ভাত
মালা চ্যাটার্জ্জী
28,7,2020
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দু‘টো বাজল। পাশে শোয়া
অভুক্ত বৌ আর তিন বছরের রোগা হাড় জিরেজিরে
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রতন মাঝি পা টিপেটিপে
দরজা খুলল, যেতে হবে প্রায় এক মাইল দূরে বুড়ো
দাদুর বাড়ি…
ভাত
মালা চ্যাটার্জ্জী
28,7,2020
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দু‘টো বাজল। পাশে শোয়া
অভুক্ত বৌ আর তিন বছরের রোগা হাড় জিরেজিরে
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রতন মাঝি পা টিপেটিপে
দরজা খুলল, যেতে হবে প্রায় এক মাইল দূরে বুড়ো
দাদুর বাড়িতে। বুড়োটা আজ গরফা স্টেট ব্যাঙ্ক
থেকে টাকা তুলেছে সে জানে, জানে মানে নিজের
চোখেই দেখেছে। সময় পেলেই এদিক-ওদিক সে
উঁকি মেরে দেখে কে কোথায় যাচ্ছে, কোন বাড়িতে
তালা ঝুলছে। এই কাজ শুধু বেপাড়াতেই করে না,
এরজন্য সাইকেল নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
ফাঁক পেলে বিনা টিকিটে অন্য জায়গায়ও যায়।
চুরি কাজ যখন তখন তো এসব করতেই হবে, কেউ
কি আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। মাঝেমাঝে যে
অন্য কাজের চিন্তাও মাথায় আসে না তা নয় কিন্তু
এপাড়া-ওপাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করে না, করবেই
বা কিভাবে কারও কিছু জিনিস নজরে পড়লেই
তার হাতটা নিসপিস করে, মনেহয় কখন জিনিসটা
আত্মসাৎ করবে। যাক গে, মরুক গে এসব কথা
আর এখন ভেবে কি লাভ বরং ‘জয় মা’ বলে
বেরিয়ে পড়াই ভালো।
প্রায় ভেঙে পড়া মাটির ঘর থেকে যত্নে লুকিয়ে রাখা
শাবলটা আর ভোজালিটা নিয়ে বেশ করে কালো
চাদরে মুখ ঢেকে গুটিগুটি পায়ে রতন ঘর থেকে
বাইরে বেরিয়ে এল, বৌকে আর ডেকে দরজা বন্ধ
করতে বললো না। মনে মনে ভাবল, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। আজ তো আর বেশিদূর যেতে হবে না মাত্র
আধঘন্টার রাস্তা। রাতবিরোতে বের হয় বলে পাড়ার
পাহারাদারের সঙ্গেও গোপনে সে একটু সম্পর্ক
করে রেখেছে। কখনও সখনও দশ বিশ টাকা না
চাইলেও হাতে গুঁজে দেয় তার, তবে সেটা খুব
গোপনে যাতে লোকে সন্দেহ না করে পাহারাদারেরও
শিথিলতা আছে তার ব্যাপারে।
দরজার বাখারিটা বাইরে থেকে বন্ধ করে রাস্তায়
নামে রতন। এদিক-ওদিক সন্তর্পণে তাকিয়ে দেখে
কেউ কোথাও নেই শুধু দু-একটা কুকুর ঘুরে
বেড়াচ্ছে। মরণ! এত রাতে ঘুরে বেড়ানো! কেনরে
বাপু কিছু পেটে পড়ে নি নাকি !কুকুরগুলো তার
গায়ের গন্ধ শুঁকতে থাকলে ভোজালিটা নিয়ে তেড়ে
যায় রতন। তারা ঘেউ-ঘেউ করতে করতে দূরে সরে
যায়। জোরে জোরে পা ফেলে বুড়ো দাদু‘র বাড়ির
সামনে এসে দাঁড়ায় , হাঁ করে শ্বাস টানে। এই
আধঘন্টার রাস্তা জোরে জোরে হেঁটে আসা তো
কম কথা নয়।
বুড়োটা ঘুমিয়ে আছে। বাইরে থেকে নাক ডাকার
আওয়াজ কানে আসে রতনের। ঘুমটা কেমন বোঝার জন্য সে দরজায় দু‘বার ঠকঠক করে। না
