Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

ছোটগল্পমৃত্তিকা সহায়✍️ শাশ্বতী মুন্সী
    খড় আর বাঁশের তৈরী কাঠামোতে কাদামাটি লেপে চলেছে জিতেনবাবুর ব্যস্ত দুটি হাত |  দিন পনেরোর মধ্যে চারটি কালী ঠাকুরের মূর্তি নির্মাণ করার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি | অন্যান্যবার দুর…

 


ছোটগল্প

মৃত্তিকা সহায়

✍️ শাশ্বতী মুন্সী


    খড় আর বাঁশের তৈরী কাঠামোতে কাদামাটি লেপে চলেছে জিতেনবাবুর ব্যস্ত দুটি হাত |  দিন পনেরোর মধ্যে চারটি কালী ঠাকুরের মূর্তি নির্মাণ করার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি | অন্যান্যবার দুর্গোৎসবের আগে থেকেই বিশ্বকর্মা, লক্ষ্মী, কালী, কার্তিক ইত্যাদি ঠাকুরের মাঝারি ও ছোট মাপের কাঠামোর প্রতিমা তৈরির বায়না পেয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি | পুজোর মরসুমে পেশাগত ব্যস্ততা প্রতি বছর তুঙ্গে থাকে তার | নাওয়া খাওয়া ভুলে মৃৎশিল্পের শৈল্পিক কারিগরি শিক্ষা দিয়ে অপূর্ব সুন্দর দেবদেবীর মূর্তি গড়তে নিজের সব বিদ্যে ঢেলে দিতেন তিনি | এমন চমৎকার নির্মাণের প্রতিমার দাম ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে থাকায় দূর্গাপুজোর আগেই অগ্রিমমূল্যসহ মূর্তি ক্রয়ের বরাত দিয়ে যেতো লোকজনেরা |

         এই বছর অতিমারীর কবলে পরে উৎসবের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত পেশার মানুষদের আর্থিক অবস্থার সমূহ ক্ষতি হয়েছে | বিশেষত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা অর্থাভাবের সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে | সাধারণত পুজোর সময় বহু খেটে খাওয়া মানুষ নিজ নিজ পেশার ওপর ভিত্তি করে কিছু বাড়তি উপার্জনের আশা করে | জিতেনবাবুও সেই শ্রেণীর মধ্যে পড়েন | নিজের পেশাগত যোগ্যতা দিয়ে দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করে আগামী এক বছরের জন্য আর্থিক স্বচ্ছলতার খানিক সংস্থান করে রাখেন | কিন্তু এবারে দেশীয় অর্থনীতির বেহাল অবস্থার দরুন মৃৎশিল্পের বাজারে দেখা দিয়েছে মন্দাভাব | যার আঁচ এসে লেগেছে জিতেনবাবুর সংসারের অর্থের ভাণ্ডারে | এই পেশায় দক্ষ হয়ে ওঠার পর শরৎকালে উৎসবের প্রারম্ভ থেকে দম ফেলার সময় পেতেন না তিনি | অথচ করোনার আবহে তার হাতে কাজ নেই বললেই চলে | দূর্গাপূজার আগে ছাঁচের লক্ষ্মী মূর্তি বানানোর একটিমাত্র বরাত পেয়েছিলেন | সেটি শেষ করার পরে সংসার খরচ চালানোর দুশ্চিন্তায় যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন, তখনই অপ্রত্যাশিত ভাবে ৪টি কালী ঠাকুরের কাঠামোর প্রতিমা তৈরির বরাত পান জিতেনবাবু |


