#বিষয়_গন্ধ
#চন্দন
#সোমা_ত্রিবেদী
আজ ঘুম ভেঙে থেকে ঘর ময় চন্দনের গন্ধে ভরে আছে। ইমরান বেশ সকাল সকাল ওঠে। নমাজ পড়েই খানিকটা শরীর চর্চা করে মোবাইলে ভাল ভাল গান চালিয়ে। ও মূলত ক্লাসিকাল ঘরানার গানই শোনে। তারপর বাগানের গাছে জল দিয়ে ত…
#বিষয়_গন্ধ
#চন্দন
#সোমা_ত্রিবেদী
আজ ঘুম ভেঙে থেকে ঘর ময় চন্দনের গন্ধে ভরে আছে। ইমরান বেশ সকাল সকাল ওঠে। নমাজ পড়েই খানিকটা শরীর চর্চা করে মোবাইলে ভাল ভাল গান চালিয়ে। ও মূলত ক্লাসিকাল ঘরানার গানই শোনে। তারপর বাগানের গাছে জল দিয়ে তবেই স্ত্রী নিতু আর কন্যা তানিয়া কে ডেকে তোলে। সকালের এই সময় টুকু তার একান্ত আপন।
ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে দাঁত মাজতে যেতে গিয়েই নিতুরও নাকে চন্দনের গন্ধটা লাগল।
সে আব্দারের ঢঙে বলে উঠে ইম্বি কতোবার বারণ করেছি চন্দন ধূপ আনবেনা। আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ে।
টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম রাখতে রাখতে ইমরান বলল না তো আমি জ্যাসমিন ফ্লেভার এনেছি। কেন কে জানে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে থেকে ঘর ময় চন্দনের গন্ধ লাগছে আমার। হয়তো পাশের বাড়িতে চন্দন ধূপ জ্বালিয়েছে। চা খেতে খেতে চন্দনের গন্ধর কথাটা প্রসঙ্গ বদল করলেও, নিতুর আজ মন থেকে থেকেই নিজের মায়ের জন্য ছটপট করতেই থাকলো।
চা পর্ব সেরে ইমরান মেয়েকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর নিতু রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে গেল। ওরা বাপ বেটিতে বেরিয়ে পড়লো ঘন্টা খানেকের মধ্যে স্কুল আর অফিসে। নিতুর সারাদিনে এই সময়টা একটা ছোট্ট অবসর। একদম নিজের জন্য কাটানোর সময় এটাই। যা ইচ্ছা করার মতন স্বাধীন সময়।
ব্যস্ততায় টের পায়নি এখন আবার সেই চন্দনের গন্ধ টা ফিরে এসেছে। যেন এই ঘরেই কোথাও ধূপ জ্বলছে আশ্চর্য ব্যাপার তো। ও ধীরে ধীরে উঠে এঁঠো থালা গুলো তুলে টেবিলটা পরিচ্ছন্ন করল তারপর ওয়াসিং মেশিনটা চালিয়ে রান্নাঘরটা পরিস্কার করল। এবার গন্ধটা রান্না ঘর থেকে আসছে।
নীতু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা। হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল।কেবল মায়ের মুখটা মনে পড়ছে আজ। মা এমন চন্দনের গন্ধ ভালবাসতো বলে সবসময় বাবা মায়ের জন্য চন্দন সাবান, পাউডার কিনে দিত। এমনকি মা চন্দন ধূপ ছাড়া ব্যাবহারই করত না। মা ঘরে ঢুকলেই ঘরটা চন্দনের গন্ধে ভরে উঠতো।
কতোদিন হয়েগেল মা কে দেখেনি নিতু, মায়ের সঙ্গে কথা বলেনি, মায়ের গায়ের সেই চন্দনের গন্ধটা পায়নি সে। কি ভালোইনা বাসতো মা তাকে। দাদা তাই নিয়ে কতো হিংসে করত। অথচ কতো সহজে মা তাকে পর করে দিল। ভালোবাসার মধ্যে এতো দোষ থাকে কি যে, সন্তানকে দূরে সরানো যায়? আজও নিতুর কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। নিতু হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে হয়ে মুসলিম ছেলে ইমরানের প্রেমে পড়েছিল। তাই মা মেনে নিতে পারেনি। আর পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে পরে দেখা করতে গেলে দাদা তাড়িয়ে দিল, মা বাবা মুখ দেখতেও চাইল না।