‘কে?’ বলে বুড়ো দাদুটা জেগে ওঠে নি তার মানে
বেশ অঘোর ঘুম। এবার শাবল দিয়ে দরজাটা ফাঁক
করার চেষ্টা করে। মনেমনে ভাবে ফাঁক হলে দড়াম
করে একটা শাবল দিয়েই জোরে আঘাত করবে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হঠাৎ দরজায় আঘাতের
শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বুড়োদাদু ও তাঁর
সবসময়ের কাজের লোক মঙ্গলা। রতন ভাবে
পিছিয়ে গেলে চলবে না। ঘরে হাড় জিরজিরে
ছেলেটা দু‘দিন ধরে কিছু খেতে পায় নি। এক নাগাড়ে
কেঁদেকেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবলটা নিয়ে বুড়োদাদু
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর মাথায় করলো
আঘাত। রক্তে রক্তারক্তি । তাই দেখে ঠকঠক করে
কাঁপছিল কাজের মাসি মঙ্গলাটা। অত বোকা ছেলে
রতন নয়, সে কোনও এই কাজের সাক্ষী রাখতে
চায় না, তাই মঙ্গলা‘র মাথায়ও দিল শাবলের
আঘাত। ছটফট করতে করতে সেও চোখ বুজলো।
দু‘টো নিথর দেহের দিকে এক পলক তাকিয়ে
বুড়োদাদু‘র আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। না,
আলমারিতে তালা নেই। আলমারি‘র সব তাক
খুঁজতে খুঁজতে ধুতির তাকের তলায় ব্যাঙ্ক থেকে
তোলা বুড়ো‘র দশ হাজার টাকা পায় সে। তারপর
এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। একটা খালি বেশ
বড় থলি পেয়ে তাতে ঠেসেঠেসে চাল ও কিছু আলু
নেয়। বুড়োর বসার ঘরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে
রাত তিনটে। আর দেরি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়
ভেবে সদর দরজাটা ভেজিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে
থাকে রতন।
ঘরের সামনে এসে বাখারি খুলে ঘরে ঢোকে।
তারপর, ঢকঢক করে দু‘গ্লাস জল খায়। বিছানায়
গিয়ে আর শুঁতে পারে না। হাত দিয়ে ঠেলে বউকে
জাগায়, বলে, ‘চাল এনেছি, ভাত রাঁধ। ছেলেটা
দু‘দিন ধরে খায় নি। ’
সোয়ামীর কথায় উঠে বসে রতনের বৌ। থলিতে
চাল দেখে বুঝতে পারে সব। মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি
থলি থেকে চাল নিতে গিয়ে দেখে থলির গায়ে ও
চালে রক্ত। এক মুহূর্ত থমকে থেকে জিগেস করে,
‘কোথা থেকে চাল আনলি। ’
আদ্যপান্ত সব শুনে কলের পুতুলের মতো মাটির
হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দেয়। ভাতের গন্ধে ম ম করে
চারিদিক। ভাতের মাড়টুকু আর গালে না।
ইতিমধ্যে রতনের ছেলেও ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
‘ভাত, ভাত,’ করে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
ছেলেকে মুখ ধুইয়ে গরম ভাত তিনজনের থালায়
ঢেলে দেয় রতনের বউ। থালাটা যখন চেটেপুটে
একেবারে শেষ করে এনেছে তখন ফ্যালফ্যাল
করে সোয়ামী‘র দিকে তাকিয়ে বউ জিগেস করে,
‘ওরা দু‘জন কি একদম মরে গেছে গো। ’
রতনের শেষ ভাতের গ্রাস মুখের কাছে একটু থেমে
গেল, কি!
