#বিভাগ_গল্প
#শিরোনাম_নানাসাহেবের_ছোরা
#কলমে_পৃথা_কর্মকার
গাড়ি থেকে নেমে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলো সুবিনয়। প্রায় পৌনে ছটা বাজে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা পুরনো কটেজ প্যাটার্নের দোতলা বাড়িটা। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া বাড…
#বিভাগ_গল্প
#শিরোনাম_নানাসাহেবের_ছোরা
#কলমে_পৃথা_কর্মকার
গাড়ি থেকে নেমে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলো সুবিনয়। প্রায় পৌনে ছটা বাজে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা পুরনো কটেজ প্যাটার্নের দোতলা বাড়িটা। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া বাড়ির সামনের আগাছাঘেরা অংশে এককালে যে বাগান ছিল,তা বেশ বোঝা যায়। আশেপাশে আর কোনো বসতি নেই। এককালে গেটের পাশের অতিকায় শ্বেতপাথরের থামে হয়তো জ্বলজ্বল করত বাড়ির নামটা। আজ ভগ্নপ্রায় শ্যাওলাধরা অংশে সবই ঝাপসা।
গাড়ির আওয়াজ শুনে এবার ভিতর থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এল বছর পঞ্চাশের বেঁটেখাটো একজন , "আসুন বাবু, আমি রঘুদা।এ বাড়ির দেখভাল করি আর কি। অসীমবাবুর কাছে আপনার আসার খবর পেইছি", বলতে বলতেই লোহার গেটটা হাট করে খুলে দিল লোকটা। প্রত্যুত্তরে ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি টেনে গেটের ভিতরে ঢুকল সুবিনয়। হ্যাঁ ,এনার কথাই বলেছিল বটে অসীম। এই রঘুদার ভরসাতেই এ বাড়ি ফেলে অসীমের দূরসম্পর্কীয় মামাটি নিশ্চিন্তে অস্ট্রেলিয়ায় ছেলের কাছে পাড়ি দিয়েছেন। রঘুদা অবশ্য রাতে এবাড়িতে থাকেনা । সারাদিনের কাজটাজ শেষ করে সন্ধ্যেবেলা খানিক দূরের নবাবগঞ্জের কাছেই ওর বাড়িতে ফিরে যায়।ফলে রাতে একাই থাকতে হবে সুবিনয়কে। তাতে অবশ্য কোন সমস্যাই নেই। নির্জনতায় লেখালেখির জন্যই তো কাঠখড় পুড়িয়ে এতদূর আসা।
সম্প্রতি নামি পত্রিকা 'নবীনতীর্থ'র প্রকাশক রথীন ভট্টাচার্য ভারতের প্রথমদিকের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন সুবিনয়কে। বিষয়টা পুরনো হলেও লেখায় একটা আনকোরা ব্যাপার আনা চাই। সম্পাদকমশাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী পুরো লেখাটা জমা দিতে হবে মাসখানেকের মধ্যেই। এদিকে সুবিনয় পড়ে গেল মহা সমস্যায় । তার অবিবাহিত জীবনে দেড়কামরার ফ্ল্যাটে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনার বিরাম নেই। এ পরিবেশে আর যাই হোক, এমন গুরুগম্ভীর বিষয়চর্চা চলেনা।
এক বিকেলে কথাপ্রসঙ্গে তার এই অসুবিধের ব্যাপারটা পুরনো বন্ধু অসীমকে জানাতেই কিছুক্ষণ চিন্তা করে ও বলেছিল, "দেখ , একটা জায়গা তোর জন্য একদম পারফেক্ট। নির্জনতা যখন খুঁজছিস,তখন নবাবগঞ্জের মাইল তিনেক দূরে আমার এক দূরসম্পর্কের মামারবাড়িতে থেকে আসতে পারিস।বাড়িটা অবশ্য অনেক পুরনো। বাড়িটাকে আসলে মামার না বলে মামির বলাই উচিত।অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাপেরবাড়ির উত্তরাধিকারসূত্রে মামি বাড়িটা পেয়েছিলেন। মামিদের এক পূর্বপুরুষ, যিনি এ বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন , তিনি ছিলেন খাঁটি সাহেব। