দৈনিক প্রতিযোগিতার জন্য
তারিখ :৬-০৭-২০২০
ছোটগল্প
বিবেক
কলমে : কথা ছবি কর
সেগুন কাঠের দামী পালঙ্কটার উপর খবরের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী শোভনলাল ভৌমিক ।
-- বাবু , আপনার চা ।
খবর…
দৈনিক প্রতিযোগিতার জন্য
তারিখ :৬-০৭-২০২০
ছোটগল্প
বিবেক
কলমে : কথা ছবি কর
সেগুন কাঠের দামী পালঙ্কটার উপর খবরের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী শোভনলাল ভৌমিক ।
-- বাবু , আপনার চা ।
খবরের কাগজে মুখ গুঁজেই বললেন ,' যা রেখে যা'। তবু দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির কাজের মাসি সবিতা ।
কি রে কিছু বলবি ....সবে তো পূজা গেল , এখন আবার ধার টার চেয়ে বসিস না যেন । দিতে পারবো না ।
সবিতা গলার স্বর নরম করে , না বাবু একটা কতা ছিল ।
--- কি বল ।
বাবু আপনি তো জানেন নেখাপড়া জানিনা । পোলাপানগুলারে পড়ালিখা শিখায় মানুষ করুম সেইজন্যই সূর্য্য উঠা থেকে ডুবার পরও লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করি । কিন্তু তাতেও কি অয় .....। ওদের বাপ তো তিনটা পোলাপান থুইয়া মইরা গেল । সব দায় অন আমার উপর ।
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে এবার শোভনবাবু তাকালেন সবিতার দিকে । বয়স কতই বা হবে ত্রিশ , বত্রিশ । কিন্তু অভাবের সংসারে তার থেকে দশ পনের বছর বেশিই দেখায় । রোগা শ্যামলা অপুষ্ট চেহারা । কাজ করে করে নখগুলো প্রায় ক্ষয়েই গেছে তবে মুখটার মধ্যে সরলতার ছাপ ।
শোভনবাবু : তোর তো দুই ছেলে তাই না ?
শোভনবাবুর একটু আশকারা পেয়ে সবিতা মেঝের উপর বসে পরে বলতে লাগলো , বাবু দুই ছেলে , এক মেয়ে । ম্যাইয়াটা সবে মাত্র চার । এক ছেলে ফাইভে আর একটা থ্রি তে পড়ে । পড়াশুনায় ভালো । ইস্কুলের মাস্টার মশাই কয়েছেন ওরা অনেক পড়াশুনা কইরা বড় মানুষ হইব , আমার আর তন কষ্ট থাকবেক না । কিন্তু বাবু প্রাইভেট দিতে পারিনা , খাতা কলমের অভাব । বড়ো ক্লাসে উঠলে কি কইরা পড়ামু এই চিন্তায় রাতে ঘুম আহে না বাবু ।
শোভনবাবু গম্ভীরভাবে , হুম । তা তো বটেই । কিন্তু কি চাস তুই ?
