#ছোটোগল্প#অন্তরের_ভাষা#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
-- আচ্ছা রাজদীপবাবু! ম্যাডামের গায়ের রংটা কেমন? চুল কার্লি না স্ট্রেট? চোখগুলো লম্বা লম্বা, না গোল গোল? উনি চশমা পরেন? ঠোঁটটা কেমন? আই মিন, ওনাকে হাসলে কেমন দেখায়? চেহারা স্লীম না মোট…
#ছোটোগল্প
#অন্তরের_ভাষা
#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
-- আচ্ছা রাজদীপবাবু! ম্যাডামের গায়ের রংটা কেমন? চুল কার্লি না স্ট্রেট? চোখগুলো লম্বা লম্বা, না গোল গোল? উনি চশমা পরেন? ঠোঁটটা কেমন? আই মিন, ওনাকে হাসলে কেমন দেখায়? চেহারা স্লীম না মোটাসোটা? রাজদীপকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চলেছে সুরভি।
আর রাজদীপ ধীরে ধীরে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে -- রংটা একেবারে দুধে আলতা গোলা। চোখগুলো অনেকটা আপনার মতো, বেশ টানাটানা। চুল ঢেউ খেলানো, খুলেই রাখে বেশীরভাগ সময়...... ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সুরভি পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তার হবিটা একটু অদ্ভুত। বর্ণনা শুনে অচেনা মানুষের ছবি আঁকতে সে খুব ভালোবাসে। আজ সে তার লাল নীল হলুদ পেন্সিল দিয়ে একমনে এঁকে চলেছে ট্রেনের সামনের সিটে বসে থাকা এক স্বল্প পরিচিত সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, রাজদীপের স্ত্রীর ছবি। রাজদীপও একজন ইঞ্জিনীয়ার, তারা দু'জনেই সেকেন্ড এসির একই কম্পার্টমেন্টের যাত্রী।
সুরভির একা একা চুপচাপ জার্নি ভালো লাগে না, তাই পরিচয়টা প্রথম সেই শুরু করে, -- হাই! আই'ম সুরভি ফ্রম কোলকাতা, আ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার। হাত বাড়ায় সে।
রাজদীপ শুকনো মুখে জবাব দেয় -- রাজদীপ। অলসো ফ্রম কোলকাতা। হাত মেলায় সেও।
সুরভি লাফিয়ে ওঠে -- আরে! আপনিও বাঙালি? তাহলেতো এবারের জার্নিটা খুব সুন্দর হবে, গল্প করতে করতে সময়টা দারুণ কাটবে আমাদের।
রাজদীপ কোনো জবাব দেয় না। নিরুদ্দেশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরের দিকে। বাইরে অঝরে বৃষ্টি ঝরছে। রাজদীপের ভেতরেও অশ্রু বর্ষণ হয়ে চলেছে একই রকমভাবে। কিন্তু তার চোখেমুখে সেসবের বিন্দুমাত্র ছাপ পড়তে দেয়নি সে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ ক্রমশঃ দুনিয়াদারি শিখতে থাকে। একসময় সে খুব সহজেই মুখের ওপর একটার পর একটা মুখোশ লাগিয়ে নিজের ভেতরের প্রকৃত অবস্থাটাকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। আজ রাজদীপের মুখোশটাও খুব কঠোর একটা মানুষের, যার সাথে সহজে গল্প করাতো দূরের কথা, সামান্য কথা বলাও মুশকিল।
খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায় সুরভি। কম্পার্টমেন্টের কো-প্যাসেঞ্জার এরকম খাড়ুশ মার্কা হলে তো খুব মুশকিল! সেও নাছোড়বান্দা। রাজদীপকে কথা বলিয়েই ছাড়বে সে -- বলছিলাম কি, বৃষ্টি আপনার খুব একটা ভালো লাগে না বুঝি? কিছু মনে করবেন না, আমি একজন আর্টিস্ট তো, তাই কিছুটা হলেও পড়ে ফেলি মনের ভাষা। আপনাকে দেখে অনেকটা ঐ রকমই মনে হচ্ছে।
রাজদীপ বাইরের দিকেই মুখ করে থাকে। একটু আড়চোখে তাকায় সুরভির দিকে। ওর ঘন কালো আঁখি পল্লব, তাকে মনে পড়িয়ে দেয় অনিতার কথা। হুবহু একই রকম চোখের গঠন দু'জনের। একসময় অনিতার ঐ চোখের পাতার ওঠা পড়ায় তার শ্বাস চলতো আর বন্ধ হতো। অথচ আজ কি সম্পর্ক তাদের! সে বলল -- না--, বৃষ্টি ভালোই লাগে। তবে, প্রিয়জন যদি পাশে থাকে তবেই।
সুরভি হেসে বলে -- আজকের দিনে এটা কোনো অসুবিধা হলো? প্রিয়জনকে ভিডিও কল করে পাশে নিয়ে নিন।
রাজদীপের চোখের জলের বাষ্প চশমায় ঘনিভূত হয়। সে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে মৃদু হাসি দিয়ে বলে -- আমার সে রকম কেউ নেই। গলা ভরে আসে তার।
রাজদীপের হাসি মুখের পিছনে লুকিয়ে থাকা কষ্টটা পড়ে নেয় সুরভি। সে বলে -- আই'ম সরি! নিজেরই অজান্তে, মনে হয় কোনো বড় আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে টাচ করে ফেলেছি।
রাজদীপ মাথা নীচু করে ঘনঘন রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে থাকে।
সুরভি তার ভুল বুঝতে পারে।
আসলে অজানা অচেনা কারো ব্যাপারে আমরা যতো তাড়াতাড়ি রায় দিয়ে দিই, ততো বেশী সেখানে ভুল হওয়ার চান্স থাকে।
রাজদীপ মোটেই খাড়ুশ নয়। সে তো বেচারা, নিজের প্রেমের রেশমি সুতোর লেগে যাওয়া জট খুলতে শশব্যস্ত এক অসহায় মানুষ।
সুরভি খুব নরম সুরে বলল -- আমাকে আপনার বন্ধু ভাবতে পারেন। আপনার মনের কষ্টটা যদি আমার সঙ্গে শেয়ার করলে একটু হাল্কা লাগে, তাহলে নিশ্চিন্তে করতে পারেন।
-- অনিতা আমার স্ত্রী। এখন কিছুদিন ও ওর মায়ের কাছেই আছে। আগামীকাল কোর্টে আমাদের ডিভোর্সের ডেট। আর আমি সেজন্যই বাড়ি যাচ্ছি। অনেক কষ্ট করে কথাগুলো বলল রাজদীপ।
-- আপনাদের বিয়ে....
