Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

#ছোটগল্প#রোদ_ছায়ার_খেলা#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য
ডায়েরীর একটা সাদা পাতার ওপর কলমটা ধরে চুপচাপ বসে আছি। রাগ দুঃখ ভালোবাসা অভিমান সব একসাথে প্রকাশ করার মতো শব্দ খুঁজে পাওয়া কি এতো সহজ! জানি না ঠিক কতক্ষণ পর আমি লিখতে শুরু করেছি --
জীব…

 


#ছোটগল্প

#রোদ_ছায়ার_খেলা

#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য


ডায়েরীর একটা সাদা পাতার ওপর কলমটা ধরে চুপচাপ বসে আছি। রাগ দুঃখ ভালোবাসা অভিমান সব একসাথে প্রকাশ করার মতো শব্দ খুঁজে পাওয়া কি এতো সহজ! জানি না ঠিক কতক্ষণ পর আমি লিখতে শুরু করেছি --


জীবনের সাথে বন্ধুত্ব আমার কোনো দিনই হয়ে ওঠেনি। বন্ধুত্ব তো দূর অস্ত আমার আর জীবনের মধ্যে রোদ ছায়ার একটা খেলা সবসময় চলতেই থাকে। আমি যখন আপন মনে ভরদুপুরে রৌদ্রের স্বপ্ন বুনেছি, তখন জীবন আমাকে সম্পূর্ণ ছায়া দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। আবার ছায়ায় বসে যখন একটু জিরিয়ে নিতে চেয়েছি তখন পেয়েছি একদম চিড়চিড়ে একটা রোদ।

হতে চেয়েছিলাম একজন ডাক্তার, নামি হার্ট স্পেশালিস্ট। কিন্তু জীবন আমাকে টেনে হিঁচড়ে এনে দাঁড় করালো লোহা লক্কড়ের জঞ্জালের মাঝে, কারখানায়, যেখানে হৃদয় সম্পূর্ণরূপে গুরুত্বহীন। এই নির্জীব বস্তুগুলোর সাথে নিজের হৃদয়কে জুড়তে পারিনি কোনোদিন। আমার কাছে আজ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নিস্প্রাণ কাজ। আসলে যে কাজের সাথে হৃদয় জোড়া যায় না, তাকে সবসময় বোঝা-ই মনে হয়। আর সে কাজ যদি নিত্যনৈমিত্তিককার হয়, তখন এই বোঝার ভার আমাদের কাছে অসহ্য, কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। এই কষ্টের কারণ হিসেবে কখনো নিজেকে, কখনো জীবনকে, কখনো পুরো দুনিয়াকে দুষতে থাকি আমরা। আমিও সেভাবেই ওগুলোকে দুষে চলেছি অবিরত।

যখন প্রেম করতে চাইনি, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের তাড়া ছিলো পেছনে, তখন জীবনে এলো প্রেমের জোয়ার। আবার চাকরি পাওয়ার পর যখন সুস্থির জীবন, মনেপ্রাণে একটা প্রেম চাইছি, তখন চারিদিক শুকনো খটখটে, শুধুই খরা....


ডিং-ডং -- দরজায় কলিংবেলের শব্দে লেখা ছাড়তে বাধ্য হলাম।

উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম, সামনে মনীষা। এ বছর‌ই ইনস্ট্রুমেন্টেশন নিয়ে ডিপ্লোমা পাশ করেছে ও। আমার‌ও ঐ এক‌ই ট্রেড ছিলো, তাই এবছর কোর্সের শেষের দিকের কয়েক মাস কিছু ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছিলাম। ও তাদের‌ই একজন। কোলে একটা ছোট্ট কুকুর ছানা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ও। ওর হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলছে। ওটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল -- স্যার, এতে পায়েস মিষ্টি আছে। মা আপনাকে দিলেন।


আমি টিফিন ক্যারিয়ারটা ওর হাত থেকে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলাম -- হঠাৎ এসব কেন?


