Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#গল্প_মাদারির_খেল  #গোপা_ব্যানার্জী 
---- আরে দিদি, দাদা, ভাই, বোন, কাকু জেঠু যে যেখানে আছেন সোব্বাই চলে আসেন, অ্যায়সি মাদারিকা খেল আপনারা দেখেন নাই কোখোনো... এরকম আধা হিন্দি আধা বাংলায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে চলেছে মন্টি। চারদিকে…

 


#গল্প_মাদারির_খেল  

#গোপা_ব্যানার্জী 


---- আরে দিদি, দাদা, ভাই, বোন, কাকু জেঠু যে যেখানে আছেন সোব্বাই চলে আসেন, অ্যায়সি মাদারিকা খেল আপনারা দেখেন নাই কোখোনো... 

এরকম আধা হিন্দি আধা বাংলায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে চলেছে মন্টি। 

চারদিকে অসংখ্য বাড়ি, দোতলা তিনতলা কোনোটা আবার ফ্ল্যাট বাড়ি। জায়গাটা কলকাতা থেকে কিছুটা দূরে হলেও বেশ ঘন জনবসতি আছে। কলকাতায় মানুষ বড্ডো বেশি ব্যস্ত। তাই আজকাল তেমন পয়সা জোটেনা ওদের। এই জায়গাটা বেশ পছন্দ হয়েছে মন্টির। তাই রাস্তায় দড়ি দিয়ে চারপাশটা ঘিরে ও খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে। এখন পূজোর ছুটি চলছে তাই সব বারান্দায় লোকজন উঁকিঝুঁকি মারতে লেগেছে। এটা দেখে মন্টি তাড়াতাড়ি মুন্নিকে এসে বললো 


----তোর সাজাগোজা করতে করতে সবাই চলে যাবে.. জলদি কর নাহলে এক ঝাপড় দিবো। 


মন্টি চলে যেতেই ছোট্ট মুন্নির চোখে জলের ধারা নামলো। কাল থেকে ওর জ্বর ছিল । সকালে ওষুধের দোকান থেকে কি একটা ওষুধ এনে খাইয়েছে মন্টি, তারপর থেকে জ্বর না থাকলেও শরীর খুব দুর্বল। এখানে আসার আগে কলকাতায় দুদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় খেলা দেখাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। খেতেও দেয়নি ঠিক করে মন্টির বউ রূপা। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো মুন্নি। এগিয়ে গেল গলির মুখে যেখানে মন্টি আর রূপা লোকের নজর কাড়ার সবরকম চেষ্টা করছে। ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছে রূপা, সঙ্গে চুমকি বসানো ব্লাউস... সবার নজর এমনিতেই পড়ছে... ওপরে তাকিয়ে সবাইকে নিচে ডাকছে। মুন্নি গিয়ে দাঁড়াতেই ওরা দ্বিগুন উৎসাহে সবাইকে ডাকতে থাকলো। 

প্রতিদিন ওকে খেলা দেখাতে হয়। কখনো শুন্যে টাঙানো দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা, কখনো বাক্স বন্দী হয়ে মরার মতো পড়ে থাকা। চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে মুন্নি ! আজ ওর বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। 

ধানবাদের কয়লা খনির মজুর ছিলো ওর বাবা। খুব ছোট ছিলো মুন্নি। একদিন খনির ভিতরে ধ্বস নেমে ওর বাবা মারা গেল। বাড়িতে মা আর দাদি রোজ রোজ ঝগড়া করতো। খাওয়া জুটতোনা প্রায় দিন। একদিন সকালে উঠে দেখলো উঠোনে বসে দাদি কপাল চাপড়ে কাঁদছে আর ওর মাকে গালি দিচ্ছে। পাড়ার কয়েকজন এসে জড়ো হয়েছে। পাশের বাড়ির মতি বুয়া ওকে দেখে বললো... 

--- তোর মা পালিয়ে গেছে। এখন তোরা খাবি কি? 

তারপরে দাদির কানে কি সব বললো। চোখ মুছে দাদি মাথা নাড়লো। মুন্নি বুঝতেই পারলোনা কি কথা হলো। দুদিন দাদি ওকে খুব যত্নে রাখলো। চুলে রঙিন ফিতে লাগিয়ে চটি বানিয়ে দিলো। বাজার থেকে কাঁচের চুড়ি, টিপ কিনে এনে পড়তে বললো। সারাক্ষন ওকে চোখে চোখে রাখলো। এসব দেখে ছোট্ট মুন্নি শুধুই অবাক হচ্ছিলো। তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলায় মতি বুয়ার সাথে মন্টি এলো। তিনজনে কিসব কথা বললো, তারপর দাদি মুন্নিকে বললো... 

