Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

দেবী না কি চন্ডী            প্রদীপ সেন  আগরতলা, ১৪/০৮/২০
  বিজয় আর মিনুর বিয়ের দশ বছর পর ওদের একমাত্র সন্তান হলে বাপ-মা আদর করে নাম রেখেছে দেবী। কিন্তু দেবীর বয়েস যতোই বাড়তে থাকে ওর দস্যিপনা ততোই বাড়তে থাকে। মা মাঝে মাঝে ওর দুরন্ত…

 

দেবী না কি চন্ডী

            প্রদীপ সেন

  আগরতলা, ১৪/০৮/২০


  বিজয় আর মিনুর বিয়ের দশ বছর পর ওদের একমাত্র সন্তান হলে বাপ-মা আদর করে নাম রেখেছে দেবী। কিন্তু দেবীর বয়েস যতোই বাড়তে থাকে ওর দস্যিপনা ততোই বাড়তে থাকে। মা মাঝে মাঝে ওর দুরন্তপনায় অতিষ্ঠ হয়ে বলে- বিশ্বকর্মা তোরে পোলা বানাইতে গিয়া ভুল কইরা মাইয়া বানাইয়া ফালাইছে।

মেয়েঅন্ত প্রাণ বিজয় প্রতিবাদ করে। ছেলেবেলায় একটু আধটু দুষ্ট হওয়ন ভাল। বড় হইলে দেইখ্য দেবীর মতন শান্ত মাইয়া আর হয়না।

মিনু সুর চড়িয়ে বলে, বার বছরের মাইয়া শিশু হইল তোমার কাছে? কবছর পর বিয়া দিতে লাগবো। এমন চন্ডী মাইয়ারে কেডা বিয়া করব,শুনি? তোমার আস্কারা পাইতে পাইতে বান্দর কিন্তু মাথায় উইঠ্যা গেছে।

মেয়ে নিরাপদ আশ্রয় বাবার কোলে গিয়ে বসে। বিজয় দেবীর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,  আমরার পোলা হইলেও দেবী, মাইয়া হইলেও দেবী। টু ইন ওয়ান। ও একটু দুষ্টামি করলে মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইত না। কী এমন করে আমার মাইয়া যে তুমি তারে বকতাছ ? 

মিনু বিজয়ের দিকে তর্জনি উঁচিয়ে বলে, থাক ত সারাদিন বাইরে বাইরে কাজে-কর্মে। মাইয়ার কীর্তিকান্ড ত তোমার .শুনতে হয় না। পোলারার মতন গাছ বায়, মাইনসের ক্ষেতে হাল চালায়, মাটি কোপায় কোদাল দিয়া,  পুকুরে কনই-জাল উড়াইয়া মারে, কুড়াল দিয়া লাকড়ি চিরে। 

বিজয় হেসে বলে, কাম করন বুঝি খারাপ?  কাম কামই। পোলারার কাম আলাদা আর মাইিয়ারার কাম আলাদা হয়না। গেরামে রান্দন বাড়ন মাইয়ালোকের কাম ভাবতাছ ত? শহরে যাইয়া দেখ হোটেলে রান্দনের কাম, খাঅন দেওনের কাম পুরুষ মানুষ করে। 

অ, মাইয়ার কোন দোষ তোমার চোখে পড়ে না। তুমি ত মাইয়ার স্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র হইয়া গেছ। কাইল পটল নেশা কইরা আইয়া তার বউয়েরে পিডাইতাছিল। পটলের বউ কানতে কানতে বাচাও বাচাও কইরা চিৎকার করলে তোমার গুনধরি মাইয়া দৌড়াইয়া যাইয়া চেলাকাঠ দিয়া পটলেরে কী মাইরটাই না দিছে। পটলেরে ধমকাইয়া তার মুখ থেইকা নেশা কারবারি জগার নাম বাইর করে। এরপর তোমার চন্ডী তার দলবল লইয়া যাইয়া জগার দোকানে হামলা কইরা দশ-বারটা বোতল আছরাইয়া আছরাইয়া ভাইঙ্গা দিছে, জগারে পিটাইছে।

এতক্ষণে দেবী কথা বলে, জান বাবা, পুলিশ আইছিল। আমারে কয়,  নিজের হাতে আইন তুইলা লইলাম কেরে। আমিও পাঁচ কথা শুনাইয়া দিছি। পটলকাক্কুর বউ পিটানের কথা কইলাম। জগাকাক্কু নেশা বেচে, পুলিশ হেই কথা জানেনা কেন জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর দিতে পারে নাই। আমারে কয় অল্প বয়স দেইখ্যা তোমারে ছাইরা দিলাম আইজ। আমি অ কইলাম আপনারার নাকের ডগায় নেশার কারবার হয় আপনারা জানেন না। এইবারের মতন ছাইড়া দিলাম। বলে কিনা আমি বলে দেবী চন্ডী। 

বাপ-মেয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। মিনু রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। 

সময় বসে থাকেনা। দেবীর বয়েস বেড়ে গেলো। তার প্রতিবাদি চন্ডী রূপ যেন আরো উগ্র রূপ ধারণ করলো। এ তল্লাটে আজকাল ওকে দেবী কম, চন্ডী নামেই বেশী করে চেনে লোকে। সবাই তটস্থ থাকে। চন্ডীর ভয়ে মাতালের মাতলামি, বউ পেটানো, পরচর্চা-পরনিন্দা অনেক কমে গেছে। অন্যায় দেখলে চন্ডীর শুধু মুখই চলেনা, হাতও চলে। কে স্ত্রীলোক কে পুরুষ সেটা গৌণ তার কাছে। সে বলে, অন্যায়কারীর কোন জাত-ধর্ম বা লিঙ্গ হয়না। তার মা হাল ছেড়ে দিল। বলে,  ও মেয়েকে সোজা করা আর কুকুরের লেজ সোজা করা ভগবানেরও অসাধ্য। 

