Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#বিভাগ_গল্পশিরোনাম: #মুখোশের_আড়ালেকলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী
"ওই যে রত্না দি এসে গেছে" হাঁফ ছেড়ে বলে সায়ন্তনা।             আজ সায়ন্তনার বিয়ে। দীর্ঘ তিন বছর পরিবারের সাথে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চালানোর পর অবশেষে সায়ন্তনা ও …

 


#বিভাগ_গল্প

শিরোনাম: #মুখোশের_আড়ালে

কলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী


"ওই যে রত্না দি এসে গেছে" হাঁফ ছেড়ে বলে সায়ন্তনা।

             আজ সায়ন্তনার বিয়ে। দীর্ঘ তিন বছর পরিবারের সাথে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ চালানোর পর অবশেষে সায়ন্তনা ও পলাশের চির অভিপ্রেত শুভপরিণয়ের তিথি উপস্থিত। তাই আজকের দিনটা যেন নিখুঁত হয় তার সবরকম প্রয়াস করেছে সায়ন্তনা।পারফেক্ট ব্রাইডাল লুকে নিজেকে সাজানোর ভার দিয়েছে শহরের বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট রত্নার উপর।

     "আমার রত্না মা এসে গেছে, আমার আর কোন চিন্তা নেই। কনে সাজানোর পর ফুলশয্যার তত্ত্বগুলো সাজিয়ে দিও মা। কিন্তু আগে বল এত দেরী করে এলে কেন? গায়ে হলুদের সময় আমরা অপেক্ষা করেছিলাম কখন রত্না আসবে আর আসর জমাবে।" এক নিঃশ্বাসে সব কথা শেষ করলেন সায়ন্তনার ঠাকুমা শান্তি দেবী।

              " অফিসের সময় ট্রাফিক এত বেশী থাকে যে গাড়ী একদম এগোতেই পারে না। তাই দেরী হয়ে গেল মাসিমা। কিন্তু এখন আমি এসে গেছি, আপনি আর চিন্তা করবেন না। কিন্তু কাজ শুরু করার আগে কব্জি ডুবিয়ে পেটপূজা সেরে আসি বুঝলেন, নাহলে ঠিক এনার্জি পাব না।" কথা শেষ করে হাসতে হাসতে ছাদের দিকে চলে যায় রত্না দি, যেখানে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।

                   রত্না তালুকদার এই শহরের খ্যাতনামা মেকআপ আর্টিস্টদের মধ্যে অন্যতম। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। সায়ন্তনার পিসির বিয়েতেও উনি সাজিয়েছিলেন। সেইসময় থেকেই লোকসমাজে রত্না দি নামেই বেশী পরিচিত। মানুষটি কিন্তু অন্যরকম। সাধারণত মেকআপ আর্টিস্টরা বুকিং অনুযায়ী নির্দিষ্ট মানুষদের সাজিয়ে চলে যান। কিন্তু রত্না দি সকাল থেকেই তাদের বিয়ে বাড়ীতে চলে আসেন। কনে সাজানো ছাড়াও তত্ত্ব সাজানো, পূজার কাজকর্ম সবকিছুতেই বাড়ীর লোকেদের সহায়তা করেন। ওনার সবচেয়ে বড় গুণ হল ওনার স্বভাব। এত মিষ্টি, মিশুকে স্বভাব, অচেনা মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা বর্তমানে খুব একটা চোখে পড়ে না। খিলখিলিয়ে এত সুন্দর হাসেন যে নির্জীব জায়গাতেও প্রাণের সঞ্চার হয়। কয়েকবার অ্যাওয়ার্ডের জন্য উনি মনোনীত হয়েছেন, কিন্তু প্রতিবার উনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন।


---- "রত্না দি তোমার হাতের টান কি সুন্দর গো! যতবার দেখি অবাক হয়ে যাই।" সায়ন্তনাকে সাজানোর সময় ওর প্রিয় বন্ধু বৃষ্টি এসেছে। "সায়ন্তনা দেখ রত্না দি শুধু যে সুন্দর সাজাতে পারেন তা নয়, নিজেও কি সুন্দর করে সাজেন। তোমার বর নিশ্চয় চোখ ফেরাতেই পারেন না।"

---- " এই দুষ্টু মেয়ে শুধু পাকা পাকা কথা। আমার কথা ছাড়, দেখবি ফুলশয্যার আগে সায়ন্তনাকে এত সুন্দর সাজাবো যে পলাশ বাবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারবেন না।"

---- " আচ্ছা রত্না দি তোমার ঠিকানা দিও গো। সামনের মাসে তো আমার বিয়ে, তোমায় গিয়ে কার্ড দিয়ে আসব।"

---- " ধুর পাগল মেয়ে, আমার বাড়ী অনেক দূর। অতদূরে একটা কার্ড দিতে যাবি! তুই মুখে বলেছিস এই যথেষ্ট। সাজাতে তো আমি যাব, আবার আলাদা করে কার্ড দেওয়ার কি দরকার!"

