কাব্য কাহিনী( পর্ব -১)শিরোনাম : অবরোধকলমে : শক্তিপদ ঘোষতারিখ : ২৯ , ০৯ , ২০২০
"মা , আসছি"--এইটুকু বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ।মা রান্নাঘর থেকে হেঁকে বললো , "তাড়াতাড়ি ফিরিস ।" কথাগুলো দাদার কানে প…
কাব্য কাহিনী( পর্ব -১)
শিরোনাম : অবরোধ
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ২৯ , ০৯ , ২০২০
"মা , আসছি"--এইটুকু বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ।
মা রান্নাঘর থেকে হেঁকে বললো , "তাড়াতাড়ি ফিরিস ।" কথাগুলো দাদার কানে পৌঁছলো কিনা ,
জানি না । দুপুর গড়িয়ে গেল , বাবা অগ্নিশর্মা , মা নিশ্চুপ । অপেক্ষায় থেকে থেকে আমাদের খাইয়ে মা হেঁসেল তুললো ;নিজে রইলো নিরন্ন । দাদার ফেরার পথে চোখ রেখে মা সারাটাদিন খোয়লো , দাদা ফিরলো না ।
হঠাৎ , মুখে মুখে জানাজানি হয়ে গেল , মহাকরণ অবরোধ রুখতে জনতার মিছিলে পুলিশ
নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং হতাহত হয়েছে
অনেক । বাবা কোথা থেকে ঝড়ের কাকের মতো
এসে দড়ির আলনা থেকে আধময়লা জামাটা
টেনে নিয়েই ঝড়ের মতোই বেরিয়ে গেল ।
মা আমাকে ঘরে রেখে সারাসন্ধ্যে দাদার বন্ধুদের
বাড়িতে বাড়িতে খোঁজ নিয়ে ফিরলো । এরমধ্যে
নির্মাল্যের ঠাকুরমা এসেছিল দাদার খোঁজ নিতে ;
কারণ , সেও দাদার সঙ্গেই বেরিয়েছে ।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় রেডিয়োর খবরে শুনলাম--পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা তখনও অবধি দশ । সংখ্যাটা আরও বাড়ার আশঙ্কা , হতাহত অনেক । খবরটা শুনেই মা ,আমি দু'জনেই ভীষণ অস্থির হয়ে উঠি । একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে
মা আবার বেরিয়ে পড়ে , আমি একা ঘর আর বার
করছি । অনেকক্ষণ পরে মা ফিরলো তেমনি শূন্য
হাতেই ; তারপর আর বাড়ির ভিতরে ঢুকলো না ।
বাইরের দরজার একপাশে লণ্ঠনটা রেখে দিয়ে ,
নিশ্চুপ বসে রইলো ; আমিও মায়ের পাশে ঠায় তেমনি বসে থেকেছি ।
দেখতে দেখতে আঁধার আরও প্রগাঢ় হলো ,
চারিদিকে কেমন গা-ছমছমে ভৌতিক নিস্তব্ধতা ।
আমাদের বাঘাটাও সেদিন ছিল অস্বাভাবিক নিশ্চুপ । দু'জনেই আশা-নিরাশার দোলায় অনেক
দুলেছি , জোনাকিরাও তেমনি জ্বলছিল-নিভছিল ।
মৃদু হাওয়ায় শুকনো পাতা মাঝে মাঝেই ঝরে
পড়ছিল পাশের জামগাছটা থেকে । আমরা সেইটুকু শব্দেই বারবার সচকিত হয়ে উঠেছি দাদার পায়ের শব্দ ভেবে ।
অনেক রাতে বাবা ফিরলো একা ; নির্মাল্য ছাড়া দাদার বন্ধুরা সবাই ফিরেছে , দাদার কোন খোঁজ নাই । সেদিন রাতে বাইরের দরজায় আর খিল পড়লো না , নিষ্পলক বোবা রাত্রিটা আমরা একসাথে কাটালাম দাদার ঘরেই । কারও মুখে কোন কথা নাই , দাদার পড়ার চেয়ার টেবিল খাঁ খাঁ করছে । মেধাবী ছাত্র হিসেবে দাদার খুব নাম ছিল ; তখন বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র , কলেজে ঢুকেই সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে । বাবা এই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেনি ; অনেকবার দাদাকে সতর্কও করেছে ।
