ছবি - গৌতম মাহাতো
উপন্যাস: চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
..................
-কী ভাল হবে না? শরৎ জিজ্ঞাসা করে।
-তারপর আবার বােনকে নিয়ে একপ্রস্থ পড়ল শরৎ।
-তুই এখনাে যাসনি ? আরে তাের বরতাে কালীবুড়াে কেবলে গেলাম। তার এখনাে সময় হলােনা…
ছবি - গৌতম মাহাতো
উপন্যাস: চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
..................
-কী ভাল হবে না? শরৎ জিজ্ঞাসা করে।
-তারপর আবার বােনকে নিয়ে একপ্রস্থ পড়ল শরৎ।
-তুই এখনাে যাসনি ? আরে তাের বরতাে কালীবুড়াে কেবলে গেলাম। তার এখনাে সময় হলােনা? না
আমাকেই নিয়ে আসতে হবে দেখছি। তাের সঙ্গে তার নিকা দিয়ে তবেই আমার নিস্তার।
গােধূলী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলাে। এবার সে রুটি বেলা বেলনি নিয়ে ছুটে
গেল শরৎ এর দিকে।
- তবে রে ?তুই এই শিখে এসছিস এত দিন ধরে।
-ও বৌদিগাে মেরে ফেলল গাে বলে শরৎ লুকালো বৌদির আঁচলের তলায়।
- গােধূলী ওর কান ধরে নিয়ে এলাে।
বলো আর কোনাে দিন এমনি বলবে ?আজ ছাড়লাম।কোনােদিন ..
আবার করব বলেই ছুটে পালাল শরৎ।
-ও চন্দ্রদা ভাল আছেন?
- শরৎ।
-তুমি ?
-আমি ভাল আছি চন্দ্র দা।
- দোতলায় ওরা সবাই গল্প করতে বসল। ওরা বলতে শরৎ, গােধূলী,আর তনিমা। চন্দ্র উপরে দোতলার ঘরে এসেছে। মাঝে মাঝে ওদের কথা
বলার শব্দশােনা যাচ্ছে।
মুনাই পড়তে বসেছে। চন্দ্র ওকে কিছুক্ষণ পড়িয়ে বসে থাকে | খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ওদের চিৎকার শুনতে পেলেই | ওর মন চলে যায়। মুনাই ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। ছােট মেয়ে তো তাছাড়া কাকু এসেছে। চন্দ্র ওকে ছুটি দিয়ে দেয়। মুনাই নীচে নেমে আসে। চন্দ্র খাটের ওপর নিজেকে বিছিয়ে দেয়। একমনে খােলা জানালা দিয়ে—
মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের ভেসে আসা কথা গুলো শুনতে ধাকে চন্দ্র।
- আচ্ছা তনিমা তােমাদের তেলেগু ভাষাতে -"আমি তোমাকে ভালবাসি"।
কী বলে? শরৎ জিজ্ঞাসা করে।
—"নানো মিকু প্রেম ইস্তে নানা"।
- এ আবার কি ধরনের কথা? আচ্ছা তােমাদের ভাষায় , চোখ,
নাক,গলা,মুখ কোমর কে কি বলে?
-তনিমা বলে চলে , চোখ-কন্নু, নাক-মুঙ্কু, গলা বুগ্গো, মুখ- মুকুমু, গলা-কন্টুসু, কোমর-নুডুম, শরৎ হাঁপ ছেড়ে বলে, থাক থাক, ওসব নুডুম ফুডুম আবার কে যােগ করুন।
- আচ্ছা তনিমা সংখ্যাতে এক থেকে দশ অবধি কে তােমাদের ভাষাতে কি বলে?
