Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

রাজ্যপাট*********
সুভদ্রা দেবীর ব্যবহারে খুবই আহত হল নতুন বৌ প্রণতি। প্রণতির বিয়ে হয়েছে সবে একমাস, কোলকাতার মেয়ে সে, কলেজের ফাইনাল দিয়েই তার বিয়ে হল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অরিত্রের সাথে। অরিত্র জামশেদপুরে কর্মরত, অরিত্রের বাবা সীতারামব…


 রাজ্যপাট

*********


সুভদ্রা দেবীর ব্যবহারে খুবই আহত হল নতুন বৌ প্রণতি। প্রণতির বিয়ে হয়েছে সবে একমাস, কোলকাতার মেয়ে সে, কলেজের ফাইনাল দিয়েই তার বিয়ে হল সিভিল ইঞ্জিনিয়ার অরিত্রের সাথে। অরিত্র জামশেদপুরে কর্মরত, অরিত্রের বাবা সীতারামবাবু পাটনার দানাপুর স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, দানাপুরের রেলের বাংলোতে থাকেন। অরিত্র যেহেতু জামশেদপুরে তখনো কোয়াটার পায়নি, তাই প্রণতিকে রেখে গেছে দানাপুরে মাস তিনেকের জন্যে সীতারামবাবু আর সুভদ্রা দেবীর তত্ত্বাবধানে। সুভদ্রাদেবী স্বল্পশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে, তাঁর ছটি সন্তানের মধ্যে অরিত্র বড়ো, অরিত্রের পরে শেফালী, তারপরে সমীর, অঞ্জলি, গোপাল আর সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণা। শেফালির বিয়ে দিয়েছেন তিনি বছর আটেক আগে, তার দুটি পুত্র, জামাই কস্ট কাম চার্টার্ড একাউন্টেন্ট। শেফালির শ্বশুরবাড়ি শ্যামনগরে। বাকি পুত্র কন্যারা সকলেই পড়াশোনা করছে।


সুভদ্রাদেবীর প্রথম থেকেই এই বিয়েতে মত ছিল না, একে শহুরে মেয়ে, তায় শিক্ষিত, সুন্দরী এবং সংস্কৃতিবান পরিবারের সদস্যা। তাই তিনি চাননি এখানে বড়ো ছেলের বিয়ে হোক। কিন্তু সীতারামবাবু আর অরিত্রের এতো পছন্দ হল যে সুভদ্রাদেবীর আপত্তি ধোপে টিকলো না। বিয়ে হল, সীতারামবাবুর বাঁকুড়ার বর্ধিষ্ণু গ্রামের জমিদারি নীল রক্ত দেনাপাওনায় কোনো খামতি রাখতে দিল না মেয়ের বাড়িকে, তিরিশ ভরি সোনা, দানের বাসন, নমস্কারির ৩৫টা শাড়ি, খাট বিছানা, আলমারিতে সবই দিতে বাধ্য হলেন মেয়ের বাবা সুবলবাবু। কষ্ট হলেও দিয়ে থুয়েই বিদায় করলেন সুবলবাবু তাঁর আদরের ছোটো মেয়েকে। কিন্তু দানাপুরে এসে প্রণতি পড়ল মহা ফাঁপরে, কারণ তাকে সারাদিন কাটাতে হয় সুভদ্রাদেবীর সঙ্গে যিনি প্রথম দিন থেকে প্রণতিকে তাঁর প্রতিযোগী ঠাউরে নিয়েছেন। সর্বদা খুঁত ধরতে ব্যস্ত তিনি প্রণতির।


