Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

ইয়ে টিয়ে(রম্য রচনা)
তখন দূর্গাপুরের বিধানে সায়েন্স নিয়ে এগারো বারো ক্লাসে পড়ি, একটা টিউশনে আমার সহপাঠী ছিল সুদীপ ভট্টাচাৰ্য। ছোটোখাটো কিন্তু গাট্টাগোট্টা চেহারার সুদীপ ছিল আমার অগতির গতি বন্ধু, কোনো রেফারেন্স পাচ্ছি না কিছুতে, সুদ…

 


ইয়ে টিয়ে(রম্য রচনা)


তখন দূর্গাপুরের বিধানে সায়েন্স নিয়ে এগারো বারো ক্লাসে পড়ি, একটা টিউশনে আমার সহপাঠী ছিল সুদীপ ভট্টাচাৰ্য। ছোটোখাটো কিন্তু গাট্টাগোট্টা চেহারার সুদীপ ছিল আমার অগতির গতি বন্ধু, কোনো রেফারেন্স পাচ্ছি না কিছুতে, সুদীপ কোথা থেকে জেনে এসে বলে দেবে, কোথাও কিছুর জন্য যেতে হবে আমায়, সুদীপ চলল আমার সঙ্গে। মাথায় আমার চেয়ে অনেকটাই বেঁটে কিন্তু আন্তরিকতা দিয়ে সেটা ও ঢেকে দিত। আমাদের বাড়িতেও ওর ছিল অবাধ গতিবিধি। আমার আরেক বন্ধু কাঞ্চন ওকে দেখলেই ক্ষেপাত ওকে, ওরা দুজনেই শিবাজী বয়েজে পড়ত। কেন ক্ষেপাত? কারণ সুদীপ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো ফ্যান, মানে সাদা বাংলায় স্তাবক বলতে যা বোঝায় তাই। আমি যা কিছুই করব, ওর মনে হত এমনটা আর কেউই করতে পারেনা। আর আমি সাজগোজ করলে একেবারে মুগ্ধ হয়ে পায়ের তলায় বসে পড়ত। আমি খুব মজা পেতাম, কিন্তু ওকে কিছু বলতাম না, কারণ ও সত্যি সত্যিই আমার ভালো চাইত।


আমার মা আমার সব বন্ধুদের কাছে জনপ্রিয় ছিল দুটো কারণে, প্রথম কারণ, মায়ের কাছে এসে কেউ কখনো খালি মুখে ফেরত যেত না, মায়ের ভাঁড়ারে কিছু না থাকলে মা চিঁড়ে ভেজে, নয় টোস্ট ওমলেট করে বা নিদেন চানাচুর, আলুভাজা, শশা দিয়ে মুড়ি মেখে চা করে হলেও খাইয়ে ছাড়বে আর দ্বিতীয় কারণ, মায়ের স্বাভাবিক সহজ হয়ে তাদের সাথে মিশে তাদের সঙ্গে গল্প করা। ফলে মায়ের সঙ্গে আমার সব বন্ধুরা একদম অসংকোচে অনেক কথা বলত। সুদীপও মাকে খুব পছন্দ করত, শ্রদ্ধা করত। মাও ওকে সন্তান স্নেহে ভালোবাসতো।


সুদীপের স্তাবকতার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। একবার কালীপুজোর দিন সকালে মা, বাপি বেরিয়েছে, আমি আর বোন বাড়িতে, আমার সেদিন পুজোর একটা না পরা লাল হলুদ শাড়ি, যেটা খুব শখ করে কিনেছিলাম, খুব পরতে ইচ্ছে হল। বোনের কয়েকটা না পরা জামা থেকে একটা পরালাম, ওকে সাজালাম, নিজে ওই শখের শাড়িটা পরে, সেজে নিলাম, কোথাও যাব না, বাড়িতেই থাকব, কিন্তু সেদিন মাথায় ঐরকম খেয়াল চেপেছিল। সেজে গুজে আমি আর বোন একটু ঘরটা ঠিকঠাক করছি, এমন সময় শুনি দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে, খুলে দেখি সুদীপ।


