রাতের অতিথি
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্রিটিশ আমলের উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স। অ্যান্ডার্সন হাউসের ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট ও দারোগা শ্রীপুলিনবিহারী ব্যানার্জী এবার বদলি হয়ে এসেছেন প্রত্যন্ত ছোট্ট এই পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা ওদলাবাড়িতে বে…
রাতের অতিথি
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্রিটিশ আমলের উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স। অ্যান্ডার্সন হাউসের ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট ও দারোগা শ্রীপুলিনবিহারী ব্যানার্জী এবার বদলি হয়ে এসেছেন প্রত্যন্ত ছোট্ট এই পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা ওদলাবাড়িতে বেশ কিছুদিন ধরে ঘটতে থাকা কয়েকটি খুন ও ডাকাতির তদন্ত করতে।পাহাড়ের ওপরে জঙ্গল ঘেরা তাঁর কাঠের বাংলোতে এসে উঠেছেন সপরিবারে স্ত্রী ইন্দুবালা আর পাঁচমাসের মেয়ে কনকলতাকে নিয়ে, বাংলোতে আছে মদেশীয় কেয়ারটেকার রঘুরাম আর আছে তাঁর প্রায় ছায়ার মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী পরমপ্রভুভক্ত জার্মান শেফার্ড কুকুর টাইগার।
বাংলোর ঠিক নীচে পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দুটি নদী লিশ আর চেল যাদের মাঝের ভূখণ্ডটিতে একটু পাহাড়ের কোলঘেঁষে এই বাংলোটির অবস্থান। চারপাশে চোখজুড়োনো সবুজের সমারোহ, নাম না জানা বহু পাখির আনাগোনায়, হাতির পাল, বন্য বরাহ, হরিণ আর গন্ডারের পদচারণায় স্থানটি যদিও খুবই মনোরম কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে পুলিনবাবুর কর্মস্থলটি তাঁর বাংলো থেকে চার কিলোমিটার দূরে আর প্রায় দিনই তাঁর ফিরতে রাত হয়ে যায়। আশেপাশে আর কোনো জনবসতি নেই।এদিকে কেয়ারটেকার রঘুরাম সন্ধ্যের পরে নেশাতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। জায়গাটি আরো বিখ্যাত ডাকাতির জন্য। পুলিনবাবুর স্ত্রী ইন্দুবালা দেবীর একটি সেলাই মেশিন আছে, যেটি রেখেছেন ড্রয়িং রুমের এক কোণে, যেটিতে তিনি সাংসারিক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন বাচ্ছার জামা, নিজের ব্লাউজ, পেটিকোট, পর্দা সেলাই করেন অবসরে আর আছে তাঁর ভীষণ সাহস।নিজের আর শিশুটির সুরক্ষার জন্য তিনি হাতের কাছে সর্বদা মজুত রাখেন একটি বড়ো টর্চ, একটি রামদা, বর্শা আর টাঙ্গি। প্রতুৎপন্নমতিত্বে আর সজাগ নজরদারিতে তিনি যথার্থই "দারোগা গিন্নি"।
