Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

নারীদের-স্বপ্নতরী-দৈনিক-সেরা-কলম-সম্মাননা

#পেন্নাম রবি ঠাকুর
#সুস্মিতা
(সেই যে...সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো কবি...যে মানুষটিকে একটা গোটা জাতি একসাথে গুরুদেব বলে মেনেছিল।যাঁর জন্য আমরা সকলে সতীর্থ অর্থাৎ এক গুরুর শিষ্য, মাত্র কদিন পরেই তাঁর জন্মদিন ...
ভাবতে অবাক লাগে দেড়শো বছরে…


#পেন্নাম রবি ঠাকুর
#সুস্মিতা
(সেই যে...সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো কবি...যে মানুষটিকে একটা গোটা জাতি একসাথে গুরুদেব বলে মেনেছিল।যাঁর জন্য আমরা সকলে সতীর্থ অর্থাৎ এক গুরুর শিষ্য, মাত্র কদিন পরেই তাঁর জন্মদিন ...
ভাবতে অবাক লাগে দেড়শো বছরেরও বেশি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আজও এই মানুষটির জন্যই বহু লোকের ঘরের অন্নের সংস্থান হয় ...

তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের গল্প ..."পেন্নাম রবি ঠাকুর")

#পেন্নাম রবি ঠাকুর

 কুলুঙ্গিতে রাখা মা কালীর ছবির  ঠিক পাশেই ওই নতুন ঠাকুরের ছবিটা রেখেছে পটলা। তা,ছবিটা রেখেছে...সেও হয়ে গেল প্রায় অনেকগুলো বছর।যবে থেকে ওই ঠাকুরের কল্যাণে পটল কুমার একটু সুদিনের মুখ দেখেছে...।
তারপর থেকে প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পটলা ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে একবার পেন্নাম ঠোকে আর তারপরে  ছবির মধ্যেকার দাড়িওয়ালা ঠাকুরকে এক চিলতে হাসি উপহার দেয়।
এখানেই শেষ নয়...মাসে এক আধবার,যেদিন পটলার মুড খুব ভালো থাকে অর্থাৎ পকেটটা বেশ ভর্তি থাকে...সেদিন ও মোড়ের মাথার বঙ্কুদার দোকান থেকে একটা গাঁদাফুলের মালা নিয়ে এসে ছবিটাকে পরিয়ে দিয়ে হাতজোড় করে বলে-"থ্যাঙ্ক ইউ বস্ ...থুড়ি...পেন্নাম ঠাকুর।"

      তা বলবে নাই বা কেন ?পূর্ববঙ্গ থেকে রেফিউজি হয়ে আসা পরিবারের ছেলে পটলার ছোটবেলাটা কেটেছে কলকাতার যাদবপুরের বস্তিতে। মা বালিগঞ্জের বড়লোকদের বাড়িতে ঠিকে ঝি এর কাজ করতে যেত। বাপকে পটলা কোনোদিনই কাজকর্ম করতে দেখেনি। সে শুধু সারা দিনরাত ঘং ঘং করে কাশত আর শুয়ে থাকত। তারপর পটলার যখন ছয় সাত বছর বয়স, সেই বাপ হঠাৎ একদিন বস্তির লোকদের কাঁধে চেপে শ্মশানে চলে গেল। বাবার স্মৃতি বলতে পটলার মনে এখন শুধু ঘংঘং কাশি আর কফ ফেলার শব্দ ...।
মাটাও কবে মরে হেজে ভূত হয়ে গিয়েছে। তবে ছেলেবেলায় পটলা মাকে একটু আধটু ভয় পেত। বস্তির আর পাঁচজন মাসীপিসিদের থেকে পটলার মাটা কেমন যেন একটু আলাদা ছিল।হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে সারাদিন আট বাড়িতে বাসন মাজা,কাপড় কাচা আর ঘর ঝাড়ামোছার কাজ করত মা। তবুও দিনের শেষে সন্ধ্যাবেলায় যখন ঘরে ফিরত,তখন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সুলেখার চোখদুটো জ্বলজ্বল্ করত ...লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন তার দু চোখের তারায়...।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে হুকিং করে টেনে আনা টিমটিমে আলোতেও পটলাকে শিক্ষিত মানুষ করে তোলার স্বপ্ন সুলেখা রানি দাসের চোখ থেকে একদিনের জন্যও নিভে যায়নি...
  অন্যদিকে বস্তির ছেলেপুলেদের সঙ্গে সারাদিনে যাবতীয় বেয়াদপি সেরে বিনি পয়সার সরকারি স্কুল পালানো পটলার প্রতি সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহ মন ...।মায়ের হাজারও চেষ্টাতেও ছাপানো বইয়ের একটা শব্দ বর্ণও তার মাথায় ঢুকত না।
বস্তির আধো অন্ধকার ঘরে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে পটলা দেখতে পেত-সারাদিনে ঝিয়ের কাজ করা মা'টা রাতের বেলা কেমন যেন অচেনা হয়ে উঠত...। এক একদিন পটলার মা কুলুঙ্গিতে রাখা মা কালীর ছবির নীচ থেকে একটা মোটা বই বের করে বিড় বিড় করে নিজের মনে কি যেন পড়ত। কে জানে ? বোধহয় মায়ের গত জন্মের শিখে আসা কোনো বিদ্যে...। মাকে নিয়ে অত মাথা ঘামানোর সময় বা বয়স তখনও পটলার হয়নি।

