সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননাপঞ্চশায়রসুমিতা সরকার ঘোষ (ম্যাহেক)১১.১০.২০২০
পর্ব - (১)
নীলা আর মৃগাঙ্ক একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল আর পাঁচ জনের মতই। কিন্তু মৃগাঙ্ক অন্য জায়গায় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করার কারণে ৫…
সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা
পঞ্চশায়র
সুমিতা সরকার ঘোষ (ম্যাহেক)
১১.১০.২০২০
পর্ব - (১)
নীলা আর মৃগাঙ্ক একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল আর পাঁচ জনের মতই। কিন্তু মৃগাঙ্ক অন্য জায়গায় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করার কারণে ৫ বছর একসাথে থাকার পর নীলা আর তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
অনেক কষ্টে নীলা তার একমাত্র সন্তান কৃত্তিকাকে মানুষ করে। সামান্য একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে নীলা চাকরী করে। কখনও আশেপাশের প্রতিবেশী, কখনও স্কুলে, কখনও বা মা, বাবার কাছে এই ভাবে কৃত্তিকাকে রেখে অফিস যায়। মন পড়ে থাকে সারাদিন সন্তানের কাছে।
ছোট প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করার জন্য আয়া বা ক্রেস কোনটাতেই রাখতে পারেনা ও মেয়েকে। সামান্য যা সেলারি পায় তাতে কষ্টে, দুঃখে কোনমতে দিন চলে যায়।
কৃত্তিকার এখন বয়স ৮+ বছর। তার স্কুলের এক বান্ধবীর সাহায্যে দূরের এক পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কৃত্তিকার। ঐ পরিবার বান্ধবীর দূর সম্পর্কের মামার বাড়ি, বান্ধবী প্রায়ই ওকে নিয়ে যাবার জন্য বায়না করে, মায়ের বকুনির ভয়ে ও বাড়ি আর যাওয়া হয় না। বান্ধবীর নাম সুপর্ণা, প্রায়ই সুপর্ণা বলে আমার মামারা খুব বড়লোক, কত খেলনা ওদের বাড়িতে। রোজই সুপর্ণার কাছে কৃত্তিকা গল্প শোনে, যাওয়া আর হয় না।
এদিকে কৃত্তিকা মাঝে মাঝে তার আগের জন্মের কিছু কথা বলে, প্রায়ই মাকে বলে সে এ বাড়ির মেয়ে নয়। ঘরের ঐ কোণে একটা ইজি চেয়ার ছিল, টেবিলের পাশে দেয়ালে বিশাল বড় মাপের এল. ই. ডি টিভি লাগানো ছিল। মা রোজ দিন এসব বলতে নেই বাবু বলে মেয়েকে চুপ করায়।
পর্ব - (২)
কৃত্তিকার সেই বান্ধবীর সূত্রে ঐ প্রতিবেশী রাজর্ষি চক্রবর্তী ও তার স্ত্রী সীমা চক্রবর্তী তাদের আত্মীয় ঐ বাচ্চা মেয়েটার কাছ থেকে কৃত্তিকার পূর্ব জন্মের সব গল্প বলার কথাটা জানতে পেরে অবাক হয়ে একদিন নীলার উপস্থিতিতে তাদের বাড়ি আসে।
ছোট্ট মেয়ের মুখে বাড়ীর সব ফার্ণিচারের অবস্থানের বিবরণ শুনে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে যায়, সবই তো তাদের বাড়ির সাথে মিলে যাচ্ছে, আর নয় বছর আগেই তো তাদের একমাত্র মেয়ে নন্দিনী মারা গেছে, সেই একই চোখ, মুখের অবয়ব আর কথা বলার ধরনেও কি আশ্চর্য মিল?? কৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে দুজনেই খুব আদর করে। নীলার সাথেও পরিচয় হবার পর মেয়ের ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে নীলা রাজর্ষিকে বলে যবে থেকে কথা ফুটেছে সব সময় এই একই কথা বলে ও, এ বাড়ির মেয়ে নয়, ওর বাবা, মা অন্য ছিল, ওদের মস্ত বড় বাড়ী, কত খেলার জায়গা, ও কত আনন্দে ছিল সেখানে। বারবার নীলাকে বায়না করত ঐ বাড়িতে ওকে নিয়ে যাবার, কিন্তু আমি কোথায় খুঁজব বলুন? এমন বাড়ি?? আর কিই বা হবে খুঁজে?? নীলা সীমাকে বলে আমার মেয়ে বোধ হয় জাতিস্মর। আমি অনেক চেষ্টা করি চুপ করাতে কিন্তু ও নিজের মনে নিজে সব সময়ই এসব বলতে থাকে। নীলার সাথে পরিচয় হবার পর সীমা ছুটির দিন মা ও মেয়েকে তাদের বাড়ি যাবার আমন্ত্রণ জানায়।
উত্তরে সম্মতি জানায় নীলা। তার বৃদ্ধ বাবা, মা ছাড়া আর বিশেষ আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধব তো কেউ নেই। শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় পরিজনেরা তো মৃগাঙ্কর চলে যাওয়ার সাথে সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাকে এখনও সমাজ তো বিশেষ ভাল চোখে দেখে না। দোষ থাকুক আর নাই থাকুক, সে বিচার কেউ করে না। এক অফিস আর বাড়ি করতে করতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জীবন, একটা ছুটির দিন অন্তত মেয়েটা একটু আনন্দ পাবে। এই ভেবে নীলা খুশী।
পর্ব - (৩)
রবিবার অফিস ছুটি থাকায় নীলা আর কৃত্তিকা রাজর্ষিদের বাড়িতে আসে। ড্রয়িং রুমে অতিথি আপ্যায়নের পর রাজর্ষি কৃত্তিকাকে কোলে করে বাড়ির ভিতরের অংশ দেখাতে নিয়ে যায়।
সীমা নীলাকে তার দুঃখের কাহিনী বলতে শুরু করে। তাদের একমাত্র মেয়ে আজ থেকে নয় বছর আগে দুরারোগ্য অসুখে মারা যায়। একমাত্র মেয়েকে হারানোর দুঃখে রাজর্ষি কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল, ধীরে ধীরে কাউন্সিলিং করাবার পরে এখন তবু অনেকটাই স্বাভাবিক।
আর অন্য দিকে কৃত্তিকা ঘরের ভিতরে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে আর বলছে এই তো আমার সেই চেনা বাড়ি, পরিচিত ঘর, এটা আমার চেয়ার ছিল, এখানে আমি পড়তে বসতাম, এখানে বসে বাবার সাথে খেলতাম আর টিভি দেখতাম। ঠাম্মি আর আমি একসঙ্গে এই এইখানে বিছানায় ঘুমোতাম। আমি এই বাড়িরই মেয়ে ছিলাম। এসব শুনে রাজর্ষি তার বৃদ্ধ বাবা, মা, সীমা, নীলা, সবাই অবাক হয়ে যায়, সবই তো মিলে যাচ্ছে। তারা বুঝতে একটুও ভুল করে না যে এই মেয়েই নয় বছর আগে মৃত্যুতে হারিয়ে যাওয়া তাদের মেয়ে।
সীমা ও তার স্বামী বহু দিন পর তাদের হারানো একমাত্র মেয়েকে আবার একই রূপে পেয়ে ছাড়তে চায় না। কি করবে নীলা?? তাড়াতাড়ি একরকম জোর করেই কৃত্তিকাকে বুঝিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়িতে এসে মনে মনে ভাবতে থাকে যা হোক করে সুখে, দুঃখে দিন চলে যাচ্ছিল, একমাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃগাঙ্কর কথা ভুলে ছিল সে। শখ, আহ্লাদ তো এই অল্প বয়সেই জলাঞ্জলি দিয়েছে। এ আবার কি নতুন বিপদ এসে হাজির হলো তার জীবনে?? কিভাবে সমাধান হবে এই সমস্যার??
