ছোট গল্প : জানালায় দাঁড়িয়ে আজকের অমল
কল্পদেব চক্রবর্তী
পড়ন্ত বিকেলের গাছের ছায়াটা যখন দীর্ঘ হতে হতে মিলিয়ে যায় তখনো ছোট্ট ছেলে সমু জানলার গ্রিল ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে পথচলতি মানুষের ভিড়ে ওর …
ছোট গল্প : জানালায় দাঁড়িয়ে আজকের অমল
কল্পদেব চক্রবর্তী
পড়ন্ত বিকেলের গাছের ছায়াটা যখন দীর্ঘ হতে হতে মিলিয়ে যায় তখনো ছোট্ট ছেলে সমু জানলার গ্রিল ধরে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে পথচলতি মানুষের ভিড়ে ওর মার আগমনের প্রত্যাশায়।
গ্রীষ্মকালের ছুটি টা ওর কাছে নিদারুণ হতাশা বয়ে আনে। স্কুল ছুটি শুনলেই ওর মন অন্য বাচ্চাদের মত আনন্দে নেচে ওঠে না, ভয় পায় একাকিত্বের নিদারুণ যন্ত্রণা কে।
" অমল ও দইওয়ালা " গল্প টা ওর খুব প্রিয় জানলার ধারে একা বসে থেকে পথচলতি মানুষদের সাথে ডেকে ডেকে কথা বলা, শুধু চেয়ে থাকা আর চেয়ে থাকা। ও যেন অমলের মতো তেমনি একজন। মাকে একদিন বলেছিল সমু, " তুমি আমার নাম অমল দিলে না কেন? "
ছোট্ট শিশুর ছোট্ট কথা, কিন্তু কি নিদারুণ একটা উপন্যাসের জন্ম দিতে পারে আমরা বাস্তবের ব্যস্ততায় সেটা অনুধাবন করার সময় পাইনা ! সমুর মা-বাবা ও পায়নি, সে ইচ্ছেও বোধহয় তাদের নেই। আমাদের কজনার ই বা তা আছে?
সরকারি চাকুরিরতা মা ফিরবে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এর দোরগোড়ায়। বাবার ভিন রাজ্যে চাকুরী। প্রান্তিক এই দুই পথের ব্যবধানে, মাঝে ছোট্ট সমু।
না এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সমুর ঠাকুরমা থাকে ওই বাড়িরই আলাদা অংশে। সেও বন্দি তবে সমুর মতো গৃহবন্দি নয়। মননে যন্ত্রনার নাগপাশে বন্দি।
সমু বড় হয়েছে ঠাকুরমার কোলে পিঠে। মার ব্যস্ততার কারণে ঠাকুরমার মধ্যেই মাকে খুঁজে পেয়েছিল সমু। কিন্তু কথায় বলেনা, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। তেমন দিন ঘনিয়ে এলো সমুর জীবনে।
শাশুড়ি বউয়ের বনাবনি নেই। নিত্যনূতন ঝগড়া-ঝাটি পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছেও গা সওয়া হয়ে গিয়ে ছিল। কিন্তু কোন কিছুই তো থেমে থাকে না চাহিদা যখন ক্রমবর্ধমান। একাকীত্ব যেমন মনে জ্বালা ধরায় তেমনি সঙ্গী যদি মন মতো না হয় তবে সঙ্গটাকে নাগপাশে আবদ্ধ বলে মনে হয়।সেটাই হলো শাশুড়ি এবং বউয়ের উভয়ত।
ব্যাপারটা তুমুল আকার নিল যখন শাশুড়ির গায়ে বউ হাত তুলল। অভিযোগ গুরুতর। স্বামী যখন সপ্তাহান্তে দেড় দিনের জন্য বাড়ি আসে, শাশুড়ি নাকি ছেলের কান ভাঙ্গায়।ছোট্ট শিশুর মনেও বিষবৃক্ষ রোপণ করে।
অপরদিকে শাশুড়ির অভিযোগও অমূলক নয়, নেপথ্যে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত।সফল না হওয়াতেই এই মরিয়া আক্রমণ।
পুত্রের তখন হয়তো মায়ের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার থেকেও মায়ের গর্ভ যন্ত্রণার অনুভূতি সেই মুহূর্তে তাকে বেশি নাড়া দিয়েছিল। বেদম মার মারল বউটাকে। গায় দগদগে কালশিটে দাগ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থেকে গেল চিরকাল বউয়ের মনে। তার ই প্রতিক্রিয়া চিরকাল বহন করে চলল সমু।
অগত্যা ঘরের ভেতরে ঘরে পাঁচিল উঠলো। প্রবেশ পথ আলাদা হয়ে গেল। শুরু হলো বৃদ্ধা মায়ের একা একা দিন গুজরান। ভালো এই যা বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হলো না। পুত্রের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা তাই আজো। নাকি পুত্রস্নেহে অন্ধ, তাই তার দোষ ত্রুটি দেখতে নেই !