সেই মুহূর্তে আমরা বোবা তিনটি প্রাণী , কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে আছি ; মা মাঝে মাঝেই চোখের জল মুছছে আঁচলে ।
হঠাৎ একটা কলপেঁচা বিশ্রীভাবে ডেকে উঠলো ;
খিড়কি পুকুরে বোধ হয় উদবেড়াল হানা দিয়েছে ,
পুকুরের জলে হঠাৎই মাছেদের লাফালাফির
শব্দ এলো কানে । পাশের বনে তেমনি হঠাৎই
একটা পাখি বারকয়েক ডানা ঝাপ্টে , দু'একবার
ডেকেই থেমে গেল ; বুঝলাম--বনবিড়ালের হানায়
একটা প্রাণ নিশ্চিত ঝরে গেল অকালে ।
এমনি করে শঙ্কার রাত্রি কেটে অন্ধকার একটু ফিকে হলে , পাড়ার সুধীরকাকু এলেন আমাদের বাড়িতে ; তাঁর ছেলেও ফেরেনি । বাবা
সেই আধময়লা জামাটাই আবার দুয়ারে দড়ির
আলনা থেকে টেনে নিয়ে সুধীর কাকুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লো ; ভোরের ফার্স্ট ট্রেনটা ধরেই রওনা
দেবে কলকাতা । মায়ের হাতে সঞ্চিত যা টাকা ছিল , সবটাই ধরে দিলো বাবার হাতে । তারপর ,
আবার সেই পথ চেয়ে নিশ্চুপ বসে থাকা । সারারাত্রি ধরে পুড়ে পুড়ে নিভন্ত মোমবাতির মতো
অবসন্ন আমরা ।
নিয়মের একটু ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সেদিন
সকালে কাগজ এলো একটু আগেই । হকারের
সাইকেল ঘিরে পাড়ার লোকের ভিড় জমেছে
আমাদের বাড়ির সামনে । একটা মৃদু গুঞ্জনও শুরু
হয়ে গেছে লোকের মুখে মুখে । আমিও একটা কাগজ কিনে প্রথম পাতায় চোখ রাখতেই আমার
চক্ষু স্থির । প্রথম পাতার ওপরেই বড় বড় হরফে লেখা--মৃতের সংখ্যা তেরো । কাগজ জুড়ে আজ কেবলই রণাঙ্গনের ছবি । মারমুখী পুলিশ ,
বিশৃঙ্খল জনতা ; লাঠি চলছে , গুলি চলছে , মাথা
ফেটে রক্ত ঝরছে ; আর লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে সেখানে ।
মা আর আমি কাগজের পাতায় বিদ্যুদ্বেগে
চোখ বোলাচ্ছি ; দেখি মায়ের চোখ হঠাৎই একটা ছবিতে স্থির হয়ে গেলো । আমিও সেই ছবিতে চোখ ঠেকিয়ে দেখছি--রক্তাক্ত অভিমন্যুর মতো
মুখ থুবড়ে রাস্তার ওপরে পড়ে আছে একটা সুঠাম যুবকের নিথর দেহ , রক্তের ছয়লাপ ।
মায়ের চিনতে ভুল হলো না ; মাথার চুল দেখেই বুঝে গেল সব এবং তারপরই ভেঙে পড়লো বুকফাটা কান্নায় । চিনতে আমারও ভুল হযনি ;
মৃতের তালিকায় চোখ রেখে দেখি--স্পষ্টাক্ষরে
দাদার নাম লেখা । আমিও আর--চোখের জলে বাঁধ দিতে পারিনি । তারই মধ্যে রক্তাক্ত সব আশা
মহাকালের জিম্মায় দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে বোবা হয়ে রইলুম । কে কাকে দেবে সান্ত্বনা ? আমার চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলছে , সব যেন কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে কুয়াশায় । আমি দু'হাতে কুয়াশার পাহাড় ঠেলছি । ঠেলতে ঠেলতে হঠাৎই চোখে পড়লো-- বাবা আর সুধীরকাকু একটা
হসপিটালের মর্গের সামনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কিসের জন্যে অপেক্ষা করছে ।
আমি জ্ঞান-অবধি ভাববাদী অলীক দর্শনে