       উত্তর ২৪ পরগনার কঙ্কালীতলা অঞ্চলের আদি বাসিন্দা জিতেন পাল পেশায় একজন মৃৎশিল্পী | বাবার কাছে হাতেখড়ি হয় তার মৃৎশিল্পে | বড় হয়ে উঠতে উঠতে প্রতিমা বানানোর পাশাপাশি মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজটিও নিজের প্রচেষ্টায় রপ্ত করে নিয়েছিলেন তিনি | বাবা জীবিত থাকাকালীন পুজোতে ব্যবহার্য মাটির সামগ্রী তৈরী করতে শুরু করে দেন |  বিবাহের পরে সংসারের ব্যয়ভার সামলানোর জন্য সারা বছর পুজোর নানা সামগ্রী যেমন - মাটির ঘট, হাঁড়ি, সরা,ধুনুচি, প্রদীপ, খুড়ি(কোনো সময় বরাত পাওয়া মাটির থালা, গেলাস, মালসা) ইত্যাদি ছাড়াও কলসি, কুঁজো বানিয়ে বানানোর কাজকে পেশার সাথে যুক্ত করে নিয়েছেন |

         কঙ্কালীতলা একটি আধা গ্রাম আধা মফঃস্বল অঞ্চল | এখানে জিতেনবাবু পৈতৃক একতলা পাকা বাড়িতে স্ত্রীসহ দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করেন | গৃহকর্মে নিপুনা স্ত্রী মিতু সংসারের যাবতীয় কর্মভার সামলানোর সাথে সাথে মাটির জিনিসপত্র গড়ার কাজেও স্বামীকে সময় সুযোগ মতো সহযোগিতা করে থাকে | এমনকি পুজোর মরসুমে জিতেনের চরম ব্যস্ততার সময়ে স্বামীর নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিমা নির্মাণের কাজে যতটা পারে হাত লাগায় সে | পিঠোপিঠি ভাই বোন পলি ও পলু স্থানীয় বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে | এই বছর নতুন ক্লাসে উঠে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শুরু হবার আগে লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় তাদের পাঠ্যাভাসের অভ্যস্থ নিয়মে খানিক ব্যাঘাত ঘটেছিলো | কিন্তু লেখাপড়ায় আগ্রহী দুই ভাইবোনের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দৈনন্দিন পাঠ্যাভ্যাস বজায় রয়েছে তাদের কুহুদিদির জন্য | এই এলাকার কাউন্সিলার বিনয়কৃষ্ণ সান্যালের মেয়ে কুহেলি(ডাকনাম কুহু), স্থানীয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা | দরদী মনের অধিকারিণী সে শিশুদের খুব ভালোবাসে | বিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি এলাকার কিছু গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় লেখাপড়া শিখিয়ে থাকে কুহু | জিতেনবাবুর দুই ছেলেমেয়েকেও সে প্রয়োজনে লেখাপড়া সংক্রান্ত বিষয়ে দেখিয়ে দেয় | তাই অনির্দিষ্ট কালের বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে ওদের দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব স্বইচ্ছায় নিয়েছে কুহেলি |

         প্রতিদিন মেয়ে কুহুর কাছে পড়তে আসা পলি ও পলুকে স্নেহের চোখে দেখেন বিনয়কৃষ্ণবাবু | রাজনীতির জগতের মানুষ হলেও সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের সাহায্যার্থে তিনি সদা তৎপর থাকেন | অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা, আমলাদের চেয়ে ওনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি গুন হলো প্রকৃত অর্থে জনসেবামূলক কর্মকে উনি জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছেন | দুস্থ পরিবারের বিদ্যোৎসাহী ছেলেমেয়েদের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে অকৃপণ হস্তে সাগ্রহে অর্থব্যয় করেন | এহেন মানসিকতাসম্পন্ন বাবার পদানুসরণ করেই শিক্ষাদানের মহৎ কর্মে নিজেকে ব্রতী করেছে কুহেলি |

       দুর্গাপুজোর শেষ হয়েছে সবে দু'তিন হলো | লক্ষ্মীপুজো অবধি কুহেলি ছুটি দিয়েছে ওর ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের | তাই পলি আর পলুও এখন পড়তে আসছে না | পুজোর আগে যেদিন ওরা শেষ পড়তে এসেছিলো, সেদিন কুহেলি জানতে পেরেছিল লকডাউনের দরুন ওদের বাবার উপার্জনের ভাঁটা পড়েছে | সংসারের আর্থিক অবস্থায় বেশ টানাটানি চলছে | সেই থেকে গোটা পুজো ধরে ভেবে সে এমন একটি পন্থা বের করেছে যাতে জিতেনকাকু নিজের জীবিকা দিয়েই আর্থিক অবস্থা উন্নতির পথ কিছুটা হলেও সুগম করতে পারেন |