---- " রত্না দি তুমি কোনদিন তোমার বাড়ীর ঠিকানা দাও না কেন? অনেক হীরে জহরত আছে লুকানো আছে নিশ্চয়, তাই কাউকে যেতে দাওনা।"

           রাত প্রায় বারোটা। সায়ন্তনার বিয়ে থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল রত্না দির। তবুও বাহানা করে আসতে হল, সায়ন্তনার আবদার রত্না দিকে ওদের সাথে বাসর জাগতে হবে। পাগলী বুঝতেই চায় না এই বুড়ি কে কি ছেলেমানুষদের হাসি ঠাট্টার সঙ্গী করা যায়!

---- " দিদি রাত দশটা থেকে কারেন্ট নেই। কতবার আপনাকে বলেছি ইনভার্টার লাগিয়ে নিন। আজকাল সবাই লাগায়।" রত্না দিকে বাড়ীতে ঢুকতে দেখে ওনার সিকিউরিটি গার্ড পল্টু বলে। পল্টুকে কয়েকবছর হল রত্না দি কাজে রেখেছে। 

             বাড়ীতে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে বারান্দায় রাখা সোফায় গিয়ে বসল রত্না দি। কি হবে ইনভার্টার দিয়ে, তার থেকে এই চাঁদের আলো বেশী মনোরম। চাঁদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রত্না দির সামনে ভেসে উঠছে কত পুরোনো দৃশ্য। শহরতলির পনেরো বছরের রত্না মাধ্যমিকের রেজাল্ট হাতে নিয়ে ছুটছে বাড়ীর দিকে। অঙ্ক আর জীবন বিজ্ঞানে নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়েছে। বাবাকে গিয়ে রেজাল্ট দেখিয়ে বলবে একাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হবে। ডাক্তার হয়ে নিজের আর বাবার স্বপ্নপূরণ করবে রত্না। কিন্তু বাড়ী ঢুকে উন্মত্ত রত্না একেবারে স্থির হয়ে যায়। সামনে বাবার মৃতদেহ রাখা, দুর্ঘটনায় রত্নার বাবা ওকে ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন। এক লহমায় বদলে গেল রত্নার জীবন। বাবা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বিধবা পেনশন মা যা পেতেন তাতে চার জনের সংসার চালানো একপ্রকার অসম্ভব ছিল। রত্না মাকে জানায় লেখাপড়ার সাথে টিউশন করে ও সংসারে সাহায্য করবে। কিন্তু মা বিমলা রাজি ছিলেন না। ওনার ধারণায় বড় মেয়ে টিউশন করলেও তার লেখাপড়ার জন্য যা খরচ হবে তা অপচয়, এতে ওনার ছেলের আর ছোট মেয়ের শিক্ষা বা চাহিদাতে ঘাটতি হতে পারে। বড় যখন তার কর্তব্য ছোট ভাইবোনের জন্য ত্যাগ করা। কাজের খোঁজে বেরোয় রত্না। কিন্তু একজন মাধ্যমিক পাশ মেয়ে তাও আবার ওই যুগে কে বা কাজ দেবে। সেই অসহায় মূহুর্তে সহায় হয়ে আসেন প্রতিবেশী রুমকি দি। রুমকি দি বিভিন্ন জায়গায় কনে সাজানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পীদের সাজানোর কাজ করত। সহায়ক হিসেবে রত্নাকে নিজের সঙ্গী করে নেয় রুমকি দি। রুমকি দির সাথে কলকাতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, যেতে শুরু করে রত্না। ভালো কাজ শিখে যায়, অনেক মানুষের সাথে আলাপ হয়। রোজগারও বেশ বাড়তে থাকে। কিন্তু কলকাতায় কোন মোড়ে হঠাৎ যদি মেডিক্যাল কলেজ চোখে পড়ে তখন গলার কাছে কিছু একটা আটকে আসে রত্নার। এদিকে সংসারও নিজের গতিতে চলতে থাকে। 

                      বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। রত্নার ভাই এখন সরকারী দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার। ভাইয়ের বিয়ের কথা চলছে বাড়ীতে। রত্নাও মিলনকে পছন্দ করে। পাড়ার ছেলে মিলন কলেজের প্রোফেসর। রত্নার অদম্য জীবনীশক্তি ও অপরাজিত মনোভাবকে সম্মান জানিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। রত্না জানায় তার উপর সংসারের অনেক দায়িত্ব। মিলন বলে রত্নার ভাই বোনের বিয়ে হয়ে গেলে ও রত্নাকে বিয়ে করবে এবং ওর বয়স্কা মায়ের দায়িত্ব নেবে। এদিকে দেখতে দেখতে বিমলা দেবী পছন্দ করে বৌমা নিয়ে আসেন বাড়ীতে। দিন গুণতে শুরু করে রত্না। এবার শুধু বোনের বিয়ে বাকি, তারপরেই এক হয়ে যাবে রত্না ও মিলন। দেখতে দেখতে বোনের বিয়েও হয়ে যায়। এরপর বছর দুয়েক পেরিয়ে যায়। মিলন রিসার্চের কাজে বিদেশ গিয়েছিল, কথা দিয়েছিল ফিরে এসে রত্নাকে বিয়ে করবে। দুবছরের প্রতিটি মূহুর্তকে রত্না সাজিয়েছিল নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের সুন্দর স্বপ্ন দিয়ে।