বিশ্বাসী নই , এবং তাই ভগবানের কাছে কোনদিন
কোন প্রার্থনা করিনি : কিছু চেয়ে কোনদিন আমি
কাঁদিনি । সেই প্রথম এবং সেই শেষ আমি কেঁদেছি , আমি বলেছি--হে দীনবন্ধু , হে কৃপাসিন্ধু ,
অন্তত একটিবার তোমার নামের সুবিচার--তুমি
নিজেই করো । চেয়ে দেখো বাবা উদ্ভ্রান্ত , মা
অচৈতন্য--লুটোচ্ছে মাটিতে ; আমি হতভাগা দাদার আদরের ছোটবোন , করজোড়ে মিনতি করছি--আমার চোখের জলে , আমার আকুতিতে
যদি কোন খাদ না থাকে , আমার দাদাকে ফিরিয়ে
দাও , এবং বুঝিয়ে দাও--মানুষের সংসারে তুমি
মোটেই কথার কথা নও ।
কিন্তু , এত ছোট্ট মুখে এত ছোট্ট কথা--অত
বড়োর কানে উঠলো না । আমাদের মতো আরও
যাদের কপাল পুড়েছে , তাদের কান্নাও অত দূর পর্যন্ত পৌঁছলো না । জানি , কোনকালেই পৌঁছয়নি এবং পৌঁছয়ও না ; আমরা মরি শুধুই স্তাবকতা করে । আমি দাদার সেই নিভে যাওয়া শ্মশানে , নিস্তব্ধ আঁধারে মনে মনে আজও নোনাজলে আলপনা আঁকি ।
---------------------------------------------------------------
কাব্য কাহিনী( পর্ব -২)
শিরোনাম : অকালবোধন
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ৩০ , ০৯ , ২০২০
গ্রামে হঠাৎ রব উঠলো--জগদ্ধাত্রী মা নাকি বিরূপা হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । মায়ের মৃৎমূর্তিতে প্রাণ নাই , মূর্তি তাই বিবর্ণ হয়ে গেছে । কথাটা কে প্রথম রটালো , তার হদিস মিললো না ; তবে কথাটা প্রথম এসেছে অনতিদূরে কোরাদের পাড়া থেকে । সেখান মহামারী লেগেছে , পরপর কয়েকজন মারাও গেছে এরমধ্যে । হাতুড়ে ডাক্তার , কবিরাজের নাইবার-খাবার সময় নাই ।
সকাল থেকেই মন্দির-প্রাঙ্গণে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমছে । মূর্তি দেখে কেউ বলছে--মূর্তিতে তেমন প্রাণ দেখা যাচ্ছে না , কেউ বলছে--মাকে মনমরা দেখাচ্ছে , কেউ বলছে মায়ের মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে--ইত্যাদি ইত্যাদি । অর্থাৎ , নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করে বাহবা কুড়োবার সুযোগ--কেউই নষ্ট করতে চাইছে না । এরই মধ্যে দশকাঠি এগিয়ে একজন বলে উঠলো--সেইজন্যেই বোধ হয় ,গতকাল ভরসন্ধ্যেয় হাড়গিলে একটা শকুনকে সে বসে থাকতে দেখেছে মন্দিরের চূড়ায় , এবং এই নিয়ে জনে জনে চলতে রইলো নানান জল্পনা । আমার চোখে---মায়ের বিবর্ণতার কিচ্ছুটি ধরা পড়লো না ।
এরই মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল--মন্দিরের পূজারী আসছেন হন্তদন্ত হয়ে । তিনি কারও সঙ্গে কোন কথা না বলে , সোজা মন্দিরে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন মায়ের মূর্তির সামনে । মুহূর্তে সব গুঞ্জন , সব কোলাহল থেমে গেল । মন্দির প্রাঙ্গণে তখন আর পিন পড়ারও শব্দ নাই । কারণ , প্রধান বিচারক এসে গেছেন ; এখন আর অন্য কারও পাণ্ডিত্য দেখাবার সাহস নাই , সুযোগও নাই। পরিবর্তে , জোড়হাত করে সকলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে
রইলো শেষ বিচারের রায় শোনার অপেক্ষায় ।
অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর বিচারক নেমে এসে দাঁড়ালেন জনতার সম্মুখে । তিনি তাঁর রায়ে জানালেন--মানুষ যা শুনেছে , তা ঠিক ; মায়ের মূর্তিতে যথার্থই প্রাণ নাই । তারপর , তিনিও তেমনি বিশকাঠি এগিয়ে অবশেষে জানালেন ,
আজ ভোরেই তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে খুব বিচলিত হয়ে ছুটে এসেছেন । মা তাঁকে জানিয়েছেন--তিনি গতবারের পুজোয় সন্তুষ্ট হতে পারেননি । তাছাড়া , মা মৃন্ময়ী মূর্তিতেও আর সন্তুষ্ট নন ; মা এবার স্বর্ণময়ী হতে চান । আমরা মাকে মাটির দামে দেখি বলেই মা অভিমানে আমাদের প্রতি বিরূপা হয়েছেন । পূজারীর মতে , মা কূপিতা বলেই পাশের কোরাপাড়ায় মহামারী লেগেছে । মহামারী অচিরেই সারা গ্রামকে গ্রাস করবে । মায়ের কোপ থেকে বাঁচতে গেলে এখনই আর একবার ধুমধাম করে মায়ের পুজো করতে হবে ।
পূজারীর কথায় , উদ্বিগ্ন সকলের মাথায় হাত । এই দুর্মূল্যের বাজারে স্বর্ণমূর্তি মানে--মঙ্গল গ্রহ থেকে মাটি আনার মতোই দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার । পথটা শেষে পূজারীই স্থির করে দিলেন । তাঁর মতে মৃন্ময়ী মুর্তি যেমন হয়--তেমনি হবে , আর তারই পাশে মায়ের অষ্টধাতুর একটা মূর্তিও থাকবে ; তবে চোখদু'টো হবে পুরোপুরি সোনার ।
একসপ্তাহ পরে , সন্ধ্যায় বারোয়ারিতলায় গ্রামের মাতব্বরদের নিয়ে একটা সভা বসলো । অনেক আলোচনার মধ্যে প্রধান দায়িত্ব নিলেন তিনজন । একজন উকিল সোনার চোখ দান করবেন , কলকাতায় সুপ্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী দেবেন অষ্টধাতুর মূর্তি , আর মন্দির-মন্দিরচত্বর মেরামত ও রঙের দায়িত্ব নিলেন একজন ডাক্তার । বাকিটা চলবে গ্রামবাসীর চাঁদায় । যে কথা , সেই কাজ । আয়োজন শুরু হয়ে গেল পূর্ণ উদ্যমে , যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি । পূজারী ইতোমধ্যেই পুজোর দিন জানিয়ে দিয়েছেন--নির্দিষ্ট সেই দিনেই হবে মায়ের অকালবোধন । সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামময় ঢেরা পিটিয়ে বিষয়টা জানিয়ে দেওয়া হলো ; হাতে মাত্র গোনাগুনতি কয়েকটা দিন বাকি।
বন্যায় বিধ্বস্ত পথের হানাগুলো তখনও
সর্বত্র দানবের মতো হাঁ করে রয়েছে , জলকাদা শুকোয়নি কোত্থাও । পথের গাছপালার সরু-মোটা
শিকড়গুলো মাটি হারিয়ে বেরিয়ে আছে মন্বন্তরের আগুনে পোড়া , অভুক্ত , হাড়জিরজিরে মানুষের পাঁজরের মতো , বাস্তুচ্যুতরা তখনও রেসকিয়ু সেন্টারগুলোতে রয়েছে গাদাগাদি করে , এবং ত্রাণসামগ্রীর জন্যে রিলিফ সেন্টারগুলোর সামনে সুদীর্ঘ লাইন পড়ছে নিত্য । মুখ থুবড়ে পড়া মাটির বাড়িগুলোর হাড়গোড়--যথাপূর্বং বেরিয়ে আছে , মাঠের ফসল ও বন-জঙ্গলপচার ভ্যাপসা দুর্গন্ধে বাতাস তখনও অসহ্য ,এবং মানুষ মরছে আন্ত্রিকে।
