Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

★ধারাবাহিক আত্মচরিত - আহাম্মকের গদ্য★

লেখক পরিচিতি - একসময় লিখতেন, এখন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাম। সব জয়ঢাক থেকে, চাওয়া পাওয়া থেকে সরে নিশ্চিত যাপনে আছেন।লেখেন, তবে সেটা কেন লেখেন নিজেও জানেন না। নিজের পরিচিতিতেও ঘোর আপত্তি।বলেন "নাম না দিয়েই ছেপে দেওয়া যায় না? …



গৌতম মাহাতো
লেখক পরিচিতি - একসময় লিখতেন, এখন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাম। সব জয়ঢাক থেকে, চাওয়া পাওয়া থেকে সরে নিশ্চিত যাপনে আছেন।লেখেন, তবে সেটা কেন লেখেন নিজেও জানেন না। নিজের পরিচিতিতেও ঘোর আপত্তি।বলেন "নাম না দিয়েই ছেপে দেওয়া যায় না? তাহলে যার হোক নাম দিয়ে দিও।"

      তার লক্ষ্যও নেই উদ্দেশ্যও নেই আছে শুধু অফুরান পথ। শুধুই হেঁটে যাওয়া। বিবাগী মুসাফির। লেখা তো লেখাই তার আবার পেটেন্ট বসিয়ে কি যে ছাই প্রমান করতে যাই জানি না। ঝাড়গ্রামের মানুষ। তাই বোধহয় এমন শালের মত ঋজু তার মনন। তিনি কি করেন জিজ্ঞেস করাতে বলেন--অপেক্ষা।ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা বা কারুর আসার অপেক্ষা...

জন্ম- ১৯ জানুয়ারি- "আর মৃত্যু তো হামেশাই হয়, চেতনার, মননের,রুচির,বোধের.. শরীর তো জড় মাত্র"! এমনই এক বিচিত্র মানুষের লেখা এবারের দেশ মানুষে

------------------------



ধারাবাহিক আত্মচরিত

★★আহাম্মকের গদ্য★★

  গৌতম মাহাতো

•••••••••••••••••••••••••

বারবার মনে হচ্ছে এই সমাজ সর্বত ভাবেই অপরাধের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে।সুপিরিয়র সবসময় সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর ক্রাইমের দিকে ইনফিরিয়রের গতি বদলে দ্যায়। যে গতির শুরু এবং শেষ তার অধীনস্থ থাকে না,অথচ সমাজের বিশ্লেষণে সে গতির নিয়ন্ত্রক সে নিজেই-ই।স্বয়ংকৃত।কিন্তু যে এই গতির ধারায় ভেসে চলে তার অনিয়ন্ত্রিত অপরাধের গ্লানি নিয়ে, সে তার ব্যাখ্যা করতে পারে না। এই যেমন ধর কাজের দিদিটি আজ এলো না। আমার বৌ ফোন করল। বলল আজ বাড়ির কাজে একটু আটকে পড়েছি বৌদি, এবেলা আর যাব না।আমার বৌ 'আচ্ছা' বলে ফোনটি রেখে দিয়ে গজগজ করতে লাগল

  --এটা এর রোজকার রুটিন হয়েছে,উফফ। এখন আমি কি করি?একগাদা কাজ পড়ে আছে এখনও কি করব!আর কি করব না বুঝে ওঠাই দায়।

    বললাম- তুমি ফোনে কিছু বললে না ক্যানো তাকে?

বৌ বলল এই তো তোমার বুদ্ধি!এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি সংসার করছো!!

আমি বুঝলাম না, শালা আমার  দোষটা কি?খামোখা আঁখের রস পুঁইডাঁটায় কেন ঝাড়ছে রে বাওয়া।

কিন্তু তিনি তাঁর মেশিনগান চালিয়ে যাচ্ছেন গ্যাদ্গ্যাদ গ্যাদগ্যাদ করে।

  তাকে ফোনে যদি ঝাড় দিতাম সে এরপর থেকে আর কামাই করলে ফোনটাই ধরবে না আর,তখন আরও মর।সকাল বারোটা অবধি কলতলায় বাসন পড়েই থাকবে আর আমাকে চারবার গা ধুয়ে ধুয়ে কাজগুলো সারতে হবে।তুমি আর কি বুঝবে, বইএর ডিপোয় বসে বসে কি যে ভ্যারণ্ডা ভাজো সে তুমিই জানো আর উপর ওয়ালাই জানে!!