দরজা খুলতে ও ভেতরে এলো, এসে সোজা আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল, আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "কি রে, কি হল তোর? অমন মেঝেতে বসে পড়লি কেন"? ও প্রথমে কিছুক্ষন হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘোরের মধ্যে বলল, "তোকে না একদম দেবীর মত লাগছে। তুই এইভাবে বসে থাক, কোথাও উঠিস না, আমি একটু দুচোখ ভরে তোকে দেখি "। আমি বললাম, "তোর কি মাথাটা একদম চলে গেল? তুই সোফায় উঠে বোস, আমি দেখি মায়ের স্টকে কি আছে, নিয়ে আসি "। বলে উঠতে যেতে আমায় হাত ধরে সোফায় বসিয়ে আমার বোনকে বলল, "দেখেছিস তোর দিদিকে কি অসাধারণ লাগছে, আমি তো চোখ ফেরাতে পারছি না "। আমার বোন নেহাতই ছোট তখন, ও চুপ করে সুদীপকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এই পাগলামি আরো কতক্ষন চলতো জানিনা, এমন সময় মা বাপি ফিরল। মাকে দেখে সুদীপ খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, "দেখেছেন কাকিমা, কি সুন্দর লাগছে পম্পাকে "। মা একঝলক আমাকে দেখে নিয়ে বলল, "জানিস তো সুদীপ, আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা আছে, "যৌবনে কুক্কুট ধন্যা" মানে যৌবন আসলে কুক্কুট মানে মুরগিকেও মানুষ সুন্দর দেখে। আর এ তো জলজ্যান্ত একটা সুশ্রী মেয়ে, এ আর বেশী কথা কি যে তোর চোখে ওকে সুন্দর লাগবে!!!"সুদীপ খুব আশাহত হল মা ওকে সেভাবে সমর্থন করল না দেখে।


সুদীপের একটা সাদা রঙের এল এম এল ভেসপা স্কুটার ছিল, সেটায় চড়িয়ে একদিন আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেল। বাড়িতে সুদীপ দেখলাম পুরুষ সিংহ, ওকে একেবারে আকাশে তুলে রাখে ওর বাবা মা, ওর একটা বোন আছে দেখলাম, সে আমাকে খুব সহজেই আপন করে নিল। সেই সময় আমিও বেশ কয়েকবার গেছি ওদের বাড়িতে, আর ও প্রায় রোজই আসতো।


স্বভাবে একটু ভীতু সুদীপের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হতে হবে ওকে জয়েন্ট এন্ট্রেন্স দিয়ে। আমরা যারা সায়েন্স পড়তাম সকলেরই এটা একটা লক্ষ্য ছিল, কিন্তু সুদীপের একেবারে ধনুর্ভাঙা পণ ছিল ওকে জয়েন্টে চান্স পেতেই হবে। যথারীতি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গেল, জয়েন্টও হল। এবার জয়েন্টের রেজাল্ট যেদিন বেরোলো, দেখা গেল আমি বা সুদীপ কেউই চান্স পাইনি(পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম জয়েন্টে দূর্গাপুরের 575টা খাতা হারিয়ে গেছিল সেবছরে, তার মধ্যে আমার খাতা ছিল), দুঃখ হল খুব। সুদীপের সঙ্গে বসে ঠিক করলাম আমরা দুজনেই তাম্বলা ব্রীজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করব। একদিন সকালে আমি বোনকে স্কুলে পৌঁছে আর ও বাড়ির বাজার করে দিয়ে চললাম সেই অভিযানে। সেই মতো তাম্বলা ব্রিজেতে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা।