দেখতে দেখতে দিন সমাগত , রঙকরা মন্দির-মণ্ডপ সেজেছে হালফ্যাশনে । গ্রামের শহরবাবুরা এসে গেছেন , সঙ্গে বাক্সবন্দী বিচিত্র সব বাজি এসেছে--অনেক । তাঁদের পূজামণ্ডপ পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে সকাল থেকেই । স্থানে স্থানে উচ্চনিনাদী বক্স বসেছে , বুকফাটানো গান বাজছে , মান্যিগণ্যিরা সব আমজনতার অভ্যর্থনা কুড়োতে ব্যস্ত ।
এরই মধ্যে নির্ঘণ্ট মেনেই পুজো শুরু গেছে । লাউড-স্পিকারের মুখে মন্ত্রপাঠে খুবই উজ্জীবিত এবং প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল পূজারীকে । আমজনতার মধ্য থেকে মাঝে মাঝেই মায়ের নামে উঠছে জয়ধ্বনি । পুজোর ছন্দ মেনে ঢাকঢোল বাজছে , কাঁসরঘণ্টা বাজছে , যজ্ঞের ধোঁয়ায় চোখের জ্বালা সইছে সব আহ্লাদে এবং তাল মিলিয়ে বাজি ফাটছে অবিরাম । পাপস্খালনের এমন সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাইছে না । তাই , এবারে মানতের পাঁঠা পড়লো দশগুণ এবং বধ্যভূমির দশহাত মাটি ভিজে গেল ছাপ্পান্নটা
পাঁঠার রক্তে । সন্ধ্যার আগেই বাড়ি বাড়ি যথারীতি বিলি হলো প্রসাদী মাংস । মাংস পৌঁছে গেল পূজারীর বাড়িতেও ।
আমি মনে মনে বুঝলাম , রবীন্দ্রনাথের সেই রঘুপতিরা বহালতবিয়তে আজও ঠিক তেমনই আছে , একটুও টলেনি তাদের আসন ।
তাদের সুকঠিন হাতের মুঠোয় আজও তেমনই ধরা আছে আমাদের ঝুঁটি । কলুর বলদের মতো মোটা
কালো কাপড়ে বাঁধা আছে আমাদের চোখ এবং সেদিনের সেই ছোট্ট অপর্ণা তাই আজও নিরুত্তর ।
এদিকে ঢাকে-ঢোলে , বাড়তি আড়ম্বরে ,
নির্ঘণ্ট মেনেই পুজোপাট সমাপ্ত হলো । আমার মনে হলো , ছাপ্পান্নটা পাঁঠার রক্তদান ব্যর্থ হয়নি । আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম--জগদ্ধাত্রী মা খুব উৎফুল্ল , পূজোয় খুব সন্তুষ্ট তিনি । তিনি কপালে রক্তের মস্ত টিপ পরে পশ্চিমের আকাশ রক্তের রঙে রাঙিয়ে হাস্যমুখে বিদায় নিচ্ছেন । মনে হলো ,
যাবার সময় তিনি যেন দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন--গ্রাম আর বন্যায় ভাসবে না , প্লাবনে মাঠের ফসল ডুববে না , ঘরচাপা পড়ে এবং মহামারীতে আর কেউ মরবেও না কক্ষনো । আগুনে কোনদিন কারও ঘর আর পুড়বে না , সাপেও কোনদিনও কাটবে না কাউকে।
আমি দেখলাম-- এবারে নৈবেদ্য
পড়েছে দশগুণ বেশি , বস্ত্রের পাহাড় জমেছে ; পূজারীও দশগুণ প্রসন্ন । পূজার শেষে তাঁর দুই সাগরেদ সমস্ত গোছগাছে ব্যস্ত ; নিচে একপাশে বসে ভারীরা প্রস্তুত । প্রণামীর নগদ অর্থ নিজের ব্যাগে ভরে নিয়ে , পরিত্রাতার গর্ব নিয়ে মুখে , মন্দির ছেড়ে এবার নেমে আসছেন স্বয়ং পূজারী । বেশ গৌরবর্ণ--নধর দেহ , ঘাড় অবধি নজরুলী চুল , গায়ে নামাবলী , গলায় রুদ্রাক্ষের মালা , বাহুভাগে রুদ্রাক্ষের তাগা , ললাটে রক্ততিলক এবং ধবধবে সাদা উপবীত ভূঁড়ির 'পরে শোভমান ; সবমিলিয়ে বেশ সৌম্য এক দিব্য পুরুষ । তিনি দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে আমজনতার প্রণাম ও অভিনন্দন গ্রহণ করে , হাস্যমুখে সকলকে ভালো থাকার আশীর্বাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন ।
আমি দেখলাম--খলনায়কের বিজয়রথ
পূর্ববৎ সগৌরবে সবেগে আজও তেমনই ছুটছে