ওখেটি, রান্ডু , মরু, নালগু, আহিদু, আরু,তরু ইয়ানমাদি, তুমনাদি , পাদি, এক নিঃশ্বাসে বলে বলে ফেলে তনিমা।
- একেবারে পাদি। এত বাজে ভাষা তোমাদের। শরৎ বলে । চন্দ্র মনে মনে ওদের কথা শুনে হেসে ফেলল। ক্রমে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে এলাে। বর্ষা নেমে এলাে। আকাশ ছাপিয়ে সুবর্ণ রেখা
নদীতে ভরপুর যৌবন বয়ে চলতে লাগল ।জীবনের চরম দুঃসময় নেমে এলো চন্দ্রের।
সেদিন সারা দিন ঝিম ঝিম্ বৃষ্টি ঝরছিল আকাশ থেকে। মেঘ গর্জন বিদীর্ন করছিল মাঝে মাঝে। রাত্রি গভীর হতে লাগল। গোধূলীর সঙ্গে ভাল করে কথাই হয় না বললে চলে চন্দ্রের।
কিন্তু সুযােগ আসেনি। মনে মনে ভয় হতে লাগল চন্দ্রের ৷ গােধূলীকে কি পেয়েও হারাব ? অসংখ্য চিন্তায় জট পাকতে থাকে মনের মধ্যে। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে। বাতি নিভে আসে। এক সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায় চন্দ্র। হঠাৎ সামান্য আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় চন্দ্রের সামনে তনিমা দাঁড়িয়ে।
তনিমা তুমি এখানে? এত রাতে? কিছু হয়েছে কারুর ? চন্দ্র জিজ্ঞাসা করে।তনিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখ থেকে যেন বিষম জ্বালা ঝরে পড়ছে?
চন্দ্র কিছু বলার আগেই তনিমা চন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলে আমি তােমায় ভালবাসি চন্দ্র। আমি তােমায় ছাড়া বাঁচবো না? চন্দ্র নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কোন তনিমা? চন্দ্র এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দেয়।
-তুমি যাও এখান থেকে তনিমা ? বেরিয়ে যাও এখান থেকে ? চন্দ্র তনিমার গালে দুটো ঠাস্ ঠাস্ করে চড় কসায়।
-তনিমা রাগে ফুসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
-অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে চন্দ্র খাটের ওপর। যখন চন্দ্র মুখ ওপরে তুলল দেখল গোধূলী দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ওর চোখে জলের ধারা।
-তুমি এত নােংরা চন্দ্রদা ? ছিঃ ছিঃ আমার ভাবতেও অবাক লাগছে।
আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম, আর তা বলার আগেই তুমি তোমার আসল
রূপ দেখিয়ে দিলে?
গোধূলী কোন কথা বলার সুযােগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে?
চন্দ্র হত বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবলো গােধূলী তুমিও আমায় ভুল বুঝলে? এতটুকু বিশ্বাস করলে না? - আমার তো বলার ছিলাে অনেক
কিছু, তাও বলতে দিলে না ? তুমি আমায় পাপী মনে করলে? ঢন্দ্রের চোখে জলের ধারা শ্রাবনের মতাে ঝরে পড়তে লাগল। ওর যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে গোধূলী আমি এসব কিছুই করিনি?
আমি দোষী নই? আমি শুধু যে তোমার? সারা রাত না ঘুমিয়ে খােলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্র। বৃষ্টির ঝাপটা ওর অশান্ত মনকে শান্ত কর চেষ্টা করতে থাকে। | চন্দ্রের বুক থেকে উঠে এলাে সেই দুঃখ মাখা হাসি। গােধূলী ওর দিকে ফিরেও তাকায় নি কয়েক দিন।। বর্ষা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সুবর্ণরেখা নদীতে জল বাড়ছে। আজ অনেক দিনগৃহবন্দী হয়ে রয়েছে চন্দ্র। আজ বৃষ্টিতে ভিজেভিজে বেরিয়ে পড়ল চন্দ্র। অনেক দিন সুখেন মাঝির খোঁজ নেওয়া হয়নি। যাওযার পথে হঠাৎ দেখা হলাে সুখেন মাঝির সঙ্গে।
সে বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম?
কেন বলতো? চন্দ্র জিজ্ঞাসা করে। মােল্লাল গ্রামে বান ঢুকেছে তাই সেখানে যাব বইল্যা।
-চলাে চলাে সুখেনদা আমি যাব। নৌকা নিয়ে চলল অশান্ত নদীর বুক বেয়ে। জলের স্রোত প্রচন্ড, আশেপাশের গ্রামগুলােকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জলের স্রোতে। মাঝে মাঝে জলের ঘূর্ণি যেন মৃত্যুর শীতল পরশ দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই চন্দ্রের। দুর থেকে কাঠের গুঁড়ি প্রবল জলের স্রোতে ভেসে আসছে। বড় বড় চালা ঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্রোতে। একবার ধাক্কা লাগলে ভেঙে ঘুরিয়ে যাবে আমাদের নৌকোখানা।
— বাবু আপনি ধইর্যা রাখেন। আমি হাল ধরছি ভয় নাই।
চন্দ্র মনে মনে হাসল—
-আমার আর কি আছে ? যে হারাবার ভয় করছি ?
