#শিরোনাম - পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে কলমে - শাশ্বতী পাল তারিখ- 14/10/2020
দত্তবাড়িতে সবাই খুব ব্যস্ত গত দুইমাস ধরে। আজ ব্যস্ততার চূড়ান্ত দিন। চারিদিকে রং- বেরংএর আলোর রোশনাই, ফুলের তোড়ায় সাজানো রাস্তা থেকে শুরু করে সমস্ত…
#শিরোনাম - পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
কলমে - শাশ্বতী পাল
তারিখ- 14/10/2020
দত্তবাড়িতে সবাই খুব ব্যস্ত গত দুইমাস ধরে। আজ ব্যস্ততার চূড়ান্ত দিন। চারিদিকে রং- বেরংএর আলোর রোশনাই, ফুলের তোড়ায় সাজানো রাস্তা থেকে শুরু করে সমস্ত বাড়ি। ফুল দিয়েই বাইরের গেটে বড়ো করে লেখা আছে -
*** ❤️ শুভবিবাহ ❤️ ***
রশ্মি ❤️ কুন্তল
বোঝাই যাচ্ছে আজ এই বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান রয়েছে । বাড়িতে হাজারো মানুষের সমাবেশ। নিকট আত্মীয়স্বজন থেকে দূরসম্পর্কের যত পরিচিত মানুষেরা আছেন , আজ সবার আনন্দের একটাই ঠিকানা, এই দত্তবাড়ি।
মিস্টার দত্ত শহরের একজন নামকরা বিজনেসম্যান। শহরের নামকরা বনেদি বাড়ির ছেলে আবীর দও । চোখে মুখে সেই গাম্ভীর্য সদা প্রস্ফুটিত।
তাছাড়াও তিনি বনেদিবাড়ির প্রাচীন কিছু ঐতিহ্যের পৃষ্ঠপোষকও বটে ।
দত্ত পরিবারের বড়ো ছেলে মিস্টার আবির দত্ত ,ভীষণ কড়া প্রকৃতির মানুষ। সত্যি বলতে, বাড়ির সবাই ওনাকে একটু ভয়ই পান। কেউ ওনার মুখের উপর সহজে কোনো কথা বলতে পারেন না। পরিবারে ওনার কথাই শেষ কথা।
বাড়িতে চার ভাই, চার বউ, বৃদ্ধ মা-বাবা আর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নিয়ে এক্কানবর্তী পরিবার। সংসারের অন্দরের সকল মনমালিন্য , অভিমান ওনার সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গুড়িয়ে যায়। তাই আজও একই ছাদের তলায় অভিন্ন এই দত্ত পরিবার।
এই মিস্টার দত্তের বড়ো মেয়ে তথা পরিবারের সবচেয়ে বড়ো মেয়ে রশ্মি। আজ ওর শুভ পরিণয় সুসম্পূর্ণ হবে। পাত্র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লন্ডনে থাকে। আদি বাড়ি যদিও কলকাতাতেই। তবে চাকরিসূত্রে পুরো পরিবার আজ প্রবাসী। মিস্টার দত্তের বিজনেস পার্টনার মিস্টার বাসুর একমাত্র ছেলেকে উনি পাত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। যদিও এই নিবার্চনের ক্ষেত্রে ওনার কথাই শেষ কথা। তবুও বিলেত ফেরত এই পাত্রকে পরিবারের সকলেরই খুব পছন্দ।
কয়েকদিন ধরেই পাড়া প্রতিবেশী, আত্বীয়স্বজন সবাই আনন্দে মেতে রয়েছে এই বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে । প্রখ্যাত বিজনেসম্যান আবির দত্তের একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা ! কত আয়োজন !কত জাঁকজমক !, বাড়ির প্রতিটি জায়গা ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে । আজ শহরের সব প্রখ্যাত ব্যাক্তিগণ উপস্থিত রয়েছেন এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যার সাক্ষী হিসেবে।
সবাই খুব খুশি। কিন্তু যার জন্য এতো কিছু সেই রশ্মি কোথায়?