---- মুন্নি, তোর দাদির অনেক উমর হয়েছে... তোকে এখন আর দেখাশোনা করতে পারবেনা ! তোর মা তো তোকে ফেলে পালিয়ে গেল ! এখন তুই এই ভাইয়ার সাথে যা ! ও তোকে ভালো খেতে পরতে দিবে ! ওর কথা শুনে চলবি তো ও তোকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিবে। 

মুন্নি খুব কেঁদেছিলো সেদিন ! দাদির পা জড়িয়ে ধরে অনেক মিনতি কিরেছিলো ! সে দুবছর আগের কথা ! তখন থেকে ওর জীবনটা নরক হয়ে গেছে। 

প্রথমে খেলা শিখতে গিয়ে খুব মার খেত। তারপর ও খুব ভালো খেলা দেখাতে শুরু করতে, অনেক পয়সা হলো মন্টির। কিন্তু ওকে দুবেলা খেতে দেওয়া আর খেলা দেখানোর জন্য একটা ঝলমলে পোশাক ছাড়া কিছুই দেয়নি আজও । বর্ষায় খেলা দেখানোর সুযোগ কমে গেলে পেট ভরে খেতে পর্যন্ত দেয়না ওকে। 

এখন এখানে ভালো রোজগার হবে বেশ বুঝতে পারে মুন্নি। তাই ওকে ওষুধ খাইয়ে আজকে খেলা দেখানোর জন্য বাধ্য করেছে মন্টি । ভাবতে ভাবতে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলো ও... হঠাৎ রূপার ঝাঁকুনি খেয়ে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখলো চারদিকে বেশ ভিড় জমে গেছে। মুন্নিও ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নেমে পড়লো রাস্তায়... তার রঙ্গ মঞ্চে। 

---- এ বাবু... দেখে লে মুন্নির জাদু... একবার দেখলে বারবার দেখতে চাইবিরে... একের পর এক ছুরির খেলা, কাগজের পাখি উড়িয়ে দেখানোর খেলা, বাক্স থেকে উধাও হওয়া আরও আরও... হাততালি দিচ্ছে উৎসাহী মানুষ! বাচ্চারা আনন্দে লাফাচ্ছে... 

এবার এলো সেই দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পালা ! ধীরে ধীরে বাঁশ বেয়ে উপরে উঠছে মুন্নি ! মাথাটা একটু টলে গেল যেন ! কিন্তু আজ অনেকদিন পরে এত লোক তার খেলা দেখছে ... থামলে চলবেনা ! মনে হলো ওপর থেকে কেউ ওকে বলছে আরও মুন্নি আরও উপরে... দড়ির ওপরে পা রেখে এগিয়ে চললো মুন্নি... নিচে মানুষের মাথাগুলো কেমন ছোট দেখাচ্ছে ! প্রায় ওপারে পৌঁছে যাবে... এমন সময় ওর চোখে অন্ধকার নেমে এলো... শুধু মনে হলো যেন বাবার চিৎকার শুনতে পেলো 

মুন্নিইইইই..... ইইই !


পনেরো দিন ধরে এক সরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে মুন্নি! উপর থেকে পড়ে মাথা আর পায়ে গুরুতর চোট সেই সঙ্গে দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা, রোদ বৃষ্টিতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলা, সব মিলিয়ে চরম অবস্থা হয়েছিল ! পাড়ার লোকজন সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে না আসলে ওর বাঁচার কোনো আশাই ছিলোনা ! দিনরাত জ্বর আর ভুল বকেছে প্রায় সাত দিন। 


সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা... চোখ মেলে কিছুই বুঝতে পারলোনা। ও কেন এখানে... 

কিছুক্ষন চারিদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে চোখ পড়লো কিছুটা দূরে বসে থাকা মহিলার দিকে। ও অনেক চেষ্টা করলো উঠে বসতে ! কিন্তু সারা শরীর অবশ... গলা দিয়ে শব্দ বের করতে গিয়ে গোঙানির মতো বের হলো। সাথে সাথে ওই মহিলা ছুটে এসে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো। ও দেখলো কয়েকজন দৌড়ে এলো। অনেকে ওদের গ্রামের হাসপাতালে ডাক্তার সাহেবের মতো পোশাক পরেছে। ওরা সবাই ওকে দেখে খুব খুশি হলো। একজন সাদা জামা পরা দিদি এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো 

---কি মুন্নি? ভালো লাগছে? 

মুন্নির চোখে জল এসে গেল... কোনোমতে জিজ্ঞেস করলো 

----রূপা ভাবি, মন্টি ভাইয়া কোথায় ? 

ওই দিদি ওর মাথায় হাত রেখে বললো সাতদিন তুমি এখানে রয়েছো। ওরা তোমাকে ফেলে পালিয়েছে ! কিন্তু তাতে তোমার ভালোই হয়েছে। তুমি যখন উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলে তখনি ওই পাড়ার সবাই তোমাকে এখানে দিয়ে গেছে ! ওনারাই তোমার চিকিৎসার খরচ দিচ্ছেন। তোমার সঙ্গীদের পুলিশ ধরেছিলো ! ওরা স্বীকার করেছে তোমাকে কিভাবে খেলা দেখানোর জন্য তোমার দাদির কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনে এনেছে ! ভয় নেই... বিকেলে থানা থেকে পুলিশ আসলে তুমি তাদের বোলো তোমার ইচ্ছে কি। তুমি চাইলে দাদির কাছে ফিরতে পারো নাহলে এখানে আমরা তোমার সব ব্যবস্থা করে দেবো। তুমি পড়াশোনা করবে... অনেক বড়ো হবে ! মুন্নি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো...

---- আর খেলা দেখাতে হবেনা? এমনিতেই খেতে দিবে? 

ওর কথায় কেউ চোখের জল সামলাতে পারলোনা। নার্স দিদি ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো 

--- না ! এবার থেকে শুধু পড়াশোনা আর খেলা। তোমার খেলা দেখানোর দিন শেষ। 

আনন্দের ঢেউ খেলে গেল নিষ্পাপ করুন মুখটায় ! আস্তে আস্তে চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো মুন্নি !!

©® গোপা 

___________________________________________________