সর্বনাশা সিরিয়াল (রম্যরচনা) রচনা কাল- ২০১৪ কলমে - অরুণ কুমার ঘোষ তারিখ : ১৪-০৮-২০২০ কোরাপটেড রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের সৌজন্যে সর্বনাশের তো আর শেষ নেই - পারিবারিক, সাংসারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রের সর্বনাশ এদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে প…
সর্বনাশা সিরিয়াল (রম্যরচনা)
রচনা কাল- ২০১৪
কলমে - অরুণ কুমার ঘোষ
তারিখ : ১৪-০৮-২০২০
কোরাপটেড রাজনৈতিক দাদা-দিদিদের সৌজন্যে সর্বনাশের তো আর শেষ নেই - পারিবারিক, সাংসারিক, সামাজিক তথা রাষ্ট্রের সর্বনাশ এদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদতে প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। এরপরেও গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে বর্তমানে স্বঘোষিত-স্বনামধন্য-ষন্ডামার্কা টিভি সিরিয়ালগুলো। এগুলো যে কতটা সর্বনাশ ঘটাচ্ছে তা একটু ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যাবে -
আমরা নামে বাঙালি জাত। ট্রেডমার্ক আলস্য ও কুড়েমি। পরচর্চা ও পরনিন্দা আমাদের বাইপ্রডাক্ট। সুযোগ পেলেই প্রোডাকশনে নেমে পড়ি। ঘন্টার পর ঘন্টা সময়ের শ্রাদ্ধ করি। ঠিক একইভাবে সময় শ্রাদ্ধ করি টিভি সিরিয়ালের পেছনেও। বর্তমানে বেশ কিছু টিভি চ্যানেল রমরমিয়ে 'ব্যাওসা' করে চলেছে সেরেফ কিছু হাতে-গরম সিরিয়াল পসরা দিয়ে। অবাস্তব-উদ্ভট-হাঁসজারু এই সিরিয়াল চিজগুলোর শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই, চলছে তো চলছেই। ভাবখানা এই - 'অনন্তকালের তরে জনম মোদের ধরণী পরে।'
বোকা-নির্বোধ, হা-ভাতে বাঙালি! গোগ্রাসে গিলে চলেছে সিরিয়াল সালসা! আহা! কী আনন্দ! কী আনন্দ! আকাশে বাতাসে! তাইতো আনন্দদাতা অনন্তকালের 'লীজ' নিয়ে বসে আছে। চলছে! চলবে! আর এই থিয়োরিতেই তো 'মা' 'ভালোবাসা ডটকম' রদ্দিমার্কা ভুসোমালগুলো অনন্তকাল ধরে চলে।
মজার বিষয় হলো - মূল কাহিনী কবে খতম! চলছে লেজুড়। প্রডিউসার ব্যাওসাদার - 'ব্যাওসাডা' বোঝেন ভালো। মওকা বুঝে নৌকা চালান। বুঝে নিয়েছেন বোকা দর্শক খাচ্ছে ভালো - 'ডালে এবার জল ঢালো।'
হ্যাঁ, তিনি এবার বদনা বদনা জল ঢাললেন। 'মা-ডাল' মিরে দেগে গেল। বোকা-দর্শক তাই হাপুস-হুপুস করে খেয়ে চলল।
কেউ কেউ বলেন, এখনকার সিরিয়াল গুলো নাকি চিউইংগাম - শুধু চিবিয়ে যাও। দাঁতে-জিভে জড়াবে, টান দেবে গুলি সুতোর মতো কেবল সুতো ছাড়বে। টেনে যাও, বেড়ে যাবে। গালে ফেলতেই অর্থাৎ শুরুতেই মিষ্টি লেগেছিল। এখন রস-কষহীন শুকনো সুতো - নিতান্ত গাল নেড়ে মাড়ি শক্ত করা ছাড়া আর এর কম্ম নেই।
নিষ্কর্মা বোকা-দর্শক সিরিয়াল চিউইংগামে মাড়ি শক্ত করে আর নিজের রসে নিজেই ভরপুর হয়।
সত্যি কথা বলতে কি, এক শ্রেণির দর্শকের কাছে সিরিয়াল দেখা চুল্লুর নেশার মতো - প্রতিদিন চাই-ই-চাই। এক বেলা খেতে না দিলে কষ্ট হয় না কিন্তু সিরিয়াল-চুল্লু সেবন না করলে বাঁচে কার বাপের সাধ্যি! দুনিয়া লয় হবার জোগাড়!
প্রসঙ্গত বলি, সিরিয়াল-চুল্লুখোরদের নব্বই শতাংশই হলেন মহিলা। আর সেই জন্যই সর্বনাশটা বেশি ঘটে। সংসার সমরাঙ্গনে পরিণত হয়, ডিভোর্স উঁকিঝুঁকি মারে। মারবেই তো - স্বামী-বেচারা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এসে এক কাপ চায়ের প্রত্যাশী হন, সঙ্গে একটু হালকা গরম গরম টিফিন। আলু চচ্চড়ি, লুচি-হালুয়া না হলেও নিদেনপক্ষে চিঁড়ে ভাজা হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু এক্ষেত্রেও আপত্তি ম্যাডামের। কর্তা যখন করুণ সুরে বলেন - 'হ্যাঁগো,একটু চা-টা হবে?'