পুলিনবাবু যেহেতু একজন দক্ষ শিকারী, তাই বাংলোতে তাঁর লাইসেন্সড রাইফেল আছে গোটা তিনেক, যেগুলি উনি জঙ্গলে শিকার করার সময় নিয়ে বেরোন, আর অন্য সময় ড্রয়িং রুমে সাজানো থাকে। বাংলোতে ঢুকলে প্রথমেই বোগেনভেলিয়া শোভিত লোহার গেটের পরে মোরামের লাল রাস্তা যেটি এসে উঠেছে বাংলোর সিঁড়ির কাছে সেটি চোখে পড়ে, মোরামের রাস্তার দুধারে প্রচুর মরশুমি ফুলের গাছ আর কিছু ফলের গাছ দিয়ে ভরা সুন্দর বাগান যার পরিচর্যা করে মালী ঝন্টু। বাগানটি চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বেষ্টিত। মোরামের রাস্তার পরে বাংলোর পাঁচটি সিঁড়ি, তার পরে টানা বারান্দা, বারান্দা সংলগ্ন প্রথম ঘরটি ড্রয়িং রুম, ড্রয়িং রুমের মধ্যে দিয়েই দুপাশে দুটি বেডরুম, একটি বেশ বড়ো, যেটি ওখানে বলে, মাস্টার বেডরুম আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোট বেডরুম, একটি লিভিং রুম, একটি স্টাডি আছে এই ছোট বেডরুমের সঙ্গে, দুটি বেডরুমের সঙ্গেই একটি করে লাগোয়া টয়লেট আছে, একটি ডাইনিং হল, একটি স্টোররুম যেটি ভাঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় আর একটি কিচেন, কিচেনের পেছনে আর একটি ছোট বারান্দা আছে যেখানে দাঁড়ালে পেছনের জঙ্গল আর নদীগুলি দৃষ্টিগোচর হয়। পুরো বাংলোটি কাঠের।
সম্প্রতি আশেপাশের অঞ্চলে ডাকাতি খুব বেড়েছে, ইনফর্মার মারফত খবর এসেছে একটি ডাকাত দলের দলপতি কালু সরদার দলবল নিয়ে গিয়ে অতর্কিতে গ্রামবাসীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের বছরের ফসলের বস্তাভর্তি চাল, ডাল, আলু, আনাজ আর পোষা ছাগল, মুরগি যখন তখন তুলে নিয়ে আসছে। কয়েকদিন ধরে সেই তদন্তের জন্যে পুলিনবাবুকে প্রায় রোজই আরো একটু দূরে যেতে হচ্ছে, ফিরছেন রাত বারোটা বাজিয়ে, ভরসার কথা সঙ্গে তাঁর সবসময়েই টাইগার রয়েছে আর রয়েছে তাঁর সার্ভিস রিভলভার।
সেদিন রাত দশটা বেজে গেছে, পুলিনবাবুর তখনো ফেরার নাম নেই। ইন্দুবালা দেবী আর কি করেন, তিনি ড্রয়িং রুমের এবং আর সব ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ করে নিজেদের রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে সেলাই মেশিনে কিছু সেলাই নিয়ে বসলেন। পুলিনবাবু আসলে উঠতে তো হবেই খেতে দেবার জন্য, তাই নিজের খাবারটাও ঢাকা দিয়ে রেখে দিলেন। বাইরে নিস্তব্ধ প্রকৃতি, শান্ত জায়গা তাই ঝিঁঝির ডাক, রাতচরা পাখিদের ডাক পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, পেছনে নদীতে হাতির পাল, বুনো জন্তুদের জল খাবার শব্দ পরিষ্কার কর্ণগোচর হচ্ছে, দূরে কোথায় যেন কোনো বন্য জন্তু ডেকে উঠল, প্রকৃতির নৈঃশব্দ খানখান করে সেই ডাক শোনা গেল। ইন্দুবালা দেবী টর্চ, রামদা আর টাঙিটা হাতের কাছে নিয়ে, মেয়েকে পাশের সোফাতে শুইয়ে ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে মেশিনে মেয়ের জামা সেলাইয়ে মন দিলেন।
