গৌতম মাহাতোঅখণ্ড চুটিয়া নাগপুর জুড়ে যে জনজাতি সুদীর্ঘ কাল ধরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন তারাই এই অঞ্চলের মূল আদিবাসী। তারা কুড়মি। আদিম জনজাতিগুলির মধ্যে কুড়মি উল্লেখ্যনীয় কারণটা অবশ্যই তাদের একান্ত নিজস্বতা, নিজস্ব রীতি …
গৌতম মাহাতো
অখণ্ড চুটিয়া নাগপুর জুড়ে যে জনজাতি সুদীর্ঘ কাল ধরে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন তারাই এই অঞ্চলের মূল আদিবাসী। তারা কুড়মি। আদিম জনজাতিগুলির মধ্যে কুড়মি উল্লেখ্যনীয় কারণটা অবশ্যই তাদের একান্ত নিজস্বতা, নিজস্ব রীতি নীতি, পরব-তেওহার ও নেগ-নেগাচার। বর্তমানে অবশ্যই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষার স্বীকৃতির পর তা পঠনপাঠনের বিষয় হিসাবে চালু করে হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই জনজাতিটি রয়ে গ্যাছে সেই তিমিরেই। এদের রহন-সহন, খাদ্যাভ্যাস, আদব কায়দা এবং সর্বোপরী জীবনযাপনের একটা বড় অংশ জুড়ে বয়ে গ্যাছে প্রকৃতি প্রেম। এরা হিন্দু/আর্য নয়। অনেক গবেষকের মতে এই জনজাতিটিও অন্যান্য আদিম জনজাতির মতোই টোটেমিক। অর্থাৎ এরা গোত্রে বিবেচিত নন, এরা গোষ্ঠীতে বিশ্বাসী। তাই এদের জীবনযাপন ও সংস্কৃতিতেও স্পষ্টভাবে ছাপ ফেলে প্রকৃতি। নানান ট্যাবু ও টোটেমদের মধ্যে প্রকৃতি তার গভীর প্রভাব আচ্ছাদিত করে রাখে। হাবার্ট একেই ‘প্রেতবাদ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
এই কুড়মি জনজাতির ভাষা ও জীবনের মতোই এদের পার্বণগুলিও ভিন্নতর স্বাদের এবং অদ্ভুত সুন্দরও। যেমন- ছাতা, জিতা,আখ্যান, টুসু, ভাদু, করম, বাঁদনা ইত্যাদি। এখানে আলোচনা করব এইসব পরব-তেওহার নিয়েই। যদিও সম্পূর্ণ পরব-পার্বণ ও নেগ নেগাচার সম্ভব হবেনা তবুও মূল কয়েকটি আলোচনার মাধ্যমে পরিচয় ঘটাব এদের সাথে।
কুড়মিদের জীবন জল, জঙ্গল ও জমির মধ্যেই আবর্তিত হয়। তাই পার্বণগুলিও এদের ব্যাতিরেকে নয়। মূল কথাটা হল এরা প্রকৃতি প্রেমিকের সাথে সাথে প্রকৃতি পুজারিও। তাই কুড়মিদের নেগ-নেগাচারে মূর্তিপূজার প্রচলন প্রায় নেই। যে কটা মূর্তিপূজার নিদর্শন দেখা যায় সেগুলি আসলে অর্বাচীন প্রথা বা বীরগাথার অংশ। তার মধ্যে পড়ে টুসু এবং ভাদু যা প্রতীকী সম্মান জ্ঞাপন। কুড়মিদের নিজস্ব ক্যালেন্ডারো বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রিন্টেড মেটিরিয়াল হিসেবে পাওয়া যায়। তবে সেটা যৎসামান্যই। তাছাড়া বাকী সব কিছুই স্মৃতি ও পরম্পরায় প্রায় তিনহাজার বছর ধরে বহন করে আসছেন এরা। কোন প্রামাণ্য কোনও লিখিতরূপ ছাড়াই।
★★জাওয়া / করমঃঃ
