Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#বিষয়_গল্প
#ফিরে_আসা #শ্রীপর্না_চক্রবর্তী 
ইন্দ্রনীল প্রচন্ড রেগে গেছে, রাগে কাল রাত থেকে গজগজ করেই চলেছে!ইন্দ্রনীল আর তনিমার একমাত্র সন্তান মাফিন, তাদের কন্যা, তাদের চোখের মণি, কাল কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে ফিরেছে! ভীষণ কাঁদছিল সে,…

 




#বিষয়_গল্প


#ফিরে_আসা 

#শ্রীপর্না_চক্রবর্তী 


ইন্দ্রনীল প্রচন্ড রেগে গেছে, রাগে কাল রাত থেকে গজগজ করেই চলেছে!

ইন্দ্রনীল আর তনিমার একমাত্র সন্তান মাফিন, তাদের কন্যা, তাদের চোখের মণি, কাল কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে ফিরেছে! 

ভীষণ কাঁদছিল সে, তাকে নাকি ক্লাসে সবাই "এলিফ্যান্ট-এলিফ্যান্ট" বলে খেপিয়ে বেড়ায় কারণ মফিনের ঠিক সামনের দুটি দাঁত বেশ বড় এবং মুখের থেকে অনেকটা বাইরে বেরিয়ে থাকে! বেশ অনেকদিন ধরেই নাকি মাফিন সহ্য করছে এসব কিন্তু ইদনিং সেটা এতটাই বেড়েছে যে মাফিন আর ওই স্কুলেই যেতে চাইছে না, স্কুলের নাম শুনলেই কান্না-কাটি করছে!


এই বছরই ইন্দ্রনীল মাফিন কে এই বড় স্কুলে ভর্তি করিয়েছে, সিবিএসসি বোর্ড, ক্লাস ওয়ানে।

স্কুলে ভর্তি কি মুখের কথা...?! 

প্রথমে ইন্টারভিউ পর্ব... সে তো শুধু বাচ্চার একার নয়, সাথে বাবা-মায়ের ও লম্বা ইন্টারভিউ, চাকরি পাওয়ার ইন্টারভিউ ও এতো লম্বা হয়েছিল কিনা সেটা সন্দেহ আছে ইন্দ্রনীলের ! তারপর লিস্টে নাম আসার টেনশন... লিস্ট টাঙ্গানোর আগের দিন তো তনিমার রাত্রে ঘুমই এলো না টেনশনের চোটে ! তারপর নাম যখন লিস্ট এলো তখন আর এক টেনশন... এত্তগুলো টাকা এবার জোগাড়ের পালা! 

আর এতো কিছু করে যখন মাফিন ভর্তি হলো এই নামি-দামী স্কুলে তখন এই অবস্থা! মেয়ে স্কুল যেতেই চাইছে না! 

ভর্তির আগে কত বড় বড় কথা ওরা বলেছিল- "আমাদের স্কুল এন্টি-বুলিং জোন, আমাদের 

স্কুলে এই হয়... সেই হয়... এই হয় না... সেই হয় না... !" আরো কত বড় বড় কথা, আর এখন সে সব 

কোথায় গেল? তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি বাজে ভাবে 

বুলিং এর শিকার হতে হচ্ছে !

কালকেই যাবে ইন্দ্রনীল আর তনিমা। 

"ওদের আমি ছেড়ে কথা বলবো না... একটা বিহিত আমি কালকেই করে ছাড়ব! টাকা নেওয়ার বেলায় কাজী আর যেই টাকা পেয়ে গেছে ওমনি পাজি!" -মনে মনে ভাবে ইন্দ্রনীল ।


পরের দিন ইন্দ্রনীল অনেক রাগারাগি করল স্কুলে গিয়ে! প্রিন্সিপল ম্যাম ইন্দ্রনীল কে নিজে কথা দিলেন যে এরকমটা আর হবে না, তিনি নিজে এই বিষয়টা দেখবেন বলে কথা দেন। 

কিন্ত ইন্দ্রনীলের রাগ কমবার নয়... তার যত রাগ তার মেয়ের ক্লাস-টিচারের ওপর। কি রকম ক্লাস-টিচার, ক্লাসে কি হচ্ছে, কি না হচ্ছে, সে দিকে কোনো খেয়াল নেই তার !?

