Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

#মেট্রোরেল এবং দেবেশবাবুর #গল্প#সুস্মিতা(গতবছর অর্থাৎ ২০১৯য়ের দুর্গা পুজোর কয়েকদিন আগেই ঘটেছিল ঘটনাটা। মিডিয়া খুব সরব হয়েছিল কিছুদিন। তারপরে....????)
#গল্প 
    হোমিওপ্যাথি ওষুধের পুরোনো কৌটোর মধ্যে লুডোর ডাইসটা বেশ কয়েকবার ভালো ভা…

 


#মেট্রোরেল এবং দেবেশবাবুর 

#গল্প

#সুস্মিতা

(গতবছর অর্থাৎ ২০১৯য়ের দুর্গা পুজোর কয়েকদিন আগেই ঘটেছিল ঘটনাটা। মিডিয়া খুব সরব হয়েছিল কিছুদিন। তারপরে....????)


#গল্প 


    হোমিওপ্যাথি ওষুধের পুরোনো কৌটোর মধ্যে লুডোর ডাইসটা বেশ কয়েকবার ভালো ভাবে ঝাঁকিয়ে নিয়ে দান ফেললেন দেবেশবাবু।

"আরিব্বাস প্রথমবারেই ছক্কা।" বেশ উত্তেজনা বোধ হল দেবেশের। লাল গুটি বেরোলো ঘর থেকে।

 

 পাশের ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছে পায়রা দম্পতি। ওদের প্রেমের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। দেবেশবাবু কানটা একটু খাড়া করে শুনলেন... অন্ধকার ঘুটঘুটে নিস্তব্ধ বাড়িটাতে তবু একটু প্রাণের স্পন্দন। শব্দটা তার প্রিয়।

 আজকালকার ফ্ল্যাটবাড়িতে ঘুলঘুলি থাকেনা। ঘরে হওয়া বাতাসের জন্য আজকাল অন্যরকম ব্যবস্থা। "ঘুলঘুলি" শব্দটাও কেউ আর বলেনা আজকাল। ছেলেছোকরারা বোধহয় শোনেইনি কখনও ঘুলঘুলির কথা।


   "ছক্কা, চার পড়েছে" - লাল গুটিকে ঘর থেকে বের করে গুনে গুনে চার ঘর এগিয়ে দিলেন দেবেশ।

  জানালার পাশে রাখা চা জুড়িয়ে জল। ফুটপাথের চায়ের দোকানের ঝন্টু অ্যালুমিনিয়াম  মগে করে চা রেখে যায় রোজ সকালে, বিকেলে। 

কিছুদিন আগেও জানলা দিয়ে হাঁক দিলে,সঙ্গে সঙ্গে গরম চা দিয়ে যেত দোকানের কর্মচারী। 


 বর্তমানে মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে রাস্তায়। চায়ের দোকানটি একটু দূরে সরে গিয়েছে। ফুটপাথ জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি। দেবেশবাবুর হাঁকডাক এখন আর ঝন্টুর দোকান পর্যন্ত পৌঁছয়না। অতএব সকালে বিকেলে দুবার মগে করে চা রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা। নিজের মর্জিমাফিক সময়ে আর চা খাওয়া হয়না আজকাল দেবেশবাবুর। বেশিরভাগ দিনই ঝন্টুর রেখে যাওয়া চা ঠান্ডা হতে হতে ঘোড়ার পেচ্ছাপের মতো স্বাদ হয়ে যায়।


     প্রথম দানেই লাল গুটির "ছক্কা-চার" পড়েছে।  এখন এককাপ গরম চা দরকার। দেবেশ বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বসা অবস্থা থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে প্রায় তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগে আজকাল। 

পাশের ঘরে কেরোসিন স্টোভে ঠান্ডা 'চা'টাকে গরম করতে হবে।


     কয়েক মাস আগে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট হয়ে এই বাড়ির সব বিদ্যুতের লাইন টাইন জ্বলে গিয়েছে। বউবাজার পাড়ার প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো বাড়িটা সারা গায়ে অন্ধকার মেখে ভূতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে থাকে আজকাল।


