শাল পাতার ডায়েরি ঃ দশ
.........................................
কুটুমবাড়ি, মথুরাপুর ঃ২
অমিত মাহাতো
রামেশ্বরপুর চকে তখন আসতে শুরু করেছে নানা লোক। নানা উদ্দেশ্যে। লাল মোরাম আর কাঁকুরে মাটি। মাটির টান। নাড়ির টান। চেনা লোকও ভয়ংকর লা…
শাল পাতার ডায়েরি ঃ দশ
.........................................
কুটুমবাড়ি, মথুরাপুর ঃ২
অমিত মাহাতো
রামেশ্বরপুর চকে তখন আসতে শুরু করেছে নানা লোক। নানা উদ্দেশ্যে। লাল মোরাম আর কাঁকুরে মাটি। মাটির টান। নাড়ির টান। চেনা লোকও ভয়ংকর লাগে এই মাটিতে।
চকের একটি ঘরে। শিশি বোতুল। ওষুধ। তুলা। ব্যান্ডেজ। একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। চালায় কমিটি। মথুরাপুরের জহর একসময় সামলাত। এটি। এখন তালাচাবি পড়ে গেছে। পড়বে নাই বা কেন। জহর তো জেল খাটছে। গাঁয়ে তার জিনিষ আর সামলায় কে।
ছত্তিশগড়ে অপারেশন গ্রিন হাণ্ট শুরু হওয়ায় প্রচুর সাধারণের অসুবিধে হতে থাকে। সরকারি ন্যুনতম পরিষেবা নেই সেখানে। জঙ্গলের ভেতরের গ্রামগুলোয় শুরু হয় জনতনা সরকার। জনগনের সরকার। গ্রামীণ যা কিছু দরকার বাঁচতে গেলে। তা জোগান দিত এই জনাতনা সরকার। এটি চালাত মাওবাদীরা। ঠিক সেই একইরকম ভাবে জঙ্গল মহলের গ্রামগুলোয় ক্লাবঘর ব্যবহার করে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। এটি তখন চালাচ্ছিল জনগনের কমিটি। খুব অবাক করার মতো ব্যাপার। যেখানে মাওবাদী আর যৌথবাহিনীর গুলির লড়াই চলছে। প্রত্যেকদিনের রুটিন অনুযায়ী। তার আসেপাশে গ্রামগুলোয় গড়ে উঠছে এই ওষুধ। তুলা। ব্যান্ডেজ। ডিসপেনসারি।
রামেশ্বরপুরেও অনুরূপ ডিসপেনসারি। অবাক করার মতো ঘটনাটি শুনলাম। মথুরাপুর এসে। গনমিলিশিয়ার ছেলেদের প্রত্যেক রাতেই তুলা ব্যান্ডেজ দরকার পড়ে । প্রত্যেকদিনই ছেলেদের কেউ না কেউ জখম হওয়ার খবর শোনা যেত। তখন ডেটল মলম আর ব্যথা নিরোধক ওষুধ নিয়ে হাওয়া হয়ে যেত জহর মাহাত। সন্ধের পরে তাকে আর এলাকায় দেখা যেত না। মাওবাদীদের প্রথম সারির তেমন কেউ গুলি খেয়েছে বা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। এমন খবর মথুরাপুর বা রামেশ্বরপুরের কেউ কখনও শোনে নি।
পিঁড়রাকুলি হয়ে কিছু হুটকো লোক ঢুকে যেত হাতিলোট কিংবা কৈমার গ্রামগুলোতে। মাঝেমাঝে চকের কাছাকাছি অচেনা কেউ ঘুরঘুর করলে সন্দেহ দানা বাঁধত। তাই তো লোকটা কে? যাও তো বাপ ধরে লিয়ে আয়।
কথাবার্তায় অসংলগ্নতা প্রকাশ পেলেই হয়ে যেত। তার ইহলীলা খতম। ব্যাটা ফেউ একটা। পুলিশের চর। রাতের অন্ধকারে বুকে ঠেসে ধরেই একটা চাপ ট্রিগারে। খেল খতম। লক্ষণপুরের জঙ্গলে পুঁতে ফেলা হত চরের লাশগুলো। একটি দুটি নয়। এমন অনেক পুলিশের চর শুয়ে আছে। মাটিচাপা।
গীতাদি'র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। কান শুনতে চাইত না। এইসব ঘটনা বুকের কোথায় যেন ঘা দিত। তীব্র মোচড় তুলত। ফিনকির মতো রক্তক্ষরণ। ব্যথা।
বিকেলে চকের দিকে বুড়োদা আর আমি বেরব। গীতাদি ডেকে সাবধান করে দিল আমাকে। কারও সাথে বেফাঁস কিছু যাতে না কথা না বলি। স্পর্শকাতর বিষয়ে চুপচাপ থাকো। কানে শোনো। একটির বেশি দুটি কথা যেন না বলি। আগ বাড়িয়ে তো নয়ই। হুঁম। হাঁ করে কাটিয়ে যেও।