সমু একা হয়ে গেল। স্কুল ছুটির দিনে মা তাকে স্নান করিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে প্রচুর আদর করে প্রতিদিন একই মন্ত্র পড়ায়, " ঠাম্মা ডাকলেও কথা বলবেনা। কিছু দিলে খাবে না, আমি তোমার জন্য ক্যাডবেরি নিয়ে আসব। "
তারপর দরজার বাইরে থেকে তালা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
ছোট্ট শিশুর এই নিদারুণ বন্দিত্ব দশায় মার মন হু হু করে তখন কাঁদে নিশ্চয়ই, কিন্তু সম্পর্কের টানাপোড়েন আর অবিশ্বাস কত ভয়ংকর দানবের জন্ম নিতে পারে সমু এই বয়সেই তা দেখেছে, বুঝেছে। শুধু বুঝতে পারে না তার অপরাধ টা কি? হয়তো ভগবানের কাছে তার কাতর প্রশ্ন, "কেন আমার এ দণ্ড?"
অন্য দিকে পাঁচিলের ওপ্রান্তে ঠাম্মা মিনতি দেবী চোখের জল ফেলে। নিজেই নিজের সাথে কথা বলে, " ছেলেটার বোধ হয় ক্ষিদে পেয়েছে।শরীরটা খারাপ হলো কি? কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছি না। না খেয়ে ঘুমিয়ে পরল কি, নাকি বাথরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গেল? বাথরুমটা তো ঘরের মেঝে থেকে আরও দুধাপ উঁচুতে ! কি জানি ভগবান তুমি ওকে দেখো। "
মাঝেমাঝেই রাস্তার দিকে দরজা খুলে বেরিয়ে ছেলের ঘরের জানলার দিকে উঁকি মেরে যায় মিনতি দেবী। তবুও জানালায় দাঁড়িয়ে আছে দেখলে স্বস্তি। না দেখতে পেলে মনটা কুডাক ডাকে।
সমু কে দেখতে পেলে বলে, " ও দাদুভাই তুমি খেয়েছ? শরীর ভালো আছে তো ? আর একটু অপেক্ষা করো এইতো মার আসবার সময় হয়ে গিয়েছে।"
সমু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠাকুরমার দিকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, বলে " ও ঠাম্মা তুমি আমার সাথে কথা বলো না। কেউ মাকে বলে দিলে মা তোমাকে মারবে, আমাকেও। যাও ঘরে যাও। চিন্তা করো না, আমি ভালো আছি। "
ছোট্ট সমু বুঝেগেছে ভালো নেই বলতে নেই।ভালো না থাকার অনেক যন্ত্রনা। এই দন্ড টা যে তার একার। মুক্তির প্রহর গোনা ছাড়া পথ নেই।
সময় তুমি তারাতারি সমুকে বড় করে দাও। তখনও মনথেকে বন্দি দিনগুলোর কথা সে ভূলতে পারবে কি?
***** সমাপ্ত *****