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে তাঁর নির্দেশেই অনেক দেশীয় রাজার মৃত্যুও হয়েছিল বলে শুনেছি। সাহেবের নামটা অবশ্য আর মনে নেই। বেশ খটোমটো নাম ছিল। শেষজীবনে পাগল হয়ে গিয়ে সুইসাইড করেছিলেন ভদ্রলোক। ওনার দুই ছেলের মৃত্যুর পর স্ত্রী আর মেয়ে কিছুদিন বাস করেছিল ওবাড়িতে। তারপর থেকে প্রায় ফাঁকাই পড়ে আছে বাড়িটা। ইতিমধ্যে বছর দেড়েক আগে মামি মারা যাবার পরই মামাও কলকাতার ফ্ল্যাটের বাস তুলে দিয়ে এখন ছেলের কাছে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী। এমনিতে রঘুদা নামের এক কেয়ারটেকারই এখন সামলায় বাড়িটা। রিসেন্টলি বাড়িটা বেচে দেওয়ারও চেষ্টা চালাচ্ছেন মামা, কিন্তু খদ্দের জোগাড় হচ্ছেনা কিছুতেই।একে তো আশেপাশে লোকালয় দোকানবাজার কিছুই নেই, তার উপর নির্জন ফাঁকা মাঠের মধ্যে মান্ধাতার আমলের তৈরি ওই জগদ্দলমার্কা বাড়ি কে আর সাধ করে কিনবে বল!তুই চাইলে কদিন কাটিয়ে আয়। আমি ফোনে রঘুদাকে বলে রাখব"।
ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর লেগেছিল সুবিনয়ের। সেই সাথে ওবাড়িতে বসবাসের প্রস্তাবটা পেয়ে হাতে প্রায় চাঁদ পেয়েছিল সে। দিন দুয়েকের মধ্যেই জিনিসপত্র গুছিয়ে গাড়ি ঠিক করে আজ সোজা চলে এসেছে এখানে। ড্রাইভার ডিকি খুলে মালপত্র নামাচ্ছে ।ওকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেল রঘুদা। মালপত্তরের মধ্যে জামাকাপড় আর নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ছাড়া বেশিরভাগই নানাধরনের ঐতিহাসিক বই। এগুলো আগে ঠান্ডা মাথায় পড়ে শেষ করা দরকার।তারপর লেখালিখি শুরু করা যাবে। পায়ে পায়ে লাল নুড়িপাথরে ঢাকা পথটা বেয়ে সুবিনয় এবার পৌঁছালো ঢাকা বারান্দায়। বারান্দার সামনে আবার একখানা ভাঙাচোরা ফোয়ারা। বাড়ির মালিক যে বেশ শৌখিন ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। জিনিসপত্র নামিয়ে ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় ভরে গেল চারপাশটা। কোত্থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ কান পেতে শুনল সুবিনয়। নাহ,চেনা ডাক নয়। পাখি ছেড়ে দিনের আলো থাকতে থাকতে জিনিসপত্রগুলো গোছগাছ সেরে নেওয়া দরকার। এদিকে ইলেক্ট্রিসিটি থাকলেও খুব নাকি গন্ডগোল করে মাঝেমাঝে। অনেকসময় যে টানা তিন চারদিন লোডশেডিং চলে, সে কথাও আগেই জানিয়েছে অসীম।
রঘুদার পিছন পিছন বাড়ির ভিতরে ঢুকলো সুবিনয়। লম্বা করিডোরে একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। তার দুপাশে ঘরগুলো।"আসেন বাবু, আপনার জন্যি এই ঘরটা গুছিয়ে রেখেছি", বলতে বলতে একতলার কোনের ডানদিকের ঘরটায় ব্যাগপত্র নিয়ে ঢুকলো রঘুদা। "আচ্ছা দোতলার ঘরগুলো কি একেবারেই ব্যবহার হয়না এখন"? জিজ্ঞেস করল সুবিনয়।
" আইজ্ঞে বাবু , উপরের ঘরগুলান ভাল নাই। সব ভেঙেচুরে একসা। নিচেতলার এই ঘরখানাই মোটামুটি ভালো আছে। তাছাড়া গেলবার বাবু বিদেশ যাবার আগে খানিক সারানোও হয়েছে। তাই ভেবেচিন্তে এঘরেই আপনের থাকার বন্দোবস্ত করলাম। দেখেন, কুনো অসুবিধে হবে নাই", রঘুদার কথার ফাঁকে ঘরটাকে জরিপ করতে গিয়ে সুবিনয়ের তো চক্ষুস্থির! এলাহি ব্যবস্থা! প্রাচীন আমলের কড়িবরগাওয়ালা উঁচু সিলিং, চওড়া পালঙ্ক ,আর দেয়ালজোড়া কাঠের আলমারির পাশে শোভা পাচ্ছে একখানা সেকেলে দোলআয়না। সবকিছুতেই বেশ প্রাচীনতার ছাপ। এককোনে পালিশচটা টেবিল আর একটা হাতলভাঙ্গা চেয়ারও রয়েছে। খড়খড়িওয়ালা তিনদিকের তিনটে প্রকাণ্ড জানালা অবশ্য বন্ধ এখন। হালআমলের টিউবলাইট আর খাটের পাশের স্ট্যান্ডফ্যানটা কেমন বেমানান লাগছে এহেন গৃহসজ্জার সাথে।
