ধারাবাহিক উপন্যাস চন্দ্রগোধূলি শেষ পর্ব
*************
চন্দ্র ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানার ওপরে মারিয়া যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন যেন অভিমান হলাে মারিয়ার। প্রথমে ভাবল, কোনাে কথাই বলবে না চন্দ্রের সঙ্গে। কিন্তু চমকে ও…
ধারাবাহিক উপন্যাস চন্দ্রগোধূলি শেষ পর্ব
*************
চন্দ্র ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানার ওপরে মারিয়া যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন যেন অভিমান হলাে মারিয়ার। প্রথমে ভাবল, কোনাে কথাই বলবে না চন্দ্রের সঙ্গে। কিন্তু চমকে ওঠে মারিয়া, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে চন্দ্রের। মারিয়া দিন রাত সেবা করে চলে চন্দ্রের তবুও জ্ঞান ফেরার কোনাে লক্ষণ নেই। অবশেষে মারিয়া যিশুর কাছে প্রার্থনায় বসে।
-প্রভু আমি চাই শুধু চন্দ্র বেঁচে উঠুক ভাল থাকুক।আর কিছুই চাই না। যদি সত্যিই পাপী
হই তাহলে আমাকে শাস্তি দাও।
চারদিন পরে চন্দ্রের জ্ঞান ফিরে আসে সুস্থ হয়ে ওঠে চন্দ্র। শরীরের অসহ্য ব্যাথা ক্রমে বিলীন হয়ে যেতে থাকে। চন্দ্রের সেবা করতে করতে তিন চারদিন না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে মারিয়া। শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। তবুও মােল্লাল গ্রামে যেতে হবে। ওখানে চাষিদের সঙ্গে আবার মহাজনের গােলমাল বেঁধেছে।একজন বৃদ্ধাকে রেখেছিল চন্দ্র চলে যাওয়ার পর। তাকে চন্দ্রের দেখা শােনার ভার দিয়ে মারিয়া মােল্লাল গ্রামে পৌঁছাল। যখন মারিয়া মােল্লাল গ্রাম থেকে ফিরে এলাে, তখন গির্জায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। গির্জার ভিতরে প্রবেশ করতেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল মারিয়া। মারিয়ার বুকটা কেমন যেন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। ছুটে গেল চন্দ্রের কাছে। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?
-আপনি মােল্লাল গ্রামে যাওয়ার পর বাবুর কেমন যেন কাঁপুনি আসে, তারপর থেকে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। মারিয়া বিছানার কাছে গিয়ে চন্দ্রের শরীরে হাত রাখে। কি অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে গেছে চন্দ্রের শরীর। হাত দিয়ে ঘষে ঘষে মারিয়া চণ্দ্রের শরীর গরম করার চেষ্টা করে। কিন্তু চন্দ্রের শীতলতা ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। একসময় মারিয়া নিরুপায় হয়ে নিজের শরীরের উত্তাপে চন্দ্রের দেহের উত্তাপ ফিরিয়ে আনে।
-এ আমি কি করলাম? আমি একজন সন্ন্যাসিনী হয়ে একি করলাম ?
