Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া সাহিত্য পত্রিকার দৈনিক সেরা সম্মাননা

#নাকফুল

    স্নানের শেষে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে তোয়ালের সুতোয় আটকিয়ে সুলোচনা দেবীর অনেকদিনের নাকফুলের ডাটিটা ভেঙে মাটিতে পড়ে যেতে ওনার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
যখন মুখার্জি বাড়ীর বড় বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিলেন তখন ঠাকুমা…


#নাকফুল

    স্নানের শেষে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে গিয়ে তোয়ালের সুতোয় আটকিয়ে সুলোচনা দেবীর অনেকদিনের নাকফুলের ডাটিটা ভেঙে মাটিতে পড়ে যেতে ওনার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
যখন মুখার্জি বাড়ীর বড় বউ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছিলেন তখন ঠাকুমাশাশুড়ি অনেক আদর করে অন্য গহনার সাথে আধফোটা বেলকুড়ির মাঝে ছোট্ট একটা হীরে বসানো নাকফুলটা নাতবৌকে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন এটা তোর ঠাকুমার আশীর্বাদস্বরূপ সর্বদা সঙ্গে রাখিস।সেইথেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন নাকের ফুলটা সুলোচনাদেবী একদিনের জন্যেও নাক থেকে খোলেননি। সারাজীবনের সমস্ত ঝড়ঝাপটায় ওনার মনে হত ঠাকুমাশাশুড়ি সর্বদা দুহাত দিয়ে তাকে আগলে রেখেছেন। তাই আজ মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে থাকে সংসারের অমঙ্গলের ভাবনায়।একবার ভাবেন এযুগে একে নিতান্তই কুসংস্কার আর ছাড়া কিছু বলা যায় না।তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে না পেরে মাথার কাঁচাপাকা চুল মুছতে মুছতে পায়েপায়ে ছেলের কাছে গিয়ে নাকের ফুলটা স্যাকরার কাছ থেকে ঠিক করে এনে দিতে বলেন।

অফিসের কাছে ব্যস্ত ছেলে বিরক্ত হয়ে মাকে বলে
তোমার ওই সামান্য নাকের ফুল ঠিক করতে যাওয়ার মত সময় আমার নেই দেখছ না ব্যস্ত আছি।কাছেই তো সোনার দোকান আছে সেখানে গিয়ে নিজেই তো ঠিক করিয়ে আনতে পার।
ছেলের কথায় খানিক ইতস্ততভাবে সুলোচনাদেবী বলেন
তোর বাবাও এখন এখানে নেই মেয়ের বাড়ি থেকে কবে আসবে তার ঠিক নেই,আর আমার হাঁটুর ব্যথাটা খুব বেড়েছে শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই তাই একা একা যেতে ভরসা পাইনা।
মায়ের কথায় ছেলে রাগে গজগজ করতে করতে বলে
এই বয়সে নাকেরফুল না পরলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি? আর অত যদি পরার সখ ওই ড্রয়ারে রেখে দাও যবে সময় পাব তখন ঠিক করে দেবো।ছেলের কথায় নাকফুলটা ড্রয়ারে রেখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়ে আসেন সুলোচনাদেবী।
এরপর মাস দুয়েক কেটে যায়,ছেলে নাকছাবি নিয়ে আর কিছু না বলায় সুলোচনাদেবী অভিমানে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নেন সংসারের মধ্য থেকে। বাড়ীর সবার নিজস্ব ব্যস্ততায় এই গুটিয়ে নেওয়া সকলের চোখ এড়িয়ে যায়।