-- লাভ ম্যারেজ।
নির্জনে নিভৃতে কোথাও কোনো এক অচেনা মানুষের সাথে পরিচয় হলে, সেই অজনবি বোধহয় চার্চের কনফেশন বক্স হয়ে যায়। যেখানে নিজের হৃদয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকা সব কথা নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় বলে যাওয়া যায়। তার কাছে এই ভয় থাকে না, যে ও আমাকে জাজ করবে, দোষী অথবা নির্দোষ প্রমাণ করবে, অথবা কোনো রায় শোনাবে। তার কাছে যেমন কোনো আশা ভরসা থাকে না, তেমন কোনো ভয়ও থাকে না। ব্যাস, মন দিয়ে শোনার মতো কাউকে যদি পাওয়া যায়, তো আমাদেরই আওয়াজ অন্যদিক থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসে আমাদেরই জীবনে লেগে যাওয়া কোনো গ্রন্থিকে আপনে আপ উন্মোচিত করে দেয়।
রাজদীপ সুরভিকে বলতে থাকে তার আর অনিতার মধ্যে সম্পর্কের নানা ওঠা পড়ার কথা।
সুরভি তার অভ্যাস মতো কাগজ আর বিভিন্ন রঙের পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ে অনিতার ছবি আঁকতে। এখন অনেকটা হয়ে এসেছে। এবার শুধু শাড়ির রংটা করে দিলেই ছবিটা সম্পূর্ণ হয় -- আচ্ছা রাজদীপবাবু! আপনার ওয়াইফের চয়েসের কালারটা কি বলুন তো? নিজের ঠোঁটে একটা পেন্সিল চেপে ধরে প্রশ্ন করে সুরভি।
রাজদীপ বেশ চিন্তায় পড়ে যায় -- নীল, না না গোলাপী, না না সবুজ...
ধুর ছাই! অনিতার পছন্দের রংটাই ভুলে গেছি?
ওর সমস্ত চয়েসের ব্যাপারে, ও আমাকেই অগ্রাধিকার দিতো। সবেতেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, গুরুত্ব দিতো আমার চয়েসকেই। এই কারনে, ধীরে ধীরে সমস্ত ব্যাপারেই ওকে আন্ডার এসটিমেট করতে থাকি আমি...
সমস্ত দোষ আমার...
ওর ভালোবাসাকে আমি ওর দুর্বলতা ভেবেছি...
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাজদীপ।
বাইরের বৃষ্টি থেমেছে। সুরভির মোবাইলের রিংটোন বেজে ওঠে। মোবাইল কানে নেয় সে -- আরে বাবা, আমি ঠিক আছি... ডিনার করে নিয়েছি... চিন্তা করার কিছু নেই।
কি? এর মধ্যে তুমি গাড়ি নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে গেছো? ট্রেনের স্টেশনে পৌঁছতে তো এখনও বেশ কিছুক্ষণ দেরি আছে! আচ্ছা রাখো।
রাজদীপের দিকে তাকিয়ে সুরভি বলে -- রাজদীপবাবু, এখনো কিছুই শেষ হয়ে যায়নি। মন থেকে ভালবেসে একটা ফোন করুন ম্যাডামকে।
নিজের মানুষ যখন জিজ্ঞাসা করে, "কেমন আছো?"
যখন জিজ্ঞাসা করে, "খেয়েছো তো?"
যখন অন্তর থেকে বলে "আই লাভ ইউ..."
তখন যে কি ভালো লাগে, তা বোলে বোঝানোর নয়।
শুধুমাত্র একটা ডিভোর্স রুখে দেওয়া নয় ...
অন্তর থেকে বেরিয়ে আসা এই কয়েকটা শব্দ, বদলে দিতে জীবনের পুরো সংগাটাই।
রাজদীপ ফোন তুলে নেয় কানে --
অনিতা, কেমন আছো?.....
সুরভির পেন্সিল অনিতাকে রামধনু রঙের শাড়িতে সাজিয়ে তোলে।