    ঠিক কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না।বলতে ইচ্ছে করছিল অনেক। এই যেমন -- কাজের দিদি হল স্বর্গীয় দূতী তার একবারও গা না ধুয়েও সব কাজ দিব্বি পরিশুদ্ধ ভাবে হয়ে যায়।যা তোমার হয় না।কিম্বা ফোনে ঝাড় না দিয়ে এই নিরীহ প্রানীটিকে খালপোষ করার মানে কি বুঝলাম না,পরের দিন আসার পর ঝাড় দিলে কি সে ঝাড়ের এফেক্টটা ফোনে পড়বে না!!

কিন্তু নাহ-কিছু বুঝি আর নাই বুঝি, এটুকু বুঝেছি "সুখের চেয়ে শান্তি বড়।" অতএব "চল মন নিজ নিকেতনে"।

  এখন তোমরা বলবে এতে ক্রাইম কই!

আমি বলব আছে আছে......., যেমন ভাবে অনন্তকে খুঁজতে হয় তেমনই ভাবে তোমাকেও ক্রাইম খুঁজে নিতে হবে এর যাবতীয় খোলস উন্মোচন করে।তাই খুঁজুন খঁজুন.......  পাইলে পাইতে পারও অমূল্য রতন--

 

          ★ডিটেকটিভ ও বাবা★


তখন আমরা খুব ছোট।আমরা মানে আমি আর বুড়ু।বুড়ু আমার বোন। বাবার বদলি-সুলভ চাকরির সুতোয় আমাদের কচুরিপানা জীবনেও টান পড়ল।গ্রাম থেকে উঠে এলাম জেলা শহরে। এখানে সবই কেমন দুর্বোধ্য মনে হত।মনে হত রাশি রাশি এলিয়েন আমার চারদিকে ঘুরে ব্যাড়াচ্ছে হাসছে বাজার করছে খাচ্ছে খেলছে অথচ তারা আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় য্যানো আমিই এলিয়েন। আসলে তারই ঠিক ছিল এতদিনে বুঝতে পারি।মেজরিটির নামই সমাজ,সরকার।আমরাই এলিয়েন।যাগ্গে যাক,সে সব বলতে গেলে আবার অনেক বোঝাতে হবে,মাগনায় অত পারা যাবে না।যা বলছিলুম, তো এখানে এসে পরিচয় হল মউলিদিদের সাথে। মউলিদির মা বড় ইস্কুলের দিদিমনি।কিন্তু পাশের বাড়ির কোয়ালিফিকেশনেই হোক বা আমাদের নীরব প্রশ্রয়েই হোক পরিচয়টা হয়েই গ্যালো।মায়ের সাথে আন্টির প্রথম প্রথম তরকারি বিনিময় পরে ছাদে তাঁর চুল শুকোনো ও মায়ের গুল দিতে বসে,গালগপ্পে বেশ সম্পর্কটা জমেই গ্যালো।কিন্তু কাল হল আমার।মউলিদি কত ভালো পড়াশুনোয় আর আমি... ইত্যাদি ইত্যাদি শুনতে শুনতে আমি আরও একা হয়ে পড়ছিলাম।সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে মনকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করতাম শহরটা খুব ভালো।কাকের দল কনসার্ট শুরু করলেই আইসক্রিম ওয়ালাটি পেরিয়ে যেত।লোভ হত কিন্তু উপায় হত না।দু একবার মা পয়সা দিয়েছিল কিন্তু পরে আর পেতাম না।আর ক্রাইমটার শুরু প্রায় সেখান থেকেই।বাবা একটি লাল প্লাস্টিকের গ্লাসে দুটো পালকের সাথে বাজারের খুচরো পয়সা রাখতো।পাঁচ পয়সা দশপয়সা কুড়ি পয়সা চারআনা আটআনা আর তার ওপরে লম্বালম্বি খাড়া করা দুটো অতি সাধারণ পায়রার পালক। 