"আপনি ফেরেশ হয়ে লিন ,আমি চা আনছি", বলে রঘুদা চলে গেল ঘর থেকে। সামনের জানালাটার খড়খড়ি একটু ফাঁক করল সুবিনয় । সূর্যদেব অস্ত যেতেই পাতলা অন্ধকার নামছে চরাচরে। সামনেই আগাছাঘেরা বাগানের খানিকটা অংশ সন্ধ্যার আঁধারের বিষন্নতা মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঝিঁঝিঁর আওয়াজে কান পাতা দায়।কতদিন এ আওয়াজ যে কানে আসেনি! শহর ছেড়ে এরকম নির্জন জায়গায় মাঝেমাঝে চলে এলে চোখ কান নাক একটা অদ্ভুত বিশ্রাম পায়, তাই না? মুগ্ধভাবে কিছুক্ষণ জানালার ধারেই বসে রইল সুবিনয় । খানিকপরে হাতমুখ ধোবার জন্য ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকতেই চোখে পড়ল হালফ্যাশনের প্লাস্টিকের বালতি মগ সবের পাশাপাশি একখানা অতিকায় বাথটবও মজুত। দেখেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে জিনিসটা। বেরিয়ে এসে তোয়ালেতে হাত মুখ মুছতে না মুছতেই চা আর পকোড়ার প্লেট নিয়ে রঘুদা ঢুকেছে ঘরে," রাতের রান্না চাপিয়ে দিয়েছি। শেষ হলেই কিন্তু আমি ফিরে যাব ছার। আমার ফোননম্বরটা আপনারে দিয়ে যাচ্ছি।অছুবিধে হলে ডাকলেই চলে আছব"।
"এক কাজ কর বরং", বলতে বলতে পার্স থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল সুবিনয়, "এটা রাখ। কাল সকালে আসার আগে দিনপাঁচেকের মত বাজার নিয়ে এসো, কেমন"? ক্ষণিকের জন্য দ্বিধা ফুটে উঠল রঘুদার মুখে," আপনি অসীমবাবুর অতিথ। আপনি কেন টাকা দিতেছেন? উনি যখন বাড়ি দেখাশোনার কাজে এসবেন,তখুনি নয় চেয়ে নিব"।
"না না, চাইতে হবেনা।এটা আমিই দিচ্ছি", বলে টাকাটা রঘুদার হাতে জোর করে গুঁজে দিল সুবিনয়। চা খাওয়া শেষ করে টেবিলে নিজের বইগুলো সযত্নে সাজালো। রান্নাবান্নার পাট চুকিয়ে প্রায় সাতটা নাগাদ রঘুদা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
বেশ গুমোট লাগছে। দক্ষিণের জানালার পাল্লা দুটো খুলল সুবিনয়। একটু হাওয়া আসুক অন্তত। ছেঁড়া মেঘের ভেতর থেকে মাঝেমাঝেই উঁকি দিচ্ছেন চাঁদমামা। ঝিরঝির করে হাওয়া আসছে বাগান থেকে। পথশ্রমে বেশ ক্লান্ত লাগছে শরীরটা। বসে থেকে লাভ নেই ভেবে সাড়ে আটটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল সে। ভরা পেটে নরম বিছানায় পড়তে না পড়তেই দুচোখ জড়িয়ে এলো ঘুমে।এক ঘুমেই রাতটা কাবার।
পরদিন সকাল হতেই কাজে নেমে পড়ল সুবিনয়। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ডায়রিতে প্রয়োজনীয় তথ্য নোট করার কাজ চলল প্রায় আড়াইঘন্টা ধরে। দুপুরে কোনরকমে স্নান খাওয়া সেরেই ফের ডুবে গেল বইয়ের পাতায়। ঘন্টাখানেক পর বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য বাড়ির পিছন দিকটায় একটা চক্কর দিতে বেরলো সে। পিছনেই টিউবওয়েল।এখানে এই জলই ভরসা।অতীতের জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটার নিতান্তই জীর্ণদশা এখন। পিছনের পাঁচিল জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। পাঁচিলের ওপাশে কচুরিপানায় ঢাকা এক মজা খাল। পায়চারি করতে করতে লেখার বিষয়বস্তু মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল সুবিনয়। তথ্যসংগ্রহ মোটামুটি কমপ্লিট। আগামীকাল থেকেই শুরু হবে লেখা। আজও সন্ধ্যেবেলা রঘুদা চলে যেতেই গতকালের মত তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল সে।