       যাক্ গে সেসব...মোদ্দা কথা হল-মায়ের স্বপ্ন সফল করতে পারেনি পটলা।ভোরবেলা সুলেখা ঠিকে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে,সারাদিনে পটলাকে শাসন  করার,আগলে রাখার আর কেউ ছিলনা।বয়সের ধর্ম অনুযায়ী পটলা ততদিনে বস্তির অন্যান্য ছেলেপুলেদের কাছ থেকে পড়াশোনার থেকে বেশি আকর্ষণীয় আরও অনেক জিনিস  শিখতে শুরু করে দিয়েছে। কাজেই ইস্কুলের ছয় ক্লাসের গন্ডি ওর আর পেরোনো হয়নি। মাস্টাররা বের করে দিয়েছিল স্কুল থেকে । ওর জন্য মায়ের কতটা দুঃখটুঃখ হয়েছিল, সেসব পটলা তখন কিছুই বোঝেনি। সুলেখার নিজেরও অবশ্য আর খুব বেশিদিন সুখদুঃখের ভার বইতে হয়নি। কয়েকমাসের মধ্যেই তার রোগা জীর্ণ শরীর জাগতিক সব দায়দায়িত্ব থেকে ছুটি পেয়েছিল।

       মা টা মরে যাওয়ার পরে প্রথম কিছুদিন পটলা একটু দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। আর কিছু না হোক, ক্ষিদের সময় নিয়ম করে এক থালা ভাত মাটা ঠিক ম্যাজিকের মত জোগাড় করে দিত।
    যাই হোক্ গরীবের জীবনে সুখদুঃখ এবং সমস্যা...সবই হয় খুব সাধারণ এবং তার সমাধানগুলোও তাই ...।
বঙ্কুদার ফুলের দোকান থেকে খদ্দেরদের বাড়িতে নিত্যপূজার ফুল পৌঁছে দেওয়ার কাজ পেয়ে গেল পটলা। হাতখরচের সাথে একবেলা ভাত,একবেলা রুটি। চমৎকার ব্যবস্থা।
এইভাবেই দিব্যি চলে যাচ্ছিল ...

        একটু বড় হওয়ার পরে শুধু লোকের বাড়িতে পুজোর ফুল সাপ্লাই নয় , বিয়েবাড়ি ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে  ফুলের জোগান দেওয়ার কাজ শুরু করল পটলা আর বঙ্কুদা। ধীরে ধীরে শুরু হল ডেকোরেটারের বিজনেস। ছোটখাটো অনুষ্টানে তেরপল,প্লাস্টিক চেয়ারের ব্যবস্থা করে দেওয়া...। বাজারে কম্পিটিশন প্রচুর ,তবুও দুই বেলার খাওয়াটার আর অভাব রইল না ।

