#তুমি অনন্যা#কলমে--সীমা রাহা
আমি মফস্বলের মেয়ে।কলকাতায় যখন নতুন বিয়ে হয়ে এলাম, তখন আমার পরিচিতির জগত ছিল একেবারেই সীমাবদ্ধ। যে বাড়িটিতে আমি ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির দিদি ছিলেন আমার একমাত্র সহায়। যখন যা দরকার পরতো আমি দিদিকেই জানাতাম।…
#তুমি অনন্যা
#কলমে--সীমা রাহা
আমি মফস্বলের মেয়ে।কলকাতায় যখন নতুন বিয়ে হয়ে এলাম, তখন আমার পরিচিতির জগত ছিল একেবারেই সীমাবদ্ধ। যে বাড়িটিতে আমি ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির দিদি ছিলেন আমার একমাত্র সহায়। যখন যা দরকার পরতো আমি দিদিকেই জানাতাম। তিনিই আমায় মার্গ দর্শন করতেন। ঠিকে ঝি রাখার ব্যাপারেও আমি তারই শরণাপন্ন হই। তিনি রত্নাদি কে ঠিক করে দেন আমার প্রাত্যহিক কাজকর্মে সহায়তার জন্য। কাউকে তো পেতাম না, তাই রোজ মন খুলে বকবক করতাম রত্নাদির সাথে। সে কোন ট্রেনে কলকাতায় কাজে আসে, সেই ট্রেনে ভীড়ের ঘটা, তার স্বামীটি যে আস্ত অকালকুষ্মাণ্ড থেকে শুরু করে তার দুটো বাচ্ছার গল্প, শাশুড়ীর অত্যাচারের কাহিনী সে আমাকে অকপটে বয়ান করতো। আর আমিও তাকে খুব জ্ঞান দিতাম একজন স্ব-উপার্জিতা নারীর নিজের অধিকার কি ভাবে বুঝে নিতে হয় সেই ব্যাপারে। সে আমার কথা শুনতো, আর ফিকফিক করে হাসত। বলতো " অ বোন, ইতেই মাইর সারা কপালে ভাত জোটেনি কো, আর তোমার কতা শুনলি তো ঘর সারা হওন লাগব।"
আমি মনে ভাবি যাদের স্বাধীনতা বোধের কোনো ধারণাই নেই,আমি তাদের মনের ভয় কি করে দূর করব? কোন জাদুবলে তাদের বোঝাবো সব কিছু লড়াই করে জিতে নিতে হয়।না হলে সারা জীবন পরে পরে মার খেতে হবে।
যাইহোক, রত্নাদি আমার বাড়ি ছাড়াও আরো চার বাড়ির ঠিকে কাজ করতো।দেখতাম সব বাড়ি থেকেই সে খাবার টিফিনবাক্সে ভরে নিয়ে আসে। তাই আমি বলতাম আমার বাড়ির খাওয়াটা তুমি আমার সাথে বসেই খেয়ে যাবে। সে তাই করতো। হঠাৎ কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করলাম সে আর বসে খেতে রাজি হচ্ছে না। রোজ এক কথা, "আমার খাওনের সময় নাই , ঘরে গিয়া খাইয়া নিমু। বোন তুমি বাইন্ধা দাও।" আমিও সরল বিশ্বাসে রোজ তার খাবার গুছিয়ে দিয়ে দিতাম। এক রবিবারে আমি ও আমার কর্তাটি জম্পেশ করে খাসির মাংস ও ভাত খেয়ে একটু ভাত ঘুম দিচ্ছিলাম। রত্নাদি বাসন মাজছিল রান্নাঘরে।আমি শোওয়া থেকে উঠে বাথরুমে যেতে গিয়ে খেয়াল করি রত্নাদি আমাদের ফেলে রাখা খাদ্যের অবশিষ্টাংশ তুলে খাচ্ছে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।আমাকে দেখতে পেয়ে লজ্জায়, দ্বিধায়,হীনমন্যতায় সে আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করে। তার সাথে কথা বলে জানতে পারি আজ দুমাস যাবৎ তার স্বামীর কোন কাজ নেই। ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। পেটে খিদে চেপে সে অতো বাড়ি কাজ করে সব খাবার বাড়ির মানুষ গুলোর মুখে তুলে দেবে বলে নিয়ে যায়। আজ খিদে সহ্য করতে না পেরে সে ওই উচ্ছিষ্টাংশ উদরস্ত করতে বাধ্য হয়েছে। সেদিন আমার চোখে এই অশিক্ষিত, গরীব, সমস্যা জর্জরিত রমনীটি যে বিশাল মনের পরিচয় রেখেছিল তা আমাকে আজও ভাবায়.......নারীরা কি সত্যি কোনোদিন সকল বন্ধন ছিন্ন করে নিজের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে? তারা নিজের মনের ঘরেই চির পরাধীন, নিজের নারী সত্তার কাছে।