ঘন্টাখানেক পরে ইন্দুবালা একটানা সেলাই করার ক্লান্তিতে একটু তন্দ্রাছন্ন হয়েছেন,হঠাৎ মনে হল পাশের দেয়ালটাতে যেন একটা আওয়াজ হল। উনি সজাগ হয়ে গেলেন। কিন্তু সেলাই বন্ধ করলেন না, এরপরে উনি খেয়াল করলেন একটানা কেউ যেন করাত চালাচ্ছে ওই দেয়ালের দিকটাতে। উনি মেশিনটা বন্ধ করে তুলে রাখলেন। নির্জন জায়গা, তায় বেশ রাত, কয়েক মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। চেঁচিয়ে যে কাউকে ডাকবেন তার উপায় নেই। রান্নাঘরের পাশের স্টোর রুমে রঘু আছে বটে কিন্তু নেশাছন্ন হয়ে সে সম্পূর্ণ অচেতন। এদিকে সেই করাত দিয়ে কাটার ঘষঘষ আওয়াজ কিন্তু হয়েই চলেছে। হঠাৎ ওঁর নজরে এল যে ওই ড্রয়িং রুমের বাগানের দিকের দেয়াল অনেকটা ফাঁক হয়ে গেছে, যেখান দিয়ে বাইরের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বাগানের কিছু অংশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। উনি টর্চ মেরে জায়গাটা নিরীক্ষণ করলেন। টর্চের আলো পড়ায় সাময়িক করাত চালানো বন্ধ হল। টর্চ নিভিয়ে যেই বসলেন আবার শুরু হল। দমবন্ধ করে উনি বসে আছেন মেয়ের পাশে আর দেখছেন একটু একটু করে কাঠের দেয়ালের ফাঁকটা বড়ো হচ্ছে। কতক্ষন সময় কেটে গেছে উনি জানেন না, দেয়ালের ফাঁক আরো বড়ো হল, এইবারে উনি দেখলেন একটি মাথায় ফেট্টি বাঁধা চুলভর্তি কালো মাথা ওই ফাঁক দিয়ে ঢুকছে। ইন্দুবালা দেবী উত্তেজনায় হাতে রামদা আর টর্চ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাথাটি সম্পূর্ণ ঘরের ভেতরে ঢুকতেই উনি হাতে ধরে রাখা টর্চটা জ্বেলে রামদা দিয়ে পরপর বেশ কয়েকটি কোপ দিলেন ওই মাথাটির ঘাড়ে আর গলায়। তখন তাঁর আর মাথা কাজ করছে না, এদিকে যার ঘাড়ে গলায় কোপ পড়ল সে ততক্ষনে আর বেঁচে নেই আর পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় ইন্দুবালা দেবী নিজে থরথর করে কাঁপছেন। এমন সময় হঠাৎ দেখলেন ওই দেয়ালের ফাঁকটুকু দিয়ে টাইগার পরিত্রাহি চিৎকার করতে করতে ঢোকার চেষ্টা করছে আর বাইরে পুলিনবাবুর জিপের শব্দ। টাইগারকে দেখে উনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না, সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালেন।
পরেরদিন যখন ওঁর জ্ঞান ফিরল দেখলেন, পুলিনবাবু অন্য অনেক সাহেব পুলিশকর্তাদের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে আছেন আর অদূরে পড়ে রয়েছে একটি মৃতদেহ। জানতে পারলেন যে ওই মৃতদেহটি ডাকাতদের দলপতি কালু সর্দারের যে আগেরদিন রাত্রে এসেছিল পুলিনবাবুর রাইফেলগুলি চুরি করত, এটা জেনেই যে পুলিনবাবু সেদিন রাত্রে বাংলোতে নেই। এই ঘটনার পরে আরো দুবছর তাঁরা ওখানে ছিলেন কিন্তু ডাকাতি অনেক কমে গেছিল।ইন্দুবালা দেবীর সাহসিকতার জন্য কালুর পুলিনবাবুর রাইফেল চুরি করা তো হলোই না, উল্টে পৈতৃক প্রাণটি সে খোয়ালো। ব্রিটিশ সরকার ইন্দুবালা দেবীকে এই সাহসিকতার জন্য মেডেল ও মানপত্র দিয়ে অবশ্য পুরস্কৃত করেছিল।
