Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া সাহিত্য পত্রিকা দৈনিক সেরা সম্মাননা

হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ
অমৃতা মুখার্জী

ঘরের মধ্যে মিনি কুরুক্ষেত্র চলছে। দুটো সুটকেস, হোল্ডল হাট করে খোলা। মিলু আর ঝিলুর যাবতীয় জামা, কাপড়, জুতো,সরমার শাড়ি, একস্ট্রা কম্বল, মশারি, তোয়ালে সব মিলিয়ে অর্জুনের রথের চাকা প্রায় বসে …

হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ
অমৃতা মুখার্জী

ঘরের মধ্যে মিনি কুরুক্ষেত্র চলছে। দুটো সুটকেস, হোল্ডল হাট করে খোলা। মিলু আর ঝিলুর যাবতীয় জামা, কাপড়, জুতো,সরমার শাড়ি, একস্ট্রা কম্বল, মশারি, তোয়ালে সব মিলিয়ে অর্জুনের রথের চাকা প্রায় বসে গেছে। সোফার উপর আরামসে ঠ্যাং তুলে সিগারেটে টান দিয়ে ছোটকা বিপদ ভঞ্জন মধুসূদন স্টাইলে ফুট কাটল, "যাবি তো দেশের বাড়ি ? এখান থেকে ভদ্রপুর, এমন গোছাচ্ছিস যেন মরুতীর্থ হিংলাজ দর্শনে বেড়িয়ে পড়বি। তোরা দেখালি মাইরি!"

মিলু কাউমাউ করে ঊঠল "ছোটকা, আমি না,ওই ঝিলু হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া, ইশহ, ক্লাস টেনে পড়ে বলে এমন পাখা গজিয়েছে, দেখোনা যত সব বিদঘুটে তোফা ড্রেস,নুরী জুতো, হিম্মতওয়ালা প্যান্ট সব সুটকেসে ঢুকিয়েছে, আমার কাফতান আর প্যাডল পুশার গুলোর কোন জায়গা নেই"।

ঝিলু মুখ ভেংচে বড় করে বক দেখালো।
"এই ছোটকা ওকে বেশি পাত্তা দিওনা । নিজের যত গুড ফর নাথিং ইঁটের মত ভারী বই গুলো ঢুকিয়েছে  বলে আমার লাল রং এর ফ্লাস্ক টা নেওয়া গেলনা!"

মিলু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল " ন্যাচারালি, তোর যা সাজের ঘটা , স্কুল তো পেরুবি না, কলেজে পড়বি আমার মত ,তবে না বুঝবি বই এর মর্ম?"

ঝিলু হি হি করে হেসে বাউন্ডারি মারল "তাও যদি বই গুলো পড়ার বই হোত, দেখেই বোঝা যাচ্ছে পাতি প্রেমের নভেল"।

অমনি দু বোনে ঝটাপটি লেগে গেল। সরমা হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
"কি হচ্ছে টা কি ? তোমাদের কোন কাজ ভদ্র ভাবে করতে এত হাঙ্গামা হয় কেন? গ্রামের বাড়ি যাচ্ছো, কথাটা যেন খেয়াল থাকে। তোমাদের ওই উদ্ভট জামাকাপড় দেখলে ঠাম্মার হার্ট ফেল না হয়!"

সরমা চেষ্টা করেন মানিয়ে গুছিয়ে চলতে। স্বামী মারা যাবার পর তাকে দুটো চাকরী করে সংসার চালাতে হয়। ধনী ও বনেদী শ্বশুরবাড়ির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আদর্শ পরনির্ভর গৃহবধূ হন নি। কিন্তু তাই বলেই মেয়েরা একেবারে মেমসাহেবি কায়দায় মিসি বাবা হচ্ছে তা যেন কেউ না ভাবে! ওদের বাবা বলতেন যেখানে যা, যাকে যেটা।

ভোরবেলা ট্রেনে চেপে মনটা ভালো হয়ে গেল। হু হু করে হেমন্তের সোনালী ভোরের বাতাস কেটে ছুটির হুইশিল বাজিয়ে সবুজ, হলুদ ফসলের মাঠ পেরিয়ে, ঝিক ঝিক রেলের গাড়ী। ঝিলুর ইনফেমাস লাল ফ্লাস্ক বেরিয়েছে, ধুমায়িত চা, ছোটকা কচরমচর করে ঝালমুড়ি খাচ্ছে। মিলুর হাতে পদ্মপাতায় গরম কচুরি আর আলুর রসা তরকারি। ওরা একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে, কেননা রামপুরহাট থেকে মেজকা উঠবেন হার্মোনিয়ামের বাক্স নিয়ে। সে সময় জায়গাতে টান না পড়ে। ওদিকে তাসুড়ে রা হল্লা জুড়েছে পাশের বেঞ্চে। সরমা এক টাকা দিয়ে চারটে লেবু লজেন্স কিনলেন। তার গা বমি করে ট্রেনের দোলায়। হ্ঠাৎ চোখের পাতা ভার হয়ে এল। স্মৃতির কাজলে। সেই যে মিলুর বাবার সাথে পূজোয় দেশের বাড়ি গেছিলেন, ঝিলু তখন পেটে, খালি গা বমি করছিল। উনি কাচের বোয়ামে অনেক লেবু লজেন্স কিনে রাখলেন। খুব রক্ষা হয়েছিল সেবার। ভাবতে গেলে বুকের তার গুলো ঝনঝন করে, সেই মানুষ টা আর নেই। সরমা লজেন্স টা ব্যাগে রেখে দিলেন। খেতে পারলেন না।