মাঝে মধ্যেই কৃত্তিকা তার বান্ধবীর সাথে রাজর্ষিদের বাড়িতে চলে আসে। তারাও কিছুক্ষণের জন্য হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়ে যত্নের ত্রুটি রাখে না। বাড়ি এলে নীলা জানতে পেরে মেয়েকে বকাবকি করে। বলে যেতে হবে না ওখানে। মৃগাঙ্কর মত মেয়েকে হারাবার অজানা আশঙ্কায় বুকের বাঁদিকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে নীলা।
পর্ব - (৪)
কৃত্তিকা শিশু, তার মন মানতে চায় না। সে লুকিয়ে, চুরিয়ে স্কুল থেকে ঠিক চলে যায়। বিরাট বাড়ি, আসবাবপত্র, দাস, দাসী, এতটুকুর অভাব নেই। তাছাড়া এ বাড়িতে আগে থাকার জন্য কোথাও একটা হৃদয়ের টানও তো অনুভব করে ছোট্ট শিশুটা। টাকার অভাবে আরও দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয় নীলা।
একদিন রাজর্ষি তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠায়, দুপুরে খাবার আমন্ত্রণ জানায়। কি বলার জন্য ডেকেছে ওরা তা জানতে নীলা ও মেয়ে কৃত্তিকা ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তাছাড়া এত ছোট্ট একটা শিশুকে নিয়ে এই টানাটানি আর টানাপোড়েনের নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। রিক্সায় করে দুজনে প্রায় বেলা একটার সময় রাজর্ষিদের বাড়ির সামনে এসে নামে।
সীমা দেখতে পেয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে কৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে পরম আদরে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। রাজর্ষি আর তার বাবা, মা ও নীলাকে সম্মানের সাথে বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসায়।
দুপুরে ডাইনিং টেবিলে খাবারের এক এলাহী আয়োজন। ফ্রায়েড রাইস, পাঁচ রকম ভাজা, কালিয়া, কোপ্তা, কোর্মা,, দুরকম চাটনি, রাবড়ি, দই, মিষ্টি, রসমালাই, দামী আইসক্রিম। এসব দেখেশুনে ছোট্ট কৃত্তিকাতো খুব খুশী। এত সব খাবার তো সে কোনদিন দেখেই নি। বাবার কথা যেটুকু মনে আছে, কখনও কথাই বলত না ওর সাথে। কোলেও নিত না, যেটুকু আদর, স্নেহ, ভালবাসা সবটাই ঘিরে ওর মা নীলা। হঠাৎ সীমা বলে, কি ভাবছ মা?? খেয়ে নাও, আমি খাইয়ে দেব?? বলে পরম যত্নে গল্প বলে বলে কৃত্তিকাকে খাইয়ে দেয় সীমা। মেয়েটা খাচ্ছে ভেবে নীলাও খুশী হয়।
পর্ব - (৫)
খাওয়া দাওয়ার পর বাড়িতে আরও এক অতিথির আবির্ভাব। রাজর্ষির দূর সম্পর্কের ছোট ভাই। তার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। নীলার থেকে হয়ত ৫/৬ বছরের বড় হবে। সীমা নীলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, বলে এ আমার সম্পর্কে একমাত্র ছোট দেওর। যেমন লেখা পড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছিল, তেমনই বিশাল ব্যবসার মালিক। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু ছোট বেলাতেই ওনারা মারা যান। আমার শ্বশুর শাশুড়ীর কাছেই ও মানুষ। ভীষণই ভাল আর উদার মনের মানুষ, নাম নিলয়। সব শুনে নীলা হাতজোড় করে নমস্কার জানায়।
