প্রেম প্রসঙ্গ
_________
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। টিফিনের সময় ছাত্রীরা সবাই ক্লাশের বাইরে। গৌতম সঞ্চিতার সিটে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকত। কিন্তু কেন! আমাদের সবার কাছে তা বিস্ময়ের।
গৌতম ক্লাশে কখনও প্রথম, কখনও দ্বিতীয়। …
প্রেম প্রসঙ্গ
_________
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। টিফিনের সময় ছাত্রীরা সবাই ক্লাশের বাইরে। গৌতম সঞ্চিতার সিটে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকত। কিন্তু কেন! আমাদের সবার কাছে তা বিস্ময়ের।
গৌতম ক্লাশে কখনও প্রথম, কখনও দ্বিতীয়। সঞ্চিতার রোল পাঁচ। প্রধান শিক্ষকের একমাত্র মেয়ে সঞ্চিতা ছিল ছিপছিপে, তীক্ষ্ণ চোখের। তার স্বতন্ত্রতার দিক এই, সে সবাইকে দেখবে নিখুঁত ভাবে কিন্তু সরাসরি না তাকিয়ে। মূলত এই সব কারণেই সঞ্চিতা আমাদের সবার কাছে দূরের নক্ষত্র সে তার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে যখন মরিয়া, তখন গৌতম ভাঙতে চেয়েছে সব বাধা। অনেক দেরিতে বুঝেছিলাম, ওই সিটটাতে গৌতম সঞ্চিতাকে পেত। এ কী সমাসোক্তি! অবচেতন বস্তুর মধ্যেই গৌতম খুঁজে পেয়েছিল চেতনা! গৌতম কখনও সঞ্চিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। সে শুধু বসবার আসনের স্পর্শে আত্ম-আবিষ্কার করতে চাইত, চাইত নির্লোভ স্বভাবে সঞ্চিতাকে অনুভব করতে।
অন্তরে আগুন। দিনদিন গৌতম একা হয়ে যাচ্ছিল।আমাদের এড়িয়ে যেতে শুরু করলো। "এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি/ দেখয়ে খসায়ে চুলি/ হসিত বয়ানে চাহে মেঘ-পানে / কি কহে দুহাত তুলি"(চণ্ডীদাস)। প্রেমিকা রাধা মেঘ ও চুলের কালোতে খুঁজে পাচ্ছেন প্রেমের আলো। কারণ কৃষ্ণ তাঁর প্রেমিক, যাঁর গায়ের রং কালো। আহা। নিজেই নিজের মনে হাসছেন। আমরা বলতেই পারি, এ-তো ভ্রান্তি, ভ্রম! কিন্তু রাধার একাত্ম স্বভাবের কাছে কিছুতেই পৌঁছতে পারবো না। কেউ কি পারে না! পারে। যারা প্রেমে পড়েছে। সে তো সকলেই আগে পরে কখনও না কখনও প্রেমে পড়েছে! না, তা নয়। বিষয়টি এত সহজ নয়। প্রেমের প্রধান শর্ত হল দূরত্ব। গৌতম ওই বয়সেই বুঝেছিল! একদিন সঞ্চিতার মাসির বিয়ে। হাফ ছুটি নিয়ে মায়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছে সঞ্চিতা। এই পেরুলো স্কুল গেট। তারপর বাম দিকের রাস্তা। সামান্য আঁকাবাঁকা, প্রায় সোজা রাস্তা ধরে চলে যাচ্ছে। বইপত্তর ফেলে, লোকনিন্দাকে তুচ্ছ করে, দূরত্ব বজায় রেখে গৌতমও চলল পিছন পিছন। একটু আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার কোথাও কোথাও জমেছে সামান্য জল। ওই তো কাদা এড়াতে সঞ্চিতা একটু লাফিয়ে আবার স্বাভাবিক হাঁটা দিল। ওই খানে গিয়ে গৌতমও একই ভঙ্গিতে লাফিয়ে পায়ের(সঞ্চিতার) ছাপে পা রেখে খুঁজে পেল নিজেকে। গৃহস্থের শখের লেবুগাছের ডালপালা বেড়া টপকে রাস্তার ওপর এসে পড়েছে। বৃষ্টিস্নাত হয়ে তার শাখাপ্রশাখায় বাজছে আনন্দগান। সঞ্চিতা সেই গানের থেকে সুর তুলে নেয়। বাম হাতের দু'আঙুলে ছিন্ন করে এক সবুজ লেবুপাতা, আর পরক্ষণে আপনমনে ঘূর্ণি করে ছুঁড়ে দেয়। মাথা ঘুরিয়ে অবহেলায় পড়ে থাকে লেবুপাতা। দূর থেকে গৌতম খেয়াল রাখে। ওই জায়গায় গিয়ে খুঁজে খুঁজে যত্ন করে তুলে নেয় ছিন্নপত্র। এভাবেই সারা রাস্তা ধরে গৌতম অনুসরণ করে নিজেকেই। দূরত্ব বজায় রেখে।
এখন প্রশ্ন : গৌতম কি তাহলে তার প্রেমের কথা কখনও সঞ্চিতাকে বলল না! এই প্রশ্ন আমরা করি। কারণ আমরা প্রেমহীনতায় ভুগি। প্রেমের মতো গৌতমরাও জানে দূরত্ব-মাহাত্ম্য। কলঙ্কও দূরত্ব জানে, গৌতমকে ছুঁতে পারে না। কালিদাস রায় লিখেছেন : " ও সব কলঙ্ক নয়, অশ্রুচিহ্ণ, ভক্ত ছিল তারা/ ঢালিয়াছে যুগে যুগে এর পরে প্রেম অশ্রুধারা।"
দূরত্বের সাধনায় গৌতম পুড়ে যাচ্ছিল দাউদাউ আগুনে। পুড়ে ছাই -- স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ। নিজস্ব মেজাজ ও মনোবীজে সে আত্মমগ্ন। সময় ও সমাজ সেদিন গৌতমকে বুঝতে পারেনি। আজও কি আর বোঝে! প্রেম কি তবে সময়ের থেকে এগিয়ে হাঁটে! তুচ্ছ হয় সমাজ! সমাজ জানলো : গৌতম প্রেমে পাগল হয়ে গেছে। প্রেম জানলো : প্রেম বেঁচে আছে। সে অতুলনীয়। তাই ব্যাখ্যাহীন।
------------------