রাত তখন কত কে জানে! আচমকা সুবিনয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল দোতলার একটা দুমদাম আওয়াজে। কেউ যেন ভারী কোনো জুতো পড়ে ভীষণ জোরে পায়চারি করছে আর সেই সাথে ভেসে আসছে সাহেবি উচ্চারণে চোস্ত ইংরেজিতে গালাগালির ফোয়ারা। এত রাতে দোতলায় কে এমন অসভ্যতা করছে? এ বাড়িতে তো সে ছাড়া আর কেউ নেই। অন্তত গত দু'দিনে আর কাউকে তো চোখে পড়েনি। তবে কি পেছনের ভাঙ্গা পাঁচিল ডিঙিয়ে কেউ উঠেছে দোতলায়? চোরটোর নাকি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে পা টিপে টিপে করিডরে বেরিয়ে এল সুবিনয়। সারা বাড়ি জুড়ে অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। মোবাইলের টর্চের আলোয় দেওয়ালের সুইচবোর্ডে হাত রাখল সে। নাহ, আলো জ্বললোনা। নির্ঘাত লোডশেডিং।
উপরের দাপাদাপিটা থেমে গিয়ে এখন একটানা গোঙানির মতো আওয়াজ আসছে। আরো কিছুক্ষণ অন্ধকারে চুপচাপ অপেক্ষার পর মরিয়া হয়ে এবার সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে এগোলো সে। একতলার মতো দোতলাতেও ধুলোমাখা লম্বা করিডরের দুপাশে দুখানা করে মোট চারখানা ঘর। তিনটি ঘরের দরজাতেই ঝুলছে সেকেলে আমলের প্রকাণ্ড তালা।টর্চের আলো চতুর্থ ঘরের দরজায় পড়তেই চমকে উঠল সুবিনয়। তালাটা খোলা অবস্থায় ভেজানো দরজার গায়ে ঝুলছে। অনুমানে বুঝল এই ঘরটার নীচের ঘরেই সম্ভবত সে রয়েছে এখন।
ভাবনার মাঝে ফের ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে এলো কিছুক্ষণ আগে শোনা সেই সাহেবি গলার চিৎকারটা," গড ড্যাম ইট, আই অ্যাম ম্যাকগ্রেগর। দা রুলার অফ ডেস্টিনি"। সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে একঝটকায় এবার ভেজানো দরজাটা ঠেলে খুলে দিল সুবিনয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নজরে পড়ল ঘরের ভেতরের দীর্ঘদেহী সাহেবি পোশাকে সজ্জিত এক শ্বেতাঙ্গর দিকে। দরজা খোলার আওয়াজে সাহেব এদিকেই হিংস্র চোখে তাকিয়েছে।কষ বেয়ে গড়িয়ে আসছে লালা।মাথার চুল উস্কোখুস্কো।দেখেই বোঝা যায় যে, সে এখন প্রকৃতিস্থ নয়।" ইউ ডার্টি নিগার, হাউ ডেয়ার উ টু এন্টার মাই হাউস? আই উইল কিল ইউ লাইক দা ওল্ড জমিনদার কেনোয়ার ",সুবিনয়ের বিস্ময় চুরমার হয়ে গেল সাহেবের গর্জনে। কি সব হচ্ছে এত রাতে! রাতবিরেতে এই অজানা জায়গায় শেষে এই পাগলের হাতে প্রাণটাই না যায়! আতঙ্কের চোটে গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছেনা সুবিনয়ের।
সাহেব ততক্ষণে এগিয়ে এসে তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল। করিডরের ভাঙা জানালা দিয়ে সুবিনয় দেখল, পিছনের পাঁচিল টপকে অকথ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে সাহেব ছুটল মজা খালটার পারে।