এটি একটি সত্য ঘটনা যেটির পাত্র ও পাত্রী পুলিনবিহারীবাবু ও ইন্দুবালা দেবী আমার বড়ো দাদু আর বড়োদিদা।
🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺
শ্রীরামচিন্তন
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীরামচন্দ্র বলতে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা হল ধনুর্ধারী শ্রীরামচন্দ্রের বামপাশে দন্ডায়মান সীতা আর ডানপাশে দন্ডায়মান লক্ষ্মণ, পায়ের কাছে পাদুকা হাতে ভরত, হাত জোড় করে সামনে হনুমানজী আর পেছনে সিংহাসনের একপাশে শত্রুঘ্ন, এটি অযোধ্যাপতি রামের সপরিবারের ছবি।
"রঘুকুলপতি রামচন্দ্র অওধকে অধিকারী,
সুর নর গণ পূজে চরণ, মুনি জন ভয়হারী।"
মর্যাদাপুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র বাল্মীকি রামায়ণের গল্পে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার অযোধ্যাপতি ছিলেন, কিন্তু তাঁর উপাস্য দেবতা ছিলেন শিব। অযোধ্যার রাজা দশরথ ও তার প্রধান স্ত্রী কৌশল্যার জ্যেষ্ঠপুত্র হলেন রাম। হিন্দুরা রামকে বলেন "মর্যাদা পুরুষোত্তম" (অর্থাৎ, "শ্রেষ্ঠ পুরুষ" বা "আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিপতি" বা "গুণাধীশ")।তিনি সীতার স্বামী। জনকনন্দিনী সীতা ছিলেন যোগমায়ার সত্তা, যিনি রাবণবধের কারণ। শ্বাশ্বতী শ্রীরূপটি সীতার আর রামচন্দ্র হচ্ছেন শ্রীকরুণা রতন।সীতা, রাম, ভরত, লক্ষ্মণ, ও শত্রুঘ্ন মিলে পঞ্চরীপুর দমনের পঞ্চায়তন, তার সঙ্গে অজ্ঞানতার প্রতীক রামপরিবারের সম্মুখে দন্ডায়মান প্রণামরত অঞ্জনীপুত্র রুদ্রাবতার হনুমানজী।রামের জীবনকথাকে ধর্মনিষ্ঠার আদর্শ হিসেবে মান্য করা হয়। তাঁকে আদর্শ মানুষ মনে করা হয়। পিতার সম্মানরক্ষার্থে তিনি সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করে চৌদ্দ বছরের জন্য বনে গিয়েছিলেন।তাঁর স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণও তাঁর বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারবেন না বলে তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে চৌদ্দ বছর বনে কাটিয়েছিলেন।রাম যেহেতু আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিপতি এবং গুণাধীশ, তাই নিজের সমস্ত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে নিজের অবতারত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং সমস্ত গুণকে নিজের চরিত্রে প্রতিফলিত করে দেখিয়েছেন। তাই এহেন রামকে নিজের ভ্রূমধ্যে ধ্যানে যিনি লাভ করেন তিনি ধন্য কারণ অযোধ্যা হল ভক্তের মস্তকের তিলকরেখা অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে রামকে দর্শনই ভক্তের অভীষ্ট। তাই রামের পতিতপাবন নাম।