সত্যিই কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। চালা ঘরের কুঁড়ের উপর বসে একটি কুকুর। ওরা প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ও অসহায়ভাবে বসে আছে। একসময় হয়ত ও ডুবে যাবে। চন্দ্রের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলাে। ওরা একটু এগােনাের পর দেখতে পেল মরা ছাগল, গরু, মরা মানুষ আরাে কত কি যে ভেসে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। ওরা এসে মােল্লাল গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছল। মােল্লাল গ্রামে কান্নার আওয়াজ শােনা যাচ্ছে। কারাে পুত্র, কারাে বৃদ্ধ মা, বাবা একসঙ্গে প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। ওরা গ্রামে পৌঁছায়। হঠাৎ একটু দূরের ঢিপি দেখতে পেল সেখান থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলছে বিশাল বান আসছে পালাও পালাও। হঠাৎ একটি মেয়ে চিৎকার করে উঠল আমার দুধের বাচ্চাটা ঘরে আছে, ও যে মরে যাবে। ওকে কেউ বাঁচাও বাবু! ওকে কেউ বাঁচাও।
-ওই বিশাল বান আসছে। তােমরা যাও সুখেনদা। আমি বাচ্চা নিয়ে আসছি।
সুখেন চেঁচিয়ে বলতে লাগল,-বাবু যাবেন না ফিরে আসুন। বান আসছে!
বাবু বান আসছে!
চন্দ্র ক্রক্ষেপ না করে এগিয়ে চলল কুঁড়ে ঘরের দিকে। তখন বাচ্চাটা পরম
নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ওকে কোলেতুলে নিল চন্দ্র। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখে বিশাল বান ধেয়ে আসছে ওর দিকে ভয়ঙ্কর রাক্ষসের মতাে। চন্দ্র প্রবল স্রোত আসার সঙ্গে সঙ্গে লাফ মারল অনেক উঁচুতে।
সুখেনদা বাচ্চাটা ধরে। চন্দ্র বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে দিলা উঁচুতে। কিন্তু চন্দ্র ভেসে গেল!
সুখেন চিৎকার করে কাঁদতে লাগল-বাবু! বাবু মশাই! কান্নায় ভেঙে পড়ে.…..….
...……...................
চলবে
উপন্যাস: চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
..................
-কী ভাল হবে না? শরৎ জিজ্ঞাসা করে।
-তারপর আবার বােনকে নিয়ে একপ্রস্থ পড়ল শরৎ।
-তুই এখনাে যাসনি ? আরে তাের বরতাে কালীবুড়াে কেবলে গেলাম। তার এখনাে সময় হলােনা? না
আমাকেই নিয়ে আসতে হবে দেখছি। তাের সঙ্গে তার নিকা দিয়ে তবেই আমার নিস্তার।
গােধূলী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলাে। এবার সে রুটি বেলা বেলনি নিয়ে ছুটে
গেল শরৎ এর দিকে।
- তবে রে ?তুই এই শিখে এসছিস এত দিন ধরে।
-ও বৌদিগাে মেরে ফেলল গাে বলে শরৎ লুকালো বৌদির আঁচলের তলায়।
- গােধূলী ওর কান ধরে নিয়ে এলাে।
বলো আর কোনাে দিন এমনি বলবে ?আজ ছাড়লাম।কোনােদিন ..
আবার করব বলেই ছুটে পালাল শরৎ।
-ও চন্দ্রদা ভাল আছেন?
- শরৎ।
-তুমি ?
-আমি ভাল আছি চন্দ্র দা।
- দোতলায় ওরা সবাই গল্প করতে বসল। ওরা বলতে শরৎ, গােধূলী,আর তনিমা। চন্দ্র উপরে দোতলার ঘরে এসেছে। মাঝে মাঝে ওদের কথা
বলার শব্দশােনা যাচ্ছে।
মুনাই পড়তে বসেছে। চন্দ্র ওকে কিছুক্ষণ পড়িয়ে বসে থাকে | খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ওদের চিৎকার শুনতে পেলেই | ওর মন চলে যায়। মুনাই ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে বারবার। ছােট মেয়ে তো তাছাড়া কাকু এসেছে। চন্দ্র ওকে ছুটি দিয়ে দেয়। মুনাই নীচে নেমে আসে। চন্দ্র খাটের ওপর নিজেকে বিছিয়ে দেয়। একমনে খােলা জানালা দিয়ে—
মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের ভেসে আসা কথা গুলো শুনতে ধাকে চন্দ্র।
- আচ্ছা তনিমা তােমাদের তেলেগু ভাষাতে -"আমি তোমাকে ভালবাসি"।
কী বলে? শরৎ জিজ্ঞাসা করে।
—"নানো মিকু প্রেম ইস্তে নানা"।
- এ আবার কি ধরনের কথা? আচ্ছা তােমাদের ভাষায় , চোখ,
নাক,গলা,মুখ কোমর কে কি বলে?