রশ্মি নিজের ঘরে একহাট লোকের মাঝে বসে আছে ।তাকে ঘিরে রেখেছে বৌদি, কাকিমা, পিসিমা ও বান্ধবীদের দল। অনেক উপদেশ দেওয়া হচ্ছে বিয়ের কোনেকে তার ভাবি সংসার জীবনকে কেন্দ্র করে ।
অনেকে অনেক রঙ্গ রসিকতাও করছেন । অনেকে আড়াল আবডালে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে বিভিন্ন মন্তব্যও করছেন নিজেদের রসনা তৃপ্তির উদ্দেশ্যে।
কিন্তু এইসবের মাঝে একেবারে নির্বিকার হয়েছে শুধুমাত্র রশ্মি। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখের পাতা স্থির । শহরের সবচেয়ে নামি দামী বিউটিশিয়ানদের হাতের জাদুও চোখ মুখের উজ্জ্বলতা ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
হঠাৎ "বর এসেছে....বর এসেছে" রব উঠতেই রশ্মিকে ঘরে একলা রেখে সবাই ছুটে গেলো বিলেত ফেরত বর দেখতে।
রশ্মির আজ শুধুমাত্র সেই পুরোনো দিনেগুলির কথা খুব মনে পড়ছে। ছোটবেলায় দাদু ঠাকুমার কাছে শোনা সেই কথাগুলি। অনির সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত।
অনি রশ্মিদের আদি বাড়ি ফুলতলার প্রতিবেশী অর্ণব সেনের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই আবিরবাবু আর অর্ণববাবু খুব ভালো বন্ধু ছিলেন । দুই পরিবারের মধ্যেই সম্পর্কের বন্ধন ছিল খুব দৃঢ়। রশ্মি আর অনির জন্মের পরই দুই পরিবারের সবাই মিলে ঠিক করেছিলেন বড়ো হয়ে তাদের বিয়ে দেবেন।
রশ্মিও কিশোরী বয়স থেকে অনিকেই নিজের পরিবারের সকলের মতোই আপন ভেবে এসেছে।অনির সাথে একসাথে পড়াশোনা করেছে, একসাথে খেলেছে, ঘুড়ে বেরিয়েছে, খেয়েছে,নিজেদের অজান্তে একে অপরের মনকে ছুঁয়েছে।
কিন্তু একটা সময়ের পর অর্ণববাবুর অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পরে। আবিরবাবু অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও স্বচ্ছল হতে থাকেন। এবং একটা সময়ের পর গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসেন। নিজের বন্ধুকে পাশে থেকে সাহায্য করার বদলে তাকে বেমালুম মন থেকে মুছে ফেলেন আবির বাবু ।
রশ্মি কিন্তু কখনোই ভুলতে পারেনি তার প্রিয় অনিকে। প্রথম ভালোবাসাকে।
আর সেই দিনটাকে রশ্মি কোনোদিন ভুলতে পারেনি, যেদিন বুড়ো বটতলায় শিবঠাকুরকে সাক্ষী রেখে অনি রশ্মির কপালে সিঁদুর পড়িয়েছিলো। আর বলেছিলো, " তুই আজ থেকে শুধুমাত্র আমার বেস্টফ্রেন্ড, আর কারোর নয়। কখনই নয়। আমার থেকে তোকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। "
সে কথা অবশ্য দুই বাড়ির সবাই জানতো। তখন কারোর কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু পরে আবিরবাবু মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন সামান্য স্কুল মাস্টারের সাথে ছোটবেলার এই বিয়ে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন এবং বিলেত ফেরত পাত্রের সাথে রশ্মির বিয়ে ঠিক করে দেন।
কিন্তু রশ্মি সেই স্মৃতি কোনোদিনও ভুলতে পারেনি। আজ শুধু সেইসব কথাই বড্ড মনে পড়ছে। রশ্মির কষ্টটা আজ কেউ বুঝতে পারছে না।
রশ্মি তার বাবাকে অনেকবার অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু আখেরে কোনো লাভ হয়নি। অনির বাবা অর্ণববাবু অনেকবার আবিরবাবুকে অনুরোধ করেছে রশ্মিকে নিজেদের পরিবারের পুত্রবধূ হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
কিন্তু আবিরবাবুর মনে দম্ভ, অহংকারের বরফ কখনই গলেনি ।
বরং একদিন অনিকে অপমান করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বলেছিলেন, আমার বাড়িতে কোনোদিন ঢোকার চেষ্টা করবি না। কোনো ছোটোলোকদের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক রাখতে চাই না।
অনি তারপর থেকে আর এই বাড়িতে আসেনি। সব কথাই আজ রশ্মির খুব মনে পড়ছে।
পুরোহিতমশাই এর কথা মতো সবাই পাত্রীকে বিয়ের মণ্ডপে আনতে গেলো । কিন্তু গিয়ে দেখে রশ্মি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। অনেকবার দরজা নক করার পর দরজা খুলছে না দেখে দরজা ভেঙে ঘরে গিয়ে দেখেন রশ্মির নিথর শরীরটা ফ্যানের সাথে ঝুলছে। রশ্মি আত্মহত্যা করেছে । মাথা ভর্তি লাল সিঁদুর।
বিছানার উপর একটা চিঠি পরে আছে তাতে লেখা, " বাবা, আমার বিয়ে অনেকদিন আগেই অনির সাথে হয়ে গিয়েছে। সেইদিন থেকে আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে সিঁদুর পড়েছি। ওকেই নিজের স্বামী বলে মেনেছি কিশোরী বয়স থেকে। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা শুধুমাত্র অনি। আমি নিজের মনপ্রাণ সর্বতভাবে একজনকেই সমর্পন করেছি। তাই আজ একজনকে ভালোবেসে অপর জনকে ঠকাতে পারলাম না। পারলাম না এই জীবনে অন্য কাউকে মেনে নিতে ।পারলাম না সিঁদুরের মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে। পারলাম না নিজেকে অন্যের কাছে সমর্পন করতে। কিছুই পারলাম না....। সবার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী। পারলে ক্ষমা কোরো আমায়......................। "
ফুলতলা গ্রাম থেকে হঠাৎ অর্ণববাবুর ফোন এলো। জানা গেলো অনি আজ সন্ধ্যে বেলা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে.........।
এক মুহূর্তে সকলের সমস্ত দম্ভ, অহংকারের সলিল সমাধি ঘোষণা করে গেলো তরতাজা দুটো প্রাণ।
সকল খুশির সুর যেন মুহূর্তে বিষাদের সুরে বাজতে লাগলো......। হাজারো রোশনাই এর মাঝে কেবল একটাই সুর.............
"যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে ..... "