চুটিয়া নাগপুরের একটি অন্তরের পরবগুলির মধ্যে এটিই অন্যতম। এটা মূলত শিশুদের উৎসব। আসলে কুড়মিরা কিন্ডারগার্ডেন অনেককাল আগেই স্থাপন করেছিল তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে। বা বলা যায় নীতিশিক্ষার পাঠ তারা প্রতিফলিত করে তাদের উদযাপনের ভেতর। ঔচিত্য অনৌচিত্যের পাঠ তথা প্রকৃতির সাথে মাখামাখি হতে শেখায় এই পরব। শিশুদের আনন্দ উদযাপনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আসল শিক্ষা যা তারা না জেনে না বুঝেই সম্পৃক্ত হয়ে যায় লোকপশিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার শেকড়ে। তারা ভালবাসতে শেখে প্রকৃতিকে। তারা গায় –
“আজ রে করম ঠাকুর ঘরে দু-আরে রে
কাইলরে করম ঠাকুর শাঁখ লদির পারে।”
প্রাচীন ভারতে যেমন নীতি শিক্ষার জন্য লেখা হয়েছিল গল্প সাহিত্য, ইংরেজিতে ফোক্ টেল, ফেব্লস তেমনি কুড়মিরা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রুতিকে মাধ্যম করে এই অনুষ্ঠান। এই উতসবটি দুটি ভাগ করে নিলে সুবিধা। একটি জাওয়া অন্যটি করম। করম তিথি নির্ভর। ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীর দিন মানে পার্শ্ব একাদশীতে এই উৎসব পালন হয়। এটি মূলত শিশু ও কিশোরী মেয়েদের উৎসব হলেও ছেলেরাও অংশ নেয়। নির্জলা উপবাস করে তারা বন থেকে পাতা দাঁতন সংগ্রহ করে আনা, করম ডাল আনা, করম ডাল পোঁতা এসব কাজে নিযুক্ত হয়। কিন্তু মেয়েরা মেতে ওঠে আসল উৎসবে। সেটা একসপ্তাহ আগে থেকেই। মূলতঃ অবিবাহিতরাই এর উপাসক।
গ্রামের কিশোরীরা এক সপ্তাহ আগে নতুন বোনা টুপা বা ডালা (বাঁশের বোনা বাটির মত আদলের ঝুড়ি) নিয়ে নদী বা খালের ধারে তারা জড়ো হয়। স্নান করে সঙ্গে নিয়ে আসা বিভিন্ন শস্যবীজ টুপাতে বালি ভর্তি করে ভক্তি সহকারে বপন করে। তারপর শুরু হয় গোল হয়ে হাতে হাত ধরে সমবেত কন্ঠে গান আর নাচ। এই নাচের রিদম অনন্য। এতে আনন্দ আছে তবে অত্যধিক উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ নেই। শান্ত, ধীর ও লালিত্যময়। এই গানে শুধু করম ঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা নয় বরং এই গানে থাকে তাদের নিজস্ব দুঃখ, দুর্দশা ও আক্ষেপের কথা। এই সময় করম ঠাকুর হয়ে ওঠে তাদের সখা, যাঁকে মনের সবটুকু উজাড় করে বলা যায়।
১) “একদিনকার হলৈদ বাটা তিন দিনিকার বাসি গ
মা-বাপকে বল্যেঁ দিবি বড়ই সুখে আছি
হবক-ডবক ঢালা মাড়ে বাঁটে শাসুই ভাত গ
নিগাইতরা পেটটাকে মারে খটা দিন রাত।”
২) “ কুল্হি মুড়ায় কুল্হি মুড়ায় এক ঝুপড়ি গ
হুলকি হুলকি বহিন কাঁদে।
তথায় সে বড় দাদা আসিয়ে বসিল গ
চইখ্যের লর পুঁছাতে লাগিল
না কাঁদ্যো না কাঁদ্যো হামার বহিনী গ
বনায়ঁ দিব দালান কঠা ঘর।”
