Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

ইভেন্ট ঃ- জীবনের গল্প নামঃ- বিভাজন কলমেঃ- তপন কুমার রায়  তারিখঃ- ২০/১১/২০
আমাদের সদরঘরটা বাড়ীর বাইরের দিকে। তারপর বিঘা দুয়েকের বিশাল উঠোন পেরিয়ে আমাদের ঘর, রান্নাঘর। আরো অনেক পিছনে খিড়কি দরজা আর কলঘর আর লাগোয়া ট…

ইভেন্ট ঃ- জীবনের গল্প 
নামঃ- বিভাজন
কলমেঃ- তপন কুমার রায় 
তারিখঃ- ২০/১১/২০

আমাদের সদরঘরটা বাড়ীর বাইরের দিকে। তারপর বিঘা দুয়েকের বিশাল উঠোন পেরিয়ে আমাদের ঘর, রান্নাঘর। আরো অনেক পিছনে খিড়কি দরজা আর কলঘর আর লাগোয়া টয়লেট।খিড়কি দরজা দিয়ে পেরলেই খিড়কি পুকুর। সেটাই মেয়েদের প্রত্যহিক বাসন মাজা, কাপড় কাচা ধরনের কাজের জায়গা। সেখানেই পাড়ার অন্যান্য মেয়েরাও আসে রোজ আড্ডা দিতে। পুকুর ঘাটেই রাজ্যের খবর,আলোচনা, পরনিন্দা - পরচর্চা, জমে যায় আড্ডা।
            আমি তখন বেশ ছোট। স্কুলে যাই মাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে স্কুল বন্ধ।দুপুরের খাওয়া দাওয়ার সেরে বাবা সদর ঘরের বারন্দায় রাখা চেয়ারে বসে নাম্বার টেন সিগারেট খচ্ছিল। এটা ছিল বাবার একটা বিলাসিতা। আমিও রাস্তার ধারের এই বারান্দা টায় বসে পথ চলতি ফেরীওয়ালা, লোক জন দেখছিলাম। হঠাৎ বারান্দার সামনে এসে দাড়ালো এক ভদ্রমহিলা, একটি মেয়ে আমার চেয়ে একটু বড়ো, আর আমার বয়সই একটি ছেলে। ওদের ধুলিধুসরিত মলিন চেহারায়,পোশাকে দারিদ্র্যের ছাপ প্রকট।ওরা এসে দাঁড়ালো বারান্দার সামনে। বাবা বললো- " উঠে এসো"। আমি তো অবাক, এরা কারা? বাবা এদের ঢুকে আসতেই বা বলছে কেন?
           ওরা উঠে আসতে বাবা বললে ইনি তোমার জ্যাঠাইমা,প্রণাম করো। আর এই হলো তোমার দিদি আর ও তোমার দাদা। আমারই বয়সী ছেলে, আমার দাদা? কি জানি বড়ো হবে বোধহয়। বাবা বললো এদের ভেতরে নিয়ে যাও। আমিও আসুন বলে ওদের নিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলাম।
        ওদের দেখেই পিসিমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। প্রচন্ড চেঁচামেচি গালাগালি শুরু করে দিলো।বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও করে, ওদের বার করে দেওয়ার উপক্রম। পিসিমার দাপট ভীষন আমাদের বাড়ীতে।মা এসে টেনে নিয়ে গেলো ওদের পিসিমার সামনে থেকে। ওরা এই দুপুর বেলা এসেছে, চান নেই, খাওয়া নেই, কোথা যাবে ওরা এখন? খাওয়া দাওয়া করুক বিশ্রাম নিক তারপর ভেবে দেখবেন । বলে মা ওদের চান করতে কলঘরে পাঠিয়ে দিল। মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমার জন্মের আগেই এই জ্যাঠাইমা তার মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে চলে গিয়েছিল তার বাপের বাড়ী। জ্যাঠাবাবু তার অনেক আগেই এদের কে ছেড়ে, গ্রামের বাড়ী থেকে কোলকাতা চলে গিয়েছিল। 
        চার ছমাস অন্তর অন্তর জ্যাঠাবাবু আসতো তাই জ্যাঠাবাবুকে চিনতাম, কিন্তু জেঠিমা বা জেঠতুতো দাদা- দিদি বলে আমার কেউ আছে তাই জানতাম না। আমার নিজের ই তো দাদা দিদি আছে, বোন আছে।