সবিতা শাড়ির আঁচলের খুঁট থেকে একটা লটারীর টিকিট বের করে মাথা নিচু করে শোভনবাবুর দিকে বাড়িয়ে দেয় । বাবু " পূজা বাম্পার " লটারী কিনেছিলাম , পুরা একশ টাকা দিয়ে । আজকের খবরের কাগজে নাকি রেজাল্ট আছে । লটারিটা মিলায় দ্যান না বাবু ।
সবিতার লটারির নম্বরটা দেখেই শোভনবাবুর বুকের ভিতর যেন সমুদ্র ঝড় উঠে । সবিতা উপরের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য ভগবানের উদ্দ্যেশ্য বিড়বিড় করে বলছে , ঠাকুর যদি মুখ তুলে চান , লটারির নম্বরটা যদি জিতে আমার পোলাপান গুলা মানুষ হবে , অনেকদূর পড়াশুনা শিখবে , পেট পুরে খাইতে পারবে ।
শোভনবাবু চা এর কাপে হাত দিয়ে , ইসস্ এক্কেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে । তুই চা টা গরম করে আন , আমি ততক্ষণ তোর লটারীর রেজাল্টটা দেখি ।
সবিতা চা গরম করতে যেতেই শোভনবাবু তাড়াতাড়ি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া নিজের কাটা পূজা বাম্পার লটারী টিকিটটা তুলে আনলেন । সবিতা ফিরে আসতেই তার হাতে নিজের লটারির টিকিটটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন , না রে তোর নম্বরটা জিতে নি ।
একটাও পুরষ্কার পাই নাই । ঠাকুররে কত ডাকলাম ।ঠাকুরও কালা বলেই লটারির টিকিটটা ছিঁড়ে ফেলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর ঝাড় দিতে শুরু করে সবিতা । দুঃখ পেলেই ঠাকুর দেবতার উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে দ্রুততার সাথে কাজ করাটা সবিতার স্বভাব ।
কাম কইরাই খাইতে হইব আমাগো বলেই আরেক বাড়ির ঝি গিরি করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সবিতা ।
সবিতা চলে যেতেই শোভনবাবু গিন্নির উদ্দ্যেশ্যে , " হ্যাঁ গো শুনছ , একবার আসো গো এ ঘরে তাড়াতাড়ি "।
" শুয়ে ছিলাম একটু ,আবার উঠিয়ে আনলে , কি হয়েছে বলো ' ...শোভনবাবুর স্ত্রী সুগন্ধা একটু বিরক্তিস্বরে বলল ।
-- বসো ,গিন্নি বসো , খুব ভালো খবর ।
" পূজা বাম্পার " লটারি কিনেছিলাম । সকালেই মিলালাম । কিন্তু ধুর ! মিললোনা । ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম । সবিতা ও কিনেছিল । ও তো পড়াশুনা জানেনা । আমাকে মিলাতে দিয়েছিল । কি ভাগ্য ওর । এক্কেবারে প্রথম পুরষ্কার । এক কোটি ।
-- বুঝলে গিন্নি বুদ্ধি করে ও কে চা গরম করতে পাঠালাম । ডাস্টবিন থেকে নিজের লটারির টিকিটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যজার মুখ করে জানালাম ওর নম্বরটা জিতে নাই । আর ওর টিকিট টা আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রেখেছিলাম । এই দ্যাখো এক কোটি বলে পকেট থেকে লটারিটা বের করলেন ।
-- সুগন্ধা : এটা ঠিক নয় , অন্যায় ।
---শোভন : আরে অত টাকা দিয়ে ওরা কি করবে বলো ।
সুগন্ধা : আমাদের তো নেহাত কম নেই ।
শোভন : এবার তোমায় নিয়ে ইউরোপ ট্যুরটা সেরে আসবো ।
সুগন্ধা ইতস্ততঃ করলেও অত টাকার লোভের চাপে বিবেকের মৃত্যু হয় । মুখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠে খুশিতে ।
দেওয়ালির আগে ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে সুগন্ধার অনেক আগের হারানো ডায়মন্ড রিং টা খুঁজে পেয়ে সবিতা সুগন্ধার হাতে তুলে দিয়ে বকবক করতে করতে নিজের কাজে লেগে যায় ।
