✍সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কোনো এক বৃষ্টি মূখর রাতে তাঁর কবিতার ভাষা কর্জ করে বলাই যায়, "দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া...সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া, অবনী বাড়ি আছো?" কিংবা সমস্যা থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকতে চাওয়া লেপের ওম পাওয়া রাতে, …
✍সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কোনো এক বৃষ্টি মূখর রাতে তাঁর কবিতার ভাষা কর্জ করে বলাই যায়, "দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া...সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া, অবনী বাড়ি আছো?" কিংবা সমস্যা থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকতে চাওয়া লেপের ওম পাওয়া রাতে, "আধেকলীন হৃদয়ে দুরগামী, ব্যাথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি, সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া, অবনী বাড়ি আছো?" কি অমোঘ সিগনেচার! কি অত্যাশ্চর্য বীক্ষণ।অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দেয় না? দাঁড় করিয়ে দেয় না নিজের সামনে? কবিরা সত্যদ্রষ্টা হন বুঝি! নাহলে লিখবেন কেন, "মানুষ বড় কাঁদছে, এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, ভালোবেসে দাঁড়াও"- আজকের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আজও কত প্রাসঙ্গিক! তিনি চলে গিয়েছেন বহুদিন। সেই ১৯৯৫র মার্চে। তবু আজও তিনি আছেন প্রবলভাবে। আছেন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে লড়ে যাওয়া জনমানসে। আছেন ক্ষমতার দাম্ভিক রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করাদের হৃদয় জুড়ে। তিনি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
১৯৩৩র ২৫শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। স্কুল জীবন উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি ও সিটি কলেজে পড়াশোনা। কিন্তু অর্থাভাবে অসমাপ্ত থাকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আসলে জীবন থেকেই শিক্ষা নিয়েই তো স্বশিক্ষিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই ভীষণভাবে ব্যতিক্রমী। তিনি বোহেমিয়ান। তাই বোধহয় স্থিতি শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিল না। তাড়না ছিল নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। তাড়না ছিল সময়কে অতিক্রম করার। কবি বুদ্ধদেব বসুর আহ্বানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে ভর্তি হয়েও ছেড়ে দেওয়া, সেই বোহেমিয়ানিজমকেই মান্যতা দেয়! তাই তো 'সকলে প্রত্যেকে একা', 'অন্ধকার নক্ষত্রবীথি', 'সোনার মাছি খুন করেছি' একে একে জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থে ছড়িয়ে দেবেন নিজেকে। উজাড় করে দেবেন তাঁর সমস্ত সত্তা। নিংড়ে দেবেন তাঁর প্রজ্ঞা। প্রচন্ড রবীন্দ্রভক্ত শক্তি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মেই খুঁজে নেবেন জীবনের প্রেরণা। কবিতাতেই তাঁর রাবীন্দ্রিক চেতনার উন্মেষ আদ্যন্ত জীবন বিশ্বাসী এই কবির।
কখনো দোকান কর্মচারী, কখনো বা ওষুধ কোম্পানির চাকরি। কখনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, কখনো বা মোটর কোম্পানির চাকরি। আদ্যন্ত বোহেমিয়ান শক্তি আনন্দবাজার পত্রিকায় যেমন চাকরি করেছেন, তেমনি শান্তিনিকেতনেও শিক্ষকতা করেছেন। বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী শক্তি কম্যুনিস্ট পার্টির সভ্য হয়েও পরে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। বেগবান নদী কবে আর একইখাতে বয়েছে, এক কুল ভেঙে এক কুল গড়াই তো তার স্বাভাবিক পরিণতি!
মূলত কবি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধও লিখেছেন। রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে ফিচার লিখেছেন। স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার নামেও কিছু লেখা লিখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য' প্রকাশিত হয় ১৯৬১তে। প্রথম উপন্যাস 'কুয়োতলা'। ১৯৭৫এ আনন্দ পুরস্কার পান।১৯৮৩তে সাহিত্য আকাদেমি।
কবিতাই তাঁর প্রেম। তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়েই পাঠক খুঁজে পায় নিজেকে। নিয়মভাঙাদের দলে নাম লেখানো শক্তি সবসময়ই অস্থির। কিছু একটা খুঁজে বেড়িয়েছেন সবসময়। সেই কারণেই হয়তো একসময় হাংরি আন্দোলনে সামিল শক্তি সুনীলের কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। পরবর্তী কালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামদুটি একযোগে উচ্চারিত হবে। মধ্য রাতে ফুটপাথ বদল করাদের অন্যতম শক্তির শক্তিশালী কলম লিখবে, "যেতে পারি কিন্তু কেন যাব"
বোহেমিয়ানিজমের মূর্ত প্রতীক অথচ শিশুর সারল্যে বলতে পারেন,"মানুষের মতো মৃত্যু ওর, কবি ছিলো লোকটা, কাঙালও ছিলো খুব"। কি সহজ সত্য কথন! কি ক্ষুরধার আত্নবিশ্লেষণ! কি স্ফুরিত স্ফুলিঙ্গের অমোঘ ব্যঞ্জনায় মোড়া কালজয়ী পংক্তি!
কালের নিয়মে মাত্র ৬১ বছর বয়সে চলে যেতে হয়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। চলে গিয়েও আজও তাঁর উপস্থিতি প্রবল। দৃঢ়ভাবে রয়ে গিয়েছে শক্তিশালী লেখনীর বিচ্ছুরণে ব্যতিক্রমী একরৈখিক অবস্থান!
২৫/১১/২০২০