লাজুক কন্ঠে মিষ্টি একটা হাসি হেসে ও বলল --আমার জন্মদিন আজ। আমাদের বাড়িতে, জন্মদিনে কেক কাটা হয় না। ধান দূর্বা দিয়ে বাবা মা আশীর্বাদ করেন, তাই পায়েস মিষ্টি।


আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিইতো! ওর চোখেমুখে আজ আলাদাই একটা ঔজ্জ্বল্য। হাত বাড়িয়ে ওর নরম হাতে হাত মিলিয়ে বললাম -- হ্যাপি বার্থডে মনীষা।

-- থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। মনীষার মুখে মুক্ত ঝরানো হাসি।

-- বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।

-- আজ থাক স্যার, একটু তাড়া আছে। অন্যদিন আসবো।

-- ও-কে। কিন্তু আজকের দিনে তোমার কোলে ঐ নেড়ীর বাচ্চাটা কি করছে? তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসতে হাসতে বললাম আমি।


মুহুর্তের মধ্যে মনীষার হাসিমুখটা ম্লান হয়ে গেল। অবলা জীবটার গায়ে হাত বুলিয়ে ও বলল -- ওভাবে বলবেন না স্যার। ওরা আমার জীবনের থেকেও বড় কিছু। খুব ভালোবাসি আমি ওদের।

কুকুর ছানাটা দু'কান নত করে চোখবুজে আদর খেতে লাগলো। 


আমার একটু খারাপ‌ই লাগলো। ওকে এভাবে ঠিক আঘাত করতে চাইনি আমি। বললাম -- আই'ম সরি মনীষা। আজকের দিনে তোমাকে আঘাত দেওয়াটা আমার ঠিক হয়নি। তুমি যে কুকুর ছানা এতো ভালোবাসো, এটা আমি জানতাম না।

 

 -- ইট'স ওকে স্যার। শুধু কুকুর ছানা নয়, সমস্ত রকম জীবের‌ প্রতিই আমার খুব মায়া। আমি ওদের বড্ড ভালোবাসি। এবার মনীষার মুখটা কেমন যেন মায়াচ্ছন্ন হয়ে গেল।

আমি ওদের সব বুঝি। জানেন! পশুরাও হাসে... একা থাকলে কখনো কখনো এরা উদাস‌ও হয়ে যায়...


আমি চুপ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শুনছি, আর প্রাণ ভরে দেখছি ওকে -- এ মনীষা যেন সেই মনীষা নয়। এ এক অন্য মনীষা। যে আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। এক অদ্ভুত প্রেম ওর চোখে মুখে। আমি যেন অনেক কিছু নতুন করে শিখছি ওর কাছে।


ও বলেই চলেছে -- ব‌ইতে সব কিছু লেখা থাকে না স্যার। কিছু কিছু জিনিষ অনুভব করতে হয়...


সত্যিই! মনে হয় অনুভূতি কখনো কাউকে শেখানো পড়ানো যায় না, ওটা আপনে আপ জন্মায়, মনের জমিতে জংগলী ঘাসের মতো।


মনীষা চলে গেল, কিন্তু আমার মনে রেখে গেল ওর প্রেমের ছোঁয়াটুকু। সারাদিন আমি ওর কথাগুলো‌ই শুধু ভাবলাম। পরদিন ও যখন টিফিন ক্যারিয়ারটা নিতে এলো, তখন ওর কোলে ছিলো একটা ছাগল ছানা। সারা গায়ে সাদা কালো ছোপ ছোপ দাগ। খুব মিষ্টি লাগছিল ওটাকে। মনীষা আমাকে আরো অনেক কিছু শিখিয়ে গেল এদিন -- সে মানুষ হোক আর পশু, জীবনতো এক‌ই। পশুর‌ও মানুষের মতো পছন্দ অপছন্দ আছে। এমন কিছু কিছু জিনিষ আছে, যা ওদের খুব ভালো লাগে। আবার কিছু জিনিষ আছে, একদম ছোঁয় না ওরা।


আরো বিভিন্ন কারণে আমার বাড়িতে ওর আসা যাওয়া বাড়তে থাকলো। বিভিন্ন কোম্পানীতে চাকরীর অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি, ইত্যাদি ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন কারণ। এ বাড়িতে ওর এভাবে আসা যাওয়া, ওর হাসি, ওর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার গল্প আমাকে ধীরে ধীরে ওর প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকলো। বিশেষ করে ওর পশুপ্রেম। ও যখন আসে, একা আসে না। প্রত্যেকবার ওর সঙ্গী থাকে কোনো না কোনো পশু। আমি হার্ট স্পেশালিস্ট হতে চেয়েছিলাম ঠিক‌ই, কিন্তু  হৃদয় বলে বস্তুটাকে বোধহয় ভালো করে বুঝতে পেরেছিল ও-ই। দিনে দিনে ওর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমি -- 

হাসির মুহূর্তগুলো কোথাও আলাদা ভাবে জন্ম নেয় না। ওগুলোকে একদম অতিসাধারণ দেখতে ম্যাড়মেড়ে দিনগুলো থেকেই চুরি করে নিতে হয়।


