হল লিটল ম্যাগাজিন।
#
সাধারণ ধারণা,  লিটল ম্যাগাজিন মানে-- ক. প্রতিষ্ঠান বিরোধী, ছোট পত্রিকা, যার পুঁজি কম। যে ব্যবসা করে না। লোকসান তার অলংকার। খ. প্রকাশ অনিয়মিত। গ. বিজ্ঞাপন প্রায় থাকবে না। ঘ. লেখককে অর্থ দেবার ক্ষমতা নেই। ঙ. যে কোনও সময় মরে যাবে যাবে করে ধুঁকছে। আকার ক্ষীণ। চ. আত্মমগ্ন লোকটি লেখেন ও পত্রিকা করেন কিন্তু প্রচারবিমুখ। ছ. মূলত সাহিত্য, মূলত কবিতা। বানান ভুলের ত্রুটি মার্জনীয়। কিছু  ছাপারও ভুল। ইত্যাদি ইত্যাদি। অক্ষম সন্তানের প্রতি আমাদের বাবামায়ের স্নেহ-কাতরতা চিরন্তন। অকারণ স্নেহ সন্তানকে ধ্বংসের পথ দেখায়। সন্তান স্নেহের কাছে আত্মসমর্পণ করে। জীবন সংগ্রামে হেরে যায়। হেরে যাওয়া মানুষেরা বেশি করে ব্যাখ্যা তৈরি করেন। অমোঘ বার্তা : লিটল ম্যাগাজিন তো! সুতরাং ক্ষণ-আয়ু। সুতরাং, সাত খুন মাপ।
#
এ সব নেতিবাচক দিক। কোনও দর্শনই নেতির ওপর লালিতপালিত হতে পারে না। আর যদি হয় তবে তাকে চর্চা করে আয়ুক্ষয় করার কী আছে!
#
আমি পুরোপুরি নাস্তিক। আমার কাছে এক জীবন, এক পৃথিবী। যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। জল থেকেই আমাদের প্রাণ। মৃত্যুর পরে পরজন্ম নেই। হয়তোবা লক্ষ লক্ষ সৌর জগৎ আছে। অথচ এক সৌর জগতের অধীন এই আমার সামান্য জীবনকে পেতে চাই ইতিবাচক তথা গঠনমূলক ভাবে। স্বাভাবিক ভাবেই নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার ওপর আমার একমাত্র লোভ। এই লোভে লোভী করে তুলেছে আমাকে একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন।
 #
লিটল শব্দটি ব্যঙ্গ। আমি নিজেই নিজেকে বলছি লিটল। আমি ছোটো। চিরকাল ছোটো। নেতিবাচক শব্দ দিয়েই এই যে আত্মপরিচয়--এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। অনেকে আক্ষরিক মানে করতে গিয়ে ভাবেন বড় কাগজের বিপরীত, অবাণিজ্যিক। তা কিন্তু নয়। প্রতিষ্ঠান তথা বিশেষ কোনও বড় বাণিজ্যিক পত্রিকার বিপরীতে--তা কিন্তু নয়। তা হতে যাবে কেন! তা যদি হয় তো যেদিন জন্ম, সেদিনই মৃত্যু। আসলে, তার লড়াই তার নিজের সঙ্গে। সে প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালায়। তাই সে নবীন, ছোটো। তার বয়স বাড়বে না। নিত্য নতুনের জন্যই সে স্বতন্ত্র। বিশেষ ভাবনা, ধ্যানধারণা, মত, বিশ্বাসে সে বিশ্বাসী হবে না। সে মুক্তমনের, স্বাধীন। বিশেষ ভাবনায় স্থির না থাকলে প্রতিষ্ঠান টেকে না। আর, প্রতিষ্ঠানের ভাবনার যে বদল সে সময়কে ধরবার জন্য। সমকালীন মানুষের, পাঠকের মনকে বুঝতে। লিটল ম্যাগাজিন এসবকে পরোয়া করে না। মনকে গুরুত্ব না দিয়ে মনন, হৃদয়কে ছুঁতে চায়। মেধা ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণে সচেষ্ট হয়। এক কথায় সে সমকালীন বিনোদনে বিশ্বাসী হয়ে পাঠকের চাহিদা পূরণ না করে পাঠককে দীক্ষিত করে তোলে। চিনিয়ে দেয় সঠিক সাহিত্য। কারণ সাহিত্য তো বহুমাত্রিক। বিশেষ ব্যাকরণ-নির্ভরতা গ্রাস করবেই। ব্যাকরণের বাধ্যবাধকতা থাকে না বলেই অল্পপুঁজি থেকেই জন্ম নিতে পারে লিটল ম্যাগাজিন। তবে টিকে থাকতে তাকেও তো তার মতো পরিকল্পনা নিতে হয়। আমি যদি বিশেষ দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে সেই দর্শনের প্রচারক হয়ে উঠতে চাই তবে তো আমাকে টিকে থাকার লড়াইটাও করতে হবে। যাঁদের পরিকল্পনা থাকে না তাঁরা থেমে যান। তাঁরা লিটল ম্যাগাজিনের স্বল্প আয়ুর মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে আসলে নিজেকে আড়াল করেন।
#
আসলে সব মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যা প্রবণতা থাকে। আসলে আয় অনুযায়ী ব্যয় নয়। বেহিসেবি মনোভাব। বেহিসেবি শব্দ ব্যবহারে কবিতা যেমন পাঠকের করুণার পাত্র হয়ে ওঠে, পরিকল্পনাহীন পত্রিকাও সময়ের কাছে অভিযোজন ক্ষমতা হারায়। প্রথমে প্রকাশ অনিয়মিত। তারপর বন্ধ। যদি অন্যভাবে ভাবি! ত্রৈমাসিক হিসাবে যে পত্রিকা শুরু হয় তা যদি প্রথমে বাৎসরিক হয়ে শুরু হয়, তবে ক্ষতি কী! ত্রৈমাসিক হয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা, শেষমেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার থেকে বাৎসরিক আকারে সংরক্ষণযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ শ্রেয়। সামান্য এই পরিকল্পনাটুকু থাকবে না! সন্তান একটি দুটি হোক কিন্তু যোগ্য হয়ে উঠুক।
#
নানা কারণে যোগ্য সন্তানেরও মৃত্যু ঘটতে পারে। সেটা স্বাভাবিক। প্রাকৃতিক। আর কোনও যোগ্য পত্রিকা এগিয়ে এসে তার স্থান পূরণ করবে। মূল্যবান পুরোনো লেখাগুলো নিয়ে হয়তোবা পুনর্বৃত্ত কিংবা পুনর্মুদ্রণ নাম দিয়ে প্রকাশ করতে থাকবে। এই হল অভিযোজন ক্ষমতা। যোগ্যতমের উদ্বর্তন। এখানেই তার জয়। হেরে যাওয়া, নিছক বন্ধ হয়ে যাওয়া, লোকসান ইত্যাদি ইত্যাদি অহংকার হতে পারে, যদি সেই সম্পাদকের লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র প্রসঙ্গে না-ধারণা তৈরি হয়ে থাকে।
 #
তবে কি ধারণা তৈরি করে তবেই এই পথে আসা উচিত! সেটাও অসম্ভব। তরুণী যখন মা হন, তখন আক্ষরিক অর্থে মা, সন্তানকে লালনপালন করতে করতে, সত্তার বিনিময় করতে করতেই হয়ে ওঠেন প্রকৃত মা। সম্পাদকও তেমনি সম্পাদনা করতে করতে, পথ হাঁটতে হাঁটতেই হয়ে ওঠেন প্রকৃত সম্পাদক। একটু একটু করে জন্ম নেবে অনুরাগ। হিংসার বিরুদ্ধে রাগ, বাক স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগ। এই স্বভাব নিয়েই সে খুঁজে পাবে মনের মানুষকে। মনের মানুষদের মধ্যে কেউ হয়তো লেখেন, কেউ পড়েন, কেউবা প্রেসে ডি টি পি করেন।
#
নিরপেক্ষতার খোঁজে লালন-স্বভাব নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের যাত্রাপথ অন্তহীন, ক্লান্তিহীন।
______________________

...............চলবে (চোখ রাখুন প্রতিরবিবার)