এগিয়ে এসে নিলয় সীমার সাথে দুটো একটা কথা বলে। রাজর্ষি, সীমা, শ্বশুর, শাশুড়ী, কৃত্তিকাকে বাড়ির ভিতরে এটা ওটা দেখাতে নিয়ে গিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে গল্পে। যতই হোক তারা তো কোনদিন স্বপ্নেই ভাবেননি, এ জন্মে হারানো মেয়েকে আবার ফিরে পাবে।
সোফায় নিলয় আর নীলা একা একাই বিভিন্ন কথা বলে যায়। স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করতেই নীলা চুপ করে যায়। অন্য প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নেয়। তার পর একটা সময় মা ও মেয়ে বাড়ি চলে আসে। বাড়ি ফিরে নীলা নানান কথা ভাবতে থাকে।
ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়েছিল সেদিনই নীলা আর নিলয়ের মধ্যে। নিলয়ের খুব ভাল লেগেছে নীলার সাথে কথা বলে। আর ইতিমধ্যেই নিলয় তার বৌদির সূত্রে জানতে পেরেছে নীলার স্বামী ও তাদের ছাড়াছাড়ির ইতিহাস।
একদিন রাজর্ষি চক্রবর্তী আবার তাদের বাড়িতে নীলাকে ডেকেছে। মা আর মেয়ে এসেছে। নীলার খুব ইচ্ছে ছিল না কিন্তু বয়স্ক মানুষ দুজনও যে তাকে খুব ভালবাসে, সম্মান করে। ছোট মেয়েটাকে ''দিদিভাই দিদিভাই'' করে বুকে জড়িয়ে রাখে।
বিভিন্ন কথা- বার্তার পর দুপুরে টেবিলে আজ ইটালিয়ান ডিশ। এ খাবার তো কৃত্তিকার একেবারেই অচেনা। খুব যত্ন করে সীমা তাকে খাওয়াতে শুরু করে। সময় বুঝে রাজর্ষি নীলাকে এ বাড়িতে চিরস্থায়ী ভাবে থাকার জন্য অনুরোধ করে, বলে বাড়িতে এইটুকু একটা মেয়েকে নিয়ে একা থাকে। এখানে চলে এসো। আমাদের তো কোন কিছুরই অভাব নেই। প্রচুর ঘর খালি পড়ে আছে। কোন অসুবিধে হবে না। ইচ্ছে হলে চাকরীটা ছেড়েও দিতে পারো। আমাদের তো অনেক আছে। দুটো মানুষের খরচ কিছুই না।
এমন প্রস্তাবে নীলা হতভম্ব, কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। বলে আমাকে একটু সময় দিন। ভেবে দেখি। যেহেতু রবিবার, ছুটির দিন, আর নিলয় তার প্রিয় বৌদি সীমার কাছ থেকে আগেই নীলাদের আসার খবর জানতে পারে। তাই বিকেল হতেই নিলয় এসে উপস্থিত। বিরাট বড় ক্যাডবেরী সেলিব্রেশন এসেছে কৃত্তকার জন্য। সেও কোলে উঠে কাকু কাকু বলে আব্দারে গলা জড়িয়ে ধরে। আদতে নিলয় খুবই সহজ, সরল, বলে নীলার সাথে খুব কম সময়েই বন্ধুত্ব হয়েছে অনেকটা বেশী।
পর্ব - (৬)
যে যার ঘরের মধ্যে কথা বার্তায় ব্যস্ত। সময় সুযোগ বুঝে নিলয় আর নীলা বাগানের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে। বাগানের দিকটা বেশ খোলামেলা। পাশাপাশি দুটো দোলনায় দুজনে বসে। নিলয় আর নীলা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আর কৃত্তিকা বাড়ির ভিতরে দামী খেলনার সাথে খেলতে ব্যস্ত।
