#গল্প#ওগো_আমার_আগমনী_আলো #গোপা_ব্যানার্জী
--মাগো তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা। আমার কোনো অসুবিধা হয়না রাত জাগলে। আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। এই কয়েকটা রঙ করা বাকি শুধু। বাবা যে অর্ডারগুলো নিয়েছিলো সেগুলো না দিতে পারলে বাবার আত্মা শান্তি …
#গল্প
#ওগো_আমার_আগমনী_আলো
#গোপা_ব্যানার্জী
--মাগো তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা। আমার কোনো অসুবিধা হয়না রাত জাগলে। আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। এই কয়েকটা রঙ করা বাকি শুধু। বাবা যে অর্ডারগুলো নিয়েছিলো সেগুলো না দিতে পারলে বাবার আত্মা শান্তি পাবেনা মা!
কথাগুলো বলে মায়ের রুগ্ন চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো উমা। কদিন ধরে জ্বরে পড়ে আছে মা। বাবার হঠাৎ চলে যাওয়া, মায়ের কাছে কি বিশাল আঘাত সেটা বেশ ভালো করে টের পাচ্ছে ছোট্ট উমা। দিনরাত বাবা আর মা তাদের এই কুমোরটুলির ছাউনির নিচে একসাথে কাজ করতো। দুজনে দুজনের কথা না বলতেই বুঝে নিতো। তাই ছোটো থেকে কখনো মা বাবার মধ্যে সামান্য ঝগড়াও হতে দ্যাখেনি ও।
সেদিন রাতেও দুজনে বায়না হয়ে যাওয়া ঠাকুরগুলো শেষ করার জন্য অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করছিলো। হঠাৎ বাবা মাটিতে পড়ে গেল। মা সবাইকে ডেকে আনলো... কিন্তু বিমল কাকা যখন ডাক্তার বাবুকে নিয়ে এলো, ততক্ষনে সব শেষ!
বাবার খুব ইচ্ছে ছিলো উমা খুব ভালো করে পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়। ও মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবা এভাবে চলে যাওয়ায় সব স্বপ্নগুলো যেন চুরমার হয়ে গেল। গত একমাসে উমা যেন অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে!
মায়ের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর নেই। জোর করে খানিকটা দুধ খাইয়ে মাকে শুইয়ে দিলো। তারপর বললো...
--- তুমি একটু ঘুমাও। আমি দেখি স্বপনদার কতদূর হলো। কাল স্বপনদা ঠাকুরের গয়না আনতে যাবে। ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে আমি আসছি।
এই বলে উঠে দাঁড়াতেই মা ওর হাতটা টেনে ধরলো। বললো...
--- তোর ওপরে কতো চাপ বেড়ে গেল! পড়াশোনা কিছুই করতে পারছিসনা। আমিও অসুস্থ হলাম এই সময়...
বলেই কাঁদতে লাগলো!
উমা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো...
--- পড়াশোনা আমি ঠিক করে নেবো। বাবার স্বপ্ন ঠিক পূরণ করবো। এখন এই কাজগুলো অনেক জরুরি। তুমি সুস্থ হয়ে যাও, আবার সব আগের মতোই হয়ে যাবে।
চালার নিচে পৌঁছে দেখলো স্বপনদা বেশ চিন্তিত মুখে বসে বিড়ি খাচ্ছে। ওকে দেখে তাড়াতাড়ি বিড়ি ফেলে দিলো।
--- তুমি আবার বিড়ি খাচ্ছ?
--- এই দ্যাখো পাগলী বোনের কান্ড! আরে রেগে যাসনা! সারাদিনে মাত্র তিন- চারখানা খাই। ছেড়ে দেবো রে... এই কটা দিন একটু না খেলে কাজে জুৎ হয়নারে!
--- থাক হয়েছে, আর অজুহাত দিতে হবেনা। সবাই মিলে আমাকে জ্বালিয়ে খেলে।
স্বপন ওর বাবার সাথে সেই ছোট্ট থেকে কাজ করে। নিজের দাদা থাকলে এত ভালোবাসতো কিনা জানেনা উমা। ও বললো...
---রঙগুলো কাল শুকিয়ে যাবে। আজ বৃষ্টি হবেনা বলেই মনে হয়। আচ্ছা তুমি আজ তাড়াতাড়ি চলে যাও। কাল আবার গয়না আনতে যেতে হবে!
কথাটা বলেই দেখলো স্বপনদার মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। সাথে সাথে উমা বুঝতে পারলো স্বপনদা কেন দুশ্চিন্তা করছে!
---তুমি একটু দাঁড়াও,আমি টাকা নিয়ে আসছি। যা টাকা ছিলো সেগুলোতো রঙ কিনতেই খরচ হয়ে গেছে। বলেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
স্বপনের চোখে জল চলে এলো! কতো আদরের মেয়েটা, অসিত কাকার প্রাণ ছিলো। এই কদিনের মধ্যে কতো ঝড় ঝাপটা সয়ে চলেছে। কতো দায়িত্ববোধ এটুকু মেয়ের।
ঘরে ঢুকে উমা দেখলো মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে নিজের খাটের তলায় রাখা ট্রাঙ্ক থেকে ওর গত জন্মদিনে বাবার দেওয়া সোনার চেনটা বের করে আনলো। কিছুক্ষণ বুকে কান্নাটা চেপে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
---স্বপনদা! তুমি আমাদের সব থেকে কাছের মানুষ। তোমার অজানা কিছুই নেই। এই চেনটা তুমি যাওয়ার সময় বিশ্বাস কাকুর দোকানে গিয়ে দেবে। আমি কথা বলেই রেখেছি। তুমি গেলেই কাকু তোমাকে টাকাটা দিয়ে দেবে।
--- আমি পারবোনা! কিছুতেই পারবোনা এটা নিতে। অসিত কাকা কতো সাধ করে এটা তোকে দিয়েছিলো।
কান্নায় ভেঙে পড়লো স্বপন।
ওর হাত ধরে টেনে মায়ের একটা মূর্তির সামনে দাঁড় করালো উমা। তারপর বললো...