-তনিমা বলে চলে , চোখ-কন্নু, নাক-মুঙ্কু, গলা বুগ্গো, মুখ- মুকুমু, গলা-কন্টুসু, কোমর-নুডুম, শরৎ হাঁপ ছেড়ে বলে, থাক থাক, ওসব নুডুম ফুডুম আবার কে যােগ করুন।
- আচ্ছা তনিমা সংখ্যাতে এক থেকে দশ অবধি কে তােমাদের ভাষাতে কি বলে?
ওখেটি, রান্ডু , মরু, নালগু, আহিদু, আরু,তরু ইয়ানমাদি, তুমনাদি , পাদি, এক নিঃশ্বাসে বলে বলে ফেলে তনিমা।
- একেবারে পাদি। এত বাজে ভাষা তোমাদের। শরৎ বলে । চন্দ্র মনে মনে ওদের কথা শুনে হেসে ফেলল। ক্রমে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে এলাে। বর্ষা নেমে এলাে। আকাশ ছাপিয়ে সুবর্ণ রেখা
নদীতে ভরপুর যৌবন বয়ে চলতে লাগল ।জীবনের চরম দুঃসময় নেমে এলো চন্দ্রের।
সেদিন সারা দিন ঝিম ঝিম্ বৃষ্টি ঝরছিল আকাশ থেকে। মেঘ গর্জন বিদীর্ন করছিল মাঝে মাঝে। রাত্রি গভীর হতে লাগল। গোধূলীর সঙ্গে ভাল করে কথাই হয় না বললে চলে চন্দ্রের।
কিন্তু সুযােগ আসেনি। মনে মনে ভয় হতে লাগল চন্দ্রের ৷ গােধূলীকে কি পেয়েও হারাব ? অসংখ্য চিন্তায় জট পাকতে থাকে মনের মধ্যে। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে। বাতি নিভে আসে। এক সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায় চন্দ্র। হঠাৎ সামান্য আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় চন্দ্রের সামনে তনিমা দাঁড়িয়ে।
তনিমা তুমি এখানে? এত রাতে? কিছু হয়েছে কারুর ? চন্দ্র জিজ্ঞাসা করে।তনিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ওর চোখ থেকে যেন বিষম জ্বালা ঝরে পড়ছে?
চন্দ্র কিছু বলার আগেই তনিমা চন্দ্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলে আমি তােমায় ভালবাসি চন্দ্র। আমি তােমায় ছাড়া বাঁচবো না? চন্দ্র নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কোন তনিমা? চন্দ্র এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দেয়।
-তুমি যাও এখান থেকে তনিমা ? বেরিয়ে যাও এখান থেকে ? চন্দ্র তনিমার গালে দুটো ঠাস্ ঠাস্ করে চড় কসায়।
-তনিমা রাগে ফুসতে ফুঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
-অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে চন্দ্র খাটের ওপর। যখন চন্দ্র মুখ ওপরে তুলল দেখল গোধূলী দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ওর চোখে জলের ধারা।
-তুমি এত নােংরা চন্দ্রদা ? ছিঃ ছিঃ আমার ভাবতেও অবাক লাগছে।
আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম, আর তা বলার আগেই তুমি তোমার আসল
রূপ দেখিয়ে দিলে?
গোধূলী কোন কথা বলার সুযােগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে?
চন্দ্র হত বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবলো গােধূলী তুমিও আমায় ভুল বুঝলে? এতটুকু বিশ্বাস করলে না? - আমার তো বলার ছিলাে অনেক
কিছু, তাও বলতে দিলে না ? তুমি আমায় পাপী মনে করলে? ঢন্দ্রের চোখে জলের ধারা শ্রাবনের মতাে ঝরে পড়তে লাগল। ওর যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে গোধূলী আমি এসব কিছুই করিনি?