      আমার পিসিমা তার পঁচিশ বছর বয়সেই বিধবা হয়ে তার এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে আমাদের বাড়ী চলে আসে।তখন আমার দাদু ঠাকুমা বেঁচে। পিসতুতো সেই দিদিকেই আমরা বড়দি বলতাম আর পিসতুতো দাদাকেই বড়দা বলতাম। পিসিমা কে দাদু বাড়ীর খিড়কির দিকের ফাঁকা অংশটা নাকি লিখে দিয়ে গেছিলো। তাছাড়া পিসিমা তার শ্বশুড়বাড়ীর সব সম্পত্তি বিক্রি করে আমাদের গ্রামেই অনেক জমি কিনেছিল।কাজেই সংসারের অনেকটা খরচই পিসিমার আয় থেকেই আসতো। তাছাড়াও সংসারেই কি আর পাড়াতেই কি পিসিমার অখন্ড দাপট ছিলো।
সন্ধ্যে হতেই আাবার অশান্তি শুরু, জেঠিমারা থাকবে কোথায়? পিসিমা ওদের এ বাড়ীতে থাকতে দিতে রাজী নয়। মার যুক্তি, ওরা তো এ বাড়ীরই লোক ওরা যাবে কোথায়, আমাদের সাথেই থাকবে। পিসিমার কথা হলো, তা হলে তেজ দেখিয়ে চলে গেছিল কেন? না গেলে তার ভাই টা তো এমন ঘর ছাড়া হতো না। ওদের যা ঝামেলা চলছিল চলছিলো আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে আড়ষ্টতা কেটে একটু একটু ভাব হচ্ছিল ক্রমশঃ। 
       বাবা পিসিমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলো, তাই বাবা পিসিমার হাঁক ডাকের মধ্যে একটু মিইয়েই থাকতো। পিসিমা তো সারাদিন টো টো করে পাড়া ঘুরে বেড়াতো। মা সারা সংসারের সমস্ত কাজ, সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা একা হাতে সামলাতো। তাই পিসিমাও ছোটবউ মানে আমার মায়ের ওপর বেশি কথা বলত না।
         মা ঠিক করে দিলো, নতুন ঘরটা জেঠিমা কে দিয়ে দেওয়া হোক ওরা ওই ঘরে থাকুক, বাচ্চারা একসাথে থাকতেই পারে, ওদের খুশী। পিসিমা যদিবা থাকাটা মেনে নিলো, প্রশ্ন তুললো,-- ওদের খাওয়ার কি হবে? কে খাওয়াবে? পিসিমা নেই ওর মধ্যে? ওদের খাবার ওরা বুঝে নিক, কোথা থেকে পাবে। মা বোঝালো--" আমাদের ও তো আপনিই খাওয়ান। ভাসুরমশাই আাসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন তারপর যা হয় আপনারা ঠিক করবেন"।
         তখনকার মতো পিসিমা মেনে নিলো বটে কিন্তু রোজ খাওয়ার সময় ওদের চোখের জলে নাকের জলে করে ছাড়তো। এর ফল যে আমাদের ওপর আসেনি একদম তা নয়। এই জেঠতুতো দিদি দাদা ও মনমরা থাকতো। একটু আড়ষ্ট ব্যবহার করতো। আমরা টানলেও ওরা তেমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসতো না। জেঠিমা সারাদিন আমাদের প্রতিবেশীদের ঘর,আত্মীয়দের ঘর ঘুরে বেড়াতো। তাদের বাড়ী গিয়ে জেঠিমা দূঃখ দুর্দশার কথা বলতো। বলতো আইন মতো তার তো এই বিশাল বসত ভিটের অর্ধেক পাওয়ার কথা। কথাটা ন্যায্য ই। সকলেই মনতো।
