Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

অচেনা সম্পর্ক।অনিতা দাশগুপ্ত।পুরীতে সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া আমাদের একসময় বার্ষিক রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছিল। যাত্রা পথে কতো মানুষের সঙ্গে তে আলাপ হয়েছে , তার হিসাব রাখা ভার। এদের কারোর কারোর  সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী আব…

 


অচেনা সম্পর্ক।

অনিতা দাশগুপ্ত।

পুরীতে সপরিবারে বেড়াতে যাওয়া আমাদের একসময় বার্ষিক রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছিল। যাত্রা পথে কতো মানুষের সঙ্গে তে আলাপ হয়েছে , তার হিসাব রাখা ভার। এদের কারোর কারোর  সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী আবার কারোর সঙ্গে সম্পর্ক ট্রেনের কামরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। তবে সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে মনের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ বেশ জায়গা করে নিয়েছে। স্বল্প সময়ের সেই বন্ধু কে নিয়ে আজকে

কিছু লিখতে ইচ্ছা করল।

     পুরীর সমুদ্র সেই সঙ্গে জগন্নাথ দেবের আকর্ষণ বড়ই অমোঘ। তাই সেইবার আমি মেয়ে কে নিয়ে একাই রওনা দিলাম পুরীতে। শীততাপনিয়ন্ত্রিত ট্রেনে মে মাসের গরম টা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা ভেতরের দিকে ই বার্থ পেয়েছিলাম। স্টেশনে আমাদের ছাড়তে এসেছিলেন আমার কর্তা মশাই। কোনো অভিভাবক ছাড়া ট্রেন জার্নি এই আমাদের প্রথম। তাই বেশ অশান্তি করেই আমাকে রাজী করাতে হয়েছিল আমার কর্তাটি কে। শেষে রাজী হলেও মনের মধ্যে শঙ্কা একটা রয়ে গিয়েছিল। তাই আমাদের উল্টো দিকে বসা একটি সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে আমাদের একটু দেখাশোনার কথা বলে নেমে গেলেন। 

     ট্রেন চলতে শুরু করল। আমরা বেশ আরাম করে মা মেয়ে তে বসলাম । তখন আমার মেয়ের বয়স বেশি নয়। এগারো, বারো হবে। স্কুলে পড়ে। গরমের ছুটিতে একটু ঘুরতে যাওয়ার জন্যেই এবার মেয়ে কে নিয়ে একা চলেছি জগন্নাথ দর্শনে।

যেহেতু ট্রেন ছেড়েছিল বিকেল বিকেল, তাই ঘসা কাঁচের মধ্যে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে একদম না হলেও কিছু পরিমাণে প্রকৃতি দর্শন হচ্ছিল। মাঠ ঘাট পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। জানি না কেন ছোট বয়সের মতো এখনও  মনে হয় বাইরে থাকা সব গাছপালা বাড়ী ঘর ও যেন আমাদের সঙ্গে ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে আমরা আবার তাদের

হারিয়ে এগিয়ে চলেছি। গরমের দিনে সূর্যাস্ত একটু দেরি তে হয়। সূর্যের রক্তিম আভায় সারা আকাশ

ছেয়ে গেছে। বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম বাইরের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ মেয়ের হাসির শব্দে মুখ ফিরিয়ে দেখি সাইড সিটে বসা একটা কম বয়সী ছেলের সঙ্গে ও গল্প জুড়ে দিয়েছে। আর হাসছে ও সেই তালে। ছেলেটার চেহারা দেখে কী রকম একটা বকাটে‌ মার্কা মনে হওয়া তে চোখ কটমট করে মেয়ের দিকে তাকালাম। ছেলে টা ও দেখলাম আমার মনোভাব বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। চুপ করে একটা বই পড়তে শুরু করলো। আমি মেয়ে কে বললাম, " যার তার সঙ্গে কথা বলতে বাবা বারণ করে দিয়েছে না। কী কথা বলছিলি?''

" মা দাদা টা খুব ভালো গো। কত মজার মজার কথা বলছিল। জানো ঐ দাদা টা ও পুরী গিয়েছে

অনেক বার। সমুদ্র তে স্নান করার সময় কতো মজা হয় , এক একজন জল কে কতো ভয় পায় আবার ঢেউ আসলে পালিয়ে যায় ,অনেকে পালাতে গিয়ে পড়েও যায় এইসব বলছিল তো। তুমি শুধু শুধু আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকালে।''

" তুই জানিস না মামন সবাই ভালো হয় না। মজার মজার কথা বললেও মনে কার যে কী আছে , তার কী বলা যায়? ''

" ঠিক আছে বাবা বলবো না কথা। ''

মেয়ের একটু রাগ হয়েছে দেখে আমি খাবারের ব্যাগ থেকে একটা পেস্ট্রী বার করে ওকে দিলাম। সঙ্গে আমিও নিলাম। আরও কয়েকটা ছিল। তাই সামনে বসা যুগল কে ও অফার করলাম। ওরা অবশ্য নিল না। ওরা নিজেদের প্রেমে এতো ই মশগুল আমাদের দিকে তাকানোর অবকাশ ই ওদের নেই। মনে মনে ভাবলাম নতুন জীবনের সব স্বামী স্ত্রী প্রথমে এইরকম ই থাকে। আমার মেয়ে ভয়ে ভয়ে আমাকে বললো, " মা ঐ দাদা টা কে জিজ্ঞেস করলে না তো?''