     দুপুরবেলা বিনয়কৃষ্ণবাবু দোতলায় শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন | এমন সময় কুহু ঘরে এসে বললো,

 " বাবা, তোমার সাথে বিশেষ কিছু কথা আছে |"

খাটে আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে তিনি বললেন,

 "বল না, কি বলবি...

কোনো ভনিতা না করে কুহু বললো,

  " প্রতিবার আমাদের বাড়ির কালী পুজোর প্রতিমা নামি শিল্পীকে দিয়ে নির্মাণ করানো হয় যা সেই তোমার দাদুর আমল থেকে চলে আসছে | কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হওয়ার জন্য চাই যে প্রতিমা বানানোর বরাত অন্য কাউকে দেওয়া হোক...!"

মেয়ের কথায় খানিক বিস্মিত হয়ে বিনয়কৃষ্ণবাবু বললেন,

  " কি বলতে চাইছিস পরিষ্কার করে বল, কিছু বুঝতে পারছি না!"

খাটের একপাশে বাবার পায়ের দিকে বসে পড়লো কুহু | তারপর গুছিয়ে বলতে লাগলো,

  ----" পলি-পলুর বাবা জিতেনকাকু পেশায় একজন মৃৎশিল্পী | দেবদেবীর মূর্তি বানাতে উনি দক্ষ কারিগর | কিন্তু লকডাউন হেতু ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে! তুমি যদি আমাদের বাড়ির কালী ঠাকুরের প্রতিমা নির্মাণের দায়িত্ব ওনাকে দাও, তাহলে ওঁদের পরিবারের একটু সুসার হয়... "

গত আট মাস যাবৎ সারাবিশ্ব তথা দেশ যে অতিমারীর কবলে পড়েছে, তাতে বহু দরিদ্র পরিবারের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ব্যাপারটা  একজন জননেতা হিসেবে বিনয়কৃষ্ণবাবু সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছেন | অচিন্তনীয় পরিস্থিতির দুর্বিপাকে পড়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পার্টির কর্মীদের এবং স্থানীয় ছেলেদের নিয়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন তিনি | তাই কুহুর এই প্রস্তাবে এককথায় সম্মতি জানিয়ে উনি বললেন,

  ---" তোর প্রস্তাবই মেনে নিলাম রে, তবে শুধু আমাদের বাড়ির নয়, এই পাড়ার পুজোর কালী মায়ের প্রতিমাও যাতে জিতেন পালকে দিয়ে বানানো হয়, সেই কথাটা পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের বলে দেবো... "

রাজনীতির দুনিয়ার পদার্পন করার আগে থেকেই বাবার এরকম মানবিক গুনের প্রকাশ সময় বিশেষে ঘটতে দেখেছিল কুহু | সেই গুনের আড়ালে থাকা দরাজ হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দ হলো তার |


                        ------------------------------


   লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন থেকে এলাকার প্রতিটি বাড়িতে কুহেলীকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে করজোড়ে  একটাই আর্জি জানিয়েছেন বিনয়কৃষ্ণবাবু,

  --- আপনাদের সবাইয়ের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ,এবারে ভূত চতুর্দশী এবং কালী পুজোর দুটি দিন বৈদ্যুতিকের রঙিন টুনি বাল্বের আলোয় বাড়ি না সাজিয়ে মাটির প্রদীপে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার পবিত্র আলোয় ঘরবাড়ির অন্ধকার দূরীভূত করুন | আর আপনাদের সম্মতিতে এই প্রদীপ তৈরির বরাত আমি এলাকার মৃৎশিল্পী জিতেন পালকে দিতে চাই | আপনারা সাধ্যমতো মূল্যে সেগুলি ক্রয় করলে মৃৎশিল্পের মন্দার বাজারে ওঁর পরিবারের আর্থিক অনটনের কষ্টের কিছুটা সুরাহা হবে | বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত একজন শিল্পীর শিল্প নির্ভর জীবিকাকে সচল রাখার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া |