   এমনই একটা সন্ধে আগলে বসে আছি।রাস্তার ওপারের শিরিশ গাছটাতে একটু একটু করে নিঃসঙ্গতা জমা করছে কাকেরা ঠোঁটে ঠোঁটে। হঠাতই  এলেন তিনি। সব ক্রাইমই আসার আগে এমনই হয়তো সব নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে।যে ভাবে সেদিন আইসক্রিম ওয়ালাকে দেখে আমার লোভ বুদ্ধির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল।বেড়ালের মত পা ফেলে হাত বাড়ালাম সেই লাল গেলাসের দিকে।টুক করে ঝেড়ে দিলুম একটা আস্ত আইসক্রিম থুড়ি আধুলি।তারপর আর কি! সেদিন ওই আইসক্রিম আমার সাময়িক লোভ প্রশমন করল ঠিকই কিন্তু তখন এটা বোঝার বয়স হয় নি যে ইন্দ্রিয় কখনও মরে না সাময়িক স্তিমিত হয় বটে কিন্তু পরে সেটা তার চতুর্গুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসে যা আরও বড় ক্রাইমের দিকে আমাদের ঠেলে নিয়ে যায়।

    সন্ধে বেলা বাবা অফিস থেকে ফেরার পরই অদ্ভুত ভাবে ধরা পড়লাম।বাবা বলল তুই আমার গ্লাস থেকে পয়সা নিয়েছিস?? আমি অবাক। জানল কি করে রে বাবা!! ঘরে তো কেউই ছিল না যখন নিই।আমাকে আইসক্রিম খেতেও কেউ দেখেনি। এই বিষয়ে আমি যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনও করেছি।কোনও ভাবেই জানতে পারা সম্ভব নয়! তাহলে! জানল কি করে...

কি করে??? কিছুতেই বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না।মনে হল তাহলে ওটা অঘটন বা কাকতালীয়, এইটুকুই বোঝাতে সক্ষম হলাম নিজেকে। তবুও আমাকে আরও সবধান হতে হবে।

  এরপর  একবার দু-বার তিনবার যতবারই নিয়েছি আশ্চর্যজনক ভাবে ততবারই ধরা পড়েছি...

    আমি বুঝে গেছলাম এটা কোনও কাকতালীয় ব্যাপার ঘটছে না,বরং আমি কোনও ট্র্যাপে সুপিরিয়র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই সন্দেহ আরও তীব্র হল যখন বাবা গম্ভীর মুখে ডেকে বলল এই বুদ্ধি নিয়ে চুরি করিস? গবেট। চুরি করার জন্য বুদ্ধি লাগে, বুদ্ধি। লেখাপড়া করতে হয়। 


                             পর্ব-২



পাঠকরা এই পর্যন্ত পড়ে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন সেই ট্র্যাপটির আগাপাশতলা? কারণ এই সময়ের পাঠক অদ্ভুত ভাবে সচেতন, প্রায় প্রত্যেকে এক একজন ব্যোমকেশ,ফেলু মিত্তির কিম্বা নিদেনপক্ষে মিতিন মাসি। তা সে যাই হোক এই পর্যন্ত এসে সবাই হয়তো ভাবছেন গপ্পটা জমলো ঠিকই কিন্তু অন্তর্রস সে ভাবে ক্ষরণ হল না।অর্থাৎ ক্রাইম সাসপেক্টকে জাস্টিফাই করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তাদের জন্য পরবর্তী অংশ।

