Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

নারীদের স্বপ্নতরীর দৈনিক সেরা লেখোনি

* বিচ্ছেদ *
--- রাফিয়া সুলতানা
17.04.20

দেশটা হলো বাংলাদেশ। তবে তখন ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে ঢাকা শহরের কাছে জয়পাড়া নামক গ্রামে ছিলো সম্ভ্রান্ত একটি হিন্দু পরিবারের বাস। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা দুই পারেই ছিলো তাদের কাপড়ে…


* বিচ্ছেদ *
--- রাফিয়া সুলতানা
17.04.20

দেশটা হলো বাংলাদেশ। তবে তখন ছিলো পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে ঢাকা শহরের কাছে জয়পাড়া নামক গ্রামে ছিলো সম্ভ্রান্ত একটি হিন্দু পরিবারের বাস। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা দুই পারেই ছিলো তাদের কাপড়ের রমরমা ব্যবসা। সেই পরিবারে গৌরীর জন্ম। তার নামটি যেমন মিষ্টি, দেখতেও তেমনই সুশ্রী সে। আর তেমনই সুন্দর ছিলো তার গানের গলা। সেদিন পাড়ার ক্লাবের অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলো গৌরী। সবাই খুব প্রশংসা করেছিলো। তবে একজনের প্রশংসা তার মনে দাগ কেটেছিলো খুবই। নাম তার আকবর।  আকবর সেদিন তার পিঠে আলতো করে সস্নেহে একটি টোকা দিয়ে বলেছিলো--বাহ! এতো সুন্দর গান গাইতে পারিস তুই! চালিয়ে যা! দেখিস, একদিন খুব নাম করবি !
কিশোরী মনে যেন খুশির তুফান উঠেছিলো সেদিন তার সেই কথাগুলো শুনে! কেমন যেন অভিভূত হয়ে পড়েছিলো গৌরী ! সেকি অনুরাগের অনুভূতি? এতদিন তো সে চিনতো না তাকে! তবে? পরে অবশ্য জেনেছিলো, আকবর তার দাদারই পরিচিত একজন, বন্ধুরই মত।

 গৌরীর বই পড়ারও খুব নেশা ছিলো। আর তাই জন্য প্রায় সে দাদার আলমারি ঘাঁটাঘাটি করে বইয়ের থাক সব ওলোট পালোট করে দিতো। দাদার কাছে মাঝে মধ্য ধমকও খেতে হতো সেই কারণে। একদিন আলমারিতে সে নতুন একটা ম্যাগাজিনের দেখা পেলো। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখে পড়লো ছোট্ট একটা গল্প। দাদার সেই বন্ধু আকবরেরই লেখা। ভারি ভালো লাগলো পড়ে।তারপর, দেখতে পেলো, পাশে আরও কয়েকটা ম্যাগাজিন। সবক'টি পাড়ার ক্লাব কতৃক প্রকাশিত। সে তাড়াতাড়ি পাতা উল্টে সেগুলো পরখ করতে লাগলো। সেখানে আকবরের আরও দু-একটা লেখার সন্ধান পেলো সে। চুপ করে সেগুলো নিয়ে এসে বালিসের নীচে লুকিয়ে রাখলো। তারপর একে একে পড়ে ফেললো সব। প্রতিটা লেখা তার এতো ভালো লাগলো, যে সে এক প্রকার আকবরের অনুরাগীই হয়ে পড়লো।

দুচারটে বাড়ি পেরিয়েই থাকতো লুৎফা পিসী।আকবরের দুরসম্পর্কের দিদি ছিলেন তিনি। লক্ষী পুজোর সময় তিনি বলে যেতেন গৌরীর মাকে, আমার লগে বেশি কইরা নাড়ু বানাবা! ঘরে তুইলা রাখুম। কাজের ফাঁকে বড্ড খিদা লাগে! তখন একটা কইরা খামু।
মাও বেশি করে নারকেলের আর তিলের নাড়ু বানিয়ে  পিসীর জন্য কৌটোয় ভরে  গৌরীকে বলতো, যা দিয়ে আয় লুৎফা পিসীর বাড়ি।

শবেবরাতে পিসীর বানানো হালুয়া রুটি বড় প্রিয় ছিলো তাদের সকলের। ঈদের দিনতো সারা দিনের দাওয়াত থাকতো সেখানে। পিসীর এক মেয়ে নিলুফা খুব বন্ধু ছিলো গৌরীর। সরস্বতী পুজোর দিন দুজনে মিলে শাড়ি পরে একসঙ্গে স্কুলে যেতো।

সেদিন পিসীর বাড়িতে দেখা হলো আকবরের সঙ্গে। গৌরী আর দেরি না ক'রে সেই সুযোগে জানিয়েই দিলো তার গল্পের প্রতি নিজের ভালোলাগার কথা। জানালো, আরো লেখা পড়তে চায় সে। এবারে কিছু লিখলে, তাকে যেন আগেই দেখানো হয়। গৌরীর লজ্জা জড়ানো সেই আবদারে, একটু খানি হাসলো আকবর। বললো, বেশ, তাই হবে! গৌরীর অনুরাগের ছোঁয়া যেন আলতো ভাবে স্পর্শ ক'রে গেলো তাকে!

