( আমি নারী )
-- জীবন্ত জীবাশ্ম ।
আমি নারী ।
আমার আছে কি কোনো বাড়ি ?
আমার আছে কি কোনো ঘর ?
কে বা আমার আপন ? আর কে বলতো পর ?
.
আমার যখন জন্ম হলো তিনটি ভাইয়ের পরে,
অনেক গর্ব ভরে,
অনেক খুশির আনন্দে আর সুখে
বাবা নাকি কেঁদেছিলো আমায় …
( আমি নারী )
-- জীবন্ত জীবাশ্ম ।
আমি নারী ।
আমার আছে কি কোনো বাড়ি ?
আমার আছে কি কোনো ঘর ?
কে বা আমার আপন ? আর কে বলতো পর ?
.
আমার যখন জন্ম হলো তিনটি ভাইয়ের পরে,
অনেক গর্ব ভরে,
অনেক খুশির আনন্দে আর সুখে
বাবা নাকি কেঁদেছিলো আমায় নিয়ে বুকে ;
বলেছিলো, " ওরে, --
শাঁখ বাজা সব , লক্ষী এলো ঘরে !"
.
লক্ষী এলো ঘরে, হাতে সৌভাগ্যের ডালি ;
আর বৈকুন্ঠে নারায়ণের ঘরটি হলো খালি ।
থেকেই গেলাম বাবার ঘরে চোখের মণি হয়ে ;
দিন, ক্ষণ, মাস, বছর গেল বয়ে ।
"হাটি হাটি পা-পা, খুকি যেথায় খুশি যা না "।
জানতাম না, খুশি হলেও সেথায় যেতে মানা ।
বাবাও বোধ হয় জানতো না, তাই বলতো সে না বুঝে ।
খুকি যে তার চার দেয়ালের মিথ্যে খুশি খুঁজে
ক্লান্ত বড় । সত্যি খুশির মিথ্যে সে আশ্বাস
শুনে বুঝি কাঁদলো পথের শিশির ভেজা ঘাস !
.
বলতে বলতে আমি যখন ' নয় ',
মাকে ছাড়া একলা শুতে করতো না আর ভয় ।
মা বললো, এখন থেকে পাশের ঘরে থেকো,
ওই ঘরটি তোমার, নিজেই গুছিয়ে সব রেখো ।
বাবা বললো, " হ্যাঁ, সেই ভালো, বড় হচ্ছে মেয়ে " ।
কি যে খুশি হলাম সেদিন নিজের ঘরটি পেয়ে !
জানতাম না, সে ঘরটি যে অন্যে নেবে কেড়ে,
বিয়ের পরে যখন যাবো বাপের বাড়ি ছেড়ে !
অনেক যত্নে সাজিয়েছিলাম ছোট্ট সে ঘরটাকে ।
এখন কি কেউ সাজায় সে ঘর ? কি জানি কে থাকে ?
.
দিনগুলি যে কাটছিলো বেশ ভালো ।
সমৃদ্ধির পাহাড় বয়ে, ভুবন করে আলো
বাবার ঘরের প্রদীপ হয়ে ছিলাম বছর ষোলো ।
হঠাৎ কি যে হলো !
.
বাবার মুখটি চিন্তা ভরা, রাত্তিরে নেই ঘুম ;
শুরু হলো আমার জন্য পাত্র দেখার ধুম ।
অনেক দেখে, অনেক শুনে, সারাটি দেশ খুঁজি
অবশেষে যোগ্যমতো পাত্র পেলো বুঝি !
ধনীর ছেলে, এই শহরেই চার-চারটি বাড়ি ।
আর দেরি নয়, পাকা কথা সারলো তাড়াতাড়ি ।
জ্বললো আলো, বাজলো সানাই সারাটি রাতভর ;
বাপের বাড়ি ছেড়ে মেয়ে চললো স্বামীর ঘর ।
.