   কিছু বছর আগেও মোট এগারোটি পরিবারের বসতি ছিল এই বাড়িতে। সরু অন্ধকার সিঁড়ির পাশেই মিটার ঘর। বৈদ্যুতিক তারের জটিল জঙ্গল হয়ে থাকত জায়গাটা। ফুটপাথে মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার কদিন পরেই আগুন লেগেছিল মিটার ঘরে। সেই যে সব লাইন টাইন জ্বলে গেল তারপরে আর সঠিক মেরামতি হয়নি। আগুন লাগার কারণ নিয়ে এবং পুরোনো বাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবস্থার স্বাস্থ্য ট্যাস্থ্য নিয়ে  খুব তদন্ত এবং সোরগোল হয়েছিল কদিন। টিভিতেও এই বাড়ির ছবি দেখা গিয়েছিল। 

 তবে শেষপর্যন্ত গরজ সহকারে দায়িত্ব নিয়ে লাইন সারানোর লোক আর পাওয়া গেলনা। এক এক করে সবাই তখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পথে। দেবেশবাবু নিজেও এই বয়সে বেশি ঝামেলা নিতে পারেননা।  মিটার ঘরটা ওইভাবেই রয়ে গেল। শুধু বিদ্যুতের তারগুলো সব মৃত।


      স্টোভ ধরিয়ে চা টা গরম করতেও কেটে গেল খানিকটা সময়। "প্রথম দানেই ছক্কা- চার পড়েছে।" - ব্যাপারটা সেলিব্রেট করা যাক। নাহ এখন তাহলে অ্যালুমিনিয়াম মগে চা খাওয়া চলেনা। 

 প্রায় মান্ধাতার আমলের বেঙ্গল পটারিজের দুটি চীনামাটির কাপ আজও দেবেশের সঙ্গী। ঘুটঘুটে অন্ধকার রান্নাঘরে অভ্যস্ত হাতে একটি কাপ দেরাজ থেকে বের করে নিলেন তিনি। চীনামাটির কাপে ঢেলে ঝন্টুর দোকানের চা। এটুকুই দেবেশবাবুর  বৌবাজারি বিলাসিতা।

 মুড়ির কৌটো খুলে বাটিতে কয়েক মুঠো মুড়ি ঢেলে নিলেন দেবেশ। সঙ্গে চারটি বাতাসা। তার জলখাবার।


  চা মুড়ি শেষ করে কাপ, বাটি এবং  মগটি মেজে ধুয়ে রাখতে হবে। বিকেলে ঝন্টু এসে মগ নিয়ে যাবে।


  এবাড়িতে এখন আর কোনো কাজের লোক আসেনা। একা দেবেশ বাবুর জন্য কেই বা আর আসবে?


     দেড়শো বছরের বৃদ্ধ বাড়ি। বাড়িটা ধীরে ধীরে এমনিতেই খালি হয়ে আসছিল। ঠিক যেমনভাবে একসময় পুরাতনের দিন শেষ হয়...


  এক কামরা, দু কামরার ফ্ল্যাট ছিল সব। অবশ্য যে আমলের বাড়ি,সেই সময়ে "ফ্ল্যাটবাড়ি" বলত কিনা কে জানে। জীবনযাপনের মতো শব্দেরও তেমন শৌখিনতা ছিলনা। 

 ভালো জিনিসের স্বাদ এবং খবর সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ জীবনে পৌঁছতইনা। বৌবাজার স্ট্রিটের ঘুপচি অন্ধকার ঘরই তাদের জগত ,কলকাতা শহরের আকাশটুকুই তাদের আকাশ...


      শিক্ষা,সভ্যতার অগ্রগতির হাত ধরে নুতন প্রজন্ম বহির্বিশ্বকে জানতে শিখল। এই বিশাল পৃথিবীকে জয় করার ইচ্ছা জাগল, চাহিদা বাড়ল। এটাই তো স্বাভাবিক... এটাই সভ্যতা।

 কালের নিয়মে এই বাড়িতে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা আর এই বৌবাজার স্ট্রিটের গন্ডীর মধ্যে আটকে থাকতে চাইলনা। কেনই বা তারা আটকে থাকবে?