বিবেক দংশন আর পাপমুক্ত হওয়ার ইচ্ছাতে দেওয়ালিতে সবিতার হাতে কিছু টাকা বকশিশ সুগন্ধা বলে , ছেলেমেয়েদের মিষ্টি খাওয়াস ।
--সবিতা : ' আরে অ্যা তো পাঁচটা দুই হাজারের নোট । পুরা দশ হাজার । অত টাকা ক্যান নিম '।
শোভনবাবু : আরে রাখ রাখ ।
সবিতা : ( টাকাগুলো ফেরত দিয়ে ) না বাবু গদর খাটায় খাই । বকশিশ লই না ।মাথার উপর ঠাকুর দেবতা আছে , ধর্ম্ম আছে । কোন অন্যায় করুম না । হক পথে অল্প পয়সায় সুখে আছি । আপনারা দেওয়ালির প্রণাম লইবেন । আশীর্বাদ করবেন , যেন ধর্ম্মপথে থাইক্যা পোলাপানদের যেন মানুষ করতে পারি বলেই আরেক বাড়ির কাজের উদ্দ্যেশ্যে হনহন করে বেরিয়ে পরে ।
______________
ছবি কর
সুকান্তনগর
এ.পি. সরণী
শিলিগুড়ি - ৬
ফোন : ৭৬৭৯৩৯৯৯২৯
বিবেক
সেগুন কাঠের দামী পালঙ্কটার উপর খবরের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী শোভনলাল ভৌমিক ।
-- বাবু , আপনার চা ।
খবরের কাগজে মুখ গুঁজেই বললেন ,' যা রেখে যা'। তবু দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির কাজের মাসি সবিতা ।
কি রে কিছু বলবি ....সবে তো পূজা গেল , এখন আবার ধার টার চেয়ে বসিস না যেন । দিতে পারবো না ।
সবিতা গলার স্বর নরম করে , না বাবু একটা কতা ছিল ।
--- কি বল ।
বাবু আপনি তো জানেন নেখাপড়া জানিনা । পোলাপানগুলারে পড়ালিখা শিখায় মানুষ করুম সেইজন্যই সূর্য্য উঠা থেকে ডুবার পরও লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি গিরি করি । কিন্তু তাতেও কি অয় .....। ওদের বাপ তো তিনটা পোলাপান থুইয়া মইরা গেল । সব দায় অন আমার উপর ।
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে এবার শোভনবাবু তাকালেন সবিতার দিকে । বয়স কতই বা হবে ত্রিশ , বত্রিশ । কিন্তু অভাবের সংসারে তার থেকে দশ পনের বছর বেশিই দেখায় । রোগা শ্যামলা অপুষ্ট চেহারা । কাজ করে করে নখগুলো প্রায় ক্ষয়েই গেছে তবে মুখটার মধ্যে সরলতার ছাপ ।
শোভনবাবু : তোর তো দুই ছেলে তাই না ?
শোভনবাবুর একটু আশকারা পেয়ে সবিতা মেঝের উপর বসে পরে বলতে লাগলো , বাবু দুই ছেলে , এক মেয়ে । ম্যাইয়াটা সবে মাত্র চার । এক ছেলে ফাইভে আর একটা থ্রি তে পড়ে । পড়াশুনায় ভালো । ইস্কুলের মাস্টার মশাই কয়েছেন ওরা অনেক পড়াশুনা কইরা বড় মানুষ হইব , আমার আর তন কষ্ট থাকবেক না । কিন্তু বাবু প্রাইভেট দিতে পারিনা , খাতা কলমের অভাব । বড়ো ক্লাসে উঠলে কি কইরা পড়ামু এই চিন্তায় রাতে ঘুম আহে না বাবু ।
শোভনবাবু গম্ভীরভাবে , হুম । তা তো বটেই । কিন্তু কি চাস তুই ?
সবিতা শাড়ির আঁচলের খুঁট থেকে একটা লটারীর টিকিট বের করে মাথা নিচু করে শোভনবাবুর দিকে বাড়িয়ে দেয় । বাবু " পূজা বাম্পার " লটারী কিনেছিলাম , পুরা একশ টাকা দিয়ে । আজকের খবরের কাগজে নাকি রেজাল্ট আছে । লটারিটা মিলায় দ্যান না বাবু ।
সবিতার লটারির নম্বরটা দেখেই শোভনবাবুর বুকের ভিতর যেন সমুদ্র ঝড় উঠে । সবিতা উপরের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য ভগবানের উদ্দ্যেশ্য বিড়বিড় করে বলছে , ঠাকুর যদি মুখ তুলে চান , লটারির নম্বরটা যদি জিতে আমার পোলাপান গুলা মানুষ হবে , অনেকদূর পড়াশুনা শিখবে , পেট পুরে খাইতে পারবে ।