শ্বেত পাথরের ঘরে শুয়ে লক্ষ টাকার খাটে
এত সুখেও কেন যে তার বিনিদ্র রাত কাটে ?
কেউ কোনোদিন জানলো না তা, বুঝলো না তার মন ;
বিলাস-জালেই সবাই তাকে বাঁধলো সারাক্ষন ।
.
এত বাড়ির এত ঘরে অবাধ আনাগোনা ;
আসলে তা স্বামীর সবই, জানি আমার তো না !
মনে তবু ভেবেছিলাম, " হোকনা সবই পর ।
স্বামীর মনের গোপন দেশেই গড়বো নিজের ঘর "।
তাকিয়ে দেখি সেথাও যে নেই একটু জমি ফাঁকা !
নাম না জানা কোন ললনার মুখটি সেথায় আঁকা !
মনের দুঃখ মনেই রেখে আশায় ছিলাম বসে ।
নারী জন্ম দিলে ঠাকুর কোন সে কপাল দোষে ?
দিলেই যদি, দিও তবে একটি সুসন্তান ;
ছেলেই মাকে ঘর বানাবার একটু দেবে স্থান ।
.
ছেলে হলো ফুটফুটে এক, চাঁদের মতো মুখ ।
কোলের কাছে আঁকড়ে তারে আশায় বাঁধি বুক ।
সেই ছেলে আজ চল্লিশ ছুঁই, মস্ত অফিসার ;
তার উপরে আগের মতো নেই যে অধিকার ।
স্বর্গগত বাবার সকল এখন তারই নামে ;
বাকি ছিল দুই কাঠার এক ছোট্ট ভিটে গ্রামে ।
নিজের নামে লিখিয়ে সেথায় আড়-দিঘে দুই হাত
একটি ছোট তুলসী বেদী গড়ার ছিল সাধ ।
থাকবোনা আর যখন, সেথায় থাকবে আমার নাম ;
দু'হাত জমির সে ঠাঁই হবে নারীর পুণ্যধাম ।
.
ছেলে বললো, "একটা কেন, দশটা বেদী গড়ো ;
কিন্তু দু'হাত লিখিয়ে নেবার সাধ কেন মা করো ?
বাবার জমি আমার জমি, - থাকবে আমার নামে ।
বছর পাঁচেক পরে ওটা বেচবো চড়া দামে ।
দু'হাত গেলে দাম পাবো না, দেবার উপায় নাই "।
নিরাশ হয়ে অশ্রুচোখে আকাশ পানে চাই ।
"বিশ্ব-জমিদার হে প্রভু, হে রাজাধিরাজ।
তোমার বিশ্বে দু'হাত জমিও পায় না নারী আজ " !
.
মনের দুঃখে মনকে বলি, "হায় অভাগী নারী,
মরেই বা তুই কোথায় যাবি ? সে-ও তো যমের বাড়ি " !
.
মায়ের পেটের আঁধার ঘরে যখন ছিলাম সুখে,
স্বপ্নগুলি জ্যোৎস্না হয়ে ঝরত সে চাঁদমুখে ।
আমি ছাড়া সে ঘরের কেউ ছিলনা দাবিদার ;
দশ মাস দশ দিন যে শুধুই আমার অধিকার ।
আঁধার নিবিড় শান্তি ঘেরা মায়ের সে জঠর ;
সেই তো নারীর নিজের বাড়ি, সেই তো নারীর ঘর !
সেই তো নারীর শেষ পরিচয়, দশটি মাসের ঠাঁই ;
তিন কুলে তার নিজের বলে আর যে কিছুই নাই !
.
আমি নারী ।
আমিই সবার বাড়ি ।
আমিই সবার ঘর ।
শুধু আমিই ভিটে হারা, আর একাই জীবনভর !
সবাই আমার আপন, শুধু আমিই সবার পর !
সবার ঘরেই আমি ; শুধু আমারই নেই ঘর !