আমি দোষী নই? আমি শুধু যে তোমার? সারা রাত না ঘুমিয়ে খােলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে চন্দ্র। বৃষ্টির ঝাপটা ওর অশান্ত মনকে শান্ত কর চেষ্টা করতে থাকে। | চন্দ্রের বুক থেকে উঠে এলাে সেই দুঃখ মাখা হাসি। গােধূলী ওর দিকে ফিরেও তাকায় নি কয়েক দিন।। বর্ষা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সুবর্ণরেখা নদীতে জল বাড়ছে। আজ অনেক দিনগৃহবন্দী হয়ে রয়েছে চন্দ্র। আজ বৃষ্টিতে ভিজেভিজে বেরিয়ে পড়ল চন্দ্র। অনেক দিন সুখেন মাঝির খোঁজ নেওয়া হয়নি। যাওযার পথে হঠাৎ দেখা হলাে সুখেন মাঝির সঙ্গে।
সে বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম?
কেন বলতো? চন্দ্র জিজ্ঞাসা করে। মােল্লাল গ্রামে বান ঢুকেছে তাই সেখানে যাব বইল্যা।
-চলাে চলাে সুখেনদা আমি যাব। নৌকা নিয়ে চলল অশান্ত নদীর বুক বেয়ে। জলের স্রোত প্রচন্ড, আশেপাশের গ্রামগুলােকেও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জলের স্রোতে। মাঝে মাঝে জলের ঘূর্ণি যেন মৃত্যুর শীতল পরশ দিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই চন্দ্রের। দুর থেকে কাঠের গুঁড়ি প্রবল জলের স্রোতে ভেসে আসছে। বড় বড় চালা ঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্রোতে। একবার ধাক্কা লাগলে ভেঙে ঘুরিয়ে যাবে আমাদের নৌকোখানা।
— বাবু আপনি ধইর্যা রাখেন। আমি হাল ধরছি ভয় নাই।
চন্দ্র মনে মনে হাসল—
-আমার আর কি আছে ? যে হারাবার ভয় করছি ?
সত্যিই কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। চালা ঘরের কুঁড়ের উপর বসে একটি কুকুর। ওরা প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ও অসহায়ভাবে বসে আছে। একসময় হয়ত ও ডুবে যাবে। চন্দ্রের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলাে। ওরা একটু এগােনাের পর দেখতে পেল মরা ছাগল, গরু, মরা মানুষ আরাে কত কি যে ভেসে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। ওরা এসে মােল্লাল গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছল। মােল্লাল গ্রামে কান্নার আওয়াজ শােনা যাচ্ছে। কারাে পুত্র, কারাে বৃদ্ধ মা, বাবা একসঙ্গে প্রবল স্রোতে ভেসে গেছে। ওরা গ্রামে পৌঁছায়। হঠাৎ একটু দূরের ঢিপি দেখতে পেল সেখান থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলছে বিশাল বান আসছে পালাও পালাও। হঠাৎ একটি মেয়ে চিৎকার করে উঠল আমার দুধের বাচ্চাটা ঘরে আছে, ও যে মরে যাবে। ওকে কেউ বাঁচাও বাবু! ওকে কেউ বাঁচাও।
-ওই বিশাল বান আসছে। তােমরা যাও সুখেনদা। আমি বাচ্চা নিয়ে আসছি।
সুখেন চেঁচিয়ে বলতে লাগল,-বাবু যাবেন না ফিরে আসুন। বান আসছে!
বাবু বান আসছে!
চন্দ্র ক্রক্ষেপ না করে এগিয়ে চলল কুঁড়ে ঘরের দিকে। তখন বাচ্চাটা পরম
নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ওকে কোলেতুলে নিল চন্দ্র। বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখে বিশাল বান ধেয়ে আসছে ওর দিকে ভয়ঙ্কর রাক্ষসের মতাে। চন্দ্র প্রবল স্রোত আসার সঙ্গে সঙ্গে লাফ মারল অনেক উঁচুতে।
সুখেনদা বাচ্চাটা ধরে। চন্দ্র বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে দিলা উঁচুতে। কিন্তু চন্দ্র ভেসে গেল!
সুখেন চিৎকার করে কাঁদতে লাগল-বাবু! বাবু মশাই! কান্নায় ভেঙে পড়ে.…..….
...……...................
চলবে