ঘড়্ ঘড়্ শব্দ তুলে । তাঁর রথের চাকার নিচে মড়মড় শব্দে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিত্বের , আমাদের শুদ্ধ চৈতন্যের হাড়গোড় । আর ,বন্যায় রাস্তাভাঙা রাক্ষুসে হানাগুলো , মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত বাড়িগুলো , মাঠের ফসলপচা দুর্গন্ধময় বাতাস--একসাথে হাততালি দিয়ে যেন বিদ্রূপের হাসি হাসছে ।
-----------------------------------------------------------------
কাব্যকাহিনি (পর্ব--০৩ )
শিরোনাম : জলছবি
কলমে : শক্তিপদ ঘোষ
তারিখ : ০১ , ১০ , ২০২০
সাপটাকে আমি দেখেছিলাম মাঠের বড়ো
আলপথের মাঝখানে , মেরুদণ্ডের ওপর খাড়া দাঁড়িয়ে ফণা বিস্তার করে পথ আটকাতে । তার ফণা দুলছিল দোখনো হাওয়ায় , তার খই-সাদা বিচিত্র বর্ণের বিস্তৃত ফণাটা দুপুরের খররোদে
জ্বলছিল । তার লকলকে দীর্ঘ জিভের খেলা দেখিয়ে , হিসহিস শব্দ তুলে জানাচ্ছিল হুঁশিয়ারি ।
তার ফণার সেই ঐশ্বর্যকে সমীহ না করে পারিনি ;
তাকে উপেক্ষা করবো--তেমন সাহস ছিল না , ইচ্ছাও ছিল না । দাঁতে যথেষ্ট বিষ আছে--এই
সারকথাটা বুঝে নিয়ে , তার প্রতি যথেষ্ট সমীহ রেখে ধরেছিলাম অন্যপ পথ ,আর সে'পথে যাইনি ।
খুব দুঃসাহস সাপটার । শুনলাম , রাজার
পেয়দাকেও সে ফণার ঝড় হেঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
আমি মনে মনে তার ফণার সেই ঝড়কে শ্রদ্ধা করেছি । কথাটা কোন প্রসঙ্গে একদিন রাজার কানে উঠলো । অত তুচ্ছের অমন দুঃসাহস , ক্ষমা করার পাত্র--রাজা নন । তবে ,পেয়াদার মুখে বর্ণনা শুনে বুঝে নিয়েছিলেন , সে যে-সে সাপ নয় , রাজসাপ । তাকে কব্জা করাও যার-তার কর্ম নয় । তাই , ডাক পড়লো অনেক দিনের পুরনো , সুদক্ষ এক রাজসাপুড়ের । রাজা তার ওপর দিলেন সেই রাজসাপ ধরার দায়িত্ব ।
সাপুড়ে সেইদিনই রওনা হলো পেয়দাকে সঙ্গে নিয়ে । সাপের অবস্থানটা দূর থেকে বুঝে নিয়ে ফিরে এলো । পরের দিন রওনা হলো একা।
মানুষের পায়ের শব্দের আঁচ পেয়ে সাপটা তার ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে তেমনি স্বমূর্তি ধারণ করলো । ফণার এমনই ঐশ্বর্য দেখে আমি একদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম । সে রাজাকেও রেয়াত করছে না দেখে তার প্রতি আমার মুগ্ধবোধ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল । আমার বিশ্বাস ছিল--তার কাছে পরাভব মেনে রাজসাপুড়েকেও ফিরতে হবে শূন্য হাতে । কিন্তু , আমাকে হতাশ করেই সাপুড়ের কাছে ধরা দিল সাপটা। তবে , সাপুড়ের হাতের কারসাজিতে , নাকি তার জাদুমন্ত্রে , নাকি অভূতপূর্ব অনাস্বাদিত বড়ো কোন টোপ গিলে সাপটা সুরসুর করে সাপুড়ের ঝাঁপিতে ঢুকলো , বোঝার সাধ্য হয়নি আমার । মোটকথা , রাজসাপ রইলো রাজসাপুড়ের জিম্মায় ।