[26/04, 12:05 PM] +91 96090 07756: যিশুর পদতলে অশ্রু ঝরে পড়ে মারিয়ার। আমায় ক্ষমা করা প্রভূ!তুমি তো জানো আমি
জীবন বাঁচানাের দায়িত্ব নিয়েছি। এতে যদি আমার কোনাে পাপ হয়ে থাকে তাহলে আমায় শাস্তি দাও।
ক্রমে দিন গড়িয়ে চলে চন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মারিয়া যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে কয়েক মাস পর বুজতে পারল। সে কি আত্মহত্যা করবে?কিন্তু কেন? সে কি অপরাধ করেছে? চন্দ্র কি জানে? না না সে কি করে জানবে সে তাে অসুস্থ! এইভাবে মারিয়া অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। মারিয়া সব সময়
যিশুর কাছে প্রার্থনা করে দ্বার রুদ্ধ করে। চন্দ্র কেমন যেন উদাস ভাবে থাকে। কোনাে খোঁজ রাখেনা চন্দ্র। এদিকে মারিয়ার শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগল। না খেয়ে না ঘুমিয়ে কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল। একদিন মারিয়া যিশুর কাছে প্রার্থনায় মগ্ন আছে মাতৃজঠর পূর্ণমাতৃত্বের রূপ নিয়েছে।
-আজ কোনো কাজ নেই মারিয়া তাই তােমার কাছে এলাম, মারিয়া পূর্ন মাতৃত্বের রূপ আড়াল করার বৃথা চেষ্টাকরতে লাগল।
চন্দ্র নস্মিত হেসে নজবাব দেয় আজ তুমি মাতৃত্বকে আড়াল করছ। কিন্তু যখন ও ভূমিষ্ট হবে তখন কি তুমি ওকে ফেলে চলে যাবে ?
মারিয়া চমকে চন্দ্রের দিকে তাকায়।-তুমি?
—হ্যাঁ, আমি সব জানি মারিয়া। বৃদ্ধামা আমায় সব বলেছে। তুমি তাে কোনাে অপরাধ করােনি। তুমিতাে জীবন বাঁচিয়েছ। তােমার কোনাে অপরাধ নেই।
মারিয়ার চোখে জল। -আমি অপরাধ করেছি চন্দ্র। তােমার মত পবিত্র
দেবতাকে অপবিত্র করেছি। চন্দ্র শান্তভাবে উত্তর দেয়।
-তুমি জীবনদাত্রী! জীবন দিয়েছ। সেবা করেছ।
[26/04, 12:15 PM] +91 96090 07756: আবার নতুন প্রাণ সৃষ্টি করেছ। কে বলে তুমি অপবিত্র। তােমাকে স্বয়ং যিশুরও অপবিত্র বলার সাহস নেই। তুমি যে নারী, যে নারী পূর্ণ মাতৃত্বের প্রকাশ রূপী, সেই রূপকে স্বয়ং যিশুও প্রনাম করেন। তুমি আমি অন্য কেউ ভাবলেও কিছুই
এসে যায় না।
মারিয়ার চোখে আনন্দের অশ্র ঝরে পড়তে লাগল। চন্দ্রকে যেন সত্যিই যত দেখছে যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে। মারিয়ার মনে হলাে স্বয়ং যিশু যেন চন্দ্র রূপে নেমে এসেছে এই পৃথিবীতে। অল্প দিনের মধ্যেই মারিয়া একটি সুন্দর শিশুর জন্ম দিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলাে। চন্দ্র নীরব হয়ে গেল। কোনাে অভিযােগের ডালি নিয়ে যিশুর কাছে গেল না। যিশু যা দেবে তাই খুশি মনে মেনে নেবে। মারিয়ার দেওয়া নামে,
শিশুর নাম রাখল দিব্য।
দিনের পর দিন চন্দ্র নিজেকে শাস্তি দিতে লাগল। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে গাঁয়ের গরীব মানুষের সেবা করতে লাগলাে। গির্জাতে বৃদ্ধা মা দিব্যকে সামলাতাে। একদিন বৃদ্ধা মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। চন্দ্রের দিব্যকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। আমার কিছু হয়ে গেলে দিব্যর কিহবে?চন্দ্র একা একা গির্জায় বসে থাকে।
