||বিসর্জন |||| বিষয় : গল্প |||| লেখক :চন্দন চক্রবর্তী |||| তারিখ : 20.11.2020 ||
'ঢ্যাং কুর কুর ঢ্যাং কুর কুর' । গঙ্গা পারে বিসর্জন চলছে । তার জোরালো শব্দ ভেসে আসছে । কনকপ্রভা কানে শীর্ন হাত দুটো চেপে ধরে বসে আছেন । যদিও ক…
||বিসর্জন ||
|| বিষয় : গল্প ||
|| লেখক :চন্দন চক্রবর্তী ||
|| তারিখ : 20.11.2020 ||
'ঢ্যাং কুর কুর ঢ্যাং কুর কুর' । গঙ্গা পারে বিসর্জন চলছে । তার জোরালো শব্দ ভেসে আসছে । কনকপ্রভা কানে শীর্ন হাত দুটো চেপে ধরে বসে আছেন । যদিও কানে কম শোনেন ! কিন্তু এই বাজনটা কানে এলেই কেমন অসহ্য লাগে !
সেই কোন ছোট্ট কালে ঠাকুমার কাছে শুনেছিলেন গল্পটা ! তখন বয়স আর কত ? নয় কি দশ ! আজ আশি বিরাশি বছর পরও ভুলতে পারেন না ! বিসর্জনের বাজনাটা বাজলেই মনে হয় তার মাথার ভেতরেই যেন বাজনাটা বাজছে । গল্পটা সত্যি হয়ে ওঠে । চোখে স্পষ্ট দেখতে পান !
গঙ্গা পারে চিতা সবে জ্বলে উঠেছে । বিসর্জন দিতে গিয়ে কাঠাম চাপা পড়ে স্বামী মারা গেছে । অল্পদিন বিয়ে হয়েছে দুর্গাময়ীর । খবরটা শোনার পর থেকে একটা কথাও বলেন নি । চোখে একফোঁটা জল কেউ দেখেনি ! বাড়িতে স্বামীর শবের পাশে বসে থেকেছেন পাথর হয়ে । সবাই একটু অবাকই হয়েছে । একটু আধটু নিন্দাও শুরু করেছে কেউ কেউ। বাড়ির ঘাটের পাশে চিতা সাজিয়ে আগুন দেওয়া হয়ে গেছে । হঠাৎ দুর্গাময়ী দৌড়ে গিয়ে চিতার ওপরে উঠে স্বামীকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন ! ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ কিছু বোঝার আগেই সব শেষে । গঙ্গা পারে তখন বিসর্জন চলছে । ঢাক বাজছে'টাক ঢ্যাং তাকে কুর ঢ্যাং তাকে কুর " ।।
সব মিলিয়ে ঘটনাটা কেমন সতীদাহ রূপ নিয়েছে । গ্রামবাসীরা ব্যাপারটাকে সেই ভাবেই নিয়েছে । সবার মুখে ছড়াতে ছড়াতে দুর্গাময়ী সতী হয়ে গিয়েছিলেন । পরে ওই স্থানে গ্রামবাসীরা একটা মন্দির স্থাপন করেছিল ।
এ বাড়িতে ষষ্ঠীতে মেঝ ছেলের ঘরে তার নাতীন এসেছে । আজ সকালেই ওরা শিশুকন্যা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে । নাতি নাতবৌ ঘরে এসে শিশু কন্যার মাথায় ওর হাতটা টেনে ছুঁইয়ে কনকপ্রভার আশীর্বাদ নিয়ে গেছে । ভালো করে মুখটা দেখতে না পেলেও মনে মনে নবাগতাকে ভগবতী ভেবে কনকপ্রভা কপালে হাতটা ঠেকিয়েছেন । । নইলে ষষ্ঠীর দিনই আগমন !
গেল বছর এই দিনে কনকপ্রভার ছোট ছেলের ঘরের নাতীন আগুনে পুড়ে মারা গেল ! বিয়ের পর থেকেই অশান্তি আর অশান্তি ! আহা কি রূপ ছিল মেয়েটার ! সাক্ষাৎ ভগবতী । তার কপালে এটা ঘটবে কে জানতো ! ভালোবেসে বিয়ে করে কি যে হল ! অকালে বিসর্জন হযে গেল !
সকাল থেকেই বাড়িতে খুব হট্টগোল । অনেকের ঘরেই কুটুম এসেছে । সকাল থেকেই এ ও এসে প্রনাম করে গ্যাছে । ভালো দেখতে পান না । কানে কম শোনেন । এখন আর এসব ভালো লাগে না ।
এখন সন্ধ্যা । এদিকে কেউ নেই । নিচের তলা সব ফাঁকা করে ওপরে । বাড়িতে অনেকেই নেই । সন্ধ্যা থেকেই আলো নেই । বাড়ির কাজের মেয়েটা একটা মোমবাতি দিয়ে গেছে ।
ঢাকটা বাজছে । ওই বিসর্জনের আওয়াজ আসছে । কনকপ্রভার চোখে একটা আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছেন !
ঐতো দুর্গাময়ী ওর দিকে তাকিয়ে আছেন । সারা গায়ে আগুন ! দুর্গাময়ী হাসছেন ! যেন বলছেন আয় আয় !
কনক প্রভা ভালো দেখতে পারছেন না।
মোমবাতিটা অনেক কষ্টে কাঁপা হাতে তুলে আনলেন । বাপরে ! একটু ফোস্কা পড়লে যা জ্বালা হয় ! তিনি নিজেওতো বিধবা হয়েছেন বছর তিরিশ আগে । আগের দিন হলে ?
কনকপ্রভা জানেন আগের দিনে একপ্রকার জোর করেই সতী বানানো হত । দৈহিক,মানসিক অত্যাচার করে ঢাকা ঢোল পিটিয়ে এসব কান্ড চলতো ।
কিন্তু যারা সত্যি নিজের ইচ্ছায় সতী হয়েছেন !
ঐতো দুর্গাময়ী বসে আছেন । মোমবাতির আলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন । ঐতো উনি ডাকছেন " আয় আয় আয় - - - - - " । ঐতো বিসর্জনের ঢাকটা বাজছে," ঢ্যাং তাক কুর ঢ্যাং তাক কুর" ।
একি ! গরম লাগছে কেন ? কনকপ্রভা গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠলেন,"আগুন আগুন -- -- -- " । গলা দিয়ে একটুও স্বর বের হল না ।
চারিদিকে ধোঁয়া । আগুনের লেলিহান শিখা তখন সবে ছড়িয়ে পড়ছে । বাড়ির লোকেরা পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে এসেছে ।
ঠিক তখন গঙ্গাপারে আর একটা বিসর্জন হচ্ছে । ঢাক বাজছে " ঢ্যাং তাক কুর --------" ।।