"গর্জন তেল মাখা আমার দুর্গারা"বিকাশ মুখোপাধ্যায়
আজ সকালে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে গিয়ে এবারের পুজোর নতুন গন্ধে আরও একবার নাক ডোবালাম।দুর্গা মায়ের থেকে নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়ানোর জায়গার কাছাকাছি স্যানেটাইজার কল লাগানো আছে।তল…
"গর্জন তেল মাখা আমার দুর্গারা"
বিকাশ মুখোপাধ্যায়
আসলে সেই ছোটবেলাতেই দুর্গার সঙ্গে আমার আলাপ হ'ত গন্ধে।ঘাম তেল বা গর্জন তেলের গন্ধ।যা সপরিবার দুর্গাকে মৃৎশিল্পীরা শেষ পর্যায়ে মাখাতেন।আমাদের গ্রামে এক আধা জমিদার রক্ষিত বাড়িতে পুজোয় কারিগররা মূর্তি নির্মাণ করতেন।সেখানেই সুযোগ মতো হাজির হতাম।যখন গর্জন তেলের গন্ধ পেতাম, তখন আনন্দে হাততালি দিতে ইচ্ছে হ'ত।তাহলে পুজো শুরু হচ্ছে।দুর্গার আগমনের গন্ধ আমি আরও এক জায়গায় প্রাণ ভরে নিতাম।একান্নবর্তী পরিবারে বিভিন্ন গুরুজনদের দেওয়া নতুন সব পোশাকে।সেই ঘ্রাণ মনকে এতই আনন্দিত করত যে পরবার আগেই মন প্যাণ্ডেলে মা দুর্গার সামনে চলে যেত।
সেই ছোটবেলার গ্রামে পুজোর আরও সুবাস ছিল।সেখানে শিউলি ফুটত, টুপ করে ঝরেও পড়ত।কাশফুলের গাছেরা সার করে দাঁড়িয়ে তাদের চামর দুলিয়ে দূর থেকে জানান দিত।সেই শিউলির গন্ধ ছিল নাকে, কাশফুলের সুবাস ছিল অনুভবে।প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে একচালার প্রতিমাকে ঘিরে ধূপধুনোর সৌরভও পাওয়া যেত।যার সঙ্গে মিশে থাকত দর্শনার্থীদের মাখা সে সময়ের হিমানী, পমেটম, কান্তা সেন্ট, জবাকুসুম আর আতরের সুঘ্রাণ।
একই দিনে ঠাকুর দেখতে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আরেকটি সুবাস পেতাম।সত্যিই যা অপার্থিব।আমাদের ভাইদের নতুন পোশাক পরিয়ে , পাউডার মাখিয়ে, জুতোর ফিতে বেঁধে ঘর্মাক্ত হয়ে যাওয়া দেহের গন্ধ।ঘামে ভেজা চকচকে মুখ থেকে যেন মা দুর্গার গর্জন তেলের আভাস পেতাম।সর্বংসহা মাতৃমূর্তি।
বড় হয়ে সেই গর্জন তেলের আভাস, সুবাস আরও কয়েকজন কাছের মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি।
অন্তত পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে বদলি হয়ে কিছু দিন চাকরি করতে যাবার জন্যে সকাল সাতটায় বেরোনোর সময় দরজা়য় দাঁড়ানো স্ত্রীর উপস্থিতি থেকে।হর দিন শেষ রাত্তিরে উঠে যে আমার চা, খাবার দাবার ম্যায় টিফিন অবধি তৈরি করে দিত।সে সময় তারও মুখে সেই গর্জন তেল মাখা।সেই আমার মা আর মা দুর্গার মতো।সেই চেনা সুবাস।
এখন কাছাকাছি থাকার সুবাদে আমার মেয়ের গর্জন তেল মাখা মুখও দেখি।সেটিও সাতসকালে।সে যখন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে , ছেলেকে তুলে , স্নান ইত্যাদি করিয়ে, পোশাক পরিয়ে খাবার খাইয়ে একই সঙ্গে নিজের অফিস যাওয়ার প্রস্তুতিও করে নিয়ে সক্কালবেলা ছেলেকে স্কুল পৌঁছে দিতে যায় তখনও তার মুখ থেকে গর্জন তেল চুইয়ে পড়ে।আবার সেই চেনা গন্ধ নাকে আসে।
আসলে সব নারীই আমার কাছে দুর্গা।তিনি আমার বাড়ির কাজের মাসি, রাস্তাঘাটে কাজ করা মহিলা শ্রমিক কিংবা ভিড় ট্রেন বাসে দাঁড়ানো চাকুরিজীবি রমণী যেই হ'ন না কেন।
কারণ সব নারীর মুখমণ্ডলে সেই গর্জন তেল মাখা থাকে।যার অপার্থিব গন্ধ সতত আমায় স্নিগ্ধ করে।