       কিন্তু জীবনের মোড় ঘুরে গেল ওই সেই ২০১১সাল থেকে। হঠাৎ করে পটলা আর বঙ্কুদা জানতে পারল ওই বছর নাকি কোনো এক দাড়িওয়ালা কবি রবি ঠাকুরের দেড়শো বছরের জন্মদিন।
   ওরে...বাবা ...সে কি মাথা খারাপ অবস্থা...। পাড়ায়-বেপাড়ায় ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়ে,দিদি,দাদা,বউদি,কাকু কাকীমা,দাদু-দিদাদের আসর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসদন,নন্দন,অ্যাকাডেমি,টাউনহল,কলেজ স্কুল সব...সব জায়গায় ওই দাড়িওয়ালা কবি বুড়োর কবিতা পড়ে,গান গেয়ে জন্মদিন পালন হচ্ছে।

  অবস্থা দেখে বুদ্ধিমান বঙ্কুদা আর পটলা ঠিক সময়মত রবি ঠাকুরের বেশ বড় মাপের কয়েকটা ছবি বাঁধিয়ে ফেলল। তারপর পটলারা ঘন্টার হিসেবে সেই ছবি বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া দিতে শুরু করল। সকালবেলা পাড়ার স্কুলে তো দুপুরে বৌদিদের আসরে। আবার সন্ধ্যায় পাড়ার ক্লাব বা নামীদামী কোনো হলে। সেই সাথে মাইক,ফুল,ধূপ,শতরঞ্চি আর চেয়ার টেবিলের চাহিদাও একেবারে তুঙ্গে।
  এইসব অনুষ্ঠানে  চা সিঙ্গাড়া সাপ্লাই দিয়ে পটলার বন্ধু হারু আর ক্যাবলাও কদিন একটু সুখের মুখ দেখল।একসঙ্গে কত্তগুলো লোকের পেটের ভাতের যোগান যে করে দিলো ওই দাড়িওয়ালা ঠাকুর।আজও দেড়শো বছর পরেও তাঁর দয়াতে কত মানুষ যে খেতে পাচ্ছে ...
পটলা তো অবাক...আরও বেশি অবাক হয়ে পটলা দেখে- এইসব প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই  লোকজনরা একটা মোটা বই খুলে কবিতা পড়ে আর গান গায়...

     আরে ...এ যে ...সেই বই ...। ছেলেবেলায় রাত গভীর হলে বস্তির ঘরের আবছায়া আলোয় পটলার মা স্বপ্নের পরীর মত যে বই পড়ত ...।
     একদিন এক অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই কুলুঙ্গি থেকে নীচে নামিয়ে মিলিয়ে দেখল পটলা...ঠিক...একদম ঠিক...বই এর ভিতরে সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো কবির ছবি ...।
     আনন্দে না দুঃখে ? কি যে কারণ...কে জানে ? অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলল স্কুলপালানো,পড়াশোনা না শেখা মায়ের অবাধ্য সেই দুরন্ত ছেলেটা। বহু বছর পরে হাড় জিরজিরে রোগা মা'টার জন্য বড্ড কান্না পেল পটলার...।

      তারপর...যেদিন রবি ঠাকুরের বাঁধানো ছবি ভাড়া দিয়ে অনেকগুলো টাকা পকেটে এল ,সেদিন পটলা নিজের ঘরে রাখার জন্য দাড়িওয়ালা কবির ছোট একটা ছবি বাঁধিয়ে এনে কুলুঙ্গিতে রাখল।
    ছবিটা রাখল মায়ের সেই বইটার ওপরে...। মা টার যে কোনো ছবি নেই ওর কাছে ...। রোগাসোগা মা টা ক্ষিদের মুখে একথালা ভাত ঠিক ম্যাজিকের মত যোগান দিত ...
আর এখন পেটভরা ভাত দিচ্ছে ওই কবি বুড়ো...

       সেইদিন থেকে প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পটলা কুলুঙ্গিতে রাখা কবির ছবির সামনে দাড়িয়ে বলে-"থ্যাঙ্ক ইউ বস্ ... থুড়ি... পেন্নাম রবি ঠাকুর"।

সুস্মিতা

             *************

কবি পক্ষ ...তাই আবার