         আমার মামার বাড়ী ছিল প্রায় পাশাপাশি। মাযের বাবা মানে আমার মামাবাড়ীর দাদুরা ছিল তিন ভাই। তাদের তিন জায়গায় তিনটে বিশাল ফ্যামিলি।আমার নিজের মামারা আমাদের সাথে থাকলেও খুড়তুতো মামারা জেঠিমার পক্ষে ই চলে গেলো। প্রতিবেশী, আত্মীয় সকলেই আস্তে আস্তে জেঠিমার পক্ষ নিলো। জেঠিমাও সবার কাছ থেকে চাল ডাল চেয়ে চিন্তে এনে আলাদা ফুটিয়ে খেতে থাকলো। জেঠতুতো দিদি সীমা আমাকে খুব ভালোবাসলেও, দাদা দিলীপ এড়িয়ে চলতে শুরু করল। রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে গেলেও কারো দিকে তাকাতে পারতাম না। সবাই কেমন অপরাধী ভাবতে শুরু করলো আমাদের। মায়ের খুড়তুতো ভাই ম্যাকু মামা তখন উঠতি নেতা। সে এসে মা কে বললো -- "বড়দি তোদের তো সম্মান ও তো যাচ্ছে। দিয়ে দে না ওদের প্রাপ্য অংশটা"। মা ম্যাকু মামাকে বললো-- সম্মান বলে কি আর কিছু রইলো রে।তুই যে কিনা আমার মুখের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে পারতিস না,সেই তুই আমাকে উপদেশ দিতে এসেছিস। এসেছিস যখন তখন তোর জামাই বাবুর সাথে কথা বল"।
ম্যাকুমামা মায়ের কাছে চা বিস্কুট খেয়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল একই কথা। বাবা বললো--" দেখ ম্যাকু, বাড়ীর অর্ধেক অংশ কার পাওনা? আমার দাদার? না বৌদির? আমার দাদা তো জীবিত। দাদা আসলেই আমি দিয়ে দেব।"
         তখন বাংলার রাজনৈতিক আকাশে এক ক্রান্তিকাল। একদিকে নকশালদের পরপর শ্রেনী শত্রুদের গুপ্তহত্যা। অন্যদিকে ঘেরাওয়ের রাজনীতি। চারদিকে একটা আতঙ্কের পরিবেশ। শম্ভু নন্দী দোকান বন্ধ করে সাইকেলে বাড়ী ফেরার পথে টাঙ্গির কোপে খুন হয়ে গেলো। যে সব সাঁওতাল, দুলে,বাগ্দী, বাউরি, ডোম,প্রভৃতি আদিবাসী বা অন্তজ শ্রেণির লোক সাধারণ ভদ্রলোকের বাড়ী জমি চাষ বা বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম করতো তারা হঠাৎ করে উগ্র মেজাজী বেপরোয়া হয়ে গেলো। হঠাৎ করে একটা শ্রেনী বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। 
           জেঠিমা তখন সীমা আর দিলীপ কে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরছে।একদিন এর মধ্য কোলকাতা থেকে রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে চার পাঁচটা ছেলে জ্যাঠাবাবুকে দুপুর বেলা ধরে নিয়ে এসে হাজির।জেঠিমার অসীম ক্ষমতা জ্যাঠাবাবুকে কোলকাতায় ট্রেস করা, এতগুলো ছেলেকে ফিট করা, গাড়ী করে আানা তখনকার দিনে সহজ ব্যাপার ছিলো না। যাহোক বাড়ী ঢুকে জ্যাঠাবাবুর উন্মত্ত অবস্থা। গালাগালি দেয় চেঁচামেচি করে লাফায় ঝাপায়, কে তার সামনে যায়।এই সব অবস্থা দেখে আমরা ভাইবোনরা ঘাবড়ে আছি। মেজমামা, ছোট মামা এসে বাবা ও জ্যাঠাবাবুর সাথে কথা বলছে। আমি সদর ঘরে গেলাম যেখানে শহুরে গুন্ডা গুলো বসে আছে। আমি যেতেই বললো-" বাবু আমাদের একটু জল খাওয়াও দেখি"। আমি বললাম তোমাদের কাছে রিভলবার আছে, দেখালে জল খাওয়াবো। ওরা রাজি।আমি এক জগ জল নিয়ে আর একটা গ্লাস নিয়ে ওদের কাছে হাজির। ওরা সকলে জল খেয়ে আমাকে তাদের রিভলবার দেখালো। সেই জীবনে ওই বস্তু প্রথম দেখা। ওরা খুব ভালো আজকের দিনটা সাবধানে থেকো, বাড়ী থেকে বেরিয়ো না বলে চলে গেল।