উত্তর না দিয়ে শেষ গ্রাসটা মুখে দেওয়ার সময়
প্রচন্ড বিষম খায় সে। চোখে ভেসে ওঠে বুড়োদাদু
ও তাঁর কাজের মাসির মুখ। দেওয়ালে মা কালির
দিকে চেয়ে মনে মনে বলে রতন, ‘মা আমার ছেলেকে
আর দ্বিতীয় রতন তৈরি করো না। ’
তারপর, সে আর বউ বাকবন্ধ করে পরস্পরের
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্য্যিমামা‘র আলো তখন মাটির ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে।
স্বত্ব সংরক্ষিত@ মালা চ্যাটার্জ্জী
মালা চ্যাটার্জ্জী
28,7,2020
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দু‘টো বাজল। পাশে শোয়া
অভুক্ত বৌ আর তিন বছরের রোগা হাড় জিরেজিরে
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রতন মাঝি পা টিপেটিপে
দরজা খুলল, যেতে হবে প্রায় এক মাইল দূরে বুড়ো
দাদুর বাড়িতে। বুড়োটা আজ গরফা স্টেট ব্যাঙ্ক
থেকে টাকা তুলেছে সে জানে, জানে মানে নিজের
চোখেই দেখেছে। সময় পেলেই এদিক-ওদিক সে
উঁকি মেরে দেখে কে কোথায় যাচ্ছে, কোন বাড়িতে
তালা ঝুলছে। এই কাজ শুধু বেপাড়াতেই করে না,
এরজন্য সাইকেল নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।
ফাঁক পেলে বিনা টিকিটে অন্য জায়গায়ও যায়।
চুরি কাজ যখন তখন তো এসব করতেই হবে, কেউ
কি আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। মাঝেমাঝে যে
অন্য কাজের চিন্তাও মাথায় আসে না তা নয় কিন্তু
এপাড়া-ওপাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করে না, করবেই
বা কিভাবে কারও কিছু জিনিস নজরে পড়লেই
তার হাতটা নিসপিস করে, মনেহয় কখন জিনিসটা
আত্মসাৎ করবে। যাক গে, মরুক গে এসব কথা
আর এখন ভেবে কি লাভ বরং ‘জয় মা’ বলে
বেরিয়ে পড়াই ভালো।
প্রায় ভেঙে পড়া মাটির ঘর থেকে যত্নে লুকিয়ে রাখা
শাবলটা আর ভোজালিটা নিয়ে বেশ করে কালো
চাদরে মুখ ঢেকে গুটিগুটি পায়ে রতন ঘর থেকে
বাইরে বেরিয়ে এল, বৌকে আর ডেকে দরজা বন্ধ
করতে বললো না। মনে মনে ভাবল, ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। আজ তো আর বেশিদূর যেতে হবে না মাত্র
আধঘন্টার রাস্তা। রাতবিরোতে বের হয় বলে পাড়ার
পাহারাদারের সঙ্গেও গোপনে সে একটু সম্পর্ক
করে রেখেছে। কখনও সখনও দশ বিশ টাকা না
চাইলেও হাতে গুঁজে দেয় তার, তবে সেটা খুব
গোপনে যাতে লোকে সন্দেহ না করে পাহারাদারেরও
শিথিলতা আছে তার ব্যাপারে।
দরজার বাখারিটা বাইরে থেকে বন্ধ করে রাস্তায়
নামে রতন। এদিক-ওদিক সন্তর্পণে তাকিয়ে দেখে
কেউ কোথাও নেই শুধু দু-একটা কুকুর ঘুরে
বেড়াচ্ছে। মরণ! এত রাতে ঘুরে বেড়ানো! কেনরে
বাপু কিছু পেটে পড়ে নি নাকি !কুকুরগুলো তার
গায়ের গন্ধ শুঁকতে থাকলে ভোজালিটা নিয়ে তেড়ে
যায় রতন। তারা ঘেউ-ঘেউ করতে করতে দূরে সরে
যায়। জোরে জোরে পা ফেলে বুড়ো দাদু‘র বাড়ির
সামনে এসে দাঁড়ায় , হাঁ করে শ্বাস টানে। এই
আধঘন্টার রাস্তা জোরে জোরে হেঁটে আসা তো
কম কথা নয়।
বুড়োটা ঘুমিয়ে আছে। বাইরে থেকে নাক ডাকার
আওয়াজ কানে আসে রতনের। ঘুমটা কেমন বোঝার জন্য সে দরজায় দু‘বার ঠকঠক করে। না
‘কে?’ বলে বুড়ো দাদুটা জেগে ওঠে নি তার মানে
বেশ অঘোর ঘুম। এবার শাবল দিয়ে দরজাটা ফাঁক
করার চেষ্টা করে। মনেমনে ভাবে ফাঁক হলে দড়াম