   ওর শত্রুও ছিল। সামনাসামনি কেউ কিছু বলার সাহস না পেলেও পিছে পিছে কম যায়না। ওর বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে পক্ষের লোকজন ওকে দেখতে আসে। মা বারবার সাবধান করে দিয়েছেন। বেফাঁস কিছু কইবি না কিন্তু। এমনই তোর একটা বদনাম আছে। সম্বন্ধের প্রস্তাব আইয়েই না। তোর মামা ছৈলেন্টা থেইক্যা একটা আলাপ আনছে। এইডা যেন মিস না হয়। 

 বেশ কিছু কথাবার্তার পর ছেলের মামী বলে,  আচ্ছা গো মেয়ে, তুমি কি কি জান?

দেবী বলে, পারি ত কত কিছুুই। তার চাইতে আমি কিতা কিতা পারি না তাই কইয়া দেই। 

ওরা সায় দিলে দেবী বলে, মিথ্যা কথা কইতে ও সইতে পারিনা, অন্যায় সইতে পারিনা, চেলাকাঠ দিয়া কত মাতালরে পাটাইছি, বউ-পিটাইনন্যা কত পুরুষ মানুষরে ডান্ডা মাইরা ঠান্ডা করছি, গইন্যা কইতাম পারতাম না।

  এমন মধুর বচন শোনার পর যা হবার তাই হল। ভেস্তে গেল। এর উপর দেবীর শত্রুরা ছেলে পক্ষের কান আগে থেকেই ভরিয়ে তুলেছিল। ভেস্তে গেল সব উদ্যোগ। এরপর আর কোনো প্রস্তাব আসেনি। 

   অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েই দেবীর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। ওর বান্ধবী কেয়ার বিয়েতে পণ নিয়ে বিয়ের আসরে লঙ্কাকান্ড। বরের বাবা আর মামা পণের পুরো পঞ্চাশ হাজার না পেলে বরকে পিঁড়িতে বসাবেন না। কান্নাকাটি অনুনয়-বিনয় কোনো কাজে এলো না। খবরটা দেবীর কানে যেতেই আগুনে ঘি পড়ল! হাতে চেলাকাঠ নিয়ে দেবী তখন রণচন্ডী। তার তীব্র হুঙ্কার - বিয়ের পিঁড়িতে বর আইত না তার ঘাড় আইবো। মহা কোলাহল শুনে বাইকে করে রাস্তা দিয়ে যাওয়া একজন ইউনিফর্ম পরা ইয়ং আর্মিম্যান বাইক থামিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় যদি কোনো উপকার করা যায়। গিয়ে দেখে একদল বরপক্ষের বিপরীতে চেলাকাঠ হাতে চন্ডীর মতো একটা মেয়ে। হুঙ্কার দিচ্ছে থানায় খবর দেওয়া হইছে। এই বিয়া ভাইঙ্গা গেলে কোমড় ভাঙুম সক্কলের। 

আর্মিম্যান এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হল? 

দেবী তখন ফুঁসছে, বলে আপনে কি বরপক্ষের? 

সে মাথা নাড়ে। কাঁধ থেকে চেলাকাঠ নামিয়ে সে বলে, তাইলে বাইচ্যা গেছেন। আপনের কোমড় ভাঙুম না। এই লোকের লাইগ্যা বর্ডারে গুল্লির মুখে খাড়া হন?  অর্থখেকো রাইক্ষস। পণ লইয়া বিয়া করত আইয়ে। হাডান নাই চাডান চাডান আছে। মাইয়ারারে মানুষ ভাবে না। ঘরে দাসী তুলত আইছে। তোলামু ডান্ডা মাইরা। যুধিষ্ঠিরে দ্রৌপদীরে বাজী ধইরা জুয়া খেলল, রামচন্দ্র বিনা দোষে সীতারে বনবাসে পাডাইল। হতচ্ছাড়া সমাজ আর বেলাজা মানুষ একজনেরে কয় ধর্মপুত্তর আরেকজনেরে কয় পুরুষোত্তম। ঢং দেইখ্যা আর বাঁচি না। 

ছেলেটি অবাক। ভাবে বর্ডারে যেমন আর্মিম্যান দেশকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করে সমাজের শত্রু দমনে এমন রণচন্ডীর দরকার। 

সেদিন তার আর দেবীর কারণে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়। পুলিশ দেবীর চাপে বরপক্ষকে সতর্ক করে -আমাদের নজর থাকবে তোমাদের উপর। মেয়েটাকে যদি ফিজিক্যাল বা মেন্টাল টর্চার করা হয় গুষ্ঠি সুদ্ধু গারদে পুরবো। 

কদিন পর দেবীকে দেখতে আসে সেই আর্মিম্যান। বলে,  নো দাবী, নো পণ। আমার শুধু লক্ষ্মীবাঈকেই চাই। 

আর্মিম্যানকে বিয়ে করে শান্তিপুরের চন্ডী চলে যায়। কেউ কেউ বলে এদ্দিনে শান্তিপুরের অশান্তি দূর হয়েছে। অনেকে বলে চন্ডীর বিদায়ে শান্তিপুরে অশান্তি শুরু হবে এরপর।