নিলয়ের সাথে নীলা তার একমাত্র ভালবাসার মানুষের সঙ্গে অতীতের জড়ানো স্মৃতির কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। স্বান্তনা দেয় নিলয়। কথা বলতে বলতে কখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে দুজনে। মৃগাঙ্ককে বড্ড ভালবাসত নীলা। জীবনের প্রথম প্রেম তাই স্বপ্ন, স্মৃতি, অনেক অনেক বেশী।
কথা, স্মৃতি, অতীত ইতিহাস, এভাবে চলতে চলতে নিলয় বলে চুপ করো।হঠাৎ কেউ এদিকে চলে এলে খারাপ মনে করতে পারে। সবকিছু আস্তে আস্তে ভুলে যাবার চেষ্টা করো। নীলা সামলে নেয় নিজেকে।
বাড়ি এসে নীলা সারারাত ধরে সবটাই ভাবে। মেয়ের ভবিষ্যৎ, স্কুলে না হয় নীলা অফিসে বেরোনোর এত তাড়ার মধ্যে কোনরকমে পৌঁছে দিয়ে আসে, কিন্তু স্কুল থেকে ফিরে?? সেই তো এতটুকু একটা শিশু মা না ফেরা পর্যন্ত একা একাই থাকে। সারাদিন চার দপওয়ালে বন্দী। কতদিন আর প্রতিবেশীরা খেয়াল রাখবে?? দু একটা কথা তো নীলাকে তাদের থেকে শুনতেই হয় রোজ।
চার দেওয়াল আর ১০/১২ ফুটের একটা ঘরই ঐ ছোট্ট শিশুটার জগৎ। বড় হয়ে যদি কৃত্তিকা নীলাকে প্রশ্ন করে যে আমার ছেলেবেলাটা কেন সুরক্ষিত ছিল না?? কেন একটা নিশ্চিত সুখের ভবিষ্যৎ আমায় উপহার দাওনি?? তোমাদের তেঁতো সম্পর্কের জন্য তো আমি দায়ী ছুলাম না। এখানে আমার দোষ কোথায়?? আর পাঁচটা সন্তানের মত কেন আমি আমার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলাম?? মাথাটা যেন চিন্তায় ফেটে যাচ্ছে।
পর্ব - (৭)
ঘুমের একটা ওষুধ খেয়ে নীলা শুয়ে পড়ে। তাকিয়ে দেখে ঐ ছোট্ট শিশুটার মুখের দিকে। শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। এই কদিনে এত আদর, ভালবাসায় ও যেন ভীষণ ভীষণ খুশি। কখন ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় নীলা। স্বপ্নে দেখতে থাকে, মৃগাঙ্ক আর তার মেয়েকে নিয়ে সে সুখের সাগরে ভাসছে, কত গল্প করছে মৃগাঙ্কর সাথে। হঠাৎ অ্যালার্ম বাজতেই চমকে উঠে পড়ে। মেয়েকে তৈরী করতে হবে স্কুলের জন্য। সপ্তাহের শুরু, তাই অফিসে কাজের চাপও বেশী। স্কুলে মেয়েকে পৌঁছে দিয়েই গাড়ি ধরতে হবে অফিসের জন্য।
দুপুরে অফিসে বসে লাঞ্চ টাইমে নীলা মেয়ের সুখের জন্য নানান কথা ভাবছে, তখনই একটা ফোন আসে নীলার মোবাইলে। তার প্রাক্তন স্বামী তার কাছে ৩০,০০০ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, না দিতে পারলে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। থানায় ফোন করতেও বারন করেছে। নীলা জানত মৃগাঙ্ক নিজের সুখের জন্য সব পারে।