" আবার বাড়াবাড়ি করছিস তুই? কী বললাম তখন তোকে?''

" ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি কিছু বলছি না।''

এরপর অবশ্য সামনে বসে থাকা যুগলের সাথে আমাদের বেশ ভাব জমে গেল। ওরা উড়িষ্যার লোক। কিন্তু বহুদিন কলকাতায় থাকার জন্য সুন্দর বাংলা বলতে পারে। তারপর আমরা রাতের খাবার ও খেলাম চারজনে একসাথে। যেহেতু আমার একটু হার্টের সমস্যা আছে তাই বাড়ি থেকে রুটি আর হালকা করে বানানো চিকেন কষা এনেছিলাম। সেই গুলো চারজনে ভাগ করে খেলাম। ওরাও দোকান থেকে আনা মাটন বিরিয়ানি আমাদের সঙ্গে ভাগ করলো। যদিও এই সব খাওয়া আমার নিষেধ তা সত্ত্বেও ওদের অনুরোধে পড়ে খেয়ে ফেললাম। 

এরমধ্যে সাইড বার্থে বসা ছেলেটার দিকে এক আধ বার নজর যে পড়ে নি , তা নয়। মাঝে মাঝে দেখেছি ও বই পড়ছে, কখনো দেখছি আমাদের চারজনের কথাবার্তা শুনছে। কিন্তু অযাচিত ভাবে এর মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করে নি। কিন্তু তার সত্ত্বেও আমার মনোভাব পাল্টায় নি। কথা তে আছে না," যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।' আমি মাঝে মাঝেই আড় চোখে দেখছি ও মামনের দিকে কুনজর দিচ্ছে কিনা। যাই হোক এই করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। সবাই যে যার মতো শোওয়ার ব্যাবস্থা করে ফেললাম। শোওয়ার আগে আমি আমার সব ওষুধ গুলো খেয়ে নিলাম। পাশের বার্থে দেখলাম ছেলেটা শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। মামন ওপরের বার্থে শুয়ে পড়ল। আমি নীচে বিছানা ঠিক করে জগন্নাথ দেবের নাম নিয়ে শুয়ে পড়লাম। 

ঘুম টা ঠিক মতো আসছিল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব এপাশ ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ বুকের বাঁ দিকে একটা যন্ত্রনা হতে শুরু করলো। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম গ্যাস হয়েছে। ব্যাগ থেকে বের করে জেলুসিল মুখে দিলাম। কিন্তু যন্ত্রনা বাড়তে ই থাকলো। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। যন্ত্রনার তীব্রতায় কাতরাতে থাকলাম। সারা ট্রেনে সমস্ত যাত্রী তখন গভীর ঘুমে। মামন কে ডাকবার মতো ক্ষমতা ও তখন নেই। হঠাৎ মনে হল পাশ থেকে কে যেন বলছে," কাকীমা শরীর খারাপ লাগছে? কী হচ্ছে ? '' অনেক কষ্টে তাকিয়ে দেখি পাশের বার্থের সেই ছেলেটি উঠে বসেছে। অনেক কষ্টে বললাম," বুকে খুব ব্যাথা। ব্যাথার জায়গা টা দেখাতেই ও নিজের ব্যাগ থেকে একটা ওষুধ বের করে আমার জিভের নীচে রাখল।আর আস্তে আস্তে আমার বাঁ দিকের বুকের ওপর হাত দিয়ে প্রেসার দিতে থাকল । এইভাবে কিছু ক্ষণ করার পর আমি ঠিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলাম। সমস্ত ব্যাপার করে গেল ছেলেটা নিঃশব্দে। মামন ও জানতে পারল না। এরমধ্যে ও আমার প্রেসার টা মেপে নিয়ে বললো , " প্রেসার টা অনেক বেড়ে গেছে। ' বলে একটা ওষুধ নিজের ব্যাগ থেকে বের আবার খাইয়ে দিয়ে বলল," ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আমি জেগে আছি।আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন। আমি একজন ডাক্তার। এম ডি করেছি। ওর কথা শুনে আমি সত্যি আশ্বস্ত হয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর বেলায় ট্রেন যখন পুরী পৌঁছল তখন দেখি সেই ছেলেটি র সিট টা খালি। নিজের অদুরদর্শীতায় নিজেকে ধিক্কার জানিয়ে ছিলাম । ঘটনা টা মনে করে বারবার সেই দেবদূতের উদ্দেশ্য প্রণাম জানালাম। সেই দিন ঐ 

বখাটে ছেলে টা র জন্য আমি আবার বেঁচে উঠেছিলাম । ঘটনা টা চিরদিন আমার মনের মনিকোঠায় সযত্নে রক্ষিত হয়ে আছে। বাইরের চেহারা দিয়ে মানুষ বিচার করার ধৃষ্টতা করি নি

আমি কোনো দিন।

----------------------


সমাপ্ত