      এই ভাবে বার কয়েক ব্যর্থতার পর আমি গ্লাসটা একদিন না ছুঁয়েই গভীর ভাবে দেখতে লাগলাম। বারবার একটা জিনিসই আমার চোখ মন দুই টানতে লাগল। পালক দুটো। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলুম না এই পয়সার গ্লাসে পালক কেন?বাবার কানে পালক দেওয়াতেও ঘোর বিরোধী।মায়েরও সে অভ্যেস বা নেশা নেই।তাছাড়া সেগুলোর মধ্যে এমন কোনও বিশেষত্বও নেই যে সাজিয়ে বা সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।তাহলে?এবার আমার কাছে খেলার নিয়মটা একটু একটু স্পষ্ট হতে লাগল।শীতে, ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে যে রকম সূর্য বেরিয়ে আসে সে ভাবেই আমার ভেতরের ক্রাইম সাসপেক্ট আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে তুলল।একদিকের পালকটা আলতো আঙুলে সরাতেই দেখলাম খুব ছোট্ট একটা নীল কালির দাগ।আমার স্নায়ুটা হঠাৎ ঝিনন্ মেরে উঠল।এবার অন্য পালকটা সরাতেই ট্র্যাপ থেকে বেরোনোর রাস্তাটা খুলে গ্যালো।দেখলাম একই রকম নীল কলম দিয়ে চিহ্নিত আরও একটি দাগ।একটু একটু করে সব দরজার দাবিগুলো খুলে যাচ্ছিল। বুঝলাম তাড়াহুড়োয় পালক হয়তো যথা নিয়মে কখনও কখনও রেখেওছি কিন্তু সেটার মেরুদণ্ডটা ওই চিহ্নিত দাগের ওপর রাখা হয়নি।আরও একটা বিষয় পালক দুটো আছে সাধারণ নিয়মে রাখা অবস্থার বিপরীতে, অর্থাৎ মুখোমুখি (দেখে মনে হবে)। 

     এবার আমি আর আইসক্রিমের জন্য পয়সা নিলাম না।নিলাম ট্র্যাক ডি-কোড হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে। এবার অপেক্ষা।সন্ধে অবধি অপেক্ষা।বাবার ফেরার অপেক্ষা কোনওদিন এভাবে এর আগে করেছিলাম কি না মনে পড়ছিল না।

  বাবা ফিরলেন যথা নিয়মেই কিন্তু আমার ডাক পড়ল না।সব অতি সাধারণ দিনের মতই দিনের শেষ হয়ে গ্যালো। শুয়ে শুয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল ইউরেকা...  ইউরেকা... 


   কিন্তু মুশকিল জীবন তার গতিপথ অন্য ভাবে লিখতে পছন্দ করে।আপনি একটি সমস্যার সমাধান  করুন পরমুহূর্তেই তারচেয়েও জোরালো অন্য আর একটি সমস্যা দাঁত কেলিয়ে এসে দাঁড়াবে।এবার সেই সমস্যা এলো মৌলিদি ও তার মায়ের হাত ধরে।আমরা সন্ধে বেলা পড়তে যেতাম বাপ্পাদার টোলে (তখন আমরা টিউশন শব্দটা অত ব্যবহার করতাম না)।মাকে এই টোলটির খোঁজ দিয়েছিল মৌলিদির মা-ই। মৌলিদি দুর্দান্ত রেজাল্ট করত।সব বিষয়েই চৌখস।সে জায়গায় আমি ভেদো মৎস্যটি।মায়েরও সাধ হল আমাকে সেখানে পড়াবে।তাই বাবা একদিন নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিল।বাবা রাতের দিকে গিয়ে শুধু নিয়ে আসতো আমাকে ও মৌলিদিকে।এই পর্যন্ত ঠিক ছিল সব।কিন্তু কেলোটা হল এরপর থেকে।পড়া শেষে আমরা বেরিয়ে দেখতাম বাবা দাঁড়িয়ে আছে।আর মৌলিদি গদগদ হয়ে বলছে জানেন আঙ্কল আজ ওকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।তিন তিনটা অঙ্ক ভুল করেছে।এর সাথে বর্ণনা।মনে মনে ভাবছি যাহ শালা আমাকে কি দেশের শিক্ষামন্ত্রী হতে হবে বলে বাপ্পাদার কাছে পড়তে পাঠায় নাকি!! বাবার মুখটা এমনিই গম্ভীর তার চেয়েও আরও গম্ভীর ও কালো হয়ে উঠল।মনে হল কোথাও বজ্র-বিদ্যুৎ সহ ঝেঁপে নামবে বোধহয়।কিন্তু নাহ দেখলাম দুরদর্শনের আবহাওয়া বিশারদ গোলদারের রিপোর্টের মতই তা ভুল। ঠিক ভুলও আবার বলা চলে না।কিয়দাংশে একটা প্রতিক্রিয়া আসতো।সেটা পরেরদিন সকালে পড়তে বসে।যখন বাবা কে.সি নাগের বই থেকে দুটো পুরোনো অঙ্ক কষতে দিত। তার মধ্যে একটি পিতা-পুত্রে আর অন্যটা গোরু মহিষের।আর আমিও অবধারিত ভাবে দুটোই প্রতি বারেই ভুল করতাম। তারপরই শুরু হয়ে যেত একটা দেড় ঘন্টার বিনা অ্যাডের শো।মনে মনে ভাবতাম পিতার বয়স পুত্রের বয়সের দ্বিগুণ তো হবেই এটা অত ক্যালক্যুলেশন করার কি যে আছে কে জানে।আর বড় হয়ে আর যাই করি গোরু-মহিষের কারবার করব না।

