শাল পাতার ডায়েরি ঃ নয়
কুটুমবাড়ি, মথুরাপুর ঃ ১
বড় মামী বললেন- ভাগ্না আসেছ্য যেখন টুকু কাজ করঅ।
--কী কাজ? জিজ্ঞেস করায় মামী ফের বললেন '- তেমন কনঅ নাই। বুড়ো দা'র সাথে টুকু গীতাদের ঘর যাত্যে হবেক। অদের দিগে বাজার হাট বন্…
শাল পাতার ডায়েরি ঃ নয়
কুটুমবাড়ি, মথুরাপুর ঃ ১
বড় মামী বললেন- ভাগ্না আসেছ্য যেখন টুকু কাজ করঅ।
--কী কাজ? জিজ্ঞেস করায় মামী ফের বললেন '- তেমন কনঅ নাই। বুড়ো দা'র সাথে টুকু গীতাদের ঘর যাত্যে হবেক। অদের দিগে বাজার হাট বন্ধ। তাই এক বস্তা মতন আলু দুজনে ভাগাভাগি করে পঁহুচায় আসব্যে।
--অ। এই কাজ।
বলে নিজেই আলুবস্তা আধা আধি করে দুজনার দুটি সাইকেলে ক্যারিয়ারে লাদালাদি কাজ একপ্রকার শেষ। এবার টিউব দড়ি তে আচ্ছাসে খিচে টান দিয়েদ রেখে মনকে বোঝাই -চাঁদি!যাত্যে ত খচখচি। উধার লে ঘুর্যে পারবিস তঅ?
বুড়ো দা আমার মামাতো দাদা। এখন চলেছি তরকারি পৌঁছাতে। হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগে জমিনের ভেঁড়ি। পুঁইশাক। ফুটবল সাইজের কুমড়া। চাষের মুসুরি ডাল। পাই'ট্যাক। আরও হ্যানাত্যানা।
ধরমপুরে বুক ঢিবঢিব। বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে নিই। ভোটার কার্ড টি। দশ বারো জনের কীর্তন দল তো নই। আমরা চলেছি দুজন। পেছনে আলুবস্তা।
এবার লাল মোরাম রাস্তা ধরলাম। যৌথ বাহিনী। হাতের ইশারায় সাইকেল থেকে নেমে যেতে বলল। রাস্তা কাঁটাতারে মোড়া। তারে ঝুলছে বিয়ারের খালি বোতল। কাচের শিশি। যেভাবে অনুষ্ঠানে ফুল ঝোলানো হয়। ঠিক সেই রকম ভাবে ঝুলছে মদের বোতল। এক দুই করে গোটা পঞ্চাশ বোতল গোনা যায় এই ঘেরাটোপ পেরতে গিয়ে। দিব্বি পেরিয়ে গেলাম। যাক প্রশ্নের মুখে পড়তে হলেই হয়ে যেত। যেখানে যৌথ বাহিনী তাঁবু গেড়েছে। সেটা এর আগে ছিল গ্রামীণ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র। কোনও এক সময় হয়ত চিকিৎসা পরিষেবা পেত মানুষ। এখন সেসব বন্ধ। বাহিনী মদের বোতল ঝুলিয়ে বন্দুক তাক করে রেখেছে রাস্তার দিকে।
লাল মোরামের রাস্তায়। তেমন জনপ্রাণী নেই। আমরা দুজন ছাড়া। শুরু হল পটাশ বাগান। ডানদিকে মাঠের রাস্তা ধরলাম। বাঁদিকের মোরাম ধরেও যাওয়া যায়। যেতে হবে গোটাটাই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। এটিই লক্ষনপুরের জঙ্গল। লক্ষনপুর, হদহদি, বক্সিবাঁধ, হাতিলোট হয়ে ভীমপুরে পিচে শেষ এই পথ। আমরা জঙ্গলের পথ ছেড়ে মাঠের ভেতর ইউক্যলি পটাস ভেলাবনের ভেতর হয়ে কাঁকড়াদাড়ার বাঁকে বাঁদিকে বাঁধের পথ ধরলাম। ডানদিকে রইল কাঁকড়দাড়া। বাঁধের শেষ। গ্রামের শুরু। আজনাশুলি।
দুটি মেয়ে সেন্ট্রি দিচ্ছিল গ্রামের মাঝামাঝি। তার আগে চোখে পড়ল কয়েকটি ঘর। তালাচাবি বন্ধ। টালিভাঙ্গা। এসবেস্টস টিন ভেঙে ফেলা হয়েছে। কেউ না বললেও বুঝে গেলাম এইসব ভাঙা ঘরগুলো ছিল লাল পার্টির নেতাকর্মীদের। ঘরছাড়াদের ঘর।
আমাদের পথ আটকাল মেয়ে দুটি। দুজনের হাতেই দেশি বন্দুক। একজনের মুখ গামছায় ঢাকা। সাধারণ ঘরের পোশাকে সজ্জিত মেয়ে দুটো।বুঝলাম। এরাই মাও স্কোয়াড সদস্যা।
প্রথম মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
--জামবনী।
--জামবনীর খবর কেমন?