      এগারোটি পরিবারের মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবার আগেই এই বাড়ি খালি করে চলে গিয়েছিল।


   তারপরে তো সেই মেট্রোরেলের ঘটনা...


  দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। রান্নাঘর থেকে আবার শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন দেবেশবাবু। বেলা বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে সূর্যের আলোও গতিপথ পাল্টাতে থাকে। এই ঘরের একটিমাত্র জানালা দিয়ে রোদ্দুর কৃপনের  মতো ভেতরে ঢোকে। দেবেশ বাবুর বিছানাটি জানালার ধারেই। রোদ্দুরটা বিছানার ওপরে সরে সরে যায়। তিনি সন্তর্পণে গুটি সাজানো লুডোর বোর্ডটা বিছানার ঠিক মাঝখানে সরিয়ে আনলেন, আলোর জন্য। 

বোর্ডে লাল গুটির ছক্কা-চার দান দেওয়া রয়েছে। 


বেলা বাড়ছে। পায়রাগুলোর আওয়াজ এখন পাওয়া যাচ্ছেনা। বাড়িটা বড্ড নিস্তব্ধ, শুনশান। ব্যস্ত রাজপথের শব্দ মাঝেমধ্যে হওয়ায় ভেসে আসে।


  দেবেশবাবু অন্যমনস্ক হয়ে যান। ফুটপাথে মেট্রোরেলের কাজ চলছে। কখনোসখনো সেই শব্দকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ বলে ভ্রম হয় দেবেশের। তিনি কান পেতে অপেক্ষা করেন- "কে এলো? কেউ কি এলো?" চকিতে মনে পড়ে ঝন্টু ছাড়া এবাড়িতে এখন আর কেউ আসেনা। সদর দরজাও আজকাল সবসময় খোলাই থাকে, এমনকি রাতেও। কড়া নাড়ার প্রয়োজন পড়েনা। এবাড়িতে কেউ আসেনা। চোর ডাকাতরাও জেনে গিয়েছে এই বাড়ির শূন্যতা...


    ঘড়ির কাঁটা দুটো পেরিয়ে গেল। আজ দেবেশবাবুর একেবারেই ক্ষিদেবোধ হচ্ছেনা। শরীরটা ঠিক যুতের নেই। কত পুরোনো কথাই যে আজ মনে পড়ছে...


      বছর খানেক আগের কথা... 

তিনঘর পরে "ধর বাবুরা" তখনও এই বাড়িতে টিকে ছিলেন। পুরোনো আমলের সোনা রুপার গয়নার কারিগর পরিবার। পড়ন্ত অবস্থা। দেবেশের সঙ্গে ছিল দীর্ঘ দিনের সহবাস।


 তারপরে একদিন সেই মাঝরাতে কি বিশাল আওয়াজ। রাস্তায় মেট্রোরেলের কাজ তখন পুরোদমে চলছে। হঠাৎ বিকট শব্দ করে আটের.বি. বৌবাজার স্ট্রিটের এই বাড়ির একদিক ভেঙে পড়ল...আচমকা হুড়মুড় করে। দেবেশবাবুর  ঘরের দেওয়ালেও বিশাল ফাটল। সে কি হুলুস্থুল কান্ড।


ধর বাবুর মা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। সেই রাতে ভয় টয় পেয়ে একেবারে অস্থির। ভোরের দিকে তাঁর তিন নম্বর হার্ট অ্যাটাক হল।


    এর পরের কয়েকদিন যে এই পাড়ায় কত শোরগোল চলল। সরকারি তদন্ত, বাড়ির স্বাস্থ্য অডিট, দুবেলা মিডিয়ার আনাগোনা, বাসিন্দাদের ইন্টারভিউ। রাতারাতি আশেপাশের বাড়িগুলো খালি করার ব্যবস্থা। পুরোনো বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা...সে এক মহাযজ্ঞ।


 ধর বাবুরাও তিনদিনের মধ্যে এই বাড়ি খালি করে চলে গেল।


 দেবেশ বাবুকেও সকলে সেই পরামর্শই দিয়েছিল। এই বাড়িতে থাকা বিপজ্জনক। তিনি কারুর কথা শোনেননি।


   দেবেশ বাবু কারুকে ঠিকমতো বোঝাতে পারেননা এই বাড়ির প্রাচীন গন্ধটা তাকে বড় টানে। কোথাও বেড়াতে গিয়েও তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননা। শুধু এই প্রাচীন গন্ধটার জন্যই...