          বাড়ীর লোকজন কে কোথায় ছিটকে গেছে কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।হঠাৎ হঠাৎ কাউকে দেখা যাচ্ছে, তারপরই কোথায় চলে যাচ্ছে। 
      বাইরে বের হতেই দেখি হাজার হাজার সাঁওতাল, বাউরি, দুলে সব তীর- ধনুক, টাঙ্গি, বর্শা, তলোয়ার নিয়ে বাড়ীর চারিদিকে বসে আছে। আমাকে কেউ তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না। আমি ঘুরে ঘুরে ওদের অস্ত্রসস্ত্র সব হাত দিয়ে দিয়ে ঘুরে দেখছি। ওরা বললো যাও খোকা বাড়ী চলে যাও। সব মদ খেয়ে আছে, খুব গন্ধ ছাড়ছে।বাড়ী ঢুকে গেলাম।
         সন্ধ্যে হতে না হতেই ওই সব সাঁওতাল লোক গুলো আমাদের বাড়ীর দুটো দরজা বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দিলো। হ্যাজাকের আলো নিয়ে চারিদিক ঘুরে পাহারা দিতে লাগলো। হাজার কন্ঠে স্লোগানে দিচ্ছে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার ব্লক জিন্দাবাদ। শ্রেনীশত্রু খতম করো। সেকি গর্জন। কান পাতা দায়। দরজা ঠুকছে , তলোয়ার ঠুকে আওয়াজ করছে। বাড়ীর মধ্যে আটকে পড়া আমরা ক ভাইবোন, মা,পিসিমা,জ্যাঠাবাবু,বাবা,
মেজমামা, ছোটমামা। বড়দা (পিসিমার ছেলে) পুলিশে চাকরি নিয়ে কোলকাতায়। বড়দা কিছু জানতেই পারলো না। মা চা করে করে দিচ্ছে। দিদি সকলকে চা দিচ্ছে কাপে কাপে। চারিদিক চিৎকারে থর থর করে কাঁপছে। আমাদের বাড়ী থেকে যে সব রাস্তা কোলকাতার দিকে গেছে, সব নাকি কড়া পাহারায় আছে। কি করবে বাবা জ্যাঠাবাবু কিছু ঠিক করতে পারছে না। আবার একটা সাঁইবাড়ী হবে মাঝরাতে নাকি। আমরাও ভয় খেয়ে আছি। মেজমামা বললো --মার্ক্স বাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা রাম চ্যাটার্জীর কাছে পৌঁছাতে হবে যে কোন প্রকারে। পৌঁছাতে তো হবে, বাড়ী থেকে বেরোবে কি করে?  
         উপায় টা বার করলো দাদা। গোয়ালঘরের পিছনদিকে। ফনী মনসার ঝোপ। ওদিকটা কেউ পাহারা দিতে যেতে পারছে না ওরা। গোয়ালে খড়ের চাল। ছোটমামা দাদা তুলে ধরতে দেওয়াল আর চালের ফাঁক দিয়ে গলে মেজমামা,বাবা,আর জ্যাঠাবাবু বেরিয়ে গেলো। তারপর কলু পুকুরের জঙ্গল ঘেসে বেরিয়ে ওরা দামোদরের পাশের ভিক্টোরিয়া ড্যামের ওপর দিয়ে সাইকেলে করে। আারাম বাগ চলে গেছিলো। মেজমামাই তার স্টুডেন্টদের কাছ থেকে সাইকেল যোগাড় করেছিল। রাম চ্যাটার্জী ডাকাবুকো কিন্তু মানবিক লোক ছিলো। সে নিজে জিপগাড়ীতে সকলকে নিয়ে এসে ঘেরাও তুলে নিয়ে ছিলো আর ম্যাকুমামাকে মারতে মারতে নিয়ে গিয়েছিলো। জ্যাঠাবাবু ওখান থেকেই কোলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলো। সারারাত উৎকন্ঠার মধ্যে কাটিয়ে পরদিন সবে ঝিমচ্ছি। এমন সময়ে আবার প্রচুর লোক এসো উঠোন বরাবর বাঁশপুঁতে লম্বা বেড়া দিয়ে দু ভাগে বাড়ীটাকে ভাগ করে দিয়ে চলে গেল। ওপারে সীমা দি, দিলীপ কে নিয়ে জ্যাঠাইমা। এদিকে আমরা। বিভাজন সম্পন্ন হয়ে গেল। 

(এটা আমার জীবনের একটা নিদারুণ ঘটনা। কোথাও কোন কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়নি। সব চরিত্র ও সব ঘটনা সত্যি।)