আর একটুও দেরী না করে নীলা নিলয়কে ফোন করে সব জানায়। নিলয় বলে, তোমার মেয়েকে আমি আর আমার বৌদি দেখব। কিচ্ছু হবেনা ওর, তুমি নিজে সাবধানে থেকো। থানায় ডায়েরি করা হয়। ৭ দিনের মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয় মৃগাঙ্ককে। কেস চলতে থাকে।
তারপর একদিন সময়, সুযোগ বুঝে নিলয় নীলাকে বলে আমি তোমার ব্যবহারে মুগ্ধ। তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি। আমার ঘর শূন্যই আছে। তুমি চিন্তা করে দেখ। সময় নিতে পারো। আমার আপত্তি নেই।
নীলা বলে এ হয়না। আমার অভিশপ্ত জীবনের সঙ্গে আমি কাউকে আর জড়াতে চাইনা। আমরা মা আর মেয়ে যেমন ভাবে আছি, তেমন ভাবেই থাকব।
পর্ব -(৮)
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে নীলা সবটা নিয়ে ভাবতে বসে। নিলয়কে বিয়ে করলে তার জীবনই শুধু নয়, তার মেয়ের জীবন ও সুরক্ষিত। কৃত্তিকা নতুন করে তার বাবাকে ফিরে পাবে।
রাজর্ষি, সীমা আর তাদের বাবা, মা নাতনিকে পেয়ে ভীষণ খুশি হবে। নীলার বাকী জীবনও সুরক্ষিত। এত সুখ কি তার কপালে আছে?? সারারাত এসব ভেবে তার ঘুম আসে না। ছোট্ট শিশুটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা ভাবে কৃত্তিকার সুখ কেড়ে নেবার কোন অধিকার তার নেই। যে আনন্দ কৃত্তিকা পেতে চলেছে তার অধিকার তাকে দেওয়া উচিত।
পরদিন ফোনে নিলয়কে সীমা বলে তার দাদা, বৌদি, এবং রাজর্ষির বাবা, মা সবার কাছে জিজ্ঞাসা করতে। তাদের মত আছে কিনা জানতে? অনুমতি নিতে। তারা যদি অনুমতি দেন তবে নীলা ভেবে দেখবে এ ব্যাপারে।
নিলয় শুনে খুব খুশি। সে রাজর্ষিকে ছোট থেকে জানে। দাদা খুব উদার এ ব্যাপারে। বৌদিও খুব ভাল মানুষ। আর বয়স্ক মানুষ দুজন চিরকালই উন্নত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। আর নাতনির কথা ভেবে তারা মত দিয়েই দেবেন।
ব্যবসার কাজ সেরে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফেরে নিলয়। গরম কফির মগ হাতে নিয়ে বসে। নীলাকে দেখার পর থেকে তার মাথায় এখন শুধু তার চিন্তা। স্বপ্নেও নীলার মুখ ভেসে আসে সব সময়। নিলয় বন্ধুকে নীলার ব্যাপারে সবটা জানায়। নীলার ফটো দেখায়। বন্ধুও বলে মেয়েটার চোখ দুটো ভীষনই উজ্জ্বল। একেই তুই জীবনসঙ্গী কর, খুশি হবি।
পর্ব - (৯)
রাজর্ষিদের বাড়ির সবাইকে সবটা জানায় নিলয়, এমনকি নীলার অতীত ইতিহাস, সবাই সবকিছু জেনেও রাজী, বাচ্চাটার কথা ভেবেই আরও খুশি।
রাজর্ষিদের বাড়ির সবাইকে সবটা জানায় নিলয়। এমনকি নীলার অতীত ইতিহাস সবাই সবকিছু জেনেও রাজি বাচ্চাটার কথা ভেবেই আরও খুশি।
যথাসময়ে দু পক্ষের সম্মতিতে পুরোহিত ডেকে বিয়ের দিন পাকা হোল। আর কিছুদিন পরেই দুর্গা পুজো। এখন শ্রাবণের শেষ দিক। এ মাসে আর একটা দিন বাকী। সেই শুভ দিনেই নিলয় ঘরে নিয়ে আসতে চায় নীলাকে। নীলাও মনে মনে খুশী। শুধু অতীতটা মনে পড়লে চুপ হয়ে যায় নীলা, কারণ মৃগাঙ্ককে বড্ড ভালবাসত সে। মেয়েরা বোধ হয় জীবনের প্রথম পুরুষকে ভুলতে পারেনা কখনও।