কার প্রতি যে সাহেবের এত রাগ সেটা বোঝাই যাচ্ছেনা। পায়ে পায়ে এবার সাহেবের ঘরটায় ঢুকল সুবিনয় । অবাক কান্ড! কি নিখুঁত পরিপাটিভাবে গোছানো ঘরটা! তবে যে রঘুদা বলেছিল ,উপরের ঘরগুলো নাকি থাকার যোগ্য নয়। আচ্ছা মিথ্যেবাদী তো! কাল এলে ধরতে হবে। অসীমটারও বলিহারি। এখানে অন্য কারো থাকার কথা তো তাকে জানায়নি আগে! অ্যান্টিকের আসবাবগুলোর কারুকাজ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সুবিনয়ের মনে হচ্ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যুগে চলে এসেছে সে। দেয়ালে ঝুলছে পূর্ণাবয়ব এক সাহেবের প্রতিকৃতি।তলায় খুদেখুদে অক্ষরে কি যে লেখা আছে, টর্চের আলোয় ভালো পড়া যাচ্ছেনা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঁড়ি বেয়ে ভারী জুতোর মশমশ শব্দ তুলে সাহেব এবার উঠে আসছে উপরে। তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দেওয়ালের পাশের অন্ধকারে মিশে দাঁড়িয়ে রইল সুবিনয়। মনে হচ্ছে কাউকে যেন খুঁজতে বেরিয়ে শেষমেষ হদিশ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরল সাহেব। হাঁপাতে হাঁপাতে উপরে উঠে কোনোদিকে না তাকিয়ে বিড়বিড় করে বকতে বকতে সাহেব আবার ঢুকল ঘরে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের মাঝে। দরজার পাশ থেকে সন্তর্পনে ঘরের ভিতরে উঁকি দিল সুবিনয়। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আচমকাই ড্রয়ার খুলে একটা পিস্তল বের করেছে সাহেব।মুখে পৈশাচিক উল্লাস। সর্বনাশ!কি হবে এবার? ভাবনার মাঝেই নিজের কপালে রিভলবার তাক করেছে পাগলা সাহেব। ব্যাপার-স্যাপার দেখে হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে সুবিনয়ের।এখনই ওকে বাধা দেওয়া দরকার। কিন্তু ভয় হচ্ছে, তাতে না খেপে গিয়ে আরো বড় কান্ড বাঁধিয়ে বসে পাগল! দুম করে একটা আওয়াজ, আর পরক্ষনেই সাহেবের আর্তনাদের সাথে ভেসে এলো একরাশ বারুদের গন্ধ। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা থমকে গেলেও প্রায় সাথে সাথেই দৌড়ে ঘরে ঢুকলো সুবিনয়।সাহেবের মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। টেবিল থেকে কাচের গ্লাসটা তুলে সাহেবের মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে রঘুদার নাম্বারটা ডায়াল করল সুবিনয়। সর্বনাশ, নট রিচেবল বলছে। আসার পর থেকেই এখানকার টাওয়ারের প্রবলেমটা লক্ষ্য করেছে সুবিনয়।
"বাবু, আমি একটু আগেই টোমার সাঠে মিসবিহেভ করঠে, টাও টুমি ডল খাওয়ালে। একটা জিনিস টোমায় প্রেজেন্ট করে ডেটে চাই। মে গড ব্লেস উ বাবু", অতিকষ্টে দুর্বোধ্য জগাখিচুড়ি মিশিয়ে বলতে বলতে শার্টের পকেট থেকে একটা বাক্স বার করে সুবিনয়ের হাতে তুলে দিল সাহেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে একসময় নিস্পন্দ হয়ে গেল তার শরীরটা।
আচমকা ঘুমটা ভেঙে যেতেই সুবিনয় দেখল ঘামে ভিজে জবজব করছে তার সারা শরীর। জানালার বাইরে ভোর হব হব। বাগান থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলকাকলি। হঠাৎ হাতটা কিসে ঠেকতেই চমকে উঠলো সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বালিশের তলা থেকে জিনিসটা টেনে বের করে আনতেই পুরো থ। কি আশ্চর্য !গতরাতে সাহেবের দেওয়া বাক্সটা এখানে এলো কি করে? আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই দ্রুত হাতে বাক্সটা খুলতেই চকচক করে উঠলো ইস্পাতের ফলার মতো তীক্ষ্ণ একটা ছোরা, যার সুদীর্ঘ হাতলে খোদাই করা আছে সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা বিঠলের ধুন্ধুপন্থ নানাসাহেবের নামাঙ্কিত সীলমোহর।