বনবাস কালে লঙ্কার রাজা রাবণ সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঋষি বিশ্রবা ও তাঁর স্ত্রী কৈকসীর সন্তান রাবণের ইষ্টও ছিলেন শিব।দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রাম হনুমানের মাধ্যমে জানতে পারেন যে সীতা লঙ্কায় (এই লঙ্কা এখন শ্রীলঙ্কা)। তখন বানর সেনা দিয়ে লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সেতু নির্মাণ করেন। আর রাবণের বিরাট রাক্ষস বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে রাবণ পরাজিত হন। রাম সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় ফিরে আসেন। কথিত আছে,রাম রাবণকে হত্যা করে ১ বৎসর ব্রহ্ম হত্যার অনুশোচনায় হিমালয়ের তপস্যা করেন। কারণ রাম ছিলেন পুরুষোত্তম অর্থাৎ সমস্ত পুরুষের মধ্যে সর্বোত্তম। সেখানে তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়। পরে তিনি একজন সম্রাটে পরিণত হন।তাঁর রাজ্যে প্রজারা সুখে, শান্তিতে বাস করত এবং রাজ্যের সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার অব্যাহত ছিল। এই জন্য রামের শাসনের অনুসরণে সুশাসিত রাজ্যকে "রামরাজ্য" বলার প্রবণতা চালু হয়।
রামায়ণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, রামের সীতা-অনুসন্ধান ও যুদ্ধজয়ের ক্ষেত্রে রামের প্রতি সীতার চরম প্রেম ও সতীত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ। রাবণের বন্দিনী হওয়া সত্ত্বেও সীতার পবিত্রতা রক্ষিত হয়েছিল। অন্যদিকে, রামের ছোটো তিন ভাই লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন ও ভরতও পবিত্রতা, ভ্রাতৃপ্রেম ও শক্তির আদর্শ।তারাও "মর্যাদা পুরুষোত্তম" ও সপ্তম অবতারের অংশ। রামের পবিত্রতা কিষ্কিন্ধ্যার বানর, বানররাজ সুগ্রীব ও হনুমানকে আকৃষ্ট করেছিল। তারাই সীতাকে উদ্ধারে সাহায্য করেন।রামের গল্প ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিশেষ জনপ্রিয় কারণ রাম অন্তহীন প্রেম,সাহস, শক্তি, ভক্তি, কর্তব্য ও মূল্যবোধের প্রতীক। ব্যক্তি রামের নামে গুনগান করলে প্রভু রামের ভদ্রতার সভ্যতার ধ্যান করা হয়। রামের গুণ চিরন্তন, রামগুণ সুমিরণের রত্নধন, রামনাম মনুজতাকে অর্থাৎ মনুষত্বকে বিভূষিত করে সম্মাননা দেয়। রাম স্বগুণ ব্রহ্ম স্বরূপতঃ সুন্দর রাজীবলোচন, নবদুর্বাদলের ন্যায় সজল রঙ্গন রূপ সুখকর, আবার আত্মাতে স্থিত বলে আত্মারামকে সম্মান করা উচিৎ।
ব্যক্তিনাম হিসেবে "রাম" শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে ,দুঃসীম প্রথবনের স্তব গাই, বেণ ও রামের স্তব গাই, বিশিষ্ট অসুরদের স্তব গাই, রাজন্যবর্গের স্তব গাই। রাম শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ হল "রামী", রাত্রির একটি বিশেষণ। বেদে দুই জন রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম জন হলেন "মার্গবেয়" বা "ঔপতশ্বিনী" রাম এবং দ্বিতীয় জন হলেন "জামদগ্ন্য" রাম। উত্তর-বৈদিক যুগে তিন জন রামের কথা জানা যায়,
বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। ইনি "জামদগ্ন্য" বা "ভার্গব" রাম নামে পরিচিত। ইনি অমর।
দশরথপুত্র অযোধ্যাপতি সগুণ ব্রহ্ম রাম যিনি রাবণ, খর, দূষণের মত অসুরদের অরি অর্থাৎ শত্রু।
কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বিষ্ণুর অষ্টম অবতার বলরাম।
বিষ্ণু সহস্রনাম স্তোত্রে বিষ্ণুর ৩৯৪তম নামটি হল রাম। আদি শঙ্করের টীকা অনুসারে (রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী তপস্যানন্দের অনুবাদ) "রাম" শব্দের দুটি অর্থ আছে:
প্রথম যোগীরা যাঁর সঙ্গে রমণ (ধ্যান) করে আনন্দ পান।
দ্বিতীয় সেই পরব্রহ্ম বা সেই বিষ্ণু যিনি দশরথের পুত্ররূপে অবতীৰ্ণ হয়েছিলেন।
অধ্যাত্ম রামায়ণে রামচন্দ্রকে দেখিয়েছে সগুণ ব্রহ্ম রূপে যিনি স্বভাবে নির্গুণ, যিনি স্বরূপতঃ অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্টরহিত গুণ ও আদর্শের সমাহার।অধ্যাত্ম রামায়ণের ৩৫% নেওয়া হয়েছে ব্রহ্মান্ড পুরাণ থেকে, যেটি আবার বৈষ্ণব সাহিত্যের অংশ বিশেষ।অধ্যাত্ম রামায়ণ শ্রীরামচন্দ্রের সব জাগতিক কার্যকলাপকে আধ্যাত্মিক বা অতীন্দ্রিয় অনুভবের আলোয় ব্যাখ্যা করেছে, যেখানে গল্পটি প্রতীকরূপে দেখিয়ে, প্রত্যেক আধ্যাত্মিক পিপাসুকে নির্দেশ দেয় নিজের জীবাত্মার যাত্রাপথটির বাহ্যিক রূপটি রূপক হিসেবে দেখে সেই পরমাত্মার মধ্যে লীন হবার শাশ্বত পন্থায় এগোতে।অধ্যাত্ম রামায়ণ যে কোনো আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসুর কাছে পথ প্রদর্শক ও সেই পথের প্রস্তুতির জন্য নির্দেশাবলীর উৎস হিসেবে ধরা হয়, বিশেষ করে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিভঙ্গিতে। 'অধ্যাত্ম' শব্দটি মহাজাগতিক বা অতীন্দ্রিয় সম্বন্ধীয় যা স্বয়ং বা জীবাত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত।
অধ্যাত্ম রামায়ণের সাতটি কাণ্ড আছে যেখানে:
১.বালকাণ্ড- মহাজাগতিক ও স্বর্গীয় সত্তা ব্রহ্মস্বরূপ বিষ্ণুর অবতার রামের অবতরণ হয় রাক্ষস(রাবণ) নিধনের নিমিত্ত ।এই পর্বে রামের শৈশব ও অহল্যা উদ্ধারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ২.অযোধ্যা কাণ্ড- রামের অযোধ্যার(অযোধ্যা অর্থে যুদ্ধ রহিত স্থান) জীবন, তাঁর বনবাসে গমন গুহক(ভক্ত ভগবানের সম্পর্ক) চণ্ডালের মিত্রতা এবং পিতা দশরথের (দশরথ-পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের রথ চালনা করেন যিনি) মৃত্যু ও দশ রথের প্রধানা মহিষী কৌশল্যার (যিনি বুদ্ধিমত্তায় কুশলী আবার কোশল রাজকন্যা) বর্ণিত।
৩.অরণ্য কাণ্ড- যেখানে রামের বনবাস, এবং সীতার অপহরণ বর্ণিত।