মনীষার সাথে কিছু দিন মিশলেই খুব ভালো ভাবে বোঝা যায় -- দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সহজ এক অনুভূতি হলো প্রেম। যা প্রত্যেক জীবের হৃদয়ের গভীরের কোনো এক প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে থাকে এবং মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে এসে খুঁজে ফেরে সমকম্পনের সঙ্গীকে।


আমিও কি করে জানি না, এই ক'দিনের মেলামেশায় মনীষার প্রেমে পড়ে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছি। জানি, বয়সে ও আমার চেয়ে অনেক ছোটো, তাও। বেশ কিছুদিন হলো ভাবছি ওকে বলবো --

মনীষা, তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথাবার্তার সাথে সাথে তোমার নিরবতার‌ও সঙ্গী হতে চাই আমি। তোমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চাই আমি।


বেশ কয়েকদিন হলো মনীষা আসছে না আমার বাড়ি। উদ্বিগ্নতা ধীরে ধীরে বাড়ছে -- কিছু হয়নি তো ওর!

আর অপেক্ষা করা গেল না। ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।


দরজায় টোকা দিতেই হাসিমুখে বেরিয়ে এলো মনীষা -- স্যার, আপনি! হঠাৎ আমাদের বাড়ি? খুব ভালো লাগছে। বহুদিন পর এলেন। ভেতরে আসুন...


আমি কথা লুকোলাম। বললাম -- না না, ভেতরে যাবো না। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার দেখা করেই যাই। তাই...


 -- আজ‌ই ভাবছিলাম আপনার বাড়ী যাবো। আমার বিয়ের কার্ড দিতে। হঠাৎ করে ঠিক হয়ে গেল বিয়েটা ... মনীষা আরো অনেক কথা বলে চললো।


কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছে না। লো সিগন্যাল রেডিও চ্যানেলের মতো কথাবার্তাগুলো সোঁ সোঁ একটা আওয়াজে ঢেকে যাচ্ছে। আমার চোখের পাতা অশ্রু লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। ডুবে যাওয়া গলারস্বরকে তুলে ধরে কোনো রকমে বললাম -- আজ আসি। তুমি কার্ড নিয়ে একসময় এসো।


বাড়ি ফিরেই ছুটির জন্য আবেদন জানালাম অফিসে।  বলতে হলো শরীর খারাপ। আশ্চর্য সিস্টেম। শরীর খারাপের জন্য ছুটি হয়, কিন্তু মন খারাপে নেই। অথচ এই মনটাই সব। এটা না কাজ করলে শরীরের কি ক্ষমতা কাজ করে!


যেতে হবে অন্য কোনো শহর। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে, তারপর ফিরবো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সব প্যাক করে নিলাম। শুধু  সেই সব স্মৃতিগুলো বাদে, যেগুলো এখনো পর্যন্ত ঘরের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে র‌য়েছে। ঘরের প্রত্যেক কোণে ওর স্মৃতি। ও হয়তো এসে বসতো এক স্থানেই, কিন্তু ওর সঙ্গীগুলোতো সমস্ত ঘর ঘুরে বেড়াতো। ওদেরকে ধরতে সেও পিছু পিছু ছুটে বেড়াতো সমস্ত ঘর।

বাকি র‌ইলো বালিশ বিছানা। ওগুলোতেও জড়িয়ে আছে ওকে নিয়ে তৈরী বহুকল্পনার স্মৃতি।

কিন্তু মনের কোণের স্মৃতিতো চললোই সাথে। তাই যেখানেই যাই না কেন, সেখানে হয়তো মনে হবে --

 এ শহরে কিছু নেই। এখানে না আছে কোনো হাসির কারণ, না আছে কোনো উদ্বিগ্নতার কারণ।

উদাস করবে ঢলে পড়া সূর্য , আর সকালের সূর্যকে মনে হবে অচেনা কেউ। প্রত্যেকটা বিনিদ্র রাতে একটাই দ্বন্দ্ব নেচে নেচে আমার চারদিকে পাক খেতে থাকবে -- ওকে নিয়েই ভাববো, না নিজেকে বারবার মনে করাবো ওকে ভুলে যাওয়ার কথা। 


বেরোবার আগে, ডায়েরীর সেই পাতাটা খুলে বসলাম আবার। কি লিখবো জানি না। এপাশ থেকে ওপাশ কলমটা ঘুরে যাচ্ছে শুধু। টপ টপ করে দু'ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো পাতাটার ওপর। কলমটা ঠিক তার নীচে বড় বড় করে লিখলো -- 

আমি যাকে ভালোবাসি, তার‌ও যে আমার প্রতি ভালোবাসা থাকবে, এমন তো কোনো কথা নেই। আমি তাকে ভালোবাসি। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।