     তো যাগ্গে যাক। গল্পে ফিরি।তো এই ভাবে রোজ রোজ মৌলিদি পড়ে বেরিয়ে আমার মানসিক ধর্ষণ করতে লাগল,সেটাও আমার বাবারই কাছে। এই প্রক্রিয়াটা ক্রমে ক্রমে পরিশীলিত হয়ে আরও তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। আর মৌলিদিও ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলায় ওস্তাদ হয়ে উঠছে।সাথে মৌলিদি ও তার মায়ের ছাদে চুল শুকোতে যাওয়া আমার মায়ের মস্তিষ্ক প্রক্ষালন।

  "জানেন গো মৌলি না বিজ্ঞানে পঞ্চাশে সাতচল্লিশ পেয়েছে।"

    "জানেন দিদি মৌলি ইংলিশে প্যারগ্রাফটা এমন লিখেছে, যে দিদিমনি ওই লেখাটাই ক্লাসের সবাইকে লিখিয়ে দিয়েছে"

       মাঝে মাঝে মনে হত খামোখা সর্বপল্লীর জীবনী না পড়িয়ে এটাই সিলেবাসে রাখতে পারত! আর আপনিও আপনিও আপনার মেয়ের নাম মৌলি না রেখে মৌলবাদী রাখতে পারতেন।যে অন্যের স্বাভাবিক উন্নতি ব্যহত করে। যত্তসব।

   এই ভাবে চলছিল ঠিকই আমিও মেনে নিয়েছিলাম।কিন্তু এরপর এলো নৈতিক আক্রমণ। আমার বাড়ির-পড়া সারতে বসলেই মৌলিদি পৌঁছে যাবে- খেলবি?

আমিও উটকো লুডোড়ু।হয়ে যাক এক হাত। পড়তে গিয়ে বুঝতাম ব্যাপারটা ঠিক হয় নি।তিনি তাঁর সব গুছিয়ে টুছিয়ে এসেছেন কোনও এক গোপন সময়ে।আর পড়ার সময় আমাকে বানিয়েছে লুডোড়ু। একটু একটু বুঝতে পারছিলাম এও একটা ট্র্যাপ, যা সুপিরিয়রের হাতে নিয়ন্ত্রিত। আমি ওই লুডোর লাল নীল ঘুঁটিগুলো ছাড়া কিছু নই।সেদিন রাতে স্বপ্নেও দেখলাম আমার মুখটা ক্যামোন চ্যাপ্টা মত।রঙটা পাল্টে যাচ্ছে সামান্য একটু সময়ের ব্যবধানে ব্যবধানে।কখনও নীল কখনও সবুজ কখনও লাল কিম্বা গেরুয়া।

      আমি বুঝেছিলাম আমাকে আরও একবার নামতে হবে এই খ্যালায়।আসলে ভিকটিম কখনওই বুঝতে পারে না যে ক্রাইমই আসলে তাকে দিয়ে ক্রাইমটাই প্রতিষ্ঠিত করে নিচ্ছে।এর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।গ্রাস করার জন্য মুখ তো আছে কিন্তু লেজ নেই।যতই শেষের দিকে যাবে ততই গভীর থেকে গভীরতর অভ্যন্তরে প্রবেশ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

    না অন্য সময় বার করে পড়া না।ওটা হলে তো আর ক্রাইম এস্টাবলিস হয় না মোহায়।ক্রাইম সব সময় অফবিট।একদিন মৌলিদিকে বললাম আইস ক্রিম খাবে?বলল হ্যাঁ।কিন্তু আন্টি তো নেই পয়সা পাবে কোথায়?