৪.কিস্কিন্ধা কাণ্ড- যেখানে কিস্কিন্ধার ঘটনা, বালি নিধন ও সীতার অন্বেষণের শুরু হয়।
৫. সুন্দর কাণ্ড-যেখানে হনুমানের প্রবেশ ও তাঁর লংকাকান্ডের বর্ণনা।
৬.লঙ্কা কাণ্ড-যেখানে বাল্মীকি রামায়ণের লঙ্কা কাণ্ডের মতোই রামের বাহিনী ও রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ, রাবণ বধ ও রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন ও রাজ্যাভিষেক বর্ণিত।
৭.উত্তর কাণ্ড- উপসংহার - যেখানে সীতার নির্বাসন, রামসীতার পুত্রদ্বয় লবকুশের জন্ম এবং রামের পৃথিবী ত্যাগ করে বৈকুন্ঠে(বিষ্ণুলোক) প্রত্যাবর্তন বর্ণিত হয়েছে। উত্তর কাণ্ডের পঞ্চম অধ্যায়ে রাম ও লক্ষ্মণের মধ্যে একটি কথোপকথন আছে যেটি "রাম গীতা" বলে অদ্বৈতবাদের বা অদ্বৈতদর্শনের মূল্যবান তত্ত্ব।
গোস্বামী তুলসীদাসজী রামকে সগুন ব্রহ্ম ব্যক্তি রাম হিসেবে আবার নির্গুণ ব্রহ্মের প্রকাশ আত্মজ্যোতি হিসেবে দেখেছেন এই আধ্যাত্মিক রামায়ণের আলোকে। তিনি রামচরণের মহিমা কীর্তনে বলছেন " রামচরণ অভিরাম কামপ্রদ তীরথ রাজ বিরাজে ” মূলতঃ যেখানে বলছেন "রামচরণ অভিরাম কামপ্রদ যেখানে তীর্থরাজ প্রয়াগ সতত বিরাজ করে, শঙ্কর হৃদয়ের ভক্তি ভূতল পল প্রেম অক্ষয়বটে বিরাজে। শ্রীরামচন্দ্রের শ্যামলবরণ পদের অরুণতল অনাহত নাদ শ্রবণের পথ দেখায়, যেমন জাহ্নবীসুতা সুরসরি সারদা নদী সমস্ত মালিন্য, কলুষতা নিয়ে প্রবাহিত হয়েও ত্রিবিধ ফল, পারমার্থিক, পারলৌকিক এবং পার্থিব ফল দান করেন। ধনুর্ধারী রামের কমল সদৃশ নয়নের মুনিজনের এবং জনমনে এমনি প্রভাব যে মুদিত নয়নেও সেই মনোহর মূর্তি বসে থাকে। বিলাপ, জপ, যোগ,যাগ, ব্রত, তপঃ, ত্যাগ, দেহকে কষ্ট না দিয়েও সব সুখ সুলভে প্রাপ্তি ঘটে শুধু রামচরণের প্রয়াগের অনুরাগে। রাম সুরলোক ও ধরণীর পালক, যাঁর অদ্ভুত কার্য মরমের অগোচর, যিনি সহজ কৃপালু, দীনদয়াল, সবাইকে অনুগ্রহ করেন, যিনি মুনিগণের মত চরিত্র, মায়া রহিত,সেই সচ্চিদানন্দ মূর্তি রামচন্দ্রের জয়গান করা উচিৎ, যিনি ভবভয়ভঞ্জন মুনিমনরঞ্জন, মন ক্রম বাণীর অতীত অথচ সকলের আশ্রয়, গো দ্বিজ মুনি হিতকরী। যিনি বিজ্ঞানহেতু, প্রজ্ঞানস্বরূপ স্বসুখহেতু তাঁকে বারংবার প্রণাম করে বন্দনা করি"।
"জয় জয় সুরনায়ক জনসুখদায়ক
প্রণত পাল ভগবন্তা,
গোদ্বীজ হিতকরী জয় অসুরারি
সিন্ধুসুতা প্ৰিয় কান্তা।"
পন্ডিত নরেন্দ্র শর্মার লেখায় পাই রাম তাঁর স্বনামে ধন্য, ধন্য রামনাম, রামকে। সবার মধ্যে রাম আবার সবেতেই রাম অনুস্যূত, তুলসীদাসের 'প্রভু', গুরুনানকের 'রব' এবং রামনামকে প্রণাম কারণ আত্মারাম সব ঘটে ঘটে অর্থাৎ সব জীবের দেহে বিরাজ করেন, যিনি যোগমায়ার মায়ায় আবৃত থাকেন অজ্ঞানতিমিরের অন্ধকারে, আত্মশক্তি জাগরিত হলে আজ্ঞাচক্রের রামগুহার জ্যোতি হয়ে তিনি সাধককে জ্যোতিরূপে দর্শন দেন। রামনাম পাবক পাবন, রামনামে আছে আত্মরবির তেজ আবার চন্দ্রের স্নিগ্ধ সুধাবর্ষী জ্যোৎস্না। রামভজনে আত্মজ্যোতি জাগরুক হয়, অন্তরের দহন বা জ্বালা শান্ত হয়।