রকমারি পুরোণ দিন আজ চখের সামনে ভীড় করে আসতে থাকে। মেশিন থেকে জামা কাপড় গুলো বার করে ছাদে শুকোতে দিয়ে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বের হয় নিতু। বাড়ি ফেরার আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। মনে মনে ভাবতে থাকে ছাদে থাকা আদ শুকনো জামাকাপড় গুলো ভিজেই গেল। মা মেয়েতে কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই সেই গন্ধটা আবার নাকে আসে। মেয়ের ইউনিফর্ম ছাড়িয়ে বাথরুমে স্নানের জন্য ঢুকিয়ে নিতু ভেজা গায়েই ছুটে যায় ছাদে। আশ্চর্য একটা জামাকাপড় ছাদে নেই। কি হলো সে তো ছাদেই.... তাড়াতাড়ি নিচে এসে ব্যালকোনিতে দেখে ভেজা পোশাক সেখানে শুকোতে দেয়া আর শুকনো গুলো পাট করে খাটের ওপর রাখা আছে। বিছানা টান টান করে পাতা। আর ঘর ময় চন্দনের গন্ধ। মনটা আবার ছটফট করে উঠল।
মেয়ে বাথরুম থেকে বেরোলে ভাত বসিয়ে নিতু স্নানে ঢুকল। মেয়েকে বারবার বলে গেল ফ্যান পড়লে গ্যাসটা অফ করে দিবি। স্নান করে এসে দেখে ভাতের ফ্যান গালা হয়েগেছে। নিতু তো অবাক হয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করে তুই ফ্যান গেলেছিস? তানিয়া প্রশ্নটা ঠিক শুনতে না পেয়ে খুব ঘাবড়ে গিয়ে বলে, সরি মা গেম খেলছিলাম তোমার মোবাইল টায় গ্যাস অফ করতেই ভুলে গেছি সরি গো। আশ্চর্য তবে কে? সেই চন্দনের গন্ধটা আবার রান্নাঘর থেকে আসছে। আজ আর নিতুর খাওয়াতে মন নেই কোন রকমে দুটো খেয়ে একটু বিছানায় গেল মা মেয়েতে একটু শুয়ে শুয়ে গল্প হয় এই সময়টা।
বিকেলের দিকে ইমরান অফিস থেকে ফোনের পর ফোন করেই চলেছে। কিছুতেই নিতু ফোন ধরছে না। ফোনে যোগাযোগ করার আশা ছেড়ে দিয়ে সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ঘর মুখো হয়। বাড়ি এসে অনেক ডাকার পর নিতু উঠে দরজা খুলে এতো তাড়াতাড়ি ইমরান কে দেখে ভূত দেখার মতন দেখে। ইমরান কোনো রকম ভূমিকা না করেই বলে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নাও আমরা বেরাবো। নিতু হাই তুলে বলে কোথায়? ইমরান নরম সুরে জবাব দেয় তোমার বাপের বাড়ি। নীতুর ঘুমের চটকা টা পুরো ভেঙে গিয়ে আবার আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে কোথায়? ইমরান শান্ত গলায় স্ত্রীকে বলে ঠিকই শুনেছ তোমার বাপের বাড়ি যাবো। নিতুর হাতটা ধরে সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে ইমরান বলতে থাকে, তোমার দাদা ফোন করেছিল, তোমার মা আর নেই, কাল রাতেই.... মারা যাওয়ার সময় তোমার নাম করেছিলেন, হয়তো তোমাকে দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল, তাই দাদা অনেক কষ্টে আমার ফোন নম্বর যোগাড় করে ফোন করে জানিয়েছে। এখনো তোমার মাকে দাহ করা হয়নি তোমার অপেক্ষা করছে দাদা।
এবার নিতু ইমরানকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কাঁদতে থাকে। কান্না জড়ানো গলায় বলে মা এসেছিল ইম্বি, আজ সারাদিন... ওই চন্দন গন্ধ... মা আমার মা... ইমরান শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিতুকে। তানিয়া পাশে এসে দাঁড়ায়।
আজ বহু বছর পর নিতু বাপের বাড়ি এসেছে। সেই চন্দনের গন্ধে বাড়ি মম করছে। শুধু সেই গন্ধটা মাখার মানুষটাই চির নিদ্রায় শায়িত।
________________
(শব্দ সংখ্যা~৭৭৮)