ইন্দ্রনীল আলাদা করে দেখা করতে চাইলো ক্লাস-টিচারের সাথে, উদ্যেশ্য তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে ক্লাস-টিচারের দায়িত্ব সে মোটেও ঠিক-ঠাক পালন করছে না। 


এর আগে ইন্দ্রনীলের তার মেয়ের ক্লাস-টিচারের এর সাথে কখনো দেখা হয় নি। 

আগে যতোবার প্যারেন্ট-টিচার মিট হয়েছে, বা কখনো অন্য বিষয়ে দেখা করার প্রয়োজন হয়েছে, ততোবার তনিমাই এসেছে, সে একাই সামলেছে এই সব, তাই ইন্দ্রনীলেরও কখনো দেখা হয় নি মেয়ের ক্লাস-টিচারের সাথে। 

একটা আলাদা ঘরে ইন্দ্রনীল আর তনিমাকে বসে অপেক্ষা করতে বলা হল।


ক্লাস-টিচারের নাম সুনয়না বসু। প্রায় ১৬-১৭ বছর ধরে উনি শিক্ষকতা করছেন এই স্কুলে, খুব সুনাম ওনার, শিক্ষক হিসাবেও উনি খুব পপুলার স্টুডেন্টদের কাছে! এসব কথা অবশ্য ইন্দ্রনীল  প্রিন্সিপল ম্যাম এর থেকে শুনেছে এই মাত্র... উনি তো একদম ওনার স্কুলের টিচারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ! 

এসব শুনে ইন্দ্রনীলের রাগটা আরো বাড়ছিল বই কমছিল না! রাগে ফোঁসফোঁস করছিলো সে!


কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সামনে এলেন এক ভদ্রমহিলা... লম্বা, ছিপ-ছিপে চেহারা, ফরসা গায়ের রং, চোখে এতই হাই-পাওয়ারের চশমা যে চোখ ঠিক দেখাই যচ্ছে না! 

ওনাকে দেখেই এক অজানা কারণে ইন্দ্রনীলের বুক ঢিব-ঢিব করতে লাগল, ওর মন এক অদ্ভুত আশঙ্কায় দুলতে লাগল!

"নমস্কার, আমিই মাফিনের ক্লাস-টিচার, সুনয়না বসু!"-স্মিত হেসে উনি ইন্দ্রনীলের উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসলেন, ইন্দ্রনীলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উনি চশমাটা খুললেন! ওনার চোখদুটো বেশ ট্যারা!


ওনার চোখদুটো দেখা মাত্র ইন্দ্রনীলের যেন মনে হতে লাগল তার পায়ের তলার মাটিটা যেন কেঁপে উঠল... তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল...

এক নিমেষে ইন্দ্রনীল পৌঁছে গেল তার অতীতে, তার কলেজ-লাইফে! 


কলেজে অনেক বন্ধু ছিল ইন্দ্রনীলের... বেশ একটু লিডার টাইপের ছিল সে! 

দেখতে সুপুরুষ ইন্দ্রনীলের মেয়ে বন্ধুও কিছু কম ছিল না এবং এই নিয়ে তার বেশ অহংকারও ছিল! 

কিন্তু কেন জানি না, ওই বেঞ্চের কোনায় আড়ষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে থাকা ওই বিচ্ছিরি ট্যারা মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারতো না ইন্দ্রনীল ! 

একে তো এরম ট্যারা বিচ্ছিরি দেখতে... তার ওপর আবার এতো এটিচিউড! 

আর পড়াশোনায় ভলো বলে ইন্দ্রনীলদের কাউকে ও পাত্তাই দিত না! 