এর মধ্যে ছাঁদা বাঁধা পুরুত ঘরের মেয়ে সুভদ্রাদেবীর আছে ঠাকুর দেবতা নিয়ে অসম্ভব আড়ম্বর করে পূজাপাঠ, পাঠ সেখানে গৌণ, ভক্তিও গৌণ, মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁর আড়ম্বর, আচার বিচারের আড়ম্বরে আর ছলনায় আসল সমর্পণটির সুর যায় কেটে।।সোনার থালা বাটিতে ছাড়া তাঁর ঠাকুরেরা খান না, কারণ তাঁরা জমিদারবাড়ির ঠাকুর। ক্ষীর, সর, ননী মাখন, মন্ডা, মেঠাই ছাড়া তাঁদের সাধারণ কিছু রোচে না, তাই ঠাকুরের নাম করে রোজই বাড়িতে উৎসবের আবহ কিন্তু সেখানে বাড়ির সদস্যরা ছাড়া প্রণতি আর কাজের লোকেরাও ব্রাত্য। তার মধ্যে সুভদ্রা দেবী অসম্ভব শুচিবায়ুগ্রস্ত, ফলে সারাদিন জল দিয়ে অন্তত বার পাঁচেক সারা বাড়ি ধোয়া হয়। প্রণতি বোঝে সুভদ্রা একে অশিক্ষিত, তায় অন্তরের উদারতাটুকুও তাঁর আসেনি, তাই নিজের রাজ্যপাট হারানোর ভয়ে সর্বদা দাবিয়ে রাখতে চাইছেন প্রণতিকে কারণ শ্বশুরের বিশেষ পছন্দ এই বৌটি। বাড়িতে থাকলে কারণে অকারণে বৌমাকে ডেকে নেন আর নানান বিষয় নিয়ে গল্প করেন। বৌমাটিও স্বচ্ছন্দে, সাবলীলভাবে তাতে যোগ দেয়। এই জায়গাটায় সুভদ্রাদেবী বড়ো অসহায় বোধ করেন, কারণ তাঁর জীবন আবদ্ধ 'রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা'র চাকায় আর সন্তান উৎপাদনে। তাঁর মেয়েরাও লেখাপড়া করে, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র পাত্রস্থ হতে। লেখাপড়া তারা ভালোবাসে না, প্রণতি লেখাপড়া ভালোবাসে, বইয়ের তার খুব নেশা, শ্বশুর অফিসের লাইব্রেরি থেকে তাই তাকে বই এনে দেন। প্রণতি ভালো গান গায়, গান শোনা তার আরেক নেশা। সুভদ্রা দেবীর মেয়েরাও রীতিমতো ওস্তাদের কাছে তালিম নিয়ে গান শিখেছে, কিন্তু গানও তারা ওই পাত্রস্থ হবার জন্যই শিখেছে। মেয়েমানুষ লেখাপড়া, গানবাজনা ভালোবাসলে সংসার উচ্ছন্নে যায়, এটাই মত সুভদ্রাদেবীর। তাই প্রণতিকে বই নিয়ে বসতে দেখলে বা গান শোনায় মগ্ন দেখলে তিনি চালডাল মিশিয়ে সেটা বাছতে বসিয়ে দেন।


শনিবার করে রাত্রে অরিত্র বাড়িতে আসে, রোববার থেকে সোমবার ফিরে যায় কর্মস্থলে। প্রণতি খুব অবাক হয়ে দেখে বাড়ির বড়ো ছেলে সপ্তাহান্তে বাড়িতে ফিরবে বলে সুভদ্রদেবী কোনো আলাদা অরিত্রর ভালোবাসার প্ৰিয় পদ রাঁধেন না, রাত্রে তার জন্যে বরাদ্দ থাকে রোজের রুটি, তরকারি, গুড়। বরং মেজ ভাই সমীর বা ছোটভাই গোপালের প্ৰিয় পদ মা সুভদ্রা দেবী রাঁধেন, কিন্তু অরিত্রর জন্য কোনো বিশেষ আয়োজন করতে তাঁর প্রবল অনীহা। অথচ অরিত্র মাইনের বেশ অনেকটাই মায়ের হাতে তুলে দেয় প্রতি মাসে।প্রণতি খুব আশ্চর্য হয় শাশুড়ির এমন অদ্ভুত আচরণে।


সেদিন সকালে সে শুনল পরেরদিন সুভদ্রাদেবী মেজছেলে সমীর আর ছোটমেয়ে কৃষ্ণাকে নিয়ে কাশী যাবেন বাবা বিশ্বনাথকে দর্শন করে গঙ্গাজল আনতে। দানাপুর থেকে কাশী ঘন্টা তিনেকের রাস্তা, তায় তাঁদের পাশ আছে রেলের শ্বশুরের রেলের চাকরির দরুণ।সেদিন শনিবার, অরিত্রর বাড়িতে আসার দিন। ভোরবেলায় বেরিয়ে গেলেন সুভদ্রাদেবী ছেলে মেয়েকে নিয়ে, বাড়িতে প্রণতি, শ্বশুর সীতারামবাবু, ছোটদেওর গোপাল আর মেজননদ অঞ্জলি। বিরাট হাঁড়িতে ভাত হবার পরে এতবড়ো হাঁড়ি নামিয়ে ফেন ঝাড়বে কিভাবে সেই চিন্তায় যখন প্রণতি চিন্তিত, শ্বশুরমশাই নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে ভাত নামিয়ে দিয়ে গেলেন। মনে মনে খুব কৃতজ্ঞ হল প্রণতি। একে একে শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশে তাঁর বলে দেওয়া পদগুলি রেঁধে ফেলল। গোপালকে বলে একটু মাংস আনিয়ে রাত্রের জন্য মাংস বানালো অরিত্রর জন্য বিশেষ করে। সারাদিন আজ খুবই স্বস্তিতে কাটলো প্রণতির।


আটটা সাড়ে আটটায় সুভদ্রাদেবী ফিরলেন সমীর আর কৃষ্ণাকে নিয়ে, প্রায় তাঁদের পরে পরেই ঢুকল অরিত্র। সুভদ্রাদেবী এসে বাইরের কাপড় ছেড়ে চান করে রান্না ঘরে ঢুকে যেই দেখলেন মাংস করেছে প্রণতি, তুমুল অশান্তি শুরু করলেন। সীতারামবাবু পরিস্থিতি যাতে আরও ঘোরালো না হয় তাই বললেন যে তিনিই নতুন বৌয়ের হাতে খাবেন বলে মাংস এনেছিলেন। সুভদ্রাদেবী সব বুঝলেও কিছু আর বলতে পারলেন না। সীতারামবাবু স্ত্রীকে বললেন বিশ্বনাথের প্রসাদ দিতে সবাইকে। সুভদ্রাদেবী সবাইকে প্রসাদ দিলেন প্রণতিকে বাদে।