সাধারণ মানুষের কাছে জনদরদী ও হৃদয়বান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিনয়কৃষ্ণ সান্যাল এলাকায় যথেষ্ট সুপরিচিত | ওনার কর্মকান্ডের ওপর সকলেই আস্থাবান | তাই এলাকাবাসীদের গণসম্মতিতে কঙ্কালীতলার প্রতিটি বাড়ি এবছর প্রদীপের আলোয় সজ্জিত হয়ে ওঠার শপথ নিল |


             অর্থের অপ্রতুলতা উপার্জনক্ষম পুরুষকে দুশ্চিন্তার অন্ধকার গভীর গহবরে নিমজ্জিত করে | সংসার প্রতিপালন তখন পাষানভারসম অনুভূত হয় | এমনই পরিস্থিতিতে যাপিত করা দিনগুলো জিতেনের কাছে ক্রমশ দুঃসহ যাতনাময় হয়ে উঠেছে | চারটি পেটের অন্নসংস্থানের তাগিদে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সেই সংকটকালে একদিন দেবদূতের মতো তার বাড়ির চৌকাঠে পা রাখলেন বিনয়কৃষ্ণ সান্যাল |

অপ্রত্যাশিত অতিথির হঠাৎ আগমনে প্রাথমিকভাবে হতচকিত হয়ে যান জিতেনবাবু! চকিতভাব খানিক কাটতে ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন,

  "কি সৌভাগ্য আমার... আজ আপনার চরণধুলো এই ভিটেতে পড়লো....

   আসুন আসুন কাউন্সিলার মশাই... "

জিতেনের কথায় সহাস্য বদনে বিনয়কৃষ্ণবাবু বললেন,

  "তোমার কাছে তো আমায় আসতেই হতো জিতেন | নাহলে যে আমার বাড়ির কালীপুজো বন্ধ হয়ে যেত...!"

কাউন্সিলার মশাইয়ের কথা অন্তর্নিহিত অর্থ একবিন্দু বোধগম্য হলো না জিতেনের!

 নিজ মুখপানে নিবদ্ধ হওয়া জিতেনের সপ্রশ্ন চাহনি দেখে মৃদু হাসলেন তিনি | ধীরে সুস্থে তারপর বলতে লাগলেন,

  " এই বছর আমার বাড়ির কালীপুজোর প্রতিমা নির্মাণের দায়িত্ব তোমাকে দিলাম জিতেন, সেই সাথে পাড়ার ক্লাবের পুজোর কালী মায়ের মূর্তিও তৈরির ভার তোমাকে নিতে হবে | অবশ্য তোমার শিল্পকর্মের যথাযোগ্য পারিশ্রমিক তুমি পাবে |"

বিস্মিত নয়নে ওনার কথাগুলি হৃদয়ঙ্গম করে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবেন, তখুনি হাত তুলে জিতেনকে থামিয়ে দিলেন সান্যাল মশাই | আরো কিছু কথা বলার বাকি আছে আমার...

  " শুধু প্রতিমা তৈরী নয়, এবারে তোমার হস্তনির্মিত মাটির প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেই কঙ্কালীতলার বাসিন্দারা দীপাবলির উৎসব পালন করবে... তাই প্রতিটি বাড়ি প্রদীপের আলোয় আলোকিত করার জন্য বহুলসংখ্যক প্রদীপ তৈরির বরাত দিলাম তোমায়... সকলে তোমার শ্রমের ন্যায্য ক্রয়মূল্যে ক্রীত প্রদীপ দ্বারা নিজেদের ঘরবাড়িকে আলোকমালায় সজ্জিত করবে..."