খুব রাগ ছিল ইন্দ্রনীলের ওই মেয়েটির ওপর ! 

তাই দায়িত্ব নিয়ে ইন্দ্রনীলরা রোজ কলেজে ওকে নানাভাবে উত্যক্ত করত, নানান ভাবে ওকে বিরক্ত করে ওরা ওকে বুঝিয়ে দিত যে ও বিচ্ছিরি,ও ট্যারা... এই সমাজে ওর কোন স্থান নেই ! 

অনেক সময় অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েটি লুকিয়ে কাঁদত কিন্তু তাতে ওরা আরো বেশী করে ওকে উত্যক্ত করত!

মেয়েটির নাম ছিল সুনয়না রায়, ক্লাস এ পরীক্ষায় রেঙ্ক  করত, কিন্তু ইন্দ্রনীলের ক্রেডিটে সবাই তাকে কুনয়না বলে ডাকত!

বাড়াবাড়ি টা হোলো ফাইনাল পরীক্ষার সময়... কালেজের এতো ভাল ছাত্রী সুনয়না পরীক্ষায় নাকি চিটিং করতে গিয়ে ধরা পড়ল...! 

সে কি ভাবে, কেন চিটিং করতে গিয়ে ধরা পড়ল সেটা খালি ইন্দ্রনীল আর তার দুই বন্ধুই জানত... তাদের প্ল্যান  মাফিক সুনয়না পরীক্ষায় চিটার প্রমাণিত হল ! 

তারপর আর তারা সুনয়নার খোঁজ রাখে নি, রাখা প্রয়োজনও মনে করে নি, শুধু এইটুকু জেনে মনে খুব শান্তি পেয়েছিল যে সুনয়নার একবছর নষ্ট হয়েছে, চিটিং করার অপরাধে!


আজ এতগুলো বছর পরে ইন্দ্রনীল সুনয়নার মুখোমুখি... সুনয়না রায়... এখন সুনয়না বসু... মানে সে বিবাহিতা !

নাহ...! আর কিচ্ছু বলতে পারল না ইন্দ্রনীল... তার যে এতো রাগ, সব কোথায় গায়েব হয়ে গেছে কর্পূরের মতন !

সুনয়না সাবলীল ভাবে কথা বলছে তনিমার সাথে, আজও সে একই রকম আছে, তাকাচ্ছেই না অবাক স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকা ইন্দ্রনীলের দিকে! হয়ত চিনতে পারে নি হবে... ইন্দ্রনীল মনে মনে ভাবে, ...ভাগ্যিস চিনতে পারে নি!


"আপনারা একদম চিন্তা করবেন না মিস্টার আর মিসেস সাহা... আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি এবাউট হোয়াট হ্যাড হ্যাপেন্ড উইথ মাফিন... আমার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগছে এটা জেনে... বাট আই প্রমিস ইউ, আজ থেকে মাফিন আমার দায়িত্ব, এরকমটা আর কখনো হবে না, ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি!" -বলতে বলতে সুনয়না চশমাটা আবার চোখে পড়ে নেয়।


মাফিনের মা-বাবা চলে গেছেন, এখন ব্রেক-টাইম চলছে।

সুনয়না ইন্দ্রনীলকে ঠিক চিনতে পেরেছে... চিনতে পারবে না !? সে তো ইচ্ছা করেই তার চশমা টা খুলে রেখেছিল ইন্দ্রনীলের সামনে, যাতে সে তার চোখ দুটি আরো ভলো করে দেখতে পায়, যাতে চিনে নিতে ইন্দ্রনীলের কোনো অসুবিধা না হয় তার "কুনয়না"কে !

তবে, সে নিজে যেই লাঞ্ছনার  শিকার হয়েছে, ছোট্ট মাফিনকে সে কিছুতেই তার শিকার হতে দেবে না... সে তার কথা রাখবে... অবশ্যই রাখবে... সে যে টিচার... তাকে সুনয়না যে হতেই হবে !


                      সমাপ্ত..