জানালার বাইরে চোখরাখে। গােধূলির কথা মনে পড়ে। সুখে থাকো তুমি গােধূলি, যেখানে থাকো! এছাড়া আর কি চাইব তােমার কাছে! একদিন নির্জন সন্ধ্যায় দিব্যকে কোলে নিয়ে চন্দ্র বসে আছে সুবর্নরেখার তীরে। হঠাৎ দমকা কাশিতে চন্দ্রের মুখে থেকে এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে এলাে। দিব্যর দিকে চেয়ে উদাস হাসি বেরিয়ে এলাে চন্দ্রের। ...এবার আমার পালা দিব্য। তােমাকে কার কাছে রেখে যাই ? দিব্যকে বুকে জড়িয়ে ফিরে আসে গির্জায়। ক্রমে চন্দ্রের রােগও বাড়তে থাকে। চন্দ্রের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। প্রায় বিছানায় শুয়েই কাটিয়ে দেয়। দিব্য পাশেই ঘুমিয়ে থাকে।
মোটর দুর্ঘটনায় গােধূলি বাঁচলেও সুলােচনকে বাঁচানাে যায়নি। ডাক্তারদের সব চষ্টা ব্যর্থ করে সুলােচন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। গােধূলি পাগলের মতাে ঘুরতে ঘরতে অবশেষে গির্জার কাছে পৌঁছায়। ক্লান্ত দেহ নিয়ে গির্জার চূড়াের দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে থাকে। চোখে অশ্রু ধারার সজল রেখা। মনে মনে বলে
হে প্রভু যিশু আমার চন্দ্র কোথায় ? তাকে একটি বার এনে দাও প্রভু.... শুধু একটিবার।"....চোখের জলে চিবুক ভেসে যেতে থাকে গোধুলীর । চন্দ্র বিছানায় শুয়ে আছে। টিবি রােগের জীবানুগুলাে সারা শরীর শেষ করে দিয়েছে। দিব্য খিদের জ্বালায় চিৎকার করে কেঁদেই চলেছে। কিছুক্ষন গােধূলি গির্জার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছােট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে গির্জার ভেতরে ঢোকে গােধূলি। চন্দ্রের বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। গােধূলি চন্দ্রকে এখানে এমন অবস্থায় পাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। -একি অবস্থা হয়েছে তােমার চন্দ্র দা?
মুখমন্ডলয় দাড়ির জঙ্গল। রােগাক্রান্ত শরীরটা যেন বিছানায় মিইয়ে গেছে। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর গােধূলি কান্নায় ভেঙে পড়ে।-চন্দ্রদা....তােমাকে কত খারাপ ভেবেছি। অথচ তুমি আমাকে এত ভালবাসতে একদিনও মুখ ফুটে বলােনি। কেন? কেন? চন্দ্রদা। আমি যে আঘাত করেছি তুমি নিরব হয়ে সহ্য করে গেছ?কেন প্রতিবাদ করােনি?
চন্দ্রের চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু ঝরে পড়ে।
-তােমার কিছু দোষ নেই গােধূলি।
সব দোষ আমার ভাগ্যের। তােমাকে তাে কোন দিন পেলাম না। আজ যদিও এলে
আমার ওপরের ডাক চলে এসেছে।
—তােমার কি হয়েছে চন্দ্র? তুমি কথা বলছ না কেন? চন্দ্রের চোখে জলের ধারা, মুখে স্মিত হাসি।
-আমি চলে যাচ্ছি গােধূলি তােমাদের এই পৃথিবী ছেড়ে। তুমি ভালাে থেকো, সুখে থেকো।
আমার সময় শেষ,বিদায় বেলায় তোমার একটু হাসি বুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাবাে।
- আমি তােমায় যেতে দেব না চন্দ্রদা। কিছুতেই না। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারনা। কিছুতেই না! চন্দ্রের বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে গােধূলি।
- কেঁদো না গোধূলি। এই শিশুকে নাও। শুধু ভাববে এই ছেলে তােমার আমার। এর মধ্যেই তুমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে। আমি আসি! চন্দ্র পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল অমৃতলােকে। গােধূলি কান্নায় ভরিয়ে তোলে আকাশ বাতাস।
- চন্দ্রদা তুমি যেওনা। আমি বড় একা! বাঁধ ভাঙা অশ্রু ঝরে পড়ে গােধূলির দু চোখ হতে। আমি বড় একা হয়ে গেলাম চন্দ্রদা। ওর কান্না বাতাসে অনুরনিত হতে লাগল। কোলের শিশুটিও কাঁদতে লাগল। গােধূলি ওকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।
............ শেষ