সত্যি সত্যিই এরপর থেকে নতুন কিছু লিখলেই, আগেই তা পাঠিয়ে দিতো আকবর গৌরীর কাছে নিলুফার মাধ্যমে, তার মতামত জানতে।  গৌরীও অকুণ্ঠ প্রশংসা করতো সেগুলোর একটা ক'রে ছোট্ট চিঠি লিখে । ভারি তৃপ্ত হতো আকবর সেগুলি পড়ে।সেও উত্তর দিতো দুচার লাইন লিখে,একটা চিরকুটে। এমনি করে ,কবে যে তিল তিল ক'রে দুজনে আবদ্ধ হয়ে গেলো এক- নিষ্পাপ নিবিড় ভালোবাসার বন্ধনে, টেরও পেলো না।

সেদিন আকবরের দাদুর পারলৌকিক ক্রিয়া ছিলো। সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলো গৌরীও। রাতের বেলায় বাড়ি ফিরতে দিলো না বন্ধু নিলুফা ও আকবরের দিদি এবং বোনেরা। মনে মনে ভয় পেলো গৌরী। বললো, না ফিরলে বাড়িতে বকবে। ধমক দিয়ে বললো রাবেয়া,আকবরের দিদি--কেন বকবে? আমরা কি পর? আমি নাহয় পৌঁছে দেবো তোকে। নিলুফাও নাছোড়বান্দা। থাক না। খুব মজা করবো সবাই! সত্যি খুব মজা হলো! অনেক রাত পর্যন্ত হৈ হৈ করলো সকলে। একবার রাবেয়া তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললো - খবরদার কষ্ট দিবা না আমার ভাইকে! বড্ড ভালোবাসে সে তোমায়! লজ্জায় লাল হয়ে গেলো গৌরী। একসময় গৌরী নিলুকে খুঁজতে গিয়ে ঢুকে পড়ে,তাদের বৈঠক খানায়। গিয়ে দেখে কেউ নেই সেখানে, শুধু আকবর চুপ করে বসে আছে এক কোণে। কি হয়েছে! কাকে খুঁজছিস? প্রশ্ন করে আকবর। গৌরী পালিয়ে আসতে গিয়েও পারে না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আকবর এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে তার। কি হলো? ভয় পেলি? গৌরী মাথা নেড়ে জবাব দেয়- "না। ভয় পাবো কেন?" তখন  তার মনে যে অনুরাগের আবেশ! প্রণয়াবেগের বিহ্বলতা!
যাক সে যাত্রা বাঁচলো সে,সেই ঘোর থেকে--। পরের দিন রাবেয়া পৌঁছে দিলো তাকে।গৌরী ফিরেছিলো দুরু দুরু বুকে, সারা রাত পরবাসের পরে। বাড়িতে অবশ্য কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি সেই নিয়ে।
------------
এমন সময় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। চারিদিকে তীব্র হলো বিক্ষোভ, বিদ্রোহ! আন্দোলন। গৌরীর দাদা অতনু এবং আকবর সহ তার বন্ধু বান্ধবেরা যোগ দিলো আন্দোলনে। যুদ্ধ শুরু হলো। চারিদিকে চললো ধরপাকড়, হানাহানি ,হত্যাযজ্ঞ। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে নিহত হলো হাজার হাজার বাঙালি। নেমে এলো ভীষণ দুর্দিন। এই সময় সুবিধাবাদীরা শুরু করলো বিভাজনের রাজনীতি।  চারিদিকে অশান্তি আর অবিশ্বাসের আগুন জ্বলে উঠলো।হিন্দুরা দলে দলে ঘরবাড়ি জমিজমা ছেড়ে পাড়ি দিলো ভারতে। সেই আঁচ এসে লাগলো গৌরীদের পরিবারেও। তারাও ঠিক করলো এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে ভারতে।
গৌরী এই প্রথম অনুভব করলো, আকবর আর সে আলাদা ,আলাদা সম্প্রদায় ।   তাদের মধ্যে মিলন কখনোই সম্ভব নয়। সে হিন্দু।আর  আকবর মুসলিম। এ দেশ মুসলমানের। আর তাই তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সারারাত খুব কাঁদলো সে। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলো। তার প্রিয় বন্ধু নিলুফাকে ডেকে বললো , খুব ভালো বাসে সে আকবরকে। তাকে ছাড়া বাঁচা যে সে কল্পনাও করতে পারে না। নিলুফা অনেক বোঝালো তাকে। এদিকে বাড়িতে  দেশ ছাড়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। গৌরীর বাবা , মা, ভাইবোন এখনই চলে যাবে কলকাতায় । শুধু কিছুদিন তার বড়দা থেকে যাবে এখানে।

গৌরী একদিন লুকিয়ে দেখা করলো আকবরের সঙ্গে। কথা মত আকবর দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের বাড়ির পিছনের আমবাগানে, দীঘির ঘাটে। গৌরী গুটি গুটি পায় দাঁড়ালো গিয়ে সেখানে,মাথা নীচু করে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। তারপর গৌরীই মুখ