এর উত্তরে কী বলা যায়! তবু বলতে হল ভালো। অন্য মেয়েটি এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ফের -জামবনীর সংগঠন কেমন? কাজ ঠিকঠাক করছে?
--হুম। ঠিকঠাক।
আমাকে ছেড়ে এবার বুড়ো দাকে জেরা শুরু করে।
--এদিকে কোথায় যাবে?
--মথুরাপুর।
--কাদের বাড়ি? উত্তম? তুই তো শালা কুটুম!
উত্তমের শালা কুটুম হল বুড়ো দা। উত্তম কমিটির সক্রিয় নেতা। মাস খানেক আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তিন দিন নিখোঁজ করে রেখেছিল পুলিশ। থানার লকাপে ঢোকায় নি। কোর্টে তুলে নি। মানুষটা গেল কোথায়? চতুর্থ দিনের দিন তোলা হল মেদিনীপুর কোর্টে। নাশকতার ছক কষতে গিয়ে ধরা পড়েছে সে। এমনই অভিযোগ খাড়া করে পুরে দেওয়া হল গারদে। এখন ঠিকানা মেদিনীপুর জেল। আসলে সেদিন উত্তম গিয়েছিল ভীমপুর। তরিতরকারি বাজারহাটে। তারপর আর ফেরেনি।
আজনাশুলি ছাড়িয়ে ফের জঙ্গলের পথ। শাল। কেঁদ। মহুল। ক্যানেল এর পথ ধরে সাইকেল ছুটছে আমাদের। বাঁদিকে ফেলে রাখলাম। বক্সিবাঁধ। এখানে মাঝেমাঝেই বাহিনী আর মাওদের গুলির লড়াই চলে। হঠাৎ হঠাৎ ঘিরে ফেলে গোলাগুলি চলে। রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। না জানি। কী লেখা রয়েছে ভবিতব্যে আমাদের। অবশ্য যৌথবাহিনীর টহলদারি থাকলে আজনাশুলি নিশ্চয় সাবধান করে দিতে। শুধু গামছায় মুখ ঢাকা মেয়েটি বলেছিল। ক্যানেল এর রাস্তা সাবধানে। দুদিকে নজর চালাতে চালাতে এগোবে। তবে ভয়ের কিছু নাই।
ভয়ের কিছু নেই তো এত ভয় পাচ্ছি কেন? আর জঙ্গল যেন বেড়েই চলেছে। ফুরোতে চাইছেনা। এমন সময়ে চ্যার চ্যার করে উঠল পেছনের চাকা। জঙ্গলের অদ্ভুত নির্জনতা খান খান হয়ে গেল। এই চ্যার চ্যার শব্দে। শুকনো শাল ঝাঁটি সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়েছে চাকায়। তারই চ্যার চ্যার। খ্যার খ্যার।
বুড়ো দা একমনে সাইকেল চালিয়ে চলেছে। আমার চাকার শব্দে তার যেন কোনও মাথা ব্যথা নেই। জানি না। কীভাবছে সে। অগত্যা আমাকে দাঁড়াতে হল। না দাঁড়িয়ে উপায় কি। যা শব্দ জুড়েছে। বনের ভিতরের অন্য আওয়াজ যা বিপদ বাড়াতে পারে এমন। আওয়াজ কানে সিঁধাবে ক্যানে।
ক্যানেল ব্রিজ। ওই গাঁ দেখা যাচ্ছে। মথুরাপুর।
বুড়ো দা বাঁদিকের একটি বাড়ির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল -অই অইটা। জহর দার ঘর।
জহর মাহাত। সেবার মথুরাপুর যখন ঘিরে ফেলল।পুলিশ আর বাহিনী মিলে। গাঁয়ের বাকি পুরুষেরা পালালেও জহর পালাতে পারেনি। শেষে আনাজ চাষের ঢড়রা কুয়ায় শালপালা ঢাকা নিয়ে চুপটি করে বসে পড়ে সে। বাহিনীর একজনের নজরে পড়ে যাওয়ায় জহর ধরা পড়ে যায়। তারপর সে কি মার। রামেশ্বরপুর চক থেকে পিঁড়রাকুলি অব্দি তাকে মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় যৌথবাহিনী। গুলি লেগে ঘায়েল মাওবাদিদের চিকিৎসা আর ঔষধ পাতি সরবরাহ করত জহর মাহাত।
চারদিকে জঙ্গল হওয়ায় মাওবাদীদের ঘাঁটির উপযুক্ত গ্রাম এই মথুরাপুর। যে গ্রামে সবে পা রেখেছি।