দিন দুয়েক আগে জয়দীপ রাতের খাওয়ার পর যখন ছাদে পায়চারি করছিল, তখন মেয়ে এষা চুপিচুপি বাবার পিছনে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বাবাকে বলে
পরশু "মাদার্স ডে" প্রতিবারের মত এবারেও মায়ের জন্য বন্ধুদের সাথে গিয়ে গিফট কিনবো, তবে একথা কিন্তু মাকে বলা যাবে না সারপ্রাইজ দেবো।
জয়দীপ হেসে বলে তুই তোর মায়ের জন্য গিফট কিনবি তার জন্য আমাকে বলছিস কেন!
মেয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে আহা! যতদিন আমি চাকরী না করছি ততদিন তুমি আমার "ব্যাঙ্ক"।
মেয়ের নাক টিপে দিয়ে জয়দীপ হাসতে হাসতে বলে ড্রয়ার থেকে আমার ওয়ালেটটা নিয়ে আয়।
এষা একছুটে গিয়ে ড্রয়ার থেকে বাবার ওয়ালেট আর একটা কাগজের মোড়ক বাবার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাস করে ' পাপা এটাতে কি আছে?'
জয়দীপ মেয়ের হাতে টাকা দেওয়ার পর কাগজের মোড়কটা খুলতেই নাকফুলের হিরেটা চাঁদের আলোয় ঝলমল করে ওঠে।
তাই দেখে এষা বলে এটা তো ঠাম্মার নাকছাবি তোমার ড্রয়ারে কেন পাপা?
জয়দীপ বলে এটার ডাটিটা ভেঙে গেছে তাই ঠাম্মা ওখানে রেখে গেছে ঠিক করার জন্য।
এষা বলে তাই ঠাম্মার নাকে ওটা দেখিনা আজকাল, ফুলটা এতদিন কেন ঠিক করে দাওনি পাপা?
জয়দীপ মেয়ের কথায় ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, তারপর দম নিয়ে বলে এতদিন সময় হয়নি এবার ঠিক করিয়ে দেবো। তুই এবার নিচে যা আমাকে একটু একা থাকতে দে খোলা আকাশের নিচে।
বাবার কথায় মেয়ে নিচে চলে যেতেই কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো একে একে জয়দীপের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছেলের সব আবদার মা কিভাবে মিটিয়েছেন যৌথ সংসারের ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে, বাবার রোজগার বেশী হওয়ার দরুন জয়দীপের বাবার কাঁধে সংসারের সিংহভাগ দায়িত্ব ছিল,তাই বাবার কাছে বকুনি খেয়েও 'মা' তার ভালো স্কুল, কলেজে পড়ার থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য খুঁটিনাটি চাহিদাগুলো যথাসম্ভব মেটানোর চেষ্টা করতেন।আর সেদিন যখন 'মা' তার কাছে এসে সামান্য নাকফুলটা ঠিক করে দিতে বলেন তখন সে কি রূঢ় ব্যবহারটাই না করেছে,একথা ভাবতেই জয়দীপ মরমে মরে যায়।
মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় মায়ের গলা জড়িয়ে মায়ের গায়ের গন্ধ নিতে নিতে নাকেরফুলটায় হাত বুলিয়ে বলত,
"মা তোমাকে দেখতে ঠিক দুর্গা ঠাকুরের মত।

মেয়ে এষার মাতৃদিবস নিয়ে উত্তেজনা দেখে জয়দীপ মনেমনে ভাবে মায়ের নাকফুলটা ঠিক করে নিয়ে এসে সেও মাকে সারপ্রাইজ দিয়ে মায়ের মনে জমা অভিমানের বরফ গলিয়ে দেবে।
মাতৃদিবসের দিন সন্ধ্যাবেলায় এষা মায়ের পছন্দের ব্ল্যাকফরেস্ট কেক আর পছন্দের গিফট নিয়ে মা ও বাবাকে ডাকাডাকি শুরু করে কেক কাটার জন্য,ঠাকুমা বিশ্রাম করছে দেখে তাকে আর বিরক্ত করে না।
কেক কাটা পর্ব মিটলে জয়দীপ প্লেটে কেকের টুকরো ও মায়ের প্রিয় নাকছাবিটা হাতে নিয়ে সুলোচনাদেবীর ঘরে যায়, মাতৃদিবসে মায়ের কাছে সেইদিনের রূঢ়তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে বলে।
ভেজানো দরজা খুলে মায়ের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে জয়দীপ 'মাকে' আস্তে করে ডাক দেয়।
দুই,তিনবার ডাক দেওয়াতেও সুলোচনাদেবী  সাড়া না দেওয়ায় জয়দীপের শরীর দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যায়।
আলতো করে মাকে ঠেলা দিতে গিয়ে দেখে মায়ের শরীর ঠাণ্ডা বরফ আর বুকের মধ্যে চেপে ধরা দার্জিলিং এর ম্যালে তোলা মায়ের গলা জড়ানো জয়দীপের সবথেকে প্রিয় ছবিটা।
হতবাক জয়দীপের হাত থেকে কেকের প্লেট ও নাকছাবির মোড়ক দুটোই মাটিতে পড়ে যায়।মাকে চমক দিতে এসে নিজেই জীবনের চূড়ান্ত নির্মম চমকের সামনে এসে উপস্থিত হয় একবুক হাহাকার আর আত্মগ্লানি নিয়ে।

......শম্পা