বললাম- আছে আছে..

এই কথাগুলো বলার সময় একটা রহস্য সৃষ্টির চেষ্টা করলাম।আমি জানি আমি ভালো অভিনেতা নই,কিন্তু এও জানি লোভ যেখানে চলে আসে সেখানে দর্শকও হাবাগোবাই বোনে যায়। যথারীতি আমি আমার কুবেরের ভাঁড় থেকে দুটো আধুলি বার করে আইসক্রিম সাঁটালাম। খেতে খেতে মৌলিদিকে বললাম বাবাকে বোলো না কিন্তু।মৌলিদি আমার চেয়ে পঞ্চাশগুণ বেশি বুদ্ধিমতি আমি জানি ও মানি।আমার অত বুদ্ধি নেই তাই আমি শুধু পঞ্চাশগুণের পর থেকে সবে ভাবতে শুরু করেছি মাত্র।

      সেদিন ছক্কাটা যখন সাদা কৌটোয় ভরে নাড়ছে তখন মৌলিদির দুটো ঘুঁটি পুট-এর দানে বসে।পুট পড়লে কোনটা আগে পাকাবে লালটা নাকি সবুজটা? আর আমি কয়েক ঘর পেছনে।পাকা ঘর থেকে একটা আটের'এর ঘরে আর একটা তিনের ঘরে। যথারীতি মৌলিদির পুট পড়ল। সবুজটা পেকেও গ্যালো।কিন্তু পরের দানে আর সঙ্গ দিল না।

       এই দিন পড়ে বেরিয়েই আমি এক অদ্ভুত সমীকরণ মেলানোতে বুঁদ হয়ে আছি। আমাকে যেন কি একটা নেশায় পেয়েছে।তবে সেটা কি বুঝতে পারছি না।দেখলাম নাহহ মৌলিদি কিছুই বলছে না আজ।আমার দুপুরের লুডো খেলার কথাটা মাথায় আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গ্যালো। মৌলিদি সবুজ ঘুঁটিটা না পাকিয়ে লালটা পাকালে হয়তো পরিস্থিতি অন্য হলেও হতে পারতো। 

   আমরা ততক্ষণে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছি।মৌলিদি এক্কেবারেই নিশ্চুপ। ঠিক বড় ঝড় আসার আগে য্যামোন হয়।একটা গুমোট ভাব।মনে হচ্ছিল ঝড়টা উঠুক,একটু স্বস্তি পাব।কিন্তু নাহহ। সে সবুজ পাকানোতেই মজা পেয়েছে বোধহয় ! কিন্তু... মৌলিদির স্বভাব! লোভেরও তো নিবৃত্তি ঘটেছে আগেই! তাহলে লাল ঘুঁটি পাকবে না ক্যানো!! আচমকা মৌলিদি তার মৌনতা ভাঙল।

   --আঙ্কল জানেন? ও না আজ লাল গ্লাস থেকে পয়সা নিয়ে আইসক্রিম খেয়েছে।

  বাবা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে আড়চোখে একবার দেখল,তাকানোটা অদ্ভুত।এর আগে এই দৃষ্টি বাবার চোখে দেখিনি।খুশির না রাগের নাকি হতাশার!ঠিক ঠাহর হল না। শুধু বাবা বাড়ি ফিরে একবার লাল গেলাসটা দেখে মৃদু হেসেছিল বোধহয়।আজ সেই স্মৃতি অনেকটাই ঝাপসা।