করে একটা শাবল দিয়েই জোরে আঘাত করবে।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হঠাৎ দরজায় আঘাতের
শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠে বুড়োদাদু ও তাঁর
সবসময়ের কাজের লোক মঙ্গলা। রতন ভাবে
পিছিয়ে গেলে চলবে না। ঘরে হাড় জিরজিরে
ছেলেটা দু‘দিন ধরে কিছু খেতে পায় নি। এক নাগাড়ে
কেঁদেকেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবলটা নিয়ে বুড়োদাদু
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর মাথায় করলো
আঘাত। রক্তে রক্তারক্তি । তাই দেখে ঠকঠক করে
কাঁপছিল কাজের মাসি মঙ্গলাটা। অত বোকা ছেলে
রতন নয়, সে কোনও এই কাজের সাক্ষী রাখতে
চায় না, তাই মঙ্গলা‘র মাথায়ও দিল শাবলের
আঘাত। ছটফট করতে করতে সেও চোখ বুজলো।
দু‘টো নিথর দেহের দিকে এক পলক তাকিয়ে
বুড়োদাদু‘র আলমারির কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। না,
আলমারিতে তালা নেই। আলমারি‘র সব তাক
খুঁজতে খুঁজতে ধুতির তাকের তলায় ব্যাঙ্ক থেকে
তোলা বুড়ো‘র দশ হাজার টাকা পায় সে। তারপর
এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। একটা খালি বেশ
বড় থলি পেয়ে তাতে ঠেসেঠেসে চাল ও কিছু আলু
নেয়। বুড়োর বসার ঘরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে
রাত তিনটে। আর দেরি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়
ভেবে সদর দরজাটা ভেজিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে
থাকে রতন।
ঘরের সামনে এসে বাখারি খুলে ঘরে ঢোকে।
তারপর, ঢকঢক করে দু‘গ্লাস জল খায়। বিছানায়
গিয়ে আর শুঁতে পারে না। হাত দিয়ে ঠেলে বউকে
জাগায়, বলে, ‘চাল এনেছি, ভাত রাঁধ। ছেলেটা
দু‘দিন ধরে খায় নি। ’
সোয়ামীর কথায় উঠে বসে রতনের বৌ। থলিতে
চাল দেখে বুঝতে পারে সব। মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি
থলি থেকে চাল নিতে গিয়ে দেখে থলির গায়ে ও
চালে রক্ত। এক মুহূর্ত থমকে থেকে জিগেস করে,
‘কোথা থেকে চাল আনলি। ’
আদ্যপান্ত সব শুনে কলের পুতুলের মতো মাটির
হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে দেয়। ভাতের গন্ধে ম ম করে
চারিদিক। ভাতের মাড়টুকু আর গালে না।
ইতিমধ্যে রতনের ছেলেও ঘুম থেকে জেগে ওঠে।
‘ভাত, ভাত,’ করে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।
ছেলেকে মুখ ধুইয়ে গরম ভাত তিনজনের থালায়
ঢেলে দেয় রতনের বউ। থালাটা যখন চেটেপুটে
একেবারে শেষ করে এনেছে তখন ফ্যালফ্যাল
করে সোয়ামী‘র দিকে তাকিয়ে বউ জিগেস করে,
‘ওরা দু‘জন কি একদম মরে গেছে গো। ’
রতনের শেষ ভাতের গ্রাস মুখের কাছে একটু থেমে
গেল, কি!
উত্তর না দিয়ে শেষ গ্রাসটা মুখে দেওয়ার সময়
প্রচন্ড বিষম খায় সে। চোখে ভেসে ওঠে বুড়োদাদু
ও তাঁর কাজের মাসির মুখ। দেওয়ালে মা কালির
দিকে চেয়ে মনে মনে বলে রতন, ‘মা আমার ছেলেকে
আর দ্বিতীয় রতন তৈরি করো না। ’
তারপর, সে আর বউ বাকবন্ধ করে পরস্পরের
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্য্যিমামা‘র আলো তখন মাটির ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে।
স্বত্ব সংরক্ষিত@ মালা চ্যাটার্জ্জী