এভাবেই তারা জাওয়া পাতায়। এই জাওয়া তাদের আগামী সাতদিনের সই। তারা জাওয়া ডালা নিয়ে এই কদিন ঠিক সন্ধ্যা হলেই গ্রামের আখড়ায় বা কুলহি মুঢ়ায় (যেখান থেকে রাস্তা ভেঙে গ্যাছে) জড়ো হয়ে চলে গান এবং হাত ধরাধরি হয়ে নাচ। আর জাওয়া ডালাগুলিকে মাঝে রেখে প্রদক্ষিণ।
“ আইসঅ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধর্যেঁ নাচি লো
এক মনে জাওয়া দিব জাওয়া যেমন
রাঢ়েহ লো
হামদের জাওয়া উঠে যেমন শাল ধুঁধের পারা লো।”
এই জাওয়া ডালায় জাওয়া পাতানোর পর থেকেই চলে তাদের নিষ্ঠা ভরে নিয়ম পালনের ব্রতও। এই জাওয়া ডালার শুচিতা বজায় রাখতে ঐ সাতদিন তারা শাক খাবেনা, খাটিয়ায় ঘুমোবে না ইত্যাদি। এর অন্যথা হলে জাওয়া ফুঁবদে যাবেক(বৃদ্ধি ব্যাহত হবে)। এক সপ্তাহ কঠিন সাধনার মধ্যে কাটিয়ে ঠিক পার্শ্ব একাদশীর দিন তারা জঙ্গলে গিয়ে ফুল ফল পাতা সংগ্রহ করে আনে। ঐদিন নিরম্বু উপবাস। তারা সারাটা দিন জঙ্গলে এই কাজ করে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে এসে করম ডালায় আতপ চাল, ঘি, গুড়, মধু , ধুনো ইত্যাদি নিয়ে পোঁতা করম ডালের কাছে যায়। ইতিপূর্বেই গ্রামের কিশোর যুবকেরা লায়াকে (গ্রামীন কুড়মি পুরোহিত) নিয়ে করম গাছের ডাল এনে আখড়ায় পুঁতে রাখে। সেই বেদিমূলে গাঁয়ের মেয়েরা তাদের নৈবেদ্যর সাথে একটা কাঁকুড় (শশা) এবং একগাছি ধানগাছ নিয়ে উপস্থিত হয়। তারা করম ডালটি ঘিরে বৃত্ত করা প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে। মাঝে করম ঠাকুরের পাদদেশে বসে লায়া। এরপর শুরু হয় গল্প। করম ঠাকুরের গল্প। করমু আর ধরমু দুই ভাই এর করম ঠাকুরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার গল্প। এই গল্পগুলি নীতিশিক্ষামূলক। যা ব্রত পালনকারীদের সুস্থ, স্বাভাবিক ও সামাজিক করে তোলে। ঐ ব্রতীরা যে কাঁকুড়টি নিয়ে আসে সেটি তারা তাদের ব্যাটা (পুত্র) রূপে কল্পনা করে। যদিও একাদশী সাধারণত হয় বিধবাদের। কিন্তু এই পার্শ্ব একাদশীর ভিন্নরূপ প্রতিফলিত হয় আপামর জঙ্গলমহল জুড়ে। এই একাদশী কুমারী কিশোরীদের। তারা প্রার্থনা করে স্বামী পুত্র সংসারের। তারা মঙ্গল কামনা করে পরিবারের তথা সমাজের। তারপর সারারাত ধরে চলে নাচ গান।
পরের দিন ব্রতচারিনীরা তাদের সব নৈবেদ্যের সাথে তাদের কল্পিত পুত্র সেই কাঁকুর এবং জাওয়া ডালাকে জলাশয় বা নদীতে বিসর্জন দ্যায়। জাওয়ার কিছু কিছু বাড়ীর আনাচে কানাচে গুঁজেও রাখা হয় পরিবারের মঙ্গলার্থে। সে বছরের মত তারা করম ঠাকুরকে বিদায় জানায় গানে গানে।
১) “জাহু জাহু করম রাজা জাহু ছয় অ মাস
আওতঅ ভাদর মাস, আনবঅ ঘুরাঞ।”
২) “যাছে যাছে করম ঠাকুর যাছে লো ছাইড়্যেঁ
ঝিঙ্গা পড়াআ বাসি ভাত যাছে লো খাঁয়েঞ।”
৩) “তুঁঞ ত রে করম রাজা যাবি হাঁসিঞ হাঁসিঞ
মুঁঞ ত রে করম রাজা যাব কাঁদিঞ কাঁদিঞ