  বেলা ঢলে পড়ছে। সূর্যের আলো দেবেশবাবুর বিছানার শেষ কোণাটি ছুঁয়ে ফেলেছে। এবার বিদায় নেবে...


    নাহ আজ আর দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবেনা। সকালে ঝন্টুকে বলে দিলে "দুপুরের খাবারটা" ওই দিয়ে যায়। ওদের চায়ের দোকানে ভাতডালের ব্যবস্থা নেই। আরেকটি ভাতের হোটেল থেকে ঝন্টু খাবার নিয়ে আসে, তবে সেটা ওকে আগে থেকে বলে দিতে হয়।


      আজ সকালে ঝন্টু যখন চা দিতে এসেছিল, দেবেশ তখন কলঘরে। দুপুরের খাবারের কথা বলা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে কদিন আগেও দেবেশ একতলায় গিয়ে সাহাবাবুর চশমার দোকান থেকে ঝন্টুকে একটা ফোন করে দিতেন। ঝন্টুর কাছে মোবাইল ফোন আছে। দেবেশবাবু ওসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জানেননা। তার কাছে ওরকম ফোন নেই।

 নীচের চশমার দোকানটিও এখন আর চলেনা, বন্ধ হয়ে গিয়েছে।


       আজ শরীরটা একেবারেই যুৎ লাগছেনা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে গিয়ে খেয়ে আসার মতো উৎসাহও পাচ্ছেননা দেবেশ। ক্ষিদেও সেরকম নেই। সকালের মুড়ি বাতাসা পেটের মধ্যে গজগজ করছে।


    ঝন্টু বিকেলে চা নিয়ে আসার সময়ে  রাতের খাবারের কথা বলে দিলেই হবে।


রোদ্দুরটা সরতে সরতে এবার চলেই গিয়েছে। দেবেশবাবুর অন্ধকার ঘর এখন আরও অন্ধকার।


দিন প্রায় শেষ...


  লুডোর বোর্ডে লাল গুটির ছক্কা- চার দান দেওয়া রয়েছে। এবার হলুদ গুটির পালা। দেবেশবাবুর আজ বড্ড অবসন্ন লাগছে। আজ একটু ঘুমিয়ে নিলে হয়। লুডোর বোর্ডটা ঠেলে একটু সরিয়ে রাখলেন দেবেশ...


দূর থেকে ভেসে আসছে মেট্রোরেলের কর্মকান্ডের গম্ভীর ধাতব আওয়াজ...


"ঝা চকচকে স্টেশন হবে, রেলগাড়ি চলবে এই রাস্তায়...শহরের মাঝখানে। ঝলমলে আলোয় ভরে যাবে চারদিক। বৌবাজার স্ট্রিটের এই বাড়িটাও কি আবার আলোয় সেজে উঠবে তখন? ইলেকট্রিকের লাইনটা সারানো হবে? বাড়িটার মেরামতি হবে? আটের.বি.বৌবাজার স্ট্রিট আবার লোকজনে ভরে উঠবে?"- ধীরে ধীরে দেবেশ বাবুর চোখের পাতা বুজে এল। তাঁর চোখের সামনে স্বপ্নের মতো,সিনেমার মতো একটা দৃশ্য ভাসতে থাকল... "আলো ঝলমলে... লোকজনের ভীড়ে গমগম করছে আটের.বি. বৌবাজার স্ট্রিট।"


     প্রাচীন বাড়িটার গন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে দেবেশ বাবু শেষবারের মতো গভীর ঘুমে ডুবে গেলেন...


 লুডোর বোর্ডে হলুদ গুটির দান দেওয়াটা  বাকি রয়ে গেল...


************