--- চেয়ে দ্যাখো মায়ের দিকে। আমরা তাঁর সাজ সজ্জা সম্পূর্ণ না করে দিলে, মা পুজো মণ্ডপে যেতে পারে? সারা বছর সবাই মাকে দেখার জন্যই অপেক্ষা করে। কাল বাদে পরশু মহালয়া। বাবা যাদের প্রতি বছর সুন্দর মাতৃমূর্তি বানিয়ে দেয়, তারা এবছর শেষবার বাবার বানানো মূর্তি পুজো করবে। সেই কাজে ঘাটতি থাকুক এটা চাও?
--- না... ওটা তোর বাবার স্মৃতি। ওটা রেখে দে। আমি তোর বৌদির গয়না বেচে ঠিক টাকা জোগাড় করে নেবো!
--- একদম না! আমার বাবার সব থেকে বড়ো স্মৃতি আমি নিজে। তুমি খবরদার বৌদির গয়না ছোঁবেনা। আমি ঠিক ছাড়িয়ে আনবো এই চেন। বিক্রি করছিনা। বন্ধক দিচ্ছি!
উমার গলায় এমন তেজ স্বপন কখনো শোনেনি । চমকে উঠে তাকালো। ওর মনে হলো যেন মাতৃমূর্তি আর উমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই...সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে! চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বপন... কানে তীব্র ঢাকের আওয়াজ!
ধীরে ধীরে ঢাকের শব্দ শান্ত হয়ে এলে, ওর মনে হলো কে যেন গাইছে... " ওগো আমার আগমনী আলো... "
চোখ খুলে স্বপন দেখলো উমা খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ! লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে... উমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো...
--- আমি জানি তুই পারবি! তুই যে উমা! তোর অসাধ্য কিছুই নেই জগতে। দে বোন চেনটা।
স্বপনদা চলে গেলে, উমা কিছুক্ষণ মাতৃমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হলো বাবা যেন আশেপাশে আছে। মনে মনে বাবাকে বললো...
--- তুমি চিন্তা কোরোনা বাবা। আমি ঠিক পারবো।
দশ বছর পর দেশে ফিরছে উমা। মা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ওদের কুমোরটুলির চাল স্বপনদার দায়িত্বে রয়েছে। মায়ের সাথেই স্বপনদা আর বৌদির থাকার ব্যবস্থা করেছে উমা।
সেবারে বাবার মৃত্যুর পর ও যেভাবে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে, নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করেছিলো, সেটা একটা দৃষ্টান্তস্বরূপ । তাই তখন থেকেই ওর পড়াশোনার সব খরচ বাবার গুণমুগ্ধ এক সার্বজনীন ক্লাব বহন করেছে । ওর ডাক্তারি পড়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়েছিলো ওরা । তারপর স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ চলে গিয়েছিলো উমা।
এয়ারপোর্টে ওকে দেখেই স্বপনদা আর বৌদি ছুটে এলো। আনন্দে জড়িয়ে ধরে স্বপনদা বললো...
--- আমার ছোট্ট বোনটা কতো বড়ো ডাক্তার হয়েছে! স্বর্গ থেকে আমার কাকার বুকটাও নিশ্চয়ই গর্বে ফুলে উঠছে।
বৌদি বললো...
--- আর তোমার বোন কতো সুন্দরী হয়েছে দ্যাখো! এবার কাকিমার দুর্গা পুজো সার্থক হবে। কাল ষষ্ঠী। আমাদের উমা ঘরে ফিরলো ।
রাস্তায় গাড়িতে বসেই স্বপনদা একটা বাক্স বের করে বললো...
--- এটা আগে গলায় পর!
উমা দেখলো সেই বাবার দেওয়া চেনটা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো...
--- আরে এটা কোথায় পেলে? মার কাছে শুনেছিলাম বিশ্বাস কাকু মারা গেছে । আমিতো ভেবেছিলাম ওটা আর ফিরে পাবোনা।
স্বপনদা বললো...
--- সেদিন তোর বৌদির কথা শুনে কতো ভালো করেছি পরে বুঝতে পেরেছি। নিজের গয়না দিয়ে বলেছিলো, তুই বড়ো হলে ওর গয়নার অভাব হবেনা। কিন্তু অসিত কাকার দেওয়া উপহার হাতছাড়া করতে দেবেনা।
বৌদির দিকে কৃতজ্ঞ চোখে চাইলো উমা!
গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো! মা মেয়ে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে যখন চোখের জলে ভাসছে...
স্বপনদা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে যেন আবার শুনতে পেলো...
" ওগো আমার আগমনী আলো... "!!
©® গোপা
__________________(সমাপ্ত)________________________