রামপুরহাটে মহা শোরগোল পড়ে গেল। মেজ ঠাকুরপো হার্মোনিয়আম এর চক্করে পানের কৌটো ভুলে গেছেন। কার্তিক কে আর রিমাকে ধমকে শেষ করছেন। কার্তিক কাজের লোক হলে কি হবে? তার খুব ট্যাঁকষ ট্যাং কথা। কাউকে ভয় করেনা। বাঁকুড়ার লোক। বীরভূমের বাবু কে সে মোটে ভয় পায় না।

"সিটা বুললে হবেক নি তো, আপুনি বুলাছিলেন বটেক আপুনি পানের বাটা টো লিয়েছেন সাথে করে, আমার কুনো দোস দিবেন না কো"।

মেজকা হুংকার দিচ্ছেন। " বড্ড লায়েক হইলছ লয়? কানশোভা (গাল) তে দুট চাপড় দিথে লাগবে ভুমরিং ধরে তুমাকে!"

মিলু ফিসফিস  করে সরমা কে জিজ্ঞেস করল মা ভুমরিং মানে কি? মেজকাকী রিমা ফিসফিস করে বললেন ওসব তোরা বুঝবি না। ওর মানে চেপে ধরা। সরমা রিমাকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসালেন। কতদিন পর দুই জা তে দেখা। রিমা র ফর্সা সুন্দর মুখ আর এক ঢাল লম্বা চুল দেখে উনি পছন্দ করেছিলেন। মেজ তো গান বাজনা নিয়ে পড়ে থাকে। রিমা দুই ছেলে, সংসার সব একা সামলায়। একমাত্র এই জার ব্যবহার পাল্টায় নি উনি চলে যাবার পর। খুব নম্র, ভদ্র মেয়েটি।

নলহাটি প্রায় এসে গেল। গোলাপী বিকেল পড়ে আসছে ফসল কাটা মাঠে। দিনমণি সোনার রাজপোষাক খুলে ডিমের কুসুমের মত দুলছেন অস্তাচলে। হু হু করে হাওয়ায় খেজুর রসে জাল দেবার গন্ধ। সোনালী সর্ষে ফুলের ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া। মেজ গলা খুলে গান করছিল "দিনের শেষে ঘুমের দেশে, ঘোমটা পরা,,,".
গিয়াস কাকা এসেছেন স্টেশনে নিতে সবাইকে। বড়কর্তার আমলের লোক ওরা। মুখার্জী বাড়ির সব জমি ওরাই চাষ করেন। এই গ্রামে মুখার্জীদের বাড়িতে ওদের অবাধ যাতায়াত। বিজয়া দশমীর দিন ওরা লুচি পায়েস খান । সরমার স্বামী এই নিয়ম চালু করেছিলেন। তিনি ছিলেন গিয়াসের ছোটবেলার খেলার সাথী। তার কাছে হিন্দু মুসলমান এসব কথা বলার সাহস কারো ছিলনা। শাশুড়ি ও তাকে ভয় পেতেন।

ভদ্রপুর এসে গেল। এখানে মহারাজা নন্দ কুমারের রাজ বাড়ির ভগ্নাবশেষ  আজো আছে। আর আছে তার প্রতিষ্ঠা করা আকালীপুরের কালী। গাড়ি এসে থামল মন্দিরে। প্রণাম না করে বাড়ি যাওয়া নিয়ম নয়। এ কালীর ইতিহাস অতি প্রাচীন। নন্দকুমার স্বপ্নে আদেশ পান ও নদীগর্ভে পড়ে থাকা মুর্তি কে উদ্ধার করেন। এ কালী গুহ্যকালী, বসে আছেন পদ্মফুলের উপর, গলায় সাপের আর নরমুন্ডের মালা, কানে দুলছে মানুষের দেহ, মাথায় একশত আট সাপের মুকুট। শাড়ি পরা, শিব নেই, কালো কষ্টিপাথরের গায়ে পিছলে পড়ছে প্রদীপের কাঁপা আলো। মনসা আর কালীর মিশ্রিত শাক্ত রূপ।

সরমা আর সকলে গড় হয়ে নমস্কার করলেন। ঝিলু ও প্রনাম করছিল, কিন্তু হ্ঠাৎ চোখ পড়ে গেল পিছনের ভাঙ্গা দালানে। অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে? একটা ছেলে, সতের, আঠারো বোধয়, গলায় তাবিজ, সাদা জামা, চোখ দুটো কিরকম দুষ্টু আর মায়াবী। রহস্যের অভ্র মাখা চিকমিকে হাসি। একদৃষ্টে ঝিলুর দিকে চেয়ে আছে। সবাই হইহই করে প্রসাদ নিল, বাড়ি যেতে হবে। ঝিলু প্রসাদ নিয়ে দেখল, ওমা! ছেলেটা আর নেই তো। গেল কোথায়?

অত রাতে আর বেশি কিছু ছিল না। গরম ভাত, কলাইএর সাদা ডাল, পোস্ত, সজনে ফুলের বড়া, আড় মাছের টক, আর পিতলের হাঁড়িতে রাঁধা হাঁসের মাংস।এত খিদে পেয়েছিল,সবাই হাপুস, হুপুস করে খেয়ে নিল। সরমা বসলেন নিরামিষ হেঁশেলে, শাশুড়ির সাথে। শেষ পাতে খেজুরগুড়ের