২০ দিন বাকী আছে, টাকার অভাব নেই দুই ভাইয়ের। রাজর্ষি আর নিলয় দুই ভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাড়ি গোছগাছে ব্যস্ত হলো সারাবাড়ি এশিয়ান পেন্টস হবে। বাড়ির চারদিকে আর বাগান মুড়ে ফেলা হবে রংবেরঙের আলোকমালায়। বসবে নানান রঙ্গীন ফোয়ারা। সব রকম ব্যবস্থা থাকবে। কোথাও কোন খামতি রাখেনি নিলয়।
ক্রমে ক্রমে সব আয়োজন শেষ করা হোল। বিয়ের দিন উপস্থিত। সমস্ত রকম নিয়ম সেরে সন্ধ্যেবেলায় নীলাকে পরানো হচ্ছে জামরঙা বেনারসী, না তাকে কিচ্ছু কিনতে দেয়নি নিলয়। মেয়ের তরফেরও সব খরচা সে একার কাঁধেই তুলে নিয়েছে। এমনকি বিয়ের বেনারসীও নিলয় নিজে পছন্দ করে কিনে দিয়েছে নীলাকে। যে গয়না দিয়ে নীলাকে সাজানো হবে, সব গয়না একটা একটা করে পি. সি. চন্দ্র জুয়েলার্স থেকে কিনে দিয়েছে নিলয়।
নীলা আপত্তি জানিয়েছিল, বলেছিল আমি সামান্য প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করি, আমি তো অত পারব না, তবু সামান্য কিছু চেষ্টা করব চমার মত করে। মেয়ের বাড়ির নিয়ম তো আমারই রক্ষা করতে হয়। না নীলা তার বৃদ্ধ বাবা মাকে আর দ্বিতীয় বার চাপ দিতে চায়না। মেয়ের আবার খুশির দিন ফিরে আসছে এটুকু শুনেই বাবা, মা, দুহাত ভরে নিলয় আর রাজর্ষিকে আশীর্বাদ করেছে। তাদের আর বিরক্ত করতে চায়নি নীলা।
পর্ব - (১০)
কিন্তু নিলয় ও কোন কথা শুনতে চায়নি। নীলার সবরকম আপত্তি অস্বীকার করে প্রচুর গয়না কিনে দিয়েছে নীলাকে। মেয়েকেও সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে নিলয়। না, নীলার বাপের বাড়িতে নয়। একটা বাড়ি ভাড়া করে নীলার বিয়ে হচ্ছে। জামরঙা বেনারসী আর সব গা ভর্তি গয়নায় নীলাকে মনে হচ্ছে যেন মা লক্ষী।
নিলয় শুধু প্রহর গোনে, কখন নীলাকে একবার দেখবে। নিয়মমাফিক শুভদৃষ্টি, সাতপাক, সিঁদুরদান, হয়ে গেল। বাসরে এসে নীলা জিজ্ঞেস করে নিলয় তুমি খুশি তো?? জামরঙা বেনারসী আর সিঁথি পরিপূর্ণ লাল চওড়া সিঁদুরে নীলাকে মনে হচ্ছে অপরূপা। দুচোখ ভরে শুধু দেখছে নিলয়। এভাবেই হই, হুল্লোড়, বাসর পর্ব শেষ করে পরদিন কনকাঞ্জলি দিয়ে নীলা পা বাড়ায় শ্বশুর বাড়ির দিকে।
নতুন বৌকে বরণ করার জন্য সীমা আর তার শ্বাশুড়ি চন্দ্রা দেবী ভীষণ ব্যস্ত। খুব খুব খুশি তারা। বরণ করে নীলাকে ঘরে নিয়ে যায় দুজনে। আজ কালরাত্রি। পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ছোট্ট কৃত্তিকা নতুন ঠাকুর্দা আর ঠাকুমা পেয়ে ভীষণ খুশি।
পরদিন সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। পুরো চারতলা বাড়ি আর বাগান নানা রঙের আলোকমালায় সেজে উঠেছে। রঙ্গীন ফোয়ারা, সানাইয়ে ভৈরবীর সুর, আলো, সব মিলিয়ে ঝলমল করছে #পঞ্চশায়র.........