বিদ্যুৎচমকের মত গতকালের তারিখটা হঠাৎ মাথায় খেলে গেল সুবিনয়ের। হ্যাঁ , গতকালই তো ছিল তেইশে এপ্রিল। সাহেবের বলা 'কেনোয়ার' নামটাও মনে পড়ে গেল ঝট করে। গতকাল দুপুরেই সুবিনয় একটা বইতে পড়েছিল, আঠারোশো আটান্নর এইদিনেই আজিমগড়ের কাছে মন্নুহারে যখন মহাবিদ্রোহের অন্যতম নেতা বিহারের মহারাজ কানোয়ার সিং নৌকা চড়ে গঙ্গা পার হচ্ছিলেন, সেইসময় কোম্পানির সাহেব রবার্ট ম্যাকগ্রেগরের নির্দেশে 'মেগনা' নামের গানবোট থেকে গোলাবর্ষণ করে তাঁকে হত্যা করেছিল কোম্পানির সেনারা। মহারাজের মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত ধনরত্নও লুট করেছিল সাহেবরা। আশ্চর্যজনকভাবে এরপর ম্যাকগ্রেগরেরও মৃত্যু হয়েছিল তেইশে এপ্রিল ,এইটিন সিক্সটি ফোরে। সাহেব নাকি সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায় নিজের মাথায় নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে জানা যায় ইতিহাসে। নানাসাহেব আর তাঁতিয়া টোপির খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন রাজা কানোয়ার সিং। এই ছোরাটা রাজা কানোয়ারকে উপহার দিয়েছিলেন নানাসাহেব স্বয়ং। রাজাকে হত্যার পর অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে এটাও লুঠ করেছিল ম্যাকগ্রেগর। এ বাড়িটাও সম্ভবত সিপাহী বিদ্রোহের আমলে ম্যাকগ্রেগরেরই তৈরি। তাছাড়া অসীমও তো বলেছিল, ওর মামীর পরিবার নাকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছিল। তার মানে ম্যাকগ্রেগর ওই পরিবারেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন।
বিছানা ছেড়ে উঠে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় এল সুবিনয়। পুরু ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢেকে আছে তালাবন্ধ ভাঙাচোরা ঘরদুটো। বোঝাই যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে মানুষের পা পড়েনি এখানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরম মমতায় ছোরাটার গায়ে হাত বোলালো সে। কল্পচক্ষে যেন দেখতে পাচ্ছে, এককালে এই ছোরা কোমরে গুঁজেই দুই হাতে দুই তলোয়ার নিয়ে ব্রিটিশদের সাথে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন পাগড়িবাঁধা এক ভারতীয় বীর, "মেরা ভারত নেহি দুঙ্গা"।
নাহ,আজই ফিরে গিয়ে মিউজিয়ামে জমা দিতে হবে ছোরাটা। সেদিন দেশের স্বাধীনতারক্ষার জন্য যাঁরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করে গেছেন, তাঁদের বীরত্বের প্রমাণ হিসেবে সকল দেশবাসী চোখ ভরে দেখতে পাবে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি। প্রভাতী সূর্যের আলো এখন ছোরাটার গায়ে পড়ে অতীত বীরের শৌর্যের মতই ঝকমক করছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুবিনয়ের মনে পড়ল বিখ্যাত কবিতার চরণ কয়টি,
"ছিঁড়ি,গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি ,
বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি
খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,
কোথায় প্রাণ!
দেখব, ওপারে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াবো দান।
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান"।।