রাত্রে খেতে বসার সময় সীতারামবাবু সুভদ্রা দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, "বৌমাকে প্রসাদ দিয়েছো "? "এই দিচ্ছি", বলে সুভদ্রাদেবী সরে গেলেন সীতারামবাবুর সামনে থেকে। খাওয়া দাওয়া মেটার পরে আবার সীতারামবাবু বললেন, "কি গো, বৌমাকে প্রসাদ দিয়েছো "? সুভদ্রাদেবী বললেন, "এই যা, একদম ভুলে গেছি, কাল সকালে দিয়ে দেব"। সীতারাম বাবু বললেন, "ওদের নামে পুজো দিলে, অরিত্রকে প্রসাদ দিলে, আর বৌমাকে দিতে ভুলে গেলে।" সুভদ্রা দেবী ঝংকার দিয়ে উঠলেন, "অত আদিখ্যেতা কোরো না তো, কালকে দিয়ে দেব।" পরেরদিন সকালে জলখাবার করে সকলকে দিল প্রণতি, কাজের লোকদের রুটি তরকারির সঙ্গে প্রসাদ বলে একটা করে প্রসাদী প্যাঁড়া দিলেন সুভদ্রাদেবী। জলখাবারের পাঠ চুকলে দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সুভদ্রাদেবী, হাতে হাতে প্রণতি আর অঞ্জলীও জোগাড় দিল। খাওয়া হয়ে গেল দুপুরের, বিকেলে বাড়ির ধোপা এল সাপ্তাহিক কাপড় কেচে ইস্ত্রি করে ফেরত দিতে আর এই সপ্তাহের কাপড় নিতে, তাকে সুভদ্রা দেবী প্রসাদী প্যাঁড়া দিলেন।


সন্ধ্যেবেলায় বাইরে বেরোনোর আগে সীতারামবাবু জিজ্ঞেস করলেন সুভদ্রাদেবীকে, "কি গো, বৌমাকে প্রসাদ দিয়েছো তো "? সুভদ্রাদেবী তাড়াতাড়ি করে প্রসাদের চাঙাড়ি আনালেন কৃষ্ণাকে দিয়ে, দেখা গেল সব প্রসাদ শেষ। সীতারামবাবু ভীষণ রেগে বলে উঠলেন, "আমি যদি বলি তুমি ইচ্ছে করে এটা করেছো"? ব্যাস, যেটুকু রাখঢাক ছিল সুভদ্রাদেবীর, সেটা আর রইল না, তিনিও রেগে বললেন, "হ্যাঁ, বেশ করেছি দিইনি, একে তো তোমাকে আর অরিত্রকে ওই মেয়ে তুক করেছে, আবার প্রসাদ দিয়ে ওকে ঠাকুরের আশীর্বাদটাও পাওয়ার ব্যবস্থা করে আমার রাজ্যপাট আমি হারাই আর কি!!! ইচ্ছে করেই ওকে দিইনি যাতে ও আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় "। স্তম্ভিত সীতারামবাবু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে অরিত্রকে ডেকে নির্দেশ দিলেন পরেরদিন প্রণতিকে নিয়েই যেন সে কর্মস্থলে ফেরত যায় আর বলে দিলেন তিনি না চাইলে অরিত্র যেন আর কোনো অর্থ বাড়িতে না পাঠায় বা মায়ের হাতে দেয় এবং সেটাই হল। পরেরদিন অরিত্রর সঙ্গে প্রণতি চলে এলো তার কর্মস্থলে।


প্রণতির তাতে লাভ বই ক্ষতি হল না, কিন্তু সেই যে বিষাক্ত হল তার সঙ্গে তার শাশুড়ির সম্পর্ক, সেটা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আর ঠিক হল না। সে যে চেষ্টা করেনি তা নয়, কিন্তু গ্রাম্য অশিক্ষিত শাশুড়ির সঙ্গে তার পরিশীলিত শিক্ষিত মন কখনোই মেলাতে পারেনি, তাই বরাবর সে শাশুড়ির প্রতিযোগীই রয়ে গেল আর তাই তাকে চিরকাল শাশুড়ির হিংসার পাত্র হয়েই থেকে যেতে হল শুধুমাত্র শাশুড়ির নিজের অধিকার তথা রাজ্যপাট হারানোর ভয়ে।তাই সুভদ্রাদেবীও শাশুড়ি থেকে মায়ে উন্নীত হলেন না প্রণতির কাছে আর প্রণতিও বৌ থেকে মেয়ে হতে পারল না সুভদ্রাদেবীর কাছে।


#পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে

08/11/20