রামভজনে জ্যোতি অসীমিত, অপার, অন্তরের মঙ্গলদীপে মন আলোকিত হয়, সকল অমঙ্গল রামভজন হরণ করে সকল মঙ্গল সাধিত করে। শ্রীরামের মানসে শঙ্কর নামের হংস বিরাজিত। অতিথি ব্রহ্ম রঘুবীরকে প্রণাম জানাই তাঁর ধীর স্বভাবের জন্য, সেই ধনুভঞ্জন শিবভক্ত রামকে সত্ত্বগুণের ব্যক্তা রূপে, বসুন্ধরার বরদান রূপে, চিরোধীর গম্ভীর উত্তরতম উত্তীর্য় হিসেবে বন্দনা করা হয়।ধ্রুব, প্রহ্লাদ, কবীর, গুরু নানক যেভাবে রামনাম করে আপ্তকাম হয়েছিলেন, সেইভাবে আজ্ঞাচক্রে নিয়ত রামজ্যোতির ধ্যান করে রামনাম করা উচিৎ। অধ্যাত্ম রামায়ণ রামকে যোগের আলোকে দেখেছে, সে আলোচনা করব প্রভু রামের কৃপা হলে।
জাতীয় জীবনে শ্রীরামচন্দ্রের জীবনের তিনটি কীর্তির প্রভাব আমরা আজও বহন করে চলেছি আমাদের জাতীয় উৎসবে।
১…প্রথমটি অকালবোধন যা তিনি করেছিলেন রাবণ বিজয়ের জন্য , যেটি আমরা দুর্গাপুজো হিসেবে পালন করি, কেন 'অকাল' কারণ দক্ষিণায়ন (২১শে জুন থেকে ২২শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কাল) সুরলোকের বিশ্রামকাল বলে চিহ্নিত আমাদের শাস্ত্রে, তার মধ্যে দেবী দুর্গাকে শ্রীরামচন্দ্র আবাহন করলেন আশ্বিন বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সময় দেবীকে তুষ্ট করে লঙ্কা জয়ের কারণে। দেবীকে তুষ্ট করতে ১০৮পদ্মের একটা কম পড়লে(যেটি দেবী নিজেই ভক্ত রামচন্দ্রকে পরীক্ষা করতে লুকিয়ে রেখে ছিলেন)নিজের রাজীবলোচনকে দানে প্রবৃত্ত হলে, দেবী তুষ্ট হলেন এবং অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণকে নিধনের বরলাভে রাবণবধ করলেন যা আমরা দশেরা উৎসবে পালন করি, সীতা উদ্ধার হল, লঙ্কা বিজয় হল।
২....দ্বিতীয় কীর্তি যা এর সঙ্গেই জুড়ে আছে, সেটি হল শ্রীরামচন্দ্র পত্নী সীতা ও অনুজ লক্ষ্মণের সঙ্গে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন ও অভিষেক, যা আমাদের আলোর উৎসব দীপাবলি ও দেওয়ালি হিসেবে পালিত হয়।
৩.... তৃতীয়টি, বস্তুতঃ এটিই প্রথম, সেটি রামনবমী উৎসব, যেটি প্রভু রামের ও তাঁরই অংশ স্বরূপ তাঁর আরো তিন ভাইয়েরও জন্ম তিথি।
রামস্তুতি
~~~~~
গুরুচক্রের জ্যোতির্ময় আত্মস্বরূপ রাম,
পূর্ণব্রহ্ম সুরনায়ক পতিতপাবন নাম।
আত্মচেতনার বিকাশে চৈতন্যময় জ্যোতি,
পূর্ণিমার স্নিগ্ধ কিরণ তোমাকে প্রণতি।
নির্গুণ ব্রহ্মস্বরূপ ঘটে ঘটে স্থিত,
সাধকের সে গুরুসত্তা রামগুহায় নিভৃত।
সগুণ ব্রহ্মরূপে সীতাপতি রাম,
গো দ্বিজের হিতকরী দুর্বাদলশ্যাম।
অহল্যা উদ্ধারণ প্রণত পাল ভগবন্ত,
তোমার পুত নামে উদ্ধার, তুমি সচ্চিদানন্দ l
শ্রীরাম জয় রাম জয় জয় রাম
অলমিতি
@সর্ব স্বত্ব সংরক্ষিত