খুশি যেন উপচে পড়ছে।
পর্ব - (১১)
নিলয়ের বাবা, মা দুজনেই ছোটবেলায় মারা গেছেন বলে নিলয় কিছুটা রাজর্ষির বাবা, মায়ের কাছেই মানুষ। কিন্তু পরে লেখা পড়া শিখে ব্যবসা করে নিজেও প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরী করেছে, সম্পূর্ণ নিজের টাকায়। ইচ্ছে সেই বাড়িতেই নীলাকে নিয়ে তোলার।
কিন্তু না, রাজর্ষি বলল এত বড় বাড়িতে আমরা একা একা। মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে সীমাও মনমরা হয়ে রয়েছে। নীলা মেয়ে নিয়ে থাকলে বাবা, মাও খুশি আর সীমার মনটাও ভাল থাকবে। আপত্তি সত্বেও বড় দাদার মুখের ওপর না বলতে পারে না নিলয়।
নিলয়ের কিনে দেওয়া গয়না ছাড়াও সীমা তার সমস্ত গয়না আলমারি থেকে বের করে একটা একটা করে নীলাকে পরিয়েছে, আর নিলয়ের কেনা গয়না গুলোও সযত্নে পরিয়ে দিয়েছে ছোট জাকে। গয়নায় যেন মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নীলার দেহ। নীলা অবাক হয়ে সীমাকে বলে "দিদি? তোমার সব গয়না আমায় দিয়ে দিলে? উত্তরে সীমা বলে আর তুমি যে আমার সবথেকে প্রিয় জিনিস আমার আদরের মেয়েকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ? তার পাশে এ গয়না কিছুই নয়। নীলা আনন্দে আর কোন কথা বলতে পারেনা।
রাতে অতিথি আপ্যায়ন পর্ব শেষ হবার পর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় নিলয়। আজ রয়্যাল ব্লু বেনারসীতে (ছেলের বাড়ি থেকে নীলার জন্য কেনা) নীলাকে অপূর্ব সুন্দরী মনে হচ্ছে। কাছে বসে যত্ন সহকারে একটা একটা করে গয়না হাতে খোলে নিলয়। ঘোমটা সরিয়ে দুহাতে গাল চেপে শুধু নীলার মুখ দেখছে নিলয়।
বলছে পারবে তো নীলা আমাকে মানিয়ে নিয়ে সুখী করতে? নীলা বলছে তুমি আমাকে আর আমার মেয়েকে এত সুখ উপহার হিসেবে দিয়েছ আর আমি এটুকু করতে পারবনা? যথাসাধ্য চেষ্টা করব। নীলা বলে বাইরে সানাই বাজছে। এত আলো, রাতটা আজ গল্প করেই কাটাই দুজনে চলো। নিলয় ছোট্ট আপত্তি জানায়, বলে, এ রাত সমস্ত মানুষের জীবনে একবারই আসে। আমি এই অসামান্য মুহূর্ত কিছুতেই নষ্ট করতে পারব না।
পর্ব - (১২)
কিছু ক্ষনের জন্য মনে পড়ে যায় নীলার অতীত জীবনের আরও একটি এই রকমই প্রথম রাতের কথা। মদের নেশায়, নীলার কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকে বেহুঁশ হয়ে সারারাত পড়েছিল মৃগাঙ্ক। সে রাত নীলার জীবনে এমনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। না, ঈশ্বর তাকে আবার সুযোগ দিয়েছেন, আরও একটি রাত যত্ন করে সাজাবার জন্য। এ রাত সে কিছুতেই নষ্ট করবেনা। নিলয় কিছুটা বুঝতে পারে নীলা কি ভাবছে। পুরোনো চিন্তা থেকে সরানোর জন্য নীলাকে বলে অনেক গুলো বছর তোমার জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেছে নীলা। আর কষ্ট কোরোনা সময়, গোলাপ, ডাফোডিল, অর্কিডে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আর রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধে ভরে যাচ্ছে দুজনের হৃদয়।
নিলয় আরও কাছে এসে জড়িয়ে ধরে নীলাকে। নীলাও তার বাহুবন্ধনে উন্মুক্ত করে দেয় নিজেকে। এই প্রথম কোন পুরুষের হৃদয়ের ভালবাসা উপলব্ধি করার সুযোগ পায় নীলা। এই প্রথম বার ভালবাসার মানুষ দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেলে নিজেদের।
যত্নে, আদরে, সোহাগে, চুম্বনে ভরিয়ে তোলে একে অন্যকে।
সাক্ষী রজনীগন্ধা,
ভালবাসা আর আদর কি? তা এই প্রথম মর্মে, মর্মে, অনুভূতির শিরায়, শিহরণে বুঝতে পারে নীলা। আজ থেকে সে নীলা চক্রবর্তী, নিলয় চক্রবর্তীর স্ত্রী আর কৃত্তিকা চক্রবর্তীর মা।
এমন মধুরেণ সমাপয়েৎ সবার জীবনে কেন সম্ভব
না??