    আমার ততক্ষণে স্বস্তি ফিরেছে।ঝড় উঠেছে। মৌলিদি আমার মত জনগণের কথা মাথায় রেখে লাল ঘুঁটি পাকিয়েছে। সবই যাকে বলে ফটো ফিনিস। পরের দিন খেলাটার পার্ট টু পেস করলাম।তখন বিকেলে শেষ দিক।কাকগুলো আজ দল বেঁধে  অন্য একটা কাকের পেছনে লেগেছে।দূরে গোঁফুদাদের নারকেল গাছ বেয়ে সূর্যটা জাস্ট সররাট করে নেমে মিলিয়ে গ্যালো।জানি এই সময় আইসক্রিম ওয়ালাটা আমাদের সদর দরজা ক্রশ করে যায়।তার বাহারি রঙ ঢালা কাঠের ঠ্যালাগাড়ি আর ভেতরে রাশি রাশি রঙীন সব মনোহারী ক্রাইম।আমি মৌলিদিকে দেখিয়ে দেখিয়ে আইসক্রিম খেলুম সেদিন।মৌলিদি কয়েকবার বলল 

--স্যরি ভুল হয়ে গ্যাছে।আর বলব না। একটা অরেঞ্জ আাইসক্রিম নেব?

  আমি কোনও প্রত্যুত্তর করলাম না।দেখলাম শুধু দুম দুম করে পা ফেলে ফেলে ঘরের দিকে চলে গ্যালো।বুঝলাম লোভ আর ক্রাইসিস ইগো ভেঙেছে কিন্তু সেই ইগো স্যাটিসফাই করতে নাও দিতে পারে এই লোভ নামক স্থিতিটি তাই এই দাওয়াই।এও দেখলাম সেদিন একা একা চলে গ্যালো আগেই। পড়তে। আমি নির্বিকার। নিজেকে ক্যামোন আর্কিমিডিস আর্কিমিডিস মনে হচ্ছিল।কোন সুখ নেই দুঃখ নেই অভাব নেই অভিযোগও নেই। শুধু আমাকে তাড়া করে ব্যাড়াচ্ছে একটা নিপাট জলজ্যান্ত সমীকরণ। চোয়ালটা কিরকম য্যানো শক্ত হয়ে উঠছিল।কোন হিংস্র বনজের মত।আর একটা প্রতীক্ষা। কিছুতেই মন বসছে না পড়ায়।অবশেষে সময় ফুরোলো।এবার শুরু আরও একটি পরীক্ষার।যথারীতি আজ মেঘ করেই ছিল বিকেল থেকেই। এ সময় শুধু বরিষণের। কোনও সময়ের অপব্যবহার নয় সটান বাবার কাছে মৌলিদি--

  -- আঙ্কল আজ না  ও আবার গ্লাস থেকে পয়সা নিয়ে আইসক্রিম খেয়েছে।

কিন্তু এই দিনের চিত্রনাট্যটা আমি লিখেছি,তাই আমি জানি কি হতে চলেছে।বাবা খুব ধীর গলায় বলল--

--মামনি তুমি অভিযোগ ছেড়ে আরও নিজের পড়ায় মনোনিবেশ কর। ওর ক্রিয়াকর্ম নিয়ে তুমি অত ভেবে সময় নষ্ট কোর না।ওর পড়াশুনো তো লবডঙ্কা, তুমি নিজেরটা ওর মত না করলেই ভালো।আর হ্যাঁ সকালে ওতো ওর বাড়ির পড়াটা সাজে তাই  আজ থেকে বাড়িতে না খেলতে আসাই ভালো,ক্যামোন?মনে থাকবে কথাটা? নাকি তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে হবে?

তারপর বাকি রাস্তা সবাই নিশ্চুপ। সেদিন বাড়ি ফিরে গেলাসের পালকগুলো যথাস্থানে সঠিক ভাবে রাখতে রাখতে বাবা বলেছিল--"বড় হয়ে গেছিস " 

জানিনা বড় বলতে বাবা সেদিন কি বোঝাতে চেয়েছিল সত্যিকারের বড় নাকি গায়ে পায়ে বড়!নাকি মেধা এবং বর্তমান সমাজকে মেনে মানিয়ে নিয়ে চলার মত বড়?আমার কিন্তু মনে হয়েছিল আমি আদতে রাজনৈতিক ভাবে সাবলীল হচ্ছিলাম।বুঝে ছিলাম সুপিরিয়ররাই আসলে ক্রাইমকে নিয়ন্ত্রণ করে তার অধস্তনের মাধ্যমে।আর সুপিরিয়র  আমি চাইলেই হতে পারি।

.............................. চলবে..............................