সেই মুহূর্তে ম্যাডাম 'মা'-তে মগ্ন কিংবা 'পাখি'-তে ডানা মেলে উড়ছেন কিংবা 'ভালোবাসা ডটকম'-এর কোমায় আচ্ছন্ন। ফলে কর্তার ফার্স্ট রাউন্ডের অ্যাপিল সাউন্ড কানেই ঢুকলো না। সেকেণ্ড রাউন্ড তথৈবচ। থার্ড রাউন্ডে কর্তা সাউন্ডটা একটু জোরেই মারলেন। এবার 'কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো---!'
চকিত চাহনি। চোখে-মুখে বিরক্তির ঝলক। রুষ্ট কণ্ঠে লাভা উদগীরণ - 'বলি, অত ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো কেন, অ্যাঁ? এক কাপ চা করে নিতে পারো না? যাও! যাও! সব জোগাড় আছে । এক কাপ চা তৈরি করে খাওগে।'
ম্যাডামের এই উপদেশের পর আর কথা চলে না। মনের রাগ মনে রেখে রান্না ঘরে পা বাড়াতেই হয়। তবে যেতে যেতে কর্তা মনে মনে আউড়ে চলেন - 'অ্যায়সা দিন নেহি রহেগা। হাম দেখ লেঙ্গে!'
দিনের পর দিন আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! সহ্য সীমান্তে এসে পৌঁছলেই কেস ফাইল। আর তারপর - ম্যাঁয়-ম্যাঁয়, তু-তু। যে যার মত চরে খাও বাওয়া! আমি কার! কে আমার!
এ গেল এক দৃশ্য। আরেক দৃশ্যে আসি -
এটা একেবারেই গ্রাম বাংলার দৃশ্য। আজকাল আর 'সাঁঝের বেলা সাঁঝের প্রদীপ জলে না।' রোদ ঝলমলে বিকেলবেলায় তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে ওঠে। শোনা যায় শঙ্খ ধ্বনি। সবাই চলে ঝড়ের বেগে। মনের খবর? এই সময়ে গাঁয়ের বধূর মন-আকাশে "ঝিলিক" শুধুই ছিল শুধুই ঝিলিক মেরে যায়।
বলি, সময় কোথায় সন্ধ্যাবেলা সন্ধ্যা দেবার? টিভিটা যে খুলতেই হবে।
হ্যাঁ, কাজকর্ম সিকেয় তুলে দিদি-বৌদি, মাসি-পিসি, জেঠি-ঠাম্মা, সাতগুষ্টি সবাই মিলে টিভির সামনে বসে গেলেন।
খানিকক্ষণ বিজ্ঞাপন তরজা - সর্ব রোগহরো মহৌষধের কবিগান, হাতে-গরম টোটকা সঙ্গে জাপানি তেল ও হাত বাড়ালেই "সুবিধা"।
আরও কত দৃষ্টিনন্দন, দৃষ্টিকটু বিজ্ঞাপন। সেসব দেখে জ্ঞান না বাড়লেও অজ্ঞান হবার জোগাড়!
বাড়ির চৌদ্দগুষ্টি এসব গোগ্রাসে গিলে চলেছে। সবাই এখন নীলকন্ঠ।
এই মুহূর্তে বাড়ির বাচ্চাগুলো মানিক পীরের নামে ছাড়া। বইয়ের পড়া মাথায় ঢোকে না, ঢোকে ভালো "মা"।
তাই "মা"-এর জন্য মা সরস্বতীকে লাটে তুলে দেয়। আর তাছাড়া সরস্বতীর দরকার-ই বা কি! সরকার-বাহাদুর পাশ- ফেল তুলে দিয়েছেন। মহৎ কর্ম বটে!
একসময় " মা" শুরু হয়। বিজ্ঞাপনের পরতে পরতে "মা" চলতে থাকে। দশ মিনিটের সলিড মাল - বিজ্ঞাপন আধঘন্টা খেলিয়ে তোলে। ধৈর্য্য বলিহারি! প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দেওয়ার সময় নেই।
একসময় "মা" নাকে কাঁদুনি দিয়ে শেষ হয়। অর্থাৎ সেদিনের মত ইতি ঘটে। উঁহুঁ, এখানেই শেষ নয়, আরও আছে - এরপর অন্য চ্যানেল "কেষ্ট লীলা" নিয়ে রেডি। অলস-ধর্মভীরু বাঙালি! "কেষ্ট লীলা"য় ধর্মের সুড়সুড়ি পরতে পরতে। অতএব, কেষ্ট লীলা দেখতেই হবে।
চললো ঘণ্টাখানেক।এরপর এটা ওটা সেটা তো আছেই। 'এক পলকের একটু দেখা আর একটু হলে ক্ষতি কি!'
না, ক্ষতি তো কিছুই নয়, সময়টা বারোটা বেজে গেলো। এবার রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া। দেড়টা দুটোয় বিছানা নেওয়া।
পরের দিনের শুভ-সূচনা ক'টায় হবে? থাক! ওকথাটা না হয় গোপনই থাক!