            মিলন ফিরে এসেছে বিদেশ থেকে। নিজের অঙ্গীকার ভোলেনি সে। আজ উভয় পরিবারের মধ্যে বিয়ের পাকা কথা হয়ে যায়। একমাস পরে চারহাত এক হয়ে যাবে। রত্নার দীর্ঘ তপস্যার অবসান হবে এবার। কিন্তু আবার নেমে এল আরেক বজ্রাঘাত। পাকা কথা হওয়ার দুদিন পরে একবছরের শিশু কন্যাকে নিয়ে ফিরে এল রত্নার ছোটবোন। তার স্বামী দুশ্চরিত্র। ছোট মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বিমলা দেবীর হার্ট অ্যাটাক হয় এবং উনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান। অরক্ষণীয়া দিদি ও স্বামী পরিত্যক্তা বোনের বোঝা বহন করার ভয়ে ভাই নিজের পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এহেন পরিস্থিতিতে ছোট বোন ও তার শিশু কন্যাকে একা রেখে নিজের সংসার শুরুর কথা ভাবতে অপারগ ছিল রত্না। ফিরিয়ে দেয় মিলনকে, সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। বোন ও নিষ্পাপ শিশুকে নিয়ে শুরু হয় রত্নার নতুন সংসার। কিছু বছর পরে বোন আবার একজন নতুন সঙ্গী খুঁজে পায়। ততদিনে কিছু কোর্স করে নামজাদা মেকআপ আর্টিস্ট হয়েছে রত্না।রত্না দাঁড়িয়ে থেকে বোনের নতুন সংসার গড়ে দেয়। বিয়ের একমাস পরে বোন তার নতুন সঙ্গী ও মেয়ের সঙ্গে জার্মানি চলে যায়। চলে যাওয়ার আগে একবারও ভাবেনি তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা দিদির কি হবে, সঙ্গী বিহীন জীবন দিদি একা কি করে কাটাবে।

                             বোন চলে যাওয়ার পরে শহরতলির বাড়ী বিক্রি করে কলকাতার বাইরের দিকে একটি ছোট ফ্ল্যাট কিনেছে রত্না দি। রোজ মানুষকে সাজাতে যায়, তাদের আনন্দে নিজেকেও ভাসিয়ে দেয় ক্ষণিকের জন্য। হ্যাঁ নিজেকে খুব সুন্দর করে সাজায় রত্না দি, কারণ পনেরো বছর বয়সে রুমকি দি বলেছিল কাজে যাওয়ার আগে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে, লোকে বলে "প্যাহলে দর্শনধারী"। সেইবয়স থেকে নিজেকে সাজানো নিতান্ত অভ্যাস ব্যতীত অন্য কিছু নয়। বৃষ্টি ঠিকই বলেছে রত্না দি নিজের ঠিকানা কাউকে দেয় না। তবে বাড়ীতে হীরে জহরত লুকানো আছে বলে নয়, এই একলা ঘরটাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য। যেসব কুঁড়ি সবে ফুল হিসেবে ফুটছে তাদের এই নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার দেখিয়ে কি লাভ! কোন পুরস্কার নেয় না রত্না দি। পুরস্কার আনন্দের জিনিস, আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে মন চায়। কিন্তু রত্না দি কাকে দেখাবে সেই পুরস্কার, ওই দেওয়ালকে যেখানে প্রিয়জনের সাথে কোন ফটো নেই, নাকি ওই দরজাকে যেখানে কোন আপনজন এসে কোনদিন কড়া নাড়বে না।

                   আজ সায়ন্তনা ও পলাশের ফুলশয্যা। সায়ন্তনাকে পরীর মত সাজিয়ে দিয়েছে রত্না দি। পলাশ বারবার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে। রত্না দির মনে পড়ে গেল কিছু বছর আগের কথা। এক পুরুষও স্বপ্ন বুনেছিল পরীরূপী রত্না কে নিজের করে পাওয়ার জন্য।

              

                এই গল্পের রত্না দি আসলে সমাজের সেইসব মানুষের প্রতিনিধি যাঁরা আনন্দের মুখোশ পরে নিজের দুঃখ লুকিয়ে রাখেন। সাধারণত আমাদের ধারণায় কোন মেয়ে খুব মেকআপ করে বা কোন মানুষ সবসময় হাসি ঠাট্টায় মানুষকে মাতিয়ে রাখে তারা খুব সুখী। বাস্তব কিন্তু ঠিক এর বিপরীত বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। খুঁজে দেখবেন নিজের আশেপাশে এইরকম মুখোশধারী আনন্দদাতা কিছু মানুষ অবশ্যই পাবেন।

(Copyright protected)