শোভনবাবু চা এর কাপে হাত দিয়ে , ইসস্ এক্কেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে । তুই চা টা গরম করে আন , আমি ততক্ষণ তোর লটারীর রেজাল্টটা দেখি ।
সবিতা চা গরম করতে যেতেই শোভনবাবু তাড়াতাড়ি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া নিজের কাটা পূজা বাম্পার লটারী টিকিটটা তুলে আনলেন । সবিতা ফিরে আসতেই তার হাতে নিজের লটারির টিকিটটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন , না রে তোর নম্বরটা জিতে নি ।
একটাও পুরষ্কার পাই নাই । ঠাকুররে কত ডাকলাম ।ঠাকুরও কালা বলেই লটারির টিকিটটা ছিঁড়ে ফেলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর ঝাড় দিতে শুরু করে সবিতা । দুঃখ পেলেই ঠাকুর দেবতার উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে দ্রুততার সাথে কাজ করাটা সবিতার স্বভাব ।
কাম কইরাই খাইতে হইব আমাগো বলেই আরেক বাড়ির ঝি গিরি করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সবিতা ।
সবিতা চলে যেতেই শোভনবাবু গিন্নির উদ্দ্যেশ্যে , " হ্যাঁ গো শুনছ , একবার আসো গো এ ঘরে তাড়াতাড়ি "।
" শুয়ে ছিলাম একটু ,আবার উঠিয়ে আনলে , কি হয়েছে বলো ' ...শোভনবাবুর স্ত্রী সুগন্ধা একটু বিরক্তিস্বরে বলল ।
-- বসো ,গিন্নি বসো , খুব ভালো খবর ।
" পূজা বাম্পার " লটারি কিনেছিলাম । সকালেই মিলালাম । কিন্তু ধুর ! মিললোনা । ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম । সবিতা ও কিনেছিল । ও তো পড়াশুনা জানেনা । আমাকে মিলাতে দিয়েছিল । কি ভাগ্য ওর । এক্কেবারে প্রথম পুরষ্কার । এক কোটি ।
-- বুঝলে গিন্নি বুদ্ধি করে ও কে চা গরম করতে পাঠালাম । ডাস্টবিন থেকে নিজের লটারির টিকিটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যজার মুখ করে জানালাম ওর নম্বরটা জিতে নাই । আর ওর টিকিট টা আমার বুক পকেটে লুকিয়ে রেখেছিলাম । এই দ্যাখো এক কোটি বলে পকেট থেকে লটারিটা বের করলেন ।
-- সুগন্ধা : এটা ঠিক নয় , অন্যায় ।
---শোভন : আরে অত টাকা দিয়ে ওরা কি করবে বলো ।
সুগন্ধা : আমাদের তো নেহাত কম নেই ।
শোভন : এবার তোমায় নিয়ে ইউরোপ ট্যুরটা সেরে আসবো ।
সুগন্ধা ইতস্ততঃ করলেও অত টাকার লোভের চাপে বিবেকের মৃত্যু হয় । মুখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠে খুশিতে ।
দেওয়ালির আগে ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে সুগন্ধার অনেক আগের হারানো ডায়মন্ড রিং টা খুঁজে পেয়ে সবিতা সুগন্ধার হাতে তুলে দিয়ে বকবক করতে করতে নিজের কাজে লেগে যায় ।
বিবেক দংশন আর পাপমুক্ত হওয়ার ইচ্ছাতে দেওয়ালিতে সবিতার হাতে কিছু টাকা বকশিশ সুগন্ধা বলে , ছেলেমেয়েদের মিষ্টি খাওয়াস ।
--সবিতা : ' আরে অ্যা তো পাঁচটা দুই হাজারের নোট । পুরা দশ হাজার । অত টাকা ক্যান নিম '।
শোভনবাবু : আরে রাখ রাখ ।
সবিতা : ( টাকাগুলো ফেরত দিয়ে ) না বাবু গদর খাটায় খাই । বকশিশ লই না ।মাথার উপর ঠাকুর দেবতা আছে , ধর্ম্ম আছে । কোন অন্যায় করুম না । হক পথে অল্প পয়সায় সুখে আছি । আপনারা দেওয়ালির প্রণাম লইবেন । আশীর্বাদ করবেন , যেন ধর্ম্মপথে থাইক্যা পোলাপানদের যেন মানুষ করতে পারি বলেই আরেক বাড়ির কাজের উদ্দ্যেশ্যে হনহন করে বেরিয়ে পরে ।
____________