সাপুড়ের কাছে শিক্ষা পেয়ে সাপটা তার সেই রাজকীয় ঐশ্বর্য , সেই রাজকীয় ঔদ্ধত্য ঝেরে ফেলে বেশ বিনীত ও শিষ্ট হয়ে উঠেছে । দিনে তিনবেলা সাপুড়ের পায়ে মাথা ঠুকতে শিখেছে , নাচ জানতো না--নাচ শিখেছে , সাপুড়ের ইঙ্গিত মতো সামন-পিছনে , ডাইনে-বামে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জিমন্যাস্টিকের খেলা শিখেছে । নাচ দেখিয়ে , খেলা দেখিয়ে , দর্শকদের সেলাম ঠুকে হাততালি পাচ্ছে , গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে অর্থও কামাচ্ছে বেশ । এছাড়া , মা মনসার বাহন বলে লোকে তাকে খাতির করছে , প্লেট সাজিয়ে তার নামে নৈবেদ্য দিচ্ছে , তার সন্তুষ্টি চেয়ে এবং ছেলেমেয়ের ভালো চেয়ে জোড়হাত কপালে তুলে
কেউ কেউ প্রণামও করছে তাকে । এ এক অভূতপূর্ব , অনাস্বাদিত সুখ ; তার সেই একলা রাজার রাজত্বে এই সুখ কখনো পায়নি ।
কিন্তু , রাত্রে যখন তার জন্যে নির্দিষ্ট একটা ছোট্ট ঝাঁপির দুর্গন্ধময় অন্ধকারে কোনক্রমে ঠেসে-ঠুসে , গুটিয়ে-পাকিয়ে , মাথা গুঁজে নিঃশব্দে
পড়ে থাকতে হয় , তখনই সব সুখ তার উবে যায় ।সাতপৃথিবীর অশান্তি-অসুখ এসে সারাগায়ে তীরের ফলার মতো বেঁধে । তার সেই বড় আদরের রাজদাঁতদু'টো আর নাই , সঙ্গে সঙ্গে গেছে তার ফণার সগর্ব সেই রাজ-আস্ফালন । তার সেই একলা রাজার রাজত্বে ইচ্ছামতো ঘুরে ঘুরে , অঙ্গ দুলিয়ে যেভাবে দোখনো হাওয়া খেতে বেরুতো ,
আজ তা' পারে না । খিদে জিনিসটা যে কী ,আগে এমন করে কখনও বোঝেনি । নিত্য অনেক খিদে সহ্য করতে করতে ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে পড়ছে , সারাগায়ে বাতের যন্ত্রণা ধরছে , রাতে ঘুম হচ্ছে না ; অথচ , সকাল হলেই সাপুড়ের সঙ্গে বেরুতে হবে শিবের গাজন গাইতে ।
সাপুড়ের ওপর ভীষণ রাগ হয় , তাকে উচিত
শিক্ষা দিতে ইচ্ছা করে ; কিন্তু সে তো আজ--ঢাল নাই , তরোয়াল নাই , নিধিরাম সর্দার হয়ে বসে আছে । তার সেই বিষদাঁতের কঠিন দু'টো মারণাস্ত্র
তো সাপুড়ে কবেই কেড়ে নিয়েছে । মিথ্যে এ ফণার আস্ফালন সে মানবে কেন ? পরিবর্তে , সাপুড়ের হাতে আছে দণ্ড ; সাপুড়ের হাতের গন্ধমূলকেও তার ভীষণ ভয় । দিনে দিনে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে , খেলা দেখাতে তার মন আর সায় দেয় না ;
তথাপি , সাপুড়ের হাতের খোঁচা খেয়ে--ফণাটা তাকে দেখাতেই হয় , নাচতেও হয় , খেলতেও হয় । তাকে নাচিয়ে সাপুড়ের দিন যাচ্ছে ভালো , সাপুড়ে ভালো আছে ; সে ভালো নাই । এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষরাতে একটু ঘুম আসে ; ঘুমের মধ্যে দেখে--ঝাঁপির এই দুর্বিষহ অন্ধকার থেকে বহু যোজন দূরের একটা নক্ষত্রলোক তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ।
দিনের পর দিন খোঁচা খেতে খেতে তার শীর্ণ শরীর ক্ষতে ভরে গেছে । ক্ষতে পচন লেগেছে , তার
নিজেরই অসহ্য হয়ে উঠেছে ক্ষতের দুর্গন্ধ । মনেপ্রাণে এই নরকের থেকে সে মুক্তি চায় ; কিন্তু , হাড়ে হাড়ে সে বুঝে গেছে--নরকে ঢোকা যত সহজ , বেরুনো ততোধিক কঠিন । তবু , ঝাঁপির এই নিশ্ছিদ্র নিরুপায় অন্ধকারে চোখ পেতে
মনে মনে কেবলই--স্বপ্নে দেখা সেই নক্ষত্রলোকের
জলছবি আঁকে ।
------------------------------------------------------------------