এই চকটি সত্যিই বিপদজনক। এদিক ওদিক থেকে নাম্বারহীন পুরনো মোটর বাইক। চকে এসে দাঁড়াচ্ছে। কালো কোঁদানো চেহারা। কাঁধে দেশি বন্দুক। ঘাড়ে গামছা। এই দৃশ্য চোখে হজম করা মুশকিল। বুড়ো দা চিনিয়ে দিচ্ছিল একে একে। এই চকে গাড়রা গ্রামের একটি লাশ শোয়ানো হয়েছিল। গন আদালত বসেছিল ওই দিকে সামনের মাঠটিতে। ব্যক্তিগত রাগ আর শত্রুতা থেকেও অনেক খুনোখুনি হয়েছে এইসব জায়গায়। যেটা হয়েছে। আলতার বিক্রি বেড়েছে। সাদা কাগজে এবড়োখেবড়ো লেখা। সি পি আই (মাওবাদী)।
একটি ছেলে হাতের ইশারায় আমাদের ডেকে নিল। বন্ধ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটি খোলা হয়েছে। চটি খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কালো ত্রিপল বিছানো। একটি ভাঙা চেয়ার। কাঠের টেবিল। কিছু তুলা। ব্যান্ডেজ তার উপর। লাঠিসোটা। কাঁড়। কাঁড়বাশ এইসব ধুতির পাড়ে বেঁধে ঝোলানো ধন্নায়। দাঁতিয়ায়।
উত্তমের আত্মীয় শালাকুটুম হওয়ায় সুবিধে হল বিশেষ আপ্যায়ন এর। এই গরম চা জল। পেঁয়াজি। এইসব আসতে লাগল। আমরাও চুপচাপ কামড় বসালুম। তেলেভাজা। অবশ্য আত্মীয়বাড়ি এসেছি ভালোকথা। যা সব দেখলাম। বা শুনলাম। তা যেন এ গ্রাম ছাড়ার আগেই ফেলে যেতে হবে। কিছুই নিয়ে যাওয়া যাবে না। পথে বাহিনী বা পুলিশের কেউ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যেতে হবে। এইসব বাতেলা দিল একটি ছেলে। কন্যবালি না কোনগাঁয়ে তার ঘর। এখন এইসব করে বেড়ায়। আমার ভালো লাগে নি ছেলেটির এই ধরনের কথাবার্তা। হুমকির মতো কানে পিড়পিড় করছিল ছেলেটির বাতেলা।
--কে রে ছেলেটা? মনে এই প্রশ্ন এলেও চুপচাপ গুটিয়ে রইলাম। আরও চুপচাপ হল রামেশ্বরপুর চক। বিকেল ফুরোল। সন্ধ্যের হালকা আবছা অন্ধকার লাল মোরামের রাস্তা কালো হয়ে আসছিল তখন। আমরাও মথুরাপুরের রাস্তায় হাঁটা দিলাম।
এখন রাতে যদি বাহিনী ঘিরে ফেলে? আশু কাজ কী! গীতা দি অবশ্য অভয় দিল। ভয়ের কিছু নাই কো। রাতে পুলিশ বা যৌথবাহিনী এ গাঁয়ে কেন। জঙ্গলের কোনও অংশেই পা রাখে না। প্রাণের ভয় সবারই রয়েছে। ওরাও তো পেটের তাগিদেই ঘর পরিবার ছেড়ে জঙ্গল ক্যাম্প করেছে। মাওবাদ সব সময় একটি সরকারের বিরোধিতা করে। সাধারণ গাঁয়ের মানুষকে দেশদ্রোহী বানাতেই জঙ্গলের গ্রামগুলোয় মাওবাদীরা যেন ঠিকা নিয়ে রেখেছে। খুউব খারাপ লাগে। শহরের কিছু বুদ্ধিজীবী, পাতি অধ্যাপক মাওবাদের হয়ে সাফাই সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। উল্টে ওই মানুষেরা কখনওই জঙ্গলের গাঁ ঘরে কিসে প্রকৃত ভালো হয় সেই চেষ্টা তো করেই না। উল্টে জহর মাহাতো, বিকাশ শশধরদের ভাই আর ভাইপোদের দেশদ্রোহী কীভাবে বানানো উঠে পড়ে লাগে। মাওবাদের পিঠ চাপড়ায়।
গীতাদি রাতের বেলা কানের পাশে ফিসফিস গলায় জানাল '-আর না ভাই। ইবার হাওয়া লে। কাইল সকাল সকাল চলে যা।
--ক্যানে?
--বিপদ বাড়বেক। বাইরের কেউ হলে বেশি জ্বালা। ধরলেই তুই তখন মাওবাদী নেতা।