এবার আমি সুদীপকে বললাম, "তুই বল তুই কেন সুইসাইড করবি "? সুদীপ বলল, "জানিসতো, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হলে কোনো মেয়ে পাত্তা দেবে না।তাছাড়া দেখ, বাবা কত পয়সা খরচা করেছে আমাকে জয়েন্টে চান্স পাওয়ানোর জন্য, সেটা তো সফল হলো না বল"? আমি বললাম, "এবারে হয়নি, পরের বারে তো হতে পারে, পরের বারে চেষ্টা কর না "। সুদীপ বলল, "তোর কি মনে হয় পরের বারে আমি পেয়ে যাব"? আমি বললাম, "না পাওয়ার কিছু নেই, তুই তো ভালো স্টুডেন্ট, চেষ্টাটা ঠিক হলে পেয়ে যাবি দেখিস "। সুদীপ বলল, "তোর আমার ওপরে এতটা কনফিডেন্স"? আমি বললাম, "না হবার কি আছে? কোনটা ভুল বলেছি বল, তুই ভালো স্টুডেন্ট সেটা, নাকি পরের বারে চেষ্টা করলে চান্স পেয়ে যাবি সেটা"? ও তাড়াতাড়ি বলল, "না না, ভুল কেন বলবি, আমি শুধু দেখছিলাম তুই মন থেকে বলছিলি কিনা, দেখলাম মন থেকে বলছিস। তাহলে আর সুইসাইড করে কাজ নেই, চল ফিরে যাই. তুইও সামনের বারে জয়েন্ট দিবি "? আমি বললাম, "না রে, আমি একবার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গেলে আর সায়েন্সই পড়ব না, নেহাত মা বাবার মন রাখতে পড়েছি, প্রচুর খেটেছি, আমার স্ট্রিম হিউম্যানিটিজ, ওটাই পড়ব। চল তাহলে ফিরি, বোনকে আনতে হবে স্কুলের থেকে "। বলে দুজনে ফিরলাম, বোনকে স্কুলের থেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে সুদীপও আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে ফিরল।


মা দুই মূর্তিকে একসঙ্গে দেখে জিজ্ঞেস করে সব শুনে আঁতকে উঠল, সুদীপকে জিজ্ঞেস করল, "তোকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে কে বলেছে? সুদীপ বলল, "জানো তো কাকিমা, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হলে কোনো মেয়ে আমাকে ইয়ে টিয়ে করবে না"। মা বলল, "কে বলেছে তোকে একথা? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও মেয়েরা ইয়ে টিয়ে করে, দেশের সব ছেলেই কি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, তাদের কি ইয়ে টিয়ে হয় না"? সুদীপ খুব আশ্বস্ত হল এবং বাড়ি চলে গেল। মায়ের কাছে সুদীপও বলল না বিয়ে টিয়ে, মাও বলল না বিয়ে টিয়ে, কিন্তু বার্তা বিনিময় হয়ে গেল। সুদীপ চলে যেতে মা আমাকে নিয়ে পড়ল, "কি ডাকাত মেয়ে তুই, তুই তো ডাকাবুকো, না হয় ঝাঁপ দিয়েই দিতিস, বেচারা সুদীপটা ভীতু, তোর ওই অবস্থা দেখে হয়তো কেঁপে ঝেঁপে অজ্ঞান হয়ে যেত ও, তোর খুনের দায়ে পুলিশ ওকে এসে ধরত "। আমি হাসতে হাসতে বললাম, "এসব কিছুই হত না, ও দেখতে বসে বসে হাপুস নয়নে কাঁদত "।


দুর্গাপুর ছেড়েছি বহুদিন, সুদীপের খবর জানিনা, কেমন আছে, জয়েন্ট পেল কিনা সেটাও জানিনা, কিন্তু সেই সময়ের স্মৃতিতে ও রয়ে গেছে অমলিনভাবে। ভালো থাকুক ও, আজ এতো বছর পরেও এই অকৃত্রিম বন্ধুদের জন্যই মনে হয় জীবনটা সরস, সজীব, সহজ হয়েছে এদের জন্য। যেখানেই থাকিস সুদীপ তোকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানালাম আজকে।


© পম্পার কলমে