একের পর এক অভাবনীয় চমকে জিতেনের বিস্ময়ের পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে চলছিল! কিন্তু সে জানতো না চমকিত হওয়া এখানেই শেষ হয় নি |

বিস্ময় ও আনন্দের মিশ্রিত জিতেনের মুখভাব দেখে একগাল হেসে বিনয়কৃষ্ণবাবু বললেন,

  ---ওহে মৃৎশিল্পের কারিগর, মা কালী কেবলমাত্র নিজের দুটি মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করিয়ে তুষ্ট হবেন না... আরো দুটি ছোট মাপের মাতৃপ্রতিমা তোমাকে তৈরী করার দায়িত্ব নিতে হবে...!

এবার বুঝি সত্যি সত্যি জিতেনের বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যাবে!

পাশে দাঁড়ানো কুহুর দিকে একঝলক তাকিয়ে পুনরায় হাস্যমুখে সান্যালবাবু বললেন,

  --- আমার এক বন্ধু এবং এক পরিচিতের বাড়ির কালীপুজোর প্রতিমা নির্মাণের বরাত তোমায় দেওয়া হলো | আমি বিশ্বাস করি নিজের শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে চারিটি প্রতিমা নির্মাণের কাজ সফল ভাবে করতে পারবে |

বাবার শেষ কথায় কুহেলিও কম বিস্মিত হয় নি! শিল্পের প্রকৃত কদর করতে তার বাবা যে পিছু পা হন না, তা জেনে অভিভূত হয়ে গেল সে!

চারটি মূর্তি নির্মাণের অগ্রিম কিছু পারিশ্রমিকসহ একমুঠো ভরসা জিতেনের হাতের মুঠিতে অর্পণ করে মেয়ের সাথে প্রস্থান করলেন জনসেবায় নিয়োজিত প্রাণের অধিকারী বিনয়কৃষ্ণ সান্যাল |


          আজ দীপান্বিতা অমাবস্যার পুন্য তিথিতে কঙ্কালীতলার অধিবাসীরা কালী মায়ের আরাধনায় সামিল হয়েছে | গোটা এলাকা জিতেনের হাতের তৈরী প্রদীপশিখার দীপ্যমান আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে অপূর্ব পরিবেশ রচনা করেছে |

বিনয়কৃষ্ণবাবুর অযাচিত বদান্যতায় বিগলিত হয়ে কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে খান পঞ্চাশেক কারুকার্যখচিত রঙিন প্রদীপ ডালি ভরে নিজের হাতে ওনাকে দিয়ে এসেছেন জিতেন | আজকে দীপাবলির রাতে মৃৎশিল্পীর শিল্পসৃষ্টির নিদর্শন রূপে মাটির প্রদীপের উষ্ণ ঔজ্জ্বল্যে সান্যালবাড়ির সর্বত্র আলোর জোয়ারে প্লাবিত হয়ে উঠেছে |

জাতশিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্ট কালী মায়ের প্রতিমার অনিন্দ্যসুন্দর রূপ দেখে কাউন্সিলার মশাইয়ের বাড়ির সকলে জিতেনের শিল্পকর্মকে সপ্রশংস বাহবা দিয়েছেন |


        সান্যালবাড়ির ঠাকুরদালানে পুজোর বেদিতে অধিষ্ঠিত শক্তিরূপিণী,দুঃখহরিণী মাতৃমূর্তির সন্মুখে মুদিত নেত্রে জোড়হস্তে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন জিতেন | অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত করুনায় সিঞ্চিত চিত্তের প্রতিটি বিন্দু দিয়ে গড়া ভক্তির অর্ঘ্য মায়ের পদযুগলে নিবেদন করে এক অনাস্বাদিত প্রশান্তি পেল জিতেন পাল |

       মৃৎশিল্পীর কাছে মাটির গুরুত্ব  অপরিসীম | মাটিকে সম্বল করেই শিল্পীর শৈল্পিক সত্তার স্বাক্